![]() ঠগীদের একটি দল (১৮৯৪) | |
প্রতিষ্ঠা | ১৩৫৬ সালের পূর্বে |
---|---|
নামকরন | সংস্কৃত ঠগ (অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক) শব্দ থেকে এসেছে। |
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল | ভারতীয় উপমহাদেশ |
সক্রিয় | ~৪৫০ বছর |
বিচরন | ভারতীয় উপমহাদেশ |
জাতি | ভারতীয় |
সন্ত্রাসী কর্মকান্ড | খুন, ডাকাতি |
ঠগী বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলায় এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা হিন্দুদের দেবী কালীর পূজা করত।[১] তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে।[২] ১৮৩০ সালে গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক ভারতে প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে ঠগীদের নির্মূল করতে নির্দেশ দেন। হেনরি শ্লীম্যান কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে ঠগিদের নির্মূল করতে সমর্থ হন।[১][৩] কিছু হিসেব অনুযায়ী ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল।[৪] তারা সাধারণত দলগতভাবে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করত এবং পথিমধ্যে অন্য তীর্থযাত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে তাদের সাথে মিশে যেত। তারপর তারা হঠাৎ করেই কোন যাত্রাবিরতিতে ভ্রমণকারীদের গলায় হলুদ রং এর কাপড় পেঁচিয়ে হত্যা করত। তারপর মৃতদেহগুলোকে একসাথে হাড় ভেঙ্গে কবর দিয়ে রাখত যাতে পচন প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়।[৫]
ঠগী শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক।[৬] ভারত শাসনের সময় যেসব শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে থাগ তাদের মধ্যে অন্যতম। শব্দটির অর্থ চোর বা ডাকাত। থাগ শব্দটি সংস্কৃত ঠগী থেকে এসেছে। ১৮৩৯ সালে ফিলিপ মেডোউস টেলরের উপন্যাস কনফেসনস অফ অ্য থাগ এর মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একই সাথে ‘থাগ’ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় অন্তর্ভূত হয়ে যায়। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের গল্প দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে জনসাধারণ্যে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল।
১৩৫৬ সালের জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে থেকে জানা যায়,
১২৯০ এর দিকে সুলতানের শাসন আমলে কিছু ঠগি ধরা পরে, কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার তাদের নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেন নি বরং তাদেরকে নৌকায় তুরে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।
— স্যার এইস.এম এলিয়ট, "ভারতের ইতিহাস" , iii. ১৪১
ঠগীরা সাধারণত বংশপরম্পরায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন ঠগী বালক ১৮ বছর হলে সে হত্যার অনুমতি পেত। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের কথা প্রথম জানতে পারে। সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ঠগীরা তাদের দেবীকে বাংলায় ভবানী নামে ডাকত। তারা সাধারনত বছরের এক সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগত ভাবে যাত্রা করত মানুষ হত্যার জন্য। ঠগিরা দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ’কালীঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ’ভবানী মন্দির’।
ঠগীরা হত্যাকাণ্ডের জন্য একটি হলুদ রং এর রুমাল বা গামছা জাতীয় কাপড় ব্যবহার করত । হত্যার সময় একজনকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি ছিল এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যক্তির গলায় পেঁচিয়ে ধরত ও অরেকজন পা ধরে থাকত।
ঠগীরা হত্যার পর লাশ গুলো মাটিতে পুঁতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগীদের অগ্রবর্তী দল তাদের হত্যা করত। তারা সাধারণত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।[৭]
প্রথমদিকে কোন তীর্থযাত্রী নিখোজ হলে ব্রিটিশ শাসকরা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করত কিন্তু যখন আস্তে আস্তে ব্রিটিশরাও নিখোজ হওয়া শুরু করল তখন গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক জানতে পারেন এটাতে একটি ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাত রয়েছে। তখন তিনি ঠগীদের নির্মূল করতে ১৮৩০-এর সালে ভারতের প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে নির্দেশ দেন।
হেনরি ঠগীদের নির্মুল করতে গুপ্তচর নিয়োগ করেন যাতে তাদের গতিবিধি সম্পর্কে আগেই আচ করা যায়। ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩৭০০ ঠগীকে ধরতে সমর্থ হন। ১৯৪০ সালের দিকে প্রায় ৫০০ ঠগীর ফাঁসি দেওয়ার পর ঠগীদের সংখ্যা কমে আসে। এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগীদের বংশধরদের দেখা যায় তবে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।