থিওডোর গোল্ড্স্ট্যুকর (জার্মান- Theodor Goldstücker) ঊনবিংশ শতকের একজন খ্যাতনামা জার্মান সংস্কৃতজ্ঞ ও ভারততত্ত্ববিদ্। জীবনকাল - জানুয়ারি ১৮, ১৮২১ থেকে মার্চ ৬, ১৮৭২ । তৎকালীন প্রুসিয়ার অন্তর্গত ক্যেনিক্সবের্ক (Königsberg) শহরে এক সম্ভ্রান্ত জার্মান ইহুদি পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ক্যেনিক্সবের্ক ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন। ক্যেনিক্সবের্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক রোজেন্ক্রানৎস্ এবং অধ্যাপক পিটার ফন্ বোহ্লেনের নিকট দর্শন ও সংস্কৃত শিক্ষার সূত্রপাত করেন। পরে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক শ্লেগেল ও সুবিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ্ মনীষী লাসেনের নিকট উত্তমরূপে সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় সাহিত্য অধ্যয়ন করেন । এরপর তিনি অধ্যাপক ফ্রাইতাগের নিকট আরবী ভাষা চর্চা আরম্ভ করেন। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে ক্যেনিক্সবের্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি 'ডক্টর' উপাধিতে ভূষিত হন। প্রকৃতপক্ষে এ'সময় থেকেই তার জ্ঞানতপস্যার জীবন শুরু হয়। [১]
১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার সংস্কৃতচর্চার প্রথম নিদর্শন হিসাবে কৃষ্ণ মিশ্র (১০৫০ -১১০০ খ্রিঃ) প্রণীত 'প্রবোধচন্দ্রোদয়' নাটকের একখানি জার্মান অনুবাদ প্রকাশ করেন; উল্লেখ্য, এ'গ্রন্থে তার দর্শন অধ্যাপক রোজেন্-ক্রান্ৎসের মুল্যবান ভূমিকা সন্নিবেশিত হয়েছিলো। কিন্তু গ্রন্থের কোথাও তিনি অনুবাদকের নাম উল্লেখ করেননি। এই সময় তিনি পারীতে এসে তিন বছর বসবাস করেন এবং বিখ্যাত ফরাসি মনীষী ও ভারততত্ত্ববিদ বুর্নুফের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। ১৮৪৪ সালে বুর্নুফ 'ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস' গ্রন্থখানি রচনা করেন এবং এ'ক্ষেত্রে তিনি গোল্ড্স্ট্যুকরের কাছ থেকে প্রভূত সাহায্য পেয়েছিলেন। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে গোল্ড্স্ট্যুকর প্রথমবারের জন্য ইংলণ্ড গমন করেন এবং অক্সফোর্ডের বড্লিয়ান লাইব্রেরিতে ও লন্ডনের ইস্ট ইণ্ডিয়া হাউসে রক্ষিত প্রাচীন সংস্কৃত পুথিঁর বিপুল সম্ভার হাতে পান। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৮৪৭ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত বার্লিনে বসবাস করেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত জার্মান শিক্ষাবিদ আলেকজাণ্ডার ফন হুমবোলতের (Alexander von Humboldt) সঙ্গে পরিচিত হন। উল্লেখ্য, হুমবোলতের 'কস্মস্' শীর্ষক গ্রন্থের ভারতীয় প্রসঙ্গের সংকলনে তিনি সহায়তা করেন। কিন্তু তার উদারনৈতিক রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তৎকালীন জার্মান শাসকের বিষনজরে পতিত হন এবং ১৮৪৮ সালের জার্মান বিপ্লবের সময় তাকে জার্মান পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৮৫০ সালে ইংরেজ সংস্কৃতজ্ঞ মনীষী হোরেস হেম্যান উইলসন (Horace Hayman Wilson) যখন তার প্রণীত সংস্কৃত অভিধানের একটি নতুন সংস্করণের প্রণয়ন-কার্যে গোল্ড্স্ট্যুকরের সাহায্য চেয়ে তাকে আহ্বান জানালেন তখন তিনি আনন্দের সঙ্গে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ইংলণ্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হতে এতটুকু ভুল করেন নি। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে উইলসন সাহেবের প্রস্তাবক্রমে থিওডোর গোল্ড্স্ট্যুকর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অবৈতনিক অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু তিনি ঐ পদে আসীন ছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উইলসনকৃত সংস্কৃত অভিধানের সম্পাদনের কাজ শুরু করেন; কিন্তু নিজ পরিকল্পনানুযায়ী তিনি এতে প্রচুর নতুন শব্দ ও তাদের বিচিত্র ব্যবহার সংবলিত উদাহরণ সন্নিবেশিত করেন ; এর ফলে অভিধানের কলেবর অত্যধিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তাই ১৮৫৬-৬৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কেবল বর্ণমালার প্রথম অক্ষর 'অ'-সংবলিত অংশটুকুই ৪৮০ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিলো। সঙ্গত কারণে এই উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয়েছিলো। [২] ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গোল্ড্স্ট্যুকরের সাধারণ সম্পাদনায় লন্ডনে একটি সংস্কৃত-গ্রন্থপ্রকাশন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গোল্ড্স্ট্যুকর মাধবাচর্যের মীমাংসা দর্শন-বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ 'জৈমিনীয় ন্যায়মালাবিস্তরঃ' সম্পাদনা করতে শুরু করেন; কিন্তু এ'কাজও তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর অধ্যাপক এডওয়ার্ড বাইলস কাওয়েল (১৮২৬-১৯০৩) এই অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করেন।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে গোল্ড্স্ট্যুকর 'মানবকল্পসূত্র' শীর্ষক একখানি প্রাচীন গ্রন্থ কুমারিলের টীকাসহ প্রকাশ করেন। এবং এর ভূমিকা হিসাবে সংস্কৃত বৈয়াকরণ পাণিনির প্রসিদ্ধ সংস্কৃত ব্যাকরণ-সম্পর্কিত তার গবেষণা গ্রন্থটিও 'পাণিনি আণ্ড হিজ প্লেস ইন স্যান্স্ক্রিট লিটারেচার' নামে প্রকাশ পায়। পাণিনির ব্যাকরণ বিষয়ে গোল্ড্স্ট্যুকরের গবেষণা গ্রন্থটি তার সংস্কৃত ব্যাকরণ বিষয়ে প্রগাঢ় জ্ঞানের পরিচায়ক। এ'বইয়ে তিনি ম্যাক্স মুলার, রোট্ ও ব্যটলিঙ্ক-প্রমুখ সমসাময়িক পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মত খণ্ডন করার পাশাপাশি নিজের মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি পতঞ্জলিকৃত মহাভাষ্যের একটি সংস্করণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন; তার মৃত্যুর পর অবশ্য এই গ্রন্থটি প্রকাশ পেয়েছিলো। প্রাচীন হিন্দু ব্যবহারশাস্ত্রে তার অগাধ পাণ্ডিত্য থাকায় প্রয়োজনে প্রিভি কাউন্সিল হিন্দু আইনঘটিত প্রশ্নে তার মতামত গ্রহণ করতো। তার 'লিটারেরি রিমেন্স' শীর্ষক প্রবন্ধ সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে হিন্দু আইনসংক্রান্ত বিষয়ে কয়েকটি আলোচনা সংকলিত হয়েছে। এ'ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে 'চেম্বার্স এন্সাইক্লোপিডিয়া' নামক ইংরাজী বিশ্বকোষে তিনি অনেকগুলি নিবন্ধ রচনা করেছেন।[৩] এছাড়াও তিনি ইংলণ্ডের 'রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি', 'ফিললজিক্যাল সোসাইটি' প্রভৃতির সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এগুলির সভ্য হিসাবে তিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের অধিবেশনগুলিতে অনেক প্রবন্ধ পাঠ করেন।
গোল্ড্স্ট্যুকর জার্মান সংস্কৃতজ্ঞ ও ভারততত্ত্ববিদ হিসাবে চিরদিন ভারতবাসীর নিকট শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন। তিনি আধুনিক ভারত ও ভারতবাসীর প্রতি প্রগাঢ় আত্মীয়তা অনুভব করতেন। ইংলণ্ড-প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রগণকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার একটি সনেটে গোল্ড্স্ট্যুকরকে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন।[৪]