তামিল জাতীয়তাবাদ (தமிழ்த் தேசியம்; তামিল দেজিয়াম) হচ্ছে তামিল জাতিদের আলাদা একটি সত্ত্বা এবং/বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি মতবাদ। তামিল জাতীয়তাবাদের প্রায় সব প্রবক্তাই 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র পক্ষে কথা বলেন কিন্তু ভাষা এবং অন্যান্য বিষয়াদি যেমনঃ পোশাক, খাদ্য, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র এর ক্ষেত্রে তামিলত্ব বজায় রাখতে হবে।[১] তামিল জাতীয়তাবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তামিল ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে।
তামিল জাতিরা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম পুরনো জাতি, যাদের অনেক আগে থেকেই নিজস্ব সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি এবং অদ্বিতীয় ভাষা ছিলো।[২] দক্ষিণ ভারতের পুরো অংশ এবং শ্রীলঙ্কার প্রায় অর্ধেক অংশ একসময় তামিল রাজাদের শাসনাধীন ছিলো। তামিলভাষী অঞ্চলগুলো ব্রিটিশরা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী এবং সিলন নামে ভাগ করে দেয় এবং তখন থেকেই ধীরে ধীরে তামিলদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে। ভারতে একসময় তামিলভাষীরা হিন্দি বিরোধী আন্দোলন শুরু করে, শ্রীলঙ্কাতে ব্রিটিশরা তামিলদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিয়ে যায়নি, তাই ঐ দেশে স্বাধীনতার পর তামিল জাতীয়তাবাদ উগ্রতায় রূপ নিয়েছিলো।[৩]
তেলুগু ভাষা, কন্নড় ভাষা এবং মালয়ালম ভাষা তামিল ভাষা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিলো। অর্থাৎ ভাষাগুলো হচ্ছে তামিল ভাষারই এক বৈবর্তনিক রূপ।[৪]
এস জে ভি সেলভানাক্কাম (১৮৯৮-১৯৭৭) নামের একজন তামিল আইনজীবী শ্রীলঙ্কায় তামিলদের ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়ছিলেন, 'তামিল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট' নামের একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেলভানাক্কাম যেই দলটি শ্রীলঙ্কায় তামিলভাষী মানুষদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলো; ১৯৭৬ সালে সেলভানাক্কাম 'ভাট্টুকোট্টাই প্রস্তাব' নামের একটি প্রস্তাব পেশ করেন শ্রীলঙ্কার উত্তর প্রদেশে, প্রস্তাবটিতে তিনি তামিলভাষীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। সেলভানাক্কাম ১৯৭৭ সালে মারা যান, তার মৃত্যুর পর শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদীরা দেশটিতে ১৯৭২ সালে প্রণীত সিংহলী জাতীয়তাবাদ এর ঘোর বিরোধিতা করা শুরু করে এবং একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র (বা তামিল ভাষায় তামিল ইলাম; தமிழ் ஈழம்) গঠনের জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়।[৫] সিংহলী জাতীয়তাবাদীরা তামিলদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার দেয়নি বলে দাবী করেন তামিল জাতীয়তাবাদীরা।
শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন হতে স্বাধীনতা লাভ করে, ঐ বছরেই শ্রীলঙ্কা সরকার 'সিলন সিটিজেনশিপ এ্যাক্ট ১৯৪৮' নামের একটি আইন পাশ করে যেই আইনে শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী তামিল জনগণদের মধ্যে যাদের জন্ম ভারতে হয়েছে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৬ সালে আবার সরকার 'সিনহালা অনলি এ্যাক্ট' দ্বারা সিংহলী ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় স্থান দেয়, এই আইনের ফলে তামিল ভাষার মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ে যায়। এছাড়াও সরকার তামিলদের মাছ ধরার ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করে যেটা তামিলরা বহু প্রাচীনকাল থেকেই করে আসছিলো।[৬]
সিংহলীরা ১৯৫৬, '৫৮ এবং '৭৭ সালে তামিলদের উপর বিভিন্ন ধরনের হামলা করে যেমন ১৯৫৮ সালের মে মাসে তামিলদের বহনকারী একটি ট্রেনে হামলা চালায় সিংহলী দূর্বৃত্তরা; এছাড়াও তামিলদের ওপর পুলিশি অত্যাচার এবং হয়রানিও হয়েছে প্রচুর। ১৯৭৬ সালে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম নামের একটি তামিল উগ্র জাতীয়তাবাদী জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলেন ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণ। সংগঠনটি সংক্ষেপে এলটিটিই বা তামিল টাইগার্স নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮১ সালে জাফনাতে তামিলদের একটি গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয় সিংহলীরা এবং ১৯৮৩ সালে সাধারণ তামিলদের উলঙ্গ করে রাস্তায় ফেলে তাদের ছবি তুলে অপমান করে সিংহলীরা যেটা 'ব্ল্যাক জুলাই' নামে পরিচিত। এই দুটো ঘটনা তামিল টাইগারদের সিংহলীবাদী বা রাষ্ট্রীয় আইনকানুন এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করতে পরিচালিত করে পূর্ণভাবে। ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের অনুসারীরা শ্রীলঙ্কায় অনেক রাজনৈতিক নেতা হত্যায় জড়িয়ে পড়ে যেমন ১৯৭৫ সালের ২২শে জুলাই আলফ্রেড দুরাইআপ্পা নামের এক তামিল ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন প্রভাকরণ কারণ দুরাইআপ্পা সিংহলী সরকারের পক্ষে ছিলেন। হিংস্রতা এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় এলটিটিই বা তামিল টাইগারদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দেয় ভারত, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী আশির দশক থেকেই এলটিটিইকে শায়েস্তা করার জন্য প্রাণপণ লেগেছিলো; ২০০৯ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এলটিটিই পরাজিত হয় এবং প্রভাকরণের বিভীষিকাময় করুণ মৃত্যু ঘটে। জাতিসংঘের এক বিবরণ অনুযায়ী শ্রীলঙ্কা সামরিক বাহিনী প্রায় ১০০,০০০ তামিলদের হত্যা করে।[৭] মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বনেতারা অভিযোগ তোলেন যে ২০০৯ সালে 'ইলাম যুদ্ধ ৪' (শ্রীলঙ্কা সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত তামিলদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান) এর শেষ পর্যায়ে নাকি তার অধীনস্থ সামরিক বাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে।[৮] ইতালীর 'পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল' (পিপিটি) তামিলদের ওপর গণহত্যা হয়েছে বলে সিংহলী সরকারকে অভিযুক্ত করে।[৯] তামিল ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স (টিএনএ) নামের একটি রাজনৈতিক দল আলাদা তামিল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব থেকে ফিরে আসে[১০] এবং উত্তর এবং পূর্ব প্রদেশকে পুনরায় একত্রিত করে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের নতুন দাবী জানায়।[১১] 'ফেডারেলিজম ইন শ্রীলঙ্কা' মতবাদ শ্রীলঙ্কা সরকার বিরোধিতা করে কারণ তারা 'ইউনিটারি স্টেট' মতবাদের পক্ষে।[১২]
২০১০ সালে বিশ্বনাথ রুদ্রকুমার নামের একজন 'তামিল ট্র্যান্সন্যাশনাল গভর্নমেন্ট অব তামিল ইলাম' (টিজিটিই) নামের একটি অস্বীকৃত সরকার গড়ে তোলেন যেটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শ্রীলঙ্কায় তামিলদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চালায়। তামিল পিপলস কাউন্সিল নামের আরেকটি সংগঠন আছে যেটি উত্তর জাফনা এবং পূর্ব বাট্টিকালোয়াতে তামিলদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছিলো সি ভি ভিগনেশ্বরণের নেতৃত্বে যিনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।[১৩][১৪]
... together with the evidence of archaeology would seem to suggest that the original Dravidian-speakers entered India from Iran in the fourth millennium BC ...