তরল প্রবাহ প্রকৌশল বা জলপ্রবাহ প্রকৌশল হল পুরাকৌশলের একটি শাখা যেখানে প্রধানত তরল পদার্থের গতি এবং বহন নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়। এই বিভাগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিকর্ষ বল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে। পুরাকৌশলের এই শাখাটি প্রধানত সেতু, বাঁধ, প্রণালী, খাল, নদীতীরের বাঁধ, পয়ঃপ্রণালী এবং প্রাকৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে।
তরল প্রবাহ প্রকৌশল প্রধানত তরলের ধর্ম এবং বৈশিষ্ট্য প্রয়োগ করে সুষ্ঠ ভাবে তরল বা জলের উত্তোলন, সঞ্চয়, নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন, পরিমাপ এবং ব্যবহার করা হয়। তরল প্রবাহ প্রকৌশ্রলে কোনো প্রকল্প শুরু করার আগে, কত পরিমান জল নিয়ে কাজ হবে তার পরিমাপ করা হয়। যদি কোনো নদীর উপর প্রকল্প হয় তাহলে নদী দ্বারা বাহিত পলি, সঞ্চয়কার্য এবং ক্ষয়কার্যের কথাও মাথায় রাখা হয়। যেসব জায়গায় তরল নিয়ে কাজ হয় সেখানে তরল প্রবাহ প্রকৌশলীরা প্রধানত তার একটা ধারণা দেয়. যেমন- বাঁধ থেকে জল বেরোনোর পথ, রাস্তার মাঝে সেতু, সেচকার্যের জন্য নির্মিত খাল, তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে জল শীতল করার ব্যবস্থা।
তরল প্রবাহ প্রকৌশলের মৌলিক নীতির কয়েকটি উদাহরণ হল তরল বলবিজ্ঞান, তরল প্রবাহ, তরলের বাস্তব আচরণ, উদ্বিজ্ঞান, পাইপলাইন, খোলা খালের জলবিজ্ঞান, পলল পরিবহনের বলবিজ্ঞান, শারীরিক মডেলিং, তরলপ্রবাহী বা জলপ্রবাহী যন্ত্র, এবং জল নিষ্কাশন।
তরল বলবিদ্যার মৌলিক নীতিতে তরল স্থিতিবিদ্যা বলতে, স্থির আবদ্ধ তরলকে নিয়ে অধ্যয়ণ বোঝায়। আবদ্ধ তরল তার চারিপার্শ্বের দেওয়ালে বল প্রয়োগ করে। একক ক্ষেত্রফলের উপর প্রযুক্ত এই বলকে তরলের চাপ বলে। এবং চাপের মান তরলের সবত্রই সমান হয়। চাপকে নিউটন/মিটার^২ এককে প্রকাশ করা হয়। তরলের উচ্চতা যত বৃদ্ধি পাবে বা তরলের যত গভীরে যাওয়া যাবে ততই প্রযুক্ত চাপের পরিমান বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া তরলের ঘনত্বের সঙ্গের চাপের সমানুপাতিক সম্পর্ক। যদি তরলের ভিতরে কোনো বিন্দুতে প্রযুক্ত চাপের মান P হয় তাহলে
যেখানে,
এই সমীকরণটি সাজিয়ে চাপ শীর্ষ পাওয়া যায় p/ρg = y. চাপ পরিমাপ করার চারটি প্রধান যন্ত্রের নাম হলো পিজোমিটার, ম্যানোমিটার, পার্থক্যমূলক ম্যানোমিটার, বোর্ডন গেজ। এছাড়াও আছে আনত ম্যানোমিটার।
প্রসুহ্ন বলেছেন,
আদর্শ তরল অসংকোচনীয় হয় ফলে নির্দিষ্ট উষ্ণতায় একটি আদর্শ তরলের ঘনত্ব সর্বত্র সমান হয়। এছাড়া আদর্শ তরলের কোন সান্দ্রতা থাকে না। আদর্শ তরল কেবল কাল্পনিক, বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ কোনো অনুভূমিক তলের উপর দিয়ে যখন কোনো তরল প্রবাহিত হয়, তখন ওই কঠিন তলের সংস্পর্শে থাকা তরলের স্তরটি আসঞ্জনের জন্য স্থির থাকে। তার ঠিক উপরের তরলস্তরটি ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়। এইভাবে যত উচ্চতা বাড়তে থাকে তত তরলের প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পায়। তরলের এই ধর্মকে সান্দ্রতা বলে। কিন্তু আদর্শ তরলে এই স্পর্শকীয় বলের প্রভাবে এরকম কোনো বিকৃতি লক্ষ্য করা যায় না।
যখন তরল কতগুলি সুসংবদ্ধ স্তরে প্রবাহিত হয় এবং প্রবাহে তরলটির বিভিন্ন কণার মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হয় না তাকে ধারারেখ বা স্তরিত প্রবাহ হয়। ধারারেখ প্রবাহে বিভিন্ন বিন্দুতে তরলটির কণার বেগ ও অভিমুখ সমান থাকে। কিন্তু যদি কোনো প্রবাহে তরলের কণাগুলির মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হয় তখন সেই প্রবাহকে বিক্ষুব্ধ বা অশান্ত প্রবাহ বলে। প্রবাহের বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে ধারারেখ প্রবাহ বিক্ষুব্ধ প্রবাহে পরিণত হয়। বিক্ষুব্ধ প্রবাহে সান্দ্র তরলের উপর স্থিতিশীল, ক্রান্তিশীল বা অস্থিতিশীল প্রভাব পড়তে পারে। সেইজন্য তরল প্রবাহ প্রকৌশলে প্রবাহের বিক্ষুব্ধতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একটি আদর্শ তরলে বার্নোলির সমীকরণ ধারারেখ প্রবাহে কার্যকর। সমীকরণটি হল,
p/ρg + u²/2g = p1/ρg + u1²/2g = p2/ρg + u2²/2g
মনে কারো একটি সমতলের উপর দিয়ে তলটির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সরলরেখা বরাবর নির্দিষ্ট গতিতে একটি তরলের প্রবাহ হচ্ছে এবং তরলটি ওই একটি একটি তল দ্বারা বেষ্টিত। এখন ওই তলের সংস্পর্শে থাকা তরলের স্তরটি আসঞ্জনের জন্য স্থির থাকে। তার ঠিক উপরের তরলস্তরটি এই আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের খুবই ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়। এইভাবে যত উচ্চতা বাড়তে থাকে তত তরলের প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পায়। এই অঞ্চলটি যেখানে স্তরগুলিতে স্পর্শকীয়ভাবে বল প্রযুক্ত হয় এবং তরলটিকে প্রবাহিত হতে বাঁধা দেয়, তাকে সীমা স্তর বলে। এই সীমা স্তরের বাইরে তরলের স্তরগুলিতে কোনোরকম সান্দ্রতা বা স্পর্শকীয় বল কাজ করে না এবং তরলটি একটি আদর্শ তরলের মতো আচরণ করে। তরলের বিভিন্ন স্তরগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক বল খুব প্রবল নয় বলে তরলটি কঠিন পদার্থের একসাথে আবদ্ধ থাকে না। অর্থাৎ একটি তরল যখন কোনো তলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন তার মধ্যে একটি কৃন্তক পীড়ন কাজ করে। স্তরগুলির মধ্যে প্রবাহ আবার রেনল্ড সংখ্যার উপর ভিত্তি করে ধারারেখ বা বিক্ষুব্ধ হতে পারে।
তরল প্রবাহ প্রকৌশলীদের সাধারণত জলবাহী কাঠামো যেমন বাঁধ, চর, জল বণ্টন ব্যবস্থা, জল সংগ্রহ ব্যবস্থা, নিকাশী ব্যবস্থা, ঝড়-ঝঞ্ঝার ফলে জমা অতিরিক্ত জলের ব্যবস্থা, পলল পরিবহন, এবং পরিবহণ প্রকৌশল ও ভূ-কারিগরি প্রকৌশল-এর বিভিন্ন বিষয়ের নকশা ও অধ্যয়ন করে। প্রবাহী গতিবিজ্ঞান এবং তরল বলবিজ্ঞানেরর বিভিন্ন সমীকরণ প্রকৌশলের বিভিন্ন শাখা যেমন যন্ত্রকৌশল, বায়বান্তরীক্ষ প্রকৌশল, যানচলাচল প্রকৌশলে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
এই শাখার সংশ্লিষ্ট শাখা হলো জলবাহী বিজ্ঞান এবং প্রবাহ বিদ্যা যারা জলবহনের নকশা, বন্যার মানচিত্র, অববাহিকায় বন্যারোধী ব্যবস্থাপনা, উপকূল ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, মোহনা পরিকল্পনা, উপকূলীয় সুরক্ষা, বন্যা বিমোচন.ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করে।
ফসল সেচ করার জন্য আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তরল প্রবাহ প্রকৌশলের প্রাচীনতম ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষ অনেক সহস্র বছর ধরে নদীপথ এবং জলের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। প্রাচীনতম জলবাহী যন্ত্রগুলির মধ্যে একটি অন্যতম যন্ত্র জলঘড়ি মানুষ দুই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ আগেও ব্যবহার করতো। অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে প্রাচীন পারস্যে ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ নালী (আরবি: قناة), প্রাচীন চীনদেশে ব্যবহৃত তুলুফ্যান (স্থানীয় নাম: ক্যারেজ) জল ব্যবস্থা এবং পেরুতে ব্যবহৃত সেচ খাল একই নীতির উপর গড়ে উঠেছে।
প্রাচীন চীনে, তরল প্রবাহ প্রকৌশল খুবই উন্নত ছিল, এবং প্রকৌশলীদের নির্মিত পাড়যুক্ত বিশাল খাল ও নদীতে বাঁধ দিয়ে সেখান থেকে নির্গত নালী সেচের কাজে ও জাহাজ চলাচল করতে ব্যবহৃত হত। সুনসু আও-কে প্রথম চীনা তরল প্রবাহ প্রকৌশলী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চীনা তরল প্রবাহ প্রকৌশলী ছিলেন শিয়ামেন পাও, যিনি প্রাচীন চীনের যুদ্ধরত রাজ্য কালে (৪৮১-২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) প্রথম বড় মাপের সেচ খাল নির্মাণের রীতি শুরু করেন। এমনকি আজও চীনে, তরল প্রবাহ প্রকৌশলীরা সম্মানজনক অবস্থানে আছে।২০০২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে হু চিনথাও একজন তরল প্রবাহ প্রকৌশলী ছিলেন এবং উনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল পাশ করেছেন।
<grammarly-btn>
</grammarly-btn>