ঢাকাইয়া কুট্টি, পুরান ঢাকাইয়া নামেও পরিচিত, বা শুধু ঢাকাইয়া, হচ্ছে একটি বাংলা উপভাষা, যে উপভাষায়বাংলাদেশেরপুরান ঢাকার কুট্টি সম্প্রদায়ের বাঙালিরা কথা বলে। এই উপভাষার শব্দভান্ডারে সামান্য কিছুটা বৈচিত্র্য থাকলেও এই উপভাষাটি মূলত প্রমিত বাংলার সাথে যথেষ্ট বোধগম্য। উপভাষাটি এখন আর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করা হয় না, যদিও ঐতিহাসিকভাবে স্থানীয়দের দ্বারা বারো পঞ্চায়েতে কখনও কখনও এটি ব্যবহার করা হত।[২][৩]ঢাকা শহর বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগতদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার্থে যারা এই উপভাষার সাথে পরিচিত নয় এবং দেশের সরকারী মাধ্যম হওয়ায় অনেক পরিবারে শিশুদের সাথে প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য এই উপভাষার ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে।[৪]
বিপুল পরিমাণে ফার্সি ও আরবি শব্দভান্ডারে সমৃদ্ধ এই উপভাষাটি একটি পূর্ব বাংলা-ভিত্তিক একটি বাংলা উপভাষা। প্রমিত বাংলার সাথে তুলনা করলে এটির উচ্চারণে কিছুটা কম মহাপ্রাণধর্মী অক্ষর রয়েছে। ঘ [gʱ], থ [tʃʰ], ধ [d̪ʱ], ভ [bʱ]- মহাপ্রাণ এই উপভাষায় পাওয়া যায় না।[৫]
ক) ‘চ’ বর্গীয় ধ্বনি এবং আরো কিছু ধ্বনির (যেমন: য) ঘৃষ্ট উচ্চারণ: উদাহরণ, প্রমিত বাংলায় যদি বলা হয়: ‘চাচা, চা খেয়ে আমার সঙ্গে যাবেন নাকি?’ এই বাক্যটি ‘চ’ ও ‘য’-এর ঘৃষ্ট উচ্চারণ দিয়ে এবং কিছু শব্দের ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমে কুট্টি উপভাষায় এভাবে বলা হয়: ‘চাচা চা খাইয়া আমার লগে যাইবেন নিকি?’
খ) দ্বিত্ব ধ্বনি ব্যবহার: এই ভাষারীতিতে শব্দ কোনো কোনো ধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়: যেমন, ‘বাজার থন কী কিন্ছস্? কল্লা আর কদ্দু?’ (এখানে ‘ল’ ‘দ’ এর দ্বিতীয় উচ্চারণ হয়েছে।)
গ) উর্দু-হিন্দি অব্যয়ের প্রভাব: উর্দু ও হিন্দি ভাষার প্রভাবে এই উপভাষায় ‘মগর’ ‘ভি > বি’ ইত্যাদি অব্যয়ের ব্যবহার থাকতে যায়। অনন্বয়ী অব্যয় হিসেবে ‘আবে’ এর ব্যবহার এই উপভাষায় যত্রতত্র দেখা যায়। যেমন: ‘আবে জলিল্লা, হইল কী? আমি বি হুনলাম ছব (সব) ঠিক আছে, মগর জাইয়া দেহি কিচছু নাই।’
ঘ) ‘শালা’ শব্দের নির্দোষ প্রয়োগ: প্রমিত বাংলা ভাষার সাধারণ প্রয়োগে ‘শালা’ প্রায়শ গালি হিসেবে ব্যবহার হলেও কুট্টি উপভাষায় শালা > হালা শব্দটির নির্দোষ প্রয়োগ দেখা যায়। তাই, বাবা, মা, শিক্ষক, গাছ, গরু, ছাগল সর্বত্র নির্দোষভাবে শালা > হালা, শালায় > হালায় শব্দ ব্যবহার হয়। যেমন: ’আইজকা ছার (স্যার) হালায় আমারে খুব আদর করছে।’ ‘গারি (গাড়ি) থুইয়া গরু বি হালায় দৌর (দৌড়) মারছে।’
ঙ) ই বা উ-ধ্বনির আগমন: ঢাকাইয়াদের উচ্চারণে ই বা উ-ধ্বনির আগমন অর্থাৎ অপিনিহিতির প্রভাব অধিকমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ‘রাজত্বি পাইছ?’ ‘আইজ আর থাউক্কা, গুমা। আবার কাইলা ছুরু করিছ।’
চ) তাড়ন ও মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনিহীনতা: এই ভাষায় মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনিগুলো যেমন: ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ উচ্চারণ যথাযথভাবে হয় না। এর বদলে ধ্বনিগুলো অল্পপ্রাণ- ঘোষ হয়ে যায়। যেমন: আঘাত > আগাত; ঝড় > জর; ঢাক >ডাক; ধান > দান; ভাত > বাত।
মুঘল আমলে, সুবাহ বাংলা ধান চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং জাহাঙ্গীরনগর (বর্তমানে ঢাকা) প্রদেশের রাজধানী ছিল। ঢাকা কেন্দ্রিক আঠারো শতকের মধ্যভাগে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য ছিল। চাল রফতানি করা ব্যবসায়ীরা মূলত মারোয়ারি এবং মধ্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। এই বণিকরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে চাল সংগ্রহ করত। প্যাকেজিংয়ের আগে ঢেঁকি ব্যবহার করে প্রথমে চাল পরিষ্কার করা হত এবং এই প্রক্রিয়াটিকে বাংলায় কুটা বলা হয়। অনেক স্থানীয় ধান চাষকারী এটি করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল। তারা এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতেন এবং সেখানে যাওয়ার ও কাজটি করার জন্য দীর্ঘ এবং ক্লান্তি হওয়ায় তাদের অনেকে ঢাকায় বসবাস শুরু করেছিলেন। এই মাইগ্রেশনটি আনুুমানিক ১৭৬০ সালে হয়েছিল। তবে সকলেই ধানের ব্যবসায় জড়িত ছিল না। ঢাকায় মুঘলদের উপস্থিতির অর্থ ছিল যে সেখানে সাধারণত অনেক বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল, তাই তারা ঢাকাইয়া উর্দুভাষীনবাবদের এবং অন্যান্য অভিজাত পরিবারগুলির জন্য খানসামাহ, সৈন্য, প্রহরী, বাবুর্চি এবং চৌফারদের মতো অন্যান্য পেশা গ্রহণ করেছিল।[৭][৮] এই গোষ্ঠীগুলির লোকেরা একত্রে বাস করত এবং তাদের হিন্দুস্তানি লোকদের সাথে কথোপকথন এবং আড্ডাায় জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের প্রধান পেশা তাদের কুট্টি হিসাবে পরিচিতি দেয়। বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভাষার সাথে কথোপকথনের ফলে কুট্টি ভাষার জন্ম হয়।[৯] বিংশ শতাব্দীতে ঢাকার বেসিস পঞ্চায়েতগুলি ঢাকাইয়া উর্দু বা ঢাকাইয়া কুট্টির মাধ্যমে আলোচনা করত।[৩] অবশেষে, পুরান ঢাকার লোকালয়ে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ এই উপভাষায় কথা বলতেন।[১০]
ঢাকাইয়া ভাষায় লিখিত সাহিত্য রয়েছে। চান্নিপশর রাইতের লৌড় নামে জুয়েল মাজহারের একটি জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে।[১১]শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ ঢাকাইয়া ভাষায় লেখা।[১২] ঢাকাইয়া নাটকগুলি দেশজুড়ে জনপ্রিয়, এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ও এই উপভাষায় সংলাপ লিখেছেন।[১৩] ঢাকাইয়া কুট্টি লোককথা সমূহ "কুট্টি কৌতুক" নামে এবং সাধারণত উপভাষার রম্য দিকের জন্য বিখ্যাত।[১৪] এটিকে বাংলা উপভাষাগুলির মধ্যে একটি মর্যাদাবান উপভাষা বলে মনে করা হয়।[১৫] সাধারণত "ঢাকাইয়া" লোকগাঁথায় উল্লেখিত, তারা বহিরাগতদের বা অ-ঢাকাইয়া বাঙালিদের "গাঁইয়া" নামে অভিহিত করে, যার অর্থ গ্রাম থেকে আগত,[১৬] এবং কোলকাতার অধিবাসীদের বিশেষ করে ডেমচি নামে ডাকে।[১৭]
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার লিখিত ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান - ঢাকার বাসিন্দারের দ্বারা কথা বলা, ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষা নামে পরিচিত বাংলার উপভাষা শব্দের অভিধান। (ঐতিহ্য, ২০১৫)
↑ভৌমিক, সত্য এন. (১৯৯৩)। Die Sprachenpolitik der Muslim-League-Regierung und die Entstehung der Bengali-Sprachbewegung in Ostbengalen, 1947-1956 [মুসলিম লীগ সরকারের ভাষা নীতি এবং পূর্ব বঙ্গে বাংলা ভাষা আন্দোলনের উত্থান, ১৯৪৭-১৯৫৬] (জার্মান ভাষায়)। স্টুটগার্ট: এফ. স্টেইনার। পৃষ্ঠা ৬০। আইএসবিএন3-515-06383-8। ওসিএলসি29492392।