তরুণ মজুমদার | |
---|---|
জন্ম | বগুড়া, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ) | ৮ জানুয়ারি ১৯৩১
মৃত্যু | ৪ জুলাই ২০২২[১] | (বয়স ৯১)
নাগরিকত্ব | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | চলচ্চিত্র পরিচালক |
তরুণ মজুমদার (জন্ম: ৮ জানুয়ারি ১৯৩১ - মৃত্যু: ৪ জুলাই ২০২২)[২] একজন ভারতীয় বাঙালি চিত্রপরিচালক। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি বি.এফ.জে.এ. সম্মান, পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একটি আনন্দলোক পুরস্কার। ১৯৯০ সালে তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়।[৩]
উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯) তরুণ মজুমদারের প্রথম পরিচালিত ছবি।[৪] তার পরিচালিত প্রথম জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি কাঁচের স্বর্গ (১৯৬২)। এরপরে পলাতক (১৯৬৩), নিমন্ত্রণ, সংসার সীমান্তে (১৯৭৫), গণদেবতা — এই সব ছবি সমালোচক মহলে বহুল প্রশংসিত হয়।[৫] তার পরিচালিত বালিকা বধূ (১৯৬৭), কুহেলী (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), দাদার কীর্তি (১৯৮০), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫), পরশমণি (১৯৮৮) ও আপন আমার আপন (১৯৯০) বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করে।[৬]
ব্রিটিশ ভারত বর্তমানে বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ৮ জানুয়ারি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তরুণ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রথমে সেন্ট পলস ও পরবর্তীকালে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি সহকর্মী ও বাঙালি অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়কে বিয়ে করেন। কিন্তু কয়েক বছর পর তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এঘটনায় আঘাত পান তরুণ মজুমদার।[৭]
তাঁর চলচ্চিত্র পরিচালনার প্রথম জীবনে যাত্রীক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পরিচালক তরুণ মজুমদার, শচীন মুখার্জি এবং দিলীপ মুখার্জির ত্রয়ী স্ক্রিন-নাম ছিল যাত্রীক (Yatrik)। পরবর্তীকালে প্রত্যেকে আলাদাভাবে পরিচালনা শুরু করে কৃতিত্ব অর্জন করেন। যাত্রিক হিসাবে, তাঁদের প্রথম উদ্যোগ ছিল উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)। এরপর এই তিন পরিচালক কাঁচের স্বর্গ (১৯৬২) তৈরি করেছিলেন। যাতে দিলীপ মুখার্জী প্রধান চরিত্রে ছিলেন। যাত্রীক পরিচালিত শেষ ছবি পলাতক (১৯৬৩)।[৮]
১৯৬৫ সালে তিনি দুটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। সৌমিত্র চ্যাটার্জির সাথে একটুকু বাসা এবং বসন্ত চৌধুরীর সাথে আলোর পিপাসা। দুটি ছবিতেই সন্ধ্যা রায় মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বছরের সেরা আয় করা চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি বালিকা বধূ পরিচালনা করেন। এটি বিমল কর রচিত একটি বাংলা গল্পের রূপান্তর। যেখানে একজন কিশোরী মৌসুমী চ্যাটার্জি তাঁর আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তরুণ মজুমদার ১৯৭৬ সালে এটি হিন্দিতে রিমেক করেন, কিন্তু ততটা সাফল্য আসেনি। তাঁর শ্রীমান পৃথ্বীরাজ বক্স অফিসে বড় সাফল্য লাভ করে।
১৯৭৪ সালে তরুণ মজুমদার ফুলেশ্বরী পরিচালনা করেন। সন্ধ্যা রায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই সময়ের বাংলা সঙ্গীত শিল্পের কিছু বড় নাম (যেমন হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখার্জি, আরতি মুখার্জি এবং অনুপ ঘোষাল) চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বহু বছর পরে তরুণ মজুমদার ফুলেশ্বরীকে তার প্রিয় চলচ্চিত্র হিসাবে স্বীকার করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি রাজেন তরফদারের একটি চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে সংসার সিমান্তে পরিচালনা করেন, যেটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি ছোটোগল্প থেকে গৃহীত হয়েছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন চোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
১৯৭৯ সালে তরুণবাবু, কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গণদেবতা পরিচালনা করেন, যেটি সর্বপ্রথম বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে সেরা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জন্য 'জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার' জিতেছিল। ইংরেজ শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলাদেশ হল এই ছবির মূল পটভূমি। যতীন ও দুর্গার অনুচ্চারিত ভালোবাসার সম্পর্ককে তরুণবাবু কুশলী চিত্রশিল্পীর মতো ছবির পর্দায় পরিবেশন করেছেন।[৯]
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটোগল্পের উপর ভিত্তি করে দাদার কীর্তি (১৯৮০) চলচ্চিত্রে তিনি মহুয়া রায়চৌধুরীকে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। এছাড়াও তরুণবাবু, দেবশ্রী রায়কে বিনির চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। সেই সময়ে দেবশ্রী রায় চলচ্চিত্রে রুমকি রায় হিসাবে কৃতিত্ব পেতেন। রুমকি নামটা তরুণ মজুমদারের পছন্দ হয়নি। তিনি রুমকির মা আরতি রায়ের সামনে তার নাম পরিবর্তন করে দেবশ্রী রাখার পরামর্শ দেন এবং রুমকির মা রাজি হন। অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় সন্তু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, বিনির চঞ্চল প্রেমিক। ছবিটি তাপস পলের আত্মপ্রকাশকে চিহ্নিত করেছিল যিনি নায়ক কেদার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে একটি বড় সাফল্যে এনে দেয় এবং পলকে স্টারডমে পরিণত করে। ছবিটি ১৯৮১ সালে রায়চৌধুরী ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ইস্ট জিতেছিল।[১০]
বিখ্যাত অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়কে পরপর চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন তরুণ মজুমদার ― শহর থেকে দূরে (১৯৮১), মেঘমুক্তি (১৯৮২), খেলার পুতুল (১৯৮৩) এবং অমর গীতি (১৯৮৪)। শেষ দুটি ছবি বক্স অফিসে বড় ধরনের বিপর্যয় এনে দেয় এবং গণমাধ্যমের লেখালেখিতে জল্পনা তৈরি করে যে সন্ধ্যা রায় আর দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম নন। এরপর তরুণ মজুমদার, তাপস পল এবং দেবশ্রী রায়কে রোম্যান্টিক জুটি বানিয়ে ভালোবাসা ভালোবাসায় অভিনয় করিয়েছিলেন। ছবিটি বক্স অফিসে বড় সাফল্য লাভ করে। তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় তাপস পাল আরও দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, আগমন (১৯৮৮) এবং পরশমনি (১৯৮৮)।
তরুণ মজুমদার এরপর আপন আমার আপন (১৯৯০) ছবিতে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি এবং শতাব্দী রায়ের সাথে তাপস পালকে দিয়ে অভিনয় করান। ছবিটি বক্স অফিসে একটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করে।[১১]
তরুণ মজুমদার পরিচালিত এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ২০০৩ সালের বক্স অফিসে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনকারী চলচ্চিত্র আলো। তরুণবাবু কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটগল্প অবলম্বনে এই ছবিটি নির্মাণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাগৃহগুলিতে চলচ্চিত্রটি দীর্ঘ আট মাস ধরে দেখানো হয় ও বেশ কয়েকটি বক্স অফিস রেকর্ড অতিক্রম করে। চলচ্চিত্রটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য জনপ্রিয়তা ও সার্বিক মনোরঞ্জনের নিরিখে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনীত হয়েছিল।[১২]
বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার বহুদিন ধরে কিডনির সমস্যা, ডায়বেটিসে ভুগছিলেন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন থেকে কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মাঝে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল; কিন্তু ২ রা জুলাই অবস্থার অবনতি হলে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। অবশেষে ৪ জুলাই সোমবার ১১টা ১৭ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।[১৩] পরিচালকের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা হয় তার চোখ এবং মরদেহ । [১৪][১৫]