ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪০-এ জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। দেশগুলোর পক্ষে যথাক্রমে জোয়াকিম ভন রিবেনট্রপ, গালিজ্জো চিয়ানো ও সাবুরো কুরুসু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এটি বার্লিন চুক্তি নামেও পরিচিত। এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল একটি প্রতিরক্ষামূলক সামরিক জোট গঠন। পরবর্তীতে এতে হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও স্লোভাকিয়া যোগদান করে। যুগোস্লাভিয়ার এ জোটে যোগদানের ফলে বেলগ্রেডে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ফলস্বরূপ জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরি যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ করে ক্রোয়েশিয়া নামে একটি তাঁবেদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ১৯৪১ সালে জোটে যোগদান করে।
ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করা। তবে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে এর কার্যকারিতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। ইতালো-জার্মান জোট এবং জাপান বিশ্বের দুইটি বিপরীত প্রান্তে যুদ্ধ করছিল। আবার, এ জোটের সদস্যদের কৌশলগত লক্ষ্যও ছিল ভিন্ন। জোটের সদস্যরা পরস্পরকে কিছুটা কারিগরি সহায়তা করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, জাপান একাই আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়, যা যুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে।
জাপান, ইতালি ও জার্মানির সরকার মনে করে যে, পৃথিবীর প্রতিটি জাতিকে উপযুক্ত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাই শান্তির পূর্বশর্ত। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতিসমূহ বিশ্বব্যাপী নতুন করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরস্পরকে পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে সহযোগিতা প্রদান করবে, যাতে জাতিগত উন্নতি ও প্রগতি সাধিত হয়। যে সকল রাষ্ট্র বিশ্বশান্তিকে তাদের চূড়ান্ত অভীষ্টরূপে বিবেচনা করে, তাদেরও এই চুক্তিতে যোগদানের আহবান জানানো হচ্ছে। এতদনুসারে নিচের বিষয়গুলো জার্মান, ইতালি ও জার্মানির সরকার মেনে চলতে সক্ষম হয়েছে:[১]
অনুচ্ছেদ ১: ইউরোপে নতুন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য জার্মানি ও ইতালির ভূমিকা জাপান স্বীকার করবে।
অনুচ্ছেদ ২: পূর্ব এশিয়ায় নতুন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাপানের ভূমিকা জার্মানি ও ইতালি স্বীকার করবে।
অনুচ্ছেদ ৩: উপরের অনুচ্ছেদগুলো অনুযায়ী জাপান, ইতালি ও জার্মানির মধ্যে যেকোনো দেশ যদি ইউরোপীয় কিংবা চীনা-জাপানি যুদ্ধে সম্পৃক্ত নয় এমন কোনো শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে বাকি দুই দেশ প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য প্রদান করবে।
অনুচ্ছেদ ৪: চুক্তিসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অতি সত্বর জাপান, ইতালি ও জার্মানি সরকার যৌথ কারিগরি কমিশন গঠন করবে।
অনুচ্ছেদ ৫: এই চুক্তি কোনোভাবেই চুক্তিরত দেশগুলোর সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক প্রভাবিত করবে না।
অনুচ্ছেদ ৬ : এই চুক্তি স্বাক্ষর করা মাত্রই কার্যকর হবে, এবং এর মেয়াদ হবে ১০ বছর। প্রয়োজনবোধে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পূর্বে চুক্তি নবায়ন করা হবে।
এ সকল শর্ত মেনে দেশগুলোর সরকার চুক্তিটি কার্যকর করছে।
১৯৪০ এর ২৭শে সেপ্টেম্বর, ফ্যাসিস্ট যুগের ১৯তম বর্ষে এবং ১৫তম শোওয়া ( সম্রাট হিরোহিতোর শাসনকাল) বর্ষের নবম মাসের ২৭-তম দিনে চুক্তিটি কার্যকর হলো।
জার্মানি ১৯৩৬ সালের অ্যান্টি-কমিন্টার্ন চুক্তির মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেও ১৯৩৯ সালের মলোটভ- রিবেনট্রপ চুক্তি জাপানকে বিস্মিত করে। ১৯৩৯ এর নভেম্বরে জাপান এবং জার্মানি সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি করে তাদের মৈত্রী পুনঃসংহত করে। এ সকল ঘটনা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভিত গড়ে দেয়। [১]
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪০-এ রিবেনট্রপ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে চুক্তিতে অন্যান্য দেশগুলোকে স্বাগত জানাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।[২] তবে ইতালীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গালিজ্জো চিয়ানো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে চুক্তির সদস্য করার বিষয়ে অসম্মতি প্রকাশ করেন।
চুক্তি স্বাক্ষরের খবর পেয়ে এবং রিবেনট্রপের বক্তৃতা শুনে বার্লিনে হাঙ্গেরির রাষ্ট্রদূত ডোম জেতায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসভান সাকির সাথে যোগাযোগ করেন। ডোম জোতায়ে বলেন, রোমানিয়ার আগে হাঙ্গেরির এ চুক্তিতে যোগ দেওয়া উচিত। ইসভান সাকি ইতালিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর পাঠান এবং রিবেনট্রপের বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চান। জার্মান এবং ইতালিয়ান সরকার মারফত সাকি জানতে পারেন, রিবেনট্রপ অন্যান্য দেশের কাছ থেকে "আত্মিক আনুগত্য" কামনা করেছেন। এক সপ্তাহের ভেতরে হাঙ্গেরি চুক্তির প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে।
পরবর্তী সপ্তাহে রোমানিয়ান সরকার জার্মান সরকারকে পিলোয়েস্তি তেলক্ষেত্র সুরক্ষিত রাখার জন্য সেনা প্রেরণের জন্য অনুরোধ করলে হাঙ্গেরি জার্মান সেনাদের নিজ ভূখণ্ড ব্যবহার করে রোমানিয়ায় যাবার অনুমতি দেয়। ৯ অক্টোবর রিবেনট্রপকে জানানো হয়, হিটলার চান বন্ধুরাষ্ট্রগুলো জোটে শামিল হোক। ১২ অক্টোবর রিবেনট্রপ সাকিকে জানান, ইতালি ও জাপান হাঙ্গেরিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। অতঃপর হাঙ্গেরিকে জোটের সদস্য করা হয়।[৩]
রোমানিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তিতে যোগ দেয় এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ট্রানসিলভানিয়া ফেরত পায়। জার্মানি ও ইতালি ট্রানসিলভানিয়ার কিছু অংশ হাঙ্গেরি এবং দক্ষিণ দোবরুজা অঞ্চল বুলগেরিয়াকে দিয়ে দেয়। আবার, সোভিয়েত ইউনিয়ন রোমানিয়ার বেসারাবিয়া ও বুকোভিনা অঞ্চল দখল করে নিলে ফ্যাসিবাদী আয়রন গার্ড ক্ষমতায় আসে। ১৯৪০ সালের ২৩শে নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রোমানিয়া চুক্তি স্বাক্ষর করে।[৩]
২৪ নভেম্বর ১৯৪০ সালে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভইতেক তুকা রিবেনট্রপের সাথে সাক্ষাৎ করে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।[৪]
১৯৪০ সালের ১৭ই নভেম্বর জার তৃতীয় বরিস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান পপভ হিটলারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বুলগেরিয়া ও অক্ষশক্তির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে বুলগেরিয়া শুরুতে এই চুক্তিতে যোগ দিতে বিলম্ব করে।
১৯৪১ সালের ১লা মার্চ ক্রমবর্ধমান জার্মান চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী বোগদান ফিলোভ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৪০-২০ ভোটে জাতীয় পরিষদের সদস্যরা চুক্তি অনুমোদন করেন। [৫]
২৫ মার্চ ১৯৪১ সালে যুগোস্লাভ প্রধানমন্ত্রী দ্রাগিসা ভেতকোভিচ ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২৭শে মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে উক্ত সরকারের পতন ঘটে। দুসান সিমোভিচের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি মেনে নিতে রাজি না হলে হিটলার ক্রুদ্ধ হয়ে ৬ এপ্রিল গ্রিস ও যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ করেন। ১৭ই এপ্রিল যুগোস্লাভিয়া আত্মসমর্পণ করে। [৬]
১৯৪১ সালের ১৫ই জুলাই ক্রোয়েশিয়া ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। [৬]
চুক্তির চতুর্থ অনুচ্ছেদে যে যৌথ কারিগরি কমিশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সেটি ১৯৪০ সালের ২০শে ডিসেম্বর গঠিত হয়। তবে এ কমিশন গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৪১ এর প্রথম সভা আয়োজিত হয় এবং সভায় চুক্তিরত দেশগুলোর দ্বারা একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করা হয়।
১৮ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে জার্মানি ও ইতালি জাপানি সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সাথে গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করে।
২৪ ফেব্রুয়ারিতে রিবেনট্রপের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কাউন্সিলের সভায় একটি প্রপাগান্ডা কমিশন গঠিত হয়। মিলিটারি কমিশন ১৯৪৩ সালে দু-তিনবার মিলিত হলেও কোনো ত্রিপক্ষীয় নৌবিষয়ক আলোচনা সম্পন্ন হয়নি।
জাপান ১৯৪১ সালে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক অবনতির ভয়ে জার্মানির সাথে আর্থিক সহযোগিতায় সম্মত হয়নি। তবে ১৯৪২ সালে এ বিষয়ক আলোচনা দুই দেশের মধ্যে সম্পন্ন হয়, এবং ১৯৪৩ সালে তাদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতালিও আলাদাভাবে জাপানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে। [৭]
১৯৪১ সালে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে জার্মানি এবং ইতালিকেও যুদ্ধে যোগ দিতে আহবান জানায়। ২ ডিসেম্বর জাপানের ঘোষণার পর ১১ ডিসেম্বর জার্মানি ও ইতালি যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৮ই ডিসেম্বর তাদের মধ্যে নতুন একটি চুক্তি প্রণীত হয়, যা ১১ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। চুক্তির অন্তর্গত কোনো দেশই যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করবে না, এটাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।[৭]