গ্রীক পুরাণে ডেসপোইনা ( গ্রিক: Δέσποινα , ডেসপোইনা) দেমেতের এবং পোসেইডন এর কন্যা এবং আরিয়নের বোন ছিলেন। [১] এলিউসিনীয় রহস্যবাদের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম দেমেতেরের সাথে তিনিও ছিলেন আর্কাডীয় কাল্ট এর রহস্যবাদের দেবী যাকে ডেসপোইনা ("বাড়ির কর্ত্রী") নামে পূজা করা হত। তার আসল নামটি তার রহস্যবাদে দীক্ষিতদের ছাড়া কারও কাছে প্রকাশ করা হয়নি।[২] খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে পসানিয়াস লিখেছেন, দেমেতেরের দুজন কন্যা ছিল, জিউসের সাথে মিলনের ফলে কোরে এর জন্ম হয়, পরবর্তীতে পোসেইডনের সাথে মিলনের ফলে ডেসপোইনার জন্ম হয়। পসানিয়াস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে কোরেই পার্সিফোন, কিন্তু তিনি ডেসপোইনার আসল নাম প্রকাশ করেননি।
পৌরাণিক কাহিনিতে পোসেইডন ডিমিটার দেখে তাকে কামনা করেছিলেন। পোসেইডনকে এড়ানোর জন্য দেমেতের একটি ঘোটকীর আকার নেন, কিন্তু পোসেইডন একটি ঘোটক বা পুরুষ ঘোড়ার রূপ নিয়ে তখন দেমেতেরের সাথে সঙ্গম করেন। এই মিলন থেকে দেমেতেরের একটি কন্যা ডেসপোইনা এবং একটি ঘোড়া, আরিয়নের জন্ম হয়। এই ঘটনার ফলে দেমেতেরের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়, এজন্য তাকে এরিনিস ( তার ফলে ঘুরে তার রাগ কারণে Demeter এছাড়াও বিশেষণ, দেওয়া হয়েছিল Erinys (ক্রোধিত) বিশেষণও দেয়া হয়।[৩]
ডেসপোইনা শব্দটি ("মিসট্রেস", Δέσποινα ) এসেছে *des-potnia থেকে, যার অর্থ, "বাড়ির গৃহিনী", এই শব্দটি আবার এসেছে প্রত্ন ইন্দো ইউরোপীয় বা পিআইই *dóm(ha)os থেকে, যার অর্থ "গৃহ"। প্রত্ন ইন্দো ইউরোপীয় *dem(ha)- দ্বারা "নির্মাণ" বোঝায়, এবং *potniha- দ্বারা "বাড়ির কর্ত্রী" বোঝায়, যার সাথে গ্রিক শব্দ domos এবং potnia তুলনীয়। এর পুংলিঙ্গ রূপটি হ'ল ডেস্পোটেস, "বাড়ির কর্তা" ( Δεσπότης ); তুলনীয় গ্রিক শব্দ posis।[৪] সংশ্লিষ্ট সত্যায়িত আকার মাইসিনীয় গ্রিক ভাষায় লিনিয়ার বি ধ্বনিদলভিত্তিক লিপিতে লেখা হয়েছিল "po-ti-ni-ja" (পটনিয়া) এবং সম্ভবত "po-se-da-o" এবং "po-se-da-wo-ne" (পোসেইডন), শব্দগুলো সনাতন গ্রিসে অভিন্ন বা সম্পর্কিত অর্থের সাথে গৃহীত হয়েছিল।[n ১]
সম্ভবত দেমেতের একটি সম্পর্কিত শব্দ, কেউ কেউ যার অর্থ দাঁড় করিয়েছেন "ঘরের মা" ( পিআইই *dems-mater থেকে)।[৫]
প্রাচীন গ্রীক ধর্মের ইতিহাসে ডেসপোইনার কাল্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্কিডীয় কাল্টগুল একটি আদিমতর ধর্ম থেকে এসেছে। স্পষ্টতই, এই অঞ্চলে প্রবেশ করা প্রথম গ্রীকভাষী লোকদের ধর্মীয় বিশ্বাস এখানকার আদিবাসীদের জনগণের বিশ্বাসের সাথে মিশ্রিত হয়েছিল। ব্রোঞ্জ যুগের সময়কার মিনোয়ান এবং মাইসিনীয় উভয় সভ্যতার কাল্টগুলোর মধ্যেই প্রকৃতি, জন্ম এবং মৃত্যুর দেবীর প্রাধান্য ছিল। [৬] ওয়ানাক্স ছিলেন তার পুরুষ সঙ্গী (পেরেড্রস), এবং সাধারণত এই উপাধিটি সমুদ্রের রাজা ও দেবতা পোসেইডনকে প্রদান করা হয়।[৭]
আর্কাডিয়ার বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের পুরাণে, উত্তর ইউরোপীয় লোককাহিনীর মতই পাতালের নদীর আত্মা একটি ঘোড়া হিসেবে (পোসেইডন হিপ্পিয়োস) প্রতীয়মান হয়। তিনি ঘোটকী দেমেতেরের সাথে মিলিত হন,[৮] এবং এই মিলন থেকে তিনি ঘোড়া আরিয়ন এবং একটি কন্যার জন্ম দেন, যার উৎপত্তিগত আকারও ঘোড়ারই ছিল। এখান থেকে মনে হয় যে প্রকৃতির শক্তি হিসাবেই গ্রীক দেবদেবীদের উদ্ভব হয়েছিল এবং পরে তাদের উপর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছিল। [৯] প্রকৃতির এই শক্তিগুলোর থেকে মানবায়িত রূপের নিম্ফ ও দেবদেবীর বিকাশ ঘটেছে, যাদের মাথা বা লেজ পশুর মত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন প্যান এবং সিলেনাস সনাতন যুগ (ক্লাসিকাল গ্রিস) পর্যন্ত টিকে ছিল। দুজন প্রধান আর্কাডীয় দেবী ছিলেন দেমেতের ও ডেসপোইনা (পরবর্তীতে পার্সিফোন), এদের সাথে ঝড়না ও পশুদের এবং দেবী আর্তেমিসের (পটনিয়া থেরন: "পশুদের কর্ত্রী", আর্তেমিস ছিলেন প্রথম নিম্ফ) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।[১০]
লাইকোসুরার একটি মার্বেল রিলিফে দেসপোইনার ঘোমটা রয়েছে, যার উপরে আচারগত নৃত্যরত মানুষের ছবি দেয়া হয়েছে যাদের মাথা বিভিন্ন পশুর।তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাঁশি ধরে আছে। এগুলি পশুর মুখোশযুক্ত নারী বা সংকর প্রাণীর মিছিল হতে পারে। [১১][১২] অনুরূপ মাইসিনীয় ফ্রেস্কো এবং সোনার আংটিতেও ডেইমনদের একই রকম পশুর মুখোশ পরিহিত মানুষের মিছিল দেখা যায়।[১৩][১৪] বেশিরভাগ মন্দিরে ঝর্ণার নিকটে নির্মিত হয়েছিল এবং এদের মধ্যে কয়েকটিতে সর্বদা প্রজ্জ্বলিত অঙ্গির উপস্থিতির সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। লাইকোসুরায় ছাগলের দেবতা প্যানের মন্দিরের সামনের একটি স্থানে আগুন জ্বালানো হত। [১৫] এলিউসিসের মেগারন এবং লাইকোসুরার ডেসপোইনার মেগারনের মধ্যে বেশ মিল পাওয়া যায়।[১৬]
মেগালোপোলিস শহরের পশ্চিমে লাইকোসুরার একটি মন্দিরে (স্যাংকচুয়ারি) ডেসপোইনার পূজা করা হত। যদিও এই কাল্টটি সর্বহেলেনীয় না হয়ে স্থানীয় কাল্টই ছিল, তবুও প্রাচীন রহস্যবাদী ধর্মের অধ্যয়নের জন্য এই প্রত্নস্থলটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে, ডেসপোইনার ধারণা পার্সিফোনের ধারণার সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়।
সাধারণ জনগণের মধ্যে তিনি তার উপাধি ডেসপোইনে নামে পরিচিত ছিলেন, ঠিক যেমন সাধারণ মানুষ জিউস ও দেমেতেরের মেয়েকে কোরে (মেইডেন বা কুমারী) পদবী দান করে।[১৭][১৮]
যে নারীরা উপাসনাস্থলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের একটি নির্দিষ্ট পোশাকের নিয়ম ছিল, এবং তাদের কালো ও বেগুনী (পার্পল) রং এর পোশাক পরা নিষিদ্ধ ছিল, সম্ভবত একারণে যে মন্দীরের পুরোহিতা সেই রং এর পোশাক পরতেন।[১৯]
রহস্যবাদটিতে দেমেতের তার মেয়ে ডেসপোইনার নিচে দ্বিতীয় দেবী ছিল, নামবিহীন "দেশপোইনা"।[২০] দেখে মনে হয় যে আর্কিডিয়ায় পুরাণগুলি ব্রোঞ্জ যুগে উত্তর থেকে আগত প্রথম গ্রীক-ভাষী মানুষের সাথে সংযুক্ত ছিল। নদী ও ঝর্ণার সাথে দুটি দেবীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তারা নদীর ও ঝরণার দেবতা পোসেইডনের সাথে এবং বিশেষত প্রথম নিম্ফ আর্টেমিসের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। তার বিশেষণ, "কর্ত্রী" (দ্য মিস্ট্রেস) এর সাথে ক্রিটের নসস এবং সক্ষিণ গ্রিসের পাইলসে প্রাপ্ত মাইসিনীয় গ্রিক লিপির সাদৃশ্য রয়েছে। পরে, ডেসপোইনা এলিউসিনীয় রহস্যবাদের দেবী কোরে (পার্সিফোন) এর সাথে একটি জীবন-মরন-পুনর্জন্ম চক্রে মিশ্রিত হয়ে যান। কার্ল কেরেনি বলেন, কাল্টটি ছিল একজন মিনোয়ান দেবীর ধারাবাহিকতা, এবং তার নামটি মিনোয়ান-মাইসিনীয় দেবী da-pu2-ri-to-jo,po-ti-ni-ja এর কথা স্মরণ অরিয়ে দেয়, অর্থাৎ নসসের "ল্যাবিরিন্থ এর কর্ত্রী" (মিস্ট্রেস অফ দ্য ল্যাবিরিন্থ), যার নাম নেয়া যায়না[২১][২২] (এখানে ল্যাবিরিন্থ বলতে ক্রিটের ল্যাবিরিন্থ বা গোলকধাঁধার কথা বলা হচ্ছে)।
"দেসপোইনা" বেশ কয়েকজন দেবীর বিশেষণ ছিল, বিশেষত এফ্রোডাইটি, পার্সিফোন, ডেমিটার এবং হেকাটির । [২৩][২৪] এলিউসিনীয় রহস্যবাদের তিনজন দেবীর মধ্যে দুজন ছিলেন পার্সিফোন এবং দেমেতের। হয়তো তারা বিভিন্ন লিনিয়ার বি শিলালিপিতে উল্লিখিত "দুই রাণী"।[২৫] অলিম্পিয়ায় তাদেরকে ডেসপোইনাই ( Δέσποιναι) বলা হত।[২৬]
ডেসপোইনা নামক উপাধিটি মাইসিনীয় উপাধি "পটনিয়া" po-ti-ni-ja) এর সাথে সম্পর্কিত যা দিয়ে সাধারণত দেবীদেরকে নির্দেশ করা হয়। এই ঐশ্বরিক উপাধিটি গ্রিক-পূর্ব উদ্ভূত অনুরূপ উপাধির অনুবাদ হয়ে থাকতে পারে, যেমনটা খ্রিস্টধর্মের "আওয়ার লেডি" উপাধিটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়।[২৭] মনে হয় উৎপত্তিগত উপাধিটি ছিল ঈজীয় মাতৃদেবীর।[২৮]
পসানিয়াস যখন খ্রিস্টীয় ২য় শতকে লাইকোসুরার স্যাংকচুয়ারিতে ভ্রমণ করেছিলেন তখন সেখানকার ভাষ্কর্যগুলো ৩০০ বছরেরও বেশি সময়ের পুরনো ছিল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে, সম্রাট হাদ্রিয়ানের একটি মূর্তি মন্দিরে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তৃতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে সেভেরান পর্যায়ের মেগালোপোলিসের মুদ্রাগুলিতে কাল্ট সম্পর্কিত একটি মূর্তি চিত্রিত দেখা যায়।[২৯]
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে একটি ছোট সংগ্রহশালা রয়েছে, সেখানে ছোট ছোট সন্ধানের পাশাপাশি কাল্ট দলটির কিছু অংশও রয়েছে, [স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] ডেসপোইনা ও দেমেতেরের কাল্ট মূর্তিগুলোর বাকিগুলো ন্যাশনাল আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম অফ এথেন্সের প্রদর্শনীতে রয়েছে। এই সংগ্রহগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য নিদর্শনটি হ'ল ডেসপোইনার ঘোমটা, যা একটি জটিল আলংকারিক নিদর্শন, সম্ভবত এটি সেই সময়কাল বয়নকৃত শিল্পসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়াও মন্দিরটিতে (স্যাংকচুয়ারি) প্রাপ্ত আর্টেমিস, দেমেতের, অ্যানাইটস এর মস্তক ও সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ট্রাইটোনেস এর মূর্তিও প্রদর্শন করা হয়।
ন্যাশনাল আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম অফ এথেন্স এর কাল্ট সম্পর্কিত ভাস্কর্যসমূহ |
---|
বাম থেকে ডান: আর্টেমিস, দেমেতের, ডেসপোইনার ঘোমটা, অ্যানিটস, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ট্রিটোনাস |