টিলা টিপ, টিলিয়া টিপ বা টিলা টাপা (ফার্সি: طلا تپه) বা (আক্ষরিক অর্থে "সুবর্ণ পাহাড়" বা "সোনালী ঢিপি") হল উত্তর আফগানিস্তানের শেবেরঘানের কাছে জওজান প্রদেশের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল। এখানে ১৯৭৮ সালে গ্রিক-রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভিক্টর সারিয়ানিডির অধীনে সোভিয়েত-আফগানের একটি দল খননকার্য চালায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের এক বছর আগে। মজুদ করা গুপ্ত ভান্ডারকে বলা হত ব্যাক্ট্রিয়ান সোনা।
মজুদ করা গুপ্ত ভান্ডারে ছিল প্রায় ২০,৬০০ অলঙ্কার সংগ্রহ, মুদ্রা এবং সোনা, রূপা, হাতির দাঁত ইত্যাদিতে তৈরি অন্যান্য ধরনের শিল্পকর্ম। এগুলো ৬টি সমাধিস্থলে (পাঁচজন নারী ও একজন পুরুষ) পাওয়া গিয়েছিল। এগুলো ছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ের অত্যন্ত সমৃদ্ধ গয়নার সংগ্রহ। অলঙ্কারগুলোর মধ্যে ছিল অর্ধ-মূল্যবান পাথর বসান কন্ঠহার, বেল্ট, পদকসমূহ এবং একটি মুকুট। এর আবিষ্কারের পরে, আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে মজুদ ভান্ডারটি হারিয়ে যায়, এটি "পুনরায় আবিষ্কৃত" না হওয়া পর্যন্ত। এটি প্রথম ২০০৩ সালে আবার জনসাধারণের সামনে আনা হয়। কাবুলে একটি নতুন যাদুঘর তৈরি করা হচ্ছে, অবশেষে যেখানে ব্যাক্ট্রিয়ান স্বর্ণ রাখা হবে।
ইয়েমেশি-টিপের বিশাল দুর্গম শহরটি, আধুনিক শেবেরঘানের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে আকচা যাবার রাস্তায়, এখনকার বিখ্যাত টিলিয়া টিপের সমাধিস্থল থেকে মাত্র অর্ধেক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর প্রথম দিকের কয়েকটি মুদ্রা দেখে, মনে করা হয়, সমাধিস্থল দুটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর। কোন মুদ্রাই এর পরের সময়ের নয়। সমাধিস্থলটি ঐ স্থানে বসবাসকারী সিথিয়ান বা পার্থিয়ান উপজাতিদের হতে পারে, অথবা ডাক্সিয়াতে কুজুলা কাদফিজেস দ্বারা অন্যান্য সমস্ত জিহোউ বা 'শাসক'এর ওপর বিজয়ের পর স্থানীয় ইউঝি রাজবংশের বিলুপ্তির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। (দেখুন আফগানিস্তানের প্রাক ইসলামী সময়।)
সমাধিস্থলে, পার্থিয়ার রাজা মিথ্রিডেটস ২-এর রাজত্বের সময়কালীন একটি রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১২৩-৮৮ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। মুদ্রাটি তৃতীয় সমাধিতে পাওয়া গিয়েছিল এবং মনে হয় একটি নিষ্ক্রিয় মহিলার হাতে ধরা ছিল।
ষষ্ঠ সমাধিস্থলে, পার্থিয়ান রাজা গোটারজেস ১ (খ্রিস্টপূর্ব ৯৫-৯০)-এর একটি অনুকরণ স্বর্ণমুদ্রা নিষ্ক্রিয় মহিলার বাম হাতে পাওয়া যায়। এই মুদ্রাটি সোনার ছিল, সাধারণ পার্থিয়ান মুদ্রার মত রূপা বা ব্রোঞ্জের ছিল না। মনে করা হয় এই অনুকরণ খ্যাতির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। মুদ্রার সামনের চিত্রণটি একজন স্থানীয় গোষ্ঠীপতির হতে পারে। পার্থিয়ান রাজার প্রতিকৃতির যাতে ক্ষতি না হয় সেই উদ্দেশ্যে এটি যোগ করা হয়েছিল, সম্ভবত এটি পার্থিয়ানদের উপর কিছু মাত্রায় নির্ভরশীলতার নিদর্শন। তৃতীয় সমাধিস্থলে একটি স্বর্ণ মুদ্রাও পাওয়া যায়, যাতে রয়েছে পরাক্রমশালী রোমান সম্রাট টিবেরিয়াসের জয়মাল্য-সম্মানিত আবক্ষ চিত্র। বিপরীত দিকে একটি সিংহাসনাসীন, যথেষ্ট পরিমানে সজ্জিত মহিলার চিত্র পাওয়া যায়। তার হাতে একটি রাজদণ্ড ছিল। এই ধরনের মুদ্রাগুলো গলের লুদুনাম শহরে খ্রিস্টপূর্ব ১৬ থেকে ২১-এর মধ্যে তৈরী করা হ্ত।[১]
ভারতের একটি বৌদ্ধ স্বর্ণ মুদ্রাও চতুর্থ সমাধিতে পাওয়া যায় (পুরুষ যোদ্ধা)। বিপরীত দিকে, নন্দিপদের সঙ্গে একটি সিংহ অঙ্কিত ছিল, খারোস্থি কিংবদন্তি "সিহ[ও] বিগতভয়[ও]" এর সঙ্গে ("সিংহ, যে ভয় দূর করে")। বিপরীত দিকে, একটি প্রায় নগ্ন মানুষ শুধুমাত্র একটি হেলেনীয়বাদী ক্ল্যামিস এবং একটি পেটাসাস টুপি পরা (হার্মিস/মারকিউরির অনুরূপ একটি মূর্র্তিশিল্প), একটি চাকা ঘোরাচ্ছেন। খারোস্থি কিংবদন্তিতে যাকে বলা হয় "ধর্মচক্রপর্বত[কো]" ("যিনি আইনের চাকা ঘোরাচ্ছেন")। মনে করা হয় যে এটি বুদ্ধের প্রাথমিক উপস্থাপনা।[২] সবশেষে, ইউঝির সেনাপতি হেরসেরসঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি বহু ব্যবহৃত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।
মনে করা হয় জায়গাটি ছিল শকেদের (এশিয়ান সিথিয়ান, যারা পরে ভারতে চলে আসে, এখানে তাদের নাম হয় ইন্দো-সিথিয়ান)। অনেকে আবার বিকল্প হিসাবে মনে করেন জায়গাটি ইউঝিদের (ভাবী কুষাণ) বা প্রাচ্যের পার্থিয়ানদের। সমাধিস্থলে আবিষ্কৃত রাজকীয় মুকুট, অনেকগুলি গোলাকার খণ্ড দ্বারা সজ্জিত ছোরা ইত্যাদি অনেকগুলি শিল্পকর্ম দেখেই মনে হয় সেগুলির উৎস সিথিয়ানরা। অনেক বিলুপ্ত সামগ্রী থেকে দেখা গেছে প্রথাগতভাবে করা মাথার খুলির বিকৃতি, এটি একটি রীতি, যা ওই সময়ের মধ্য এশিয়ার যাযাবরদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
এইগুলির সঙ্গে, বসফরাস এবং চেরসোনেসের হাজার হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে পাওয়া বিখ্যাত সিথিয়ান স্বর্ণনির্মিত হস্তশিল্পের মিল রয়েছে।
একটি উচ্চস্তরের সাংস্কৃতিক মিশ্রণ এই আবিষ্কারগুলির মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। মানুষের চিত্রণ এবং নানা সাংস্কৃতিক এবং শৈল্পিক ক্ষেত্রে হেলেনীয় প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় (অ্যামোরিনো থেকে শুরু করে অ্যাথিনার চিত্র সংবলিত আংটি এবং গ্রিক ভাষায় লেখা তাঁর নাম)। এর থেকে, একই অঞ্চলে, প্রায় ১৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, সেল্যুসিড সাম্রাজ্য এবং গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় রাজ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, এবং আমাদের যুগের শুরুর আগে পর্যন্ত, উত্তর পশ্চিম ভারতীয় উপ মহাদেশে ইন্দো-গ্রিক সাম্রাজ্যের অব্যাহত অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
শিল্পকর্মগুলি অনেক দূর থেকে আসা সামগ্রীর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে গেছে দেখা যায়। পাওয়া জিনিসে আছে কিছু চৈনিক শিল্পকর্ম (বিশেষ করে চীনা ব্রোঞ্জ আয়না), কিছু ভারতীয় শিল্পকর্ম (হাতির দাঁতের অলংকৃত থালা)। এইগুলি ব্যাক্ট্রিয়া অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রভাবের সাক্ষী বলে মনে হয়।
মনে করা হয়, ১৯৯০ এর দশকের কোন সময়ে ধনসম্পদ হারিয়ে গিয়েছিল। আফগানিস্তান জাতীয় যাদুঘর বহুবার লুন্ঠিত হয়েছে, যার জন্য প্রদর্শিত ১০০,০০০ বস্তুর ৭০ শতাংশই হারিয়ে গিয়েছিল।[৩] তবে, ২০০৩ সালে, কাবুলের সেন্ট্রাল ব্যাংকের গোপন ভল্টে এটি খুঁজে পাওয়া যায়।
১৯৮৯ সালে, একটি কমিটির সিদ্ধান্তের পর, আফগানিস্তানের শেষ কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট, মুহাম্মদ নজিবউল্লাহ আদেশ দেন যাদুঘর থেকে ধনসম্পদ সরিয়ে কাবুলের সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ আফগানিস্তানের ভূগর্ভস্থ ভল্টে স্থানান্তরিত করার। ভল্টের দরজা তালাবন্ধ করে চাবিগুলি পাঁচজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। [৩] ২০০৩ সালে, তালিবানদের অপসারণের পর, নতুন সরকার ভল্ট খুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চাবি রক্ষকদের ("তাওয়াদার" বলা হত) ডাকা যায়নি, কারণ তাদের নাম উদ্দেশ্যমূলকভাবে গোপন রাখা হয়েছিল। হামিদ কারজাই, অ্যাটর্নি জেনারেলকে অনুমোদন করে, একটি আদেশনামা জারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যাতে তিনি নিরাপদে তালা ভাঙ্গতে পারেন। কিন্তু এইসময়, পাঁচজন চাবি রক্ষক একত্রিত হন এবং ভল্ট খোলা হয়। তখন থেকে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি সংগ্রহগুলিকে তালিকাভুক্ত করেছে, যা সম্পূর্ণ বলে মনে হচ্ছে – সর্বমোট ২২,০০০ বস্তু। এছাড়াও, পুনরায় খোলার সাক্ষী ছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার এবং প্রত্নতত্ত্ব সদস্য ফ্রেড্রিক হিবার্ট এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ভিক্টর সরিয়ানিদি, যিনি মূলত রত্নভান্ডারটি খুঁজে পেয়েছিলেন। আফগান সরকার এবং ফ্রান্সের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে, সংগ্রহটির মূল্যায়ন করা হয়, এবং বিভিন্ন বিশিষ্ট যাদুঘর এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সহযোগিতার মাধ্যমে একটি প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত হয়। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বস্তুগুলি প্যারিসের গিমিত মিউজিয়াম, ওয়াশিংটন, ডি.সি.র ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্ট, সান ফ্রান্সিস্কোর এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম, হিউস্টনের মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, এবং নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ান অফ আর্ট গ্যালারীতে প্রদর্শিত হয়।[৪]
বেশিরভাগ দর্শনীয় আবিষ্কারগুলি নিয়ে একটি পর্যটন প্রদর্শনী করা হয়েছিল, নাম দেওয়া হয়েছিল "আফগানিস্তান: কাবুলের জাতীয় যাদুঘরের লুকানো সম্পদ" বা "আফগানিস্তান: প্রাচীন বিশ্বের সম্মুখে"। এটি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে, ফ্রান্সের প্যারিস শহরের গিমিত মিউজিয়ামে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দ্বারা সমর্থিত প্রদর্শনীটি, ২৫শে মে থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত ওয়াশিংটন, ডি.সি.র ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্টে প্রদর্শিত হয়; ২৪শে অক্টোবর ২০০৮ থেকে ২৫শে জানুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত এটি ছিল এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম অফ সান ফ্রান্সিস্কোতে; ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ই মে ২০০৯ এটি যায় হিউস্টনের মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টসে; তারপর নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ান অফ আর্ট গ্যালারীতে এটি প্রদর্শিত হয় ২০০৯ এর ২৩শে জুন থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। গ্যাটিনো-অটোয়ার কানাডিয়ান মিউজিয়াম অফ সিভিলাইজেশন এই প্রদর্শনীটি চালায় ২৩শে অক্টোবর ২০০৯ থেকে ২৮শে মার্চ ২০১০ পর্যন্ত; জার্মানির বন মিউজিয়ামে চলে ২০১০ এর ১১ই জুন থেকে ২রা জানুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত এবং লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম এটি প্রদর্শন করে ৩রা মার্চ থেকে ৩রা জুলাই ২০১১ পর্যন্ত। এরপর ২৬শে জুলাই থেকে ২৬শে নভেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত প্রদর্শনী চলেছিল পার্থের ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়ামে, এবং ১৭ই মে থেকে ১৭ই জুন ২০১৭ পর্যন্ত বেজিংএর প্রাসাদ জাদুঘরে।[৫] ইতালির তুরিনের মিউজিয়াম অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট এবং আমস্টারডামের নিউই কার্কেও প্রদর্শনীটি চলেছিল।[৬]
আফগানিস্তানের ইতিহাস |
---|
সময়রেখা |