দামেস্ক অবরোধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: মুসলিমদের সিরিয়া বিজয় বাইজেন্টাইন-আরব যুদ্ধ | |||||||
কিসান গেট, দামেস্কের একটি প্রাচীন প্রবেশদ্বার। | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
রাশিদুন খিলাফত | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান | থমাস | ||||||
শক্তি | |||||||
২০,০০০ | ১৫-১৬,০০০[১] | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
স্বল্প | প্রচুর |
দামেস্ক অবরোধের এই ঘটনাটি ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দেরb[›] ২১ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর রাশিদুন খিলাফতের কাছে দামেস্কের পতনের আগ পর্যন্ত সংঘটিত হয়। দামেস্ক ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শহর যা মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ের সময় অধিকৃত হয়।
সর্বশেষ রোমান-পারসিয়ান যুদ্ধ ৬২৭ সালে শেষ হয়। এতে সম্রাট হেরাক্লিয়াস মেসোপটেমিয়ায় পারসিয়ানদের বিরুদ্ধে একটি সফল যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেন। একই সময় নবী মুহাম্মদ ইসলামের অধীনে আরবদের একত্রিত করেন। ৬৩২ সালে তার মৃত্যুর পর আবু বকর প্রথম খলিফা হিসেবে তার উত্তরসূরি হন। বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের পর আবু বকর আরব উপদ্বীপের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেন।[২]
৬৩৪ সালের এপ্রিলে আবু বকর লেভান্টে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন এবং আজনাদায়নের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা পরাজিত হয়। মুসলিম সেনাবাহিনী উত্তরের দিকে যাত্রা করে এবং দামেস্ক অবরোধ করে। রাতের বেলা হালকা প্রতিরক্ষা থাকা অবস্থায় শহরের দেয়ালে আক্রমণ করলে তার পতন ঘটানো সম্ভব - একজন বিশপ কর্তৃক মুসলিমদের প্রধান সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদকে এই সংবাদ দেয়ার পর শহর দখল করা হয়। খালিদ যখন পূর্ব গেট দিয়ে আক্রমণ চালান তখন বাইজেন্টাইন গেরিসনের কমান্ডার থমাস জাবিয়াহ গেটে খালিদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহর সাথে শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন। শহরের আত্মসমর্পণের পর কমান্ডাররা শান্তিচুক্তির শর্তগুলোর ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত আবু উবাইদাহর করা চুক্তিটি মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর তিনদিন পর খালিদ এন্টিওকের দিকে যাত্রা করা দামেস্কের লোকদের পিছু নেন এবং ছয় দিন পর বর্তমান আল জায়াদের নিকটে একটি যুদ্ধে পরাজিত করে।[৩]
বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধ (৬০২-৬২৮) এর মধ্যবর্তী সময় ৬১০ এ ফোকাসকে সরিয়ে হেরাক্লিয়াস বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট হন।[৪] হেরাক্লিয়াস যখন সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছিলেন তখন সাসানীয়রা মেসোপটেমিয়া দখল করে নেয়। ৬১১ এ সিরিয়া জয় করে ও কায়সারিয়া মাজাকা দখলের উদ্দেশ্যে আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করে। ৬১২ সালে হেরাক্লিয়াস আনাতোলিয়া থেকে পারসিয়ানদেরকে হটিয়ে দেন। ৬১৩ সালে তিনি সিরিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালান কিন্তু পরাজিত হন।[৫]
পরবর্তী দশকে পারসিয়ানরা ফিলিস্তিন ও মিশর দখল করে নেয়। হেরাক্লিয়াস নতুন করে হামলার জন্য তার সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন এবং ৬২২ এ তিনি হামলা চালান।[৬] তিনি পারসিয়ান এবং ককেসাস ও আর্মেনিয়ায় তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন। ৬২৭ সালে মেসোপটোমিয়ায় পারসিয়ানদের বিরুদ্ধে তিনি একটি শীতকালীন হামলা পরিচালনা করেন এবং নিনেভের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই বিজয় পারসিয়ান রাজধানী তিসফুনের উপর হুমকি হিসেব প্রতীয়মান হয়।[৭]
বেশ কিছু পরাজয়ে বিপর্যস্ত দ্বিতীয় খসরু তার পুত্র দ্বিতীয় কাবাদ কর্তৃক একটি অভ্যুত্থানে হন। তিনি শান্তির আবেদন করেন এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দিতে রাজি হন। ৬২৯ হেরাক্লিয়াস একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেরুজালেমে ট্রু ক্রস পুনরায় স্থাপন করে।[৮]
আরবে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) আরবের বেশিরভাগ অঞ্চলকে একই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে নিয়ে আসেন। ৬৩২ এর জুনে তিনি মৃত্যুবরণ করলে আবু বকর(রাঃ) মুহাম্মদ(সাঃ) এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তরসুরি হিসেবে নবগঠিত খলিফা পদে নির্বাচিত হন। কিছু আরব গোত্র তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। রিদ্দার যুদ্ধে আবু বকর(রাঃ) এই বিদ্রোহ দমন করে। ৬৩৩ সাল নাগাদ সমগ্র আরব খলিফার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অধীনে সম্পূর্ণরূপে একীভূত হয়।[৯] ৬৩৩ সালে আবু বকর প্রতিবেশী সাসানীয় ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন।[১০] পারসিয়ান প্রদেশ ইরাক জয়ের পর ৬৩৪ এর এপ্রিলে চারটি ভিন্ন পথে বাইজেন্টাইন লেভান্ট আক্রমণ করেন। এই বাহিনীগুলো এই কাজের তুলনায় ক্ষুদ্র ছিল তাই সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ ইরাক থেকে নতুন সৈন্য সমাবেশ করেন।[১১] মরুভূমি অতিক্রম করে খালিদ বিন ওয়ালিদ একটি ভিন্ন পথে দ্রুত বেগে সিরিয়া প্রবেশ করেন। তিনি লেভান্টে বাইজেন্টাইন প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে দেন এবং দ্রুত গাসানীয় রাজধানী শহর বসরা অধিকার করেন। ৬৩৪ এর জুলাই খালিদের অধীনস্থ মুসলিম বাহিনী আজনাদায়নের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। দক্ষিণ অংশ নিষ্কন্টক করার পর মুসলিমরা দামেস্ক অবরোধ করে।[১২]
কৌশলগত অবস্থানের কারণে দামেস্ক ব্যবসায়ীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান ছিল। এই শহরটি সিরিয়ার বেহেশত বলে পরিচিত ছিল।[১৩]
শহরের প্রতিরক্ষা মজবুত ছিল। প্রধান অংশ ১১ মিটার (৩৬ ফুট) উঁচু বিশাল১১ মি (৩৬ ফু) দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।c[›] এই দুর্গনগরটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায়১,৫০০ মি (৪,৯০০ ফু) ১,৫০০ মিটার (৪,৯০০ ফুট) ও প্রস্থ ছিল প্রায় ৮০০ মিটার (২,৬০০ ফুট)।[১৩]
এতে মোট ছয়টি গেট ছিল:
দামেস্কের উত্তর দেয়ালের পাশ দিয়ে বারাদা নদী প্রবাহিত হলেও প্রতিরক্ষার জন্য এটি যথেষ্ট অগভীর ছিল।[১৪]
সিরিয়া অভিযানের সময় দামেস্কে বাইজেন্টাইন কমান্ডার ছিলেন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের জামাতা থমাস। তিনি একজন একনিষ্ঠ খ্রিষ্টান ছিলেন। নেতৃত্বে নিজের সাহস ও দক্ষতা এবং বুদ্ধি ও শিক্ষার জন্য তার খ্যাতি ছিল।[১৩]
সপ্তম শতকে মুসলিম সেনাবাহিনীতে কোনো অবরোধ যন্ত্র ছিল না। অন্য কোনো উপায় না থাকলে সাধারণত অবরোধ কৌশল ব্যবহার করা হত। প্রয়োজনীয় অবরোধ যন্ত্রের অভাবে তৎকালীন বিজয় অভিযানের সময় শহরের আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত শহরের সরবরাহ বন্ধ করে এর চারপাশে অবস্থান নেয়া হত।[১৫] একই সাথে সম্ভাব্য স্থলে শহরের দেয়াল ভেঙ্গে ঢুকে পড়ার কৌশল কাজে লাগত। মুসলিম সেনাবাহিনী শহরকে অন্যান্য স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত এবং বিভিন্ন স্থানে সেনাদল পাঠাতো।
দামেস্ককে বিচ্ছিন্ন করার জন্য খালিদ উত্তর সিরিয়ার সাথে সরবরাহ ও যোগাযোগের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] পশ্চিমে ফাহালে অশ্বারোহী দলের আগমন বাইজেন্টাইন গেরিসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন].[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এই দলটি মদীনার মুসলিম সরবরাহ পথের নিরাপত্তার দিকে নজর রাখছিল।[১৬] ফলে এই দলটি সিরিয়া ফ্রন্টে মুসলিম বাহিনীর পশ্চাতভাগ হিসেবে কাজ করে। এমেসার পথে আরেকটি সেনাদলকে পাঠানো হয়। এরা প্রায় ১০ মাইল (১৬ কিমি) দূরে বাইত লাহিয়ায় অবস্থান নেয়। বাইজেন্টাইনদের সাহায্য আসছে কিনা তা নজর রাখা তাদের দায়িত্ব ছিল। পরাজিত বাইজেন্টানদের উদ্ধারকারী দলকে পরাজিত বা ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হলে এর কমান্ডার যাতে খালিদের কাছে সৈন্য চেয়ে পাঠায় তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
২১ আগস্ট (২০ জামাদিউল আখির, ১৩ হিজরি) খালিদ তার সেনাবাহিনীকে শহর ঘিরে থাকার জন্য নির্দেশ দেন।[১৭] সেনাদলগুলোকে নিজেদের অবস্থানের গেটে যেকোনো বাইজেন্টাইন হামলা রুখে দিতে নির্দেশ দেয়া হয় এবং বড় হামলার সময় সাহায্যের আবেদন পাঠানোর জন্য বলা হয়। দিরার বিন আল-আজওয়ার মোবাইল গার্ডের ২,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে গেটগুলোর মধ্যের খালি স্থানগুলোতে[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] টহল দেন ও বাইজেন্টাইনদের আক্রমণের সময় সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকেন।[১৮]
নিম্নোক্ত মুসলিম সেনাপতিরা দামেস্কের ছয়টি গেটে অবরোধ স্থাপন করেন। প্রত্যেক কমান্ডারের অধীনে ৪,০০০ – ৫,০০০ সৈনিক ছিল:
খালিদ তার নিজ বাহিনীর মূল অংশকে রাফায় বিন উমাইরের অধীনে পূর্ব গেটে স্থাপন করেন।[১৯] এর থেকে অল্প দূরত্বে একটি মঠে তিনি তার সদর দপ্তর স্থাপন করেন। এটি তখন থেকে দাইর আল খালিদ, খালিদের মঠ বলে পরিচিত।[১৯] শহর ঘিরে রাখার মাধ্যমে খালিদের সেনারা দামেস্কে সকল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। মুসলিম সেনাবাহিনী দামেস্ক থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ লাভ করে।[১৭]
অবরোধের শুরুতে সম্রাট হেরাক্লিয়াস এন্টিওকে ছিলেন এবং [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ তিনি সাহায্যের জন্য ১২,০০০ জনের একটি বাহিনী পাঠান।[২০] এমেসা থেকে দামেস্কের পথে টহল দেয়া সৈনিকরা বাইজেন্টাইনদের আগমনের সংবাদ দেয়। এই খবর পাওয়ার পর খালিদ রাফায় বিন উমাইরকে ৫,০০০ জন সেনা সহকারে প্রেরণ করেন। দামেস্ক থেকে ২০ মাইল (৩২ কিমি) উত্তরে দামেস্ক-এমেসা সড়কের উকাব গিরিপথে (ঈগল গিরিপথ) তারা মুখোমুখি হয়।[২১] সংখ্যাস্বল্পতার কারণে বাইজেন্টাইনরা তাদের ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়। বাইজেন্টাইনরা তাদের হারানোর আগে খালিদ ৪,০০০ জনের একটি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং বাইজেন্টাইনদের হটিয়ে দেন।[২২] এটিকে উকাব গিরিপথের যুদ্ধ বলা হয়।[২১]
বাইজেন্টাইনদের হটাতে ৯,০০০ জন সৈনিক সরিয়ে ফেলায় মুসলিমদের অবরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকদের মতে বাইজেন্টাইনরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে শহর থেকে বেরিয়ে পড়লে অবরোধ ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হত ও মুসলিমদের পরাজিত করতে পারত। প্রতিকূল অবস্থা বিবেচনা করে খালিদ দ্রুত দামেস্ক ফিরে আসেন।[২৩]
বাড়তি সেনা সাহায্য আসবে না বুঝতে পেরে থমাস একটি পাল্টা আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।[২৪] ৬৩৪ এর সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে থমাস শহরের সব এলাকা থেকে লোক সংগ্রহ করেন যাতে তারা থমাস গেট দিয়ে বের হয়ে আক্রমণ চালাতে পারে। এখানে তিনি শুরাহবিল ও তার ৫,০০০ সৈনিকের মুখোমুখি হন। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে তীর চালনার মাধ্যমে বাইজেন্টাইনদের আক্রমণ শুরু হয়। বাইজেন্টাইন পদাতিকদেরকে তীরন্দাজরা দেয়ালের উপর থেকে ঘিরে রেখেছিল। সৈনিকরা গেট দিয়ে বের হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধবিন্যাস অনুযায়ী অবস্থান নেয়। থমাস নিজে এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন।[২৫] এসময় একটি তীর তার ডান চোখে লাগে। মুসলিমদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে তারা শহরের দিকে পিছু হটে। বলা হয় যে থমাস তার চোখের বদলে হাজার চোখ নেয়ার শপথ নেন। সেই রাতে আরেকটি বড় হামলার জন্য তিনি আদেশ দেন।[২১]
এবার থমাস চারটি গেট থেকে একই সাথে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। মূল সেক্টর হিসেবে পুনরায় থমাস গেটকে নির্ধারণ করা হয় যাতে সেখানে অবস্থানরত ক্লান্ত মুসলিম সৈনিকদের উপর হামলা করা যায়। জাবিয়া গেট, ছোট গেট ও পূর্ব গেট থেকে হামলা করার উদ্দেশ্য ছিল এখানে অবস্থানরত মুসলিমদেরকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাতে তারা থমাস গেটে অবস্থানরত শুরাহবিলের সেনাদেরকে সাহায্য করতে না পারে।[২৬]
পূর্ব গেটে থমাস অন্যান্য গেটের চেয়ে বেশি সেনা সমাবেশ করেন যাতে খালিদ শুরাহবিলের সাহায্য ও সেই সেক্টরের দায়িত্ব না নিতে পারেন। থমাসের বিভিন্ন দিকে হামলা এই অপারেশনকে সুবিধা দেয়।থমাস গেট বাদে অন্য যেকোন সেক্টরে সাফল্য অর্জিত হলে তা অবরোধ ভেঙ্গে ফেলতে কাজে লাগত। থমাস আদেশ দেন যাতে খালিদকে জীবিত গ্রেপ্তার করা হয়।[২৭]
জাবিয়া গেটে কয়েকটি লড়াইয়ের পর কমান্ডার আবু উবাইদাহ ও তার সৈনিকরা প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দিতে সক্ষম এবং বাইজেন্টাইনরা শহরের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। ছোট গেটে লড়াই তীব্র আকার ধারণ করে। এখানে ইয়াজিদ ও তার সৈনিকরা অবস্থান করছিলেন। ইয়াজিদের স্বল্প সৈনিক ছিল কিন্ত জারার তার অধীন মোবাইল গার্ডের ২,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। অশ্বারোহীরা বাইজেন্টাইনদের আক্রমণ করে পিছু হটতে বাধ্য করে।[২৪]
পূর্ব গেটে বিরাট সংখ্যক বাইজেন্টাইন সৈনিক থাকায় অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করে। তাদের আক্রমণ প্রতিহত করা রাফায়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। খালিদ তার ৪০০ দক্ষ অশ্বারোহী নিয়ে সময়মত উপস্থিত হন এবং প্রতিপক্ষের উপর হামলা করেন। এই ঘটনা পূর্ব গেটের যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।[২৮]
সবচেয়ে ভারী লড়াইটা হয় থমাস গেটে। থমাস এখানে নিজে সৈনিকদের নেতৃত্বে দেন।[২৪] তীব্র লড়াইয়ের পর থমাস যখন দেখতে পান যে মুসলিমদের দুর্বল করা সম্ভব হচ্ছে না তখন সিদ্ধান্ত নেন যে এভাবে আক্রমণ ফলপ্রসূ হবে না এবং এর ফলে তার লোকেরা দুর্দশার সম্মুখীন হবে। তিনি সেনা প্রত্যাহারের আদেশ দেন এবং সৈনিকরা স্থান ত্যাগ করে। এসময় তারা মুসলিমদের তীর নিক্ষেপের স্বীকার হয়। অবরোধ ভাঙ্গার জন্য এটা ছিল থমাসের শেষ চেষ্টা। এটি ব্যর্থ হয়। তিনি এই হামলায় তার কয়েক হাজার[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] সৈনিক নিহত হয় এবং তিনি শহরের বাইরে গিয়ে আক্রমণের ক্ষমতা হারান।[২৯]
১৮ সেপ্টেম্বর (১৯ রজব ১৩ হিজরি) বীতশ্রদ্ধ দামেস্কের বিশপ জোনাহ নামের[৩০] একজন ব্যক্তিকে খালিদের কাছে ঐ রাতের উৎসব উৎযাপনের ব্যাপারে জানান।e[›] এই উৎসব খালিদকে শহর দখলের জন্য একটি অতর্কিত হামলার সুযোগ করে দেয়। এর বিনিময়ে জোনাহ তার নিজের ও তার বাগদত্তার নিরাপত্তা চায়।[৩১] মুসলিম সূত্র মতে মুসলিম সেনাবাহিনীর দামেস্ক অবরোধের কারণে তাকে তার হাতে তুলে দেয়া হয়নি এবং সে ব্যক্তি খালিদের কাছে এই তথ্য শুধু তার ভবিষ্যত স্ত্রীকে পাওয়ার জন্যই পৌছে দেয়। জোনাহ একই সাথে ইসলাম গ্রহণ করে।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন][২৮]
পুরো সেনাবাহিনীর জন্য আক্রমণ পরিকল্পনার সময় না থাকায় খালিদ পূর্ব গেটে হামলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে, কাদা বিন আমর ও মাজুর বিন আদি গেটের পাশ থেকে দেয়াল বেয়ে উঠে পড়েন।[৩২] দেয়ালের এই অংশ খুব মজবুত ছিল এবং এখানে কোনো রক্ষী ছিল না। তারা দেয়ালের উপর রশি বাধেন ও নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ১০০ জন নির্বাচিত সৈনিকের দিকে ছুড়ে দেন।[২৯] আরোহণরতদের পাহারায় কয়েকজনকে রেখে ভেতর ঢুকে প্রহরীদেরকে হত্যা করা হয়। খালিদ ও কাদা গেট খুলে দেন ও বাকি লোকেরা শহরে প্রবেশ করে। ফলে যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে।[১৭]
অন্যান্য গেট থেকে সেনারা অবস্থান পরিবর্তন করেনি দেখে থমাস ধারণা করেন যে শুধু খালিদের সেনারাই শহরে ঢুকেছে এবং অন্য কমান্ডাররা অতর্কিত আক্রমণের ব্যাপারে জানতেন না। মুসলিমদের কৌশল নির্দিষ্ট ছিল: যদি কোনো শহর আত্মসমর্পণ করে তবে বাসিন্দাদেরকে সুরক্ষা দেয়া হত, কিন্তু প্রতিরোধ করলে প্রতিরোধকারীদের হত্যা করা হত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] থমাস শেষবারের মত দামেস্ক রক্ষার চেষ্টা করে। খালিদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবু উবাইদাহর সাথে আলোচনার জন্য তিনি জাবিয়া গেটে দূত প্রেরণ করেন এবং শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও জিজিয়া দেয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দেন।[৩৩] আবু উবাইদাহ শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি খালিদও তার সাথে একমত হবেন ভেবে তিনি থমাসের শর্তে রাজি হন।[৩৪]
অন্যান্য সেনাদলের কমান্ডারের কাছে এই সংবাদ পৌছায়। ভোরের পর আবু উবাইদাহ জাবিয়া গেট দিয়ে দামেস্কে প্রবেশ করেন এবং অন্যান্য কমান্ডাররা নিজেদের অবস্থান নেয়ার গেট দিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। এসময় খালিদ পূর্ব গেটে লড়াইরত ছিলেন।[২৪] আবু উবাইদাহ তার সেনাদলসহ থমাস, হারবিস, উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ও দামেস্কের বিশপের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে শহরের কেন্দ্রে আসেন। পূর্ব গেটে খালিদ ও তার সৈনিকরা লড়াই করতে করতে দামেস্কের কেন্দ্রে আসেন। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চার্চ অব মেরিতে সেনাপতিরা সাক্ষাৎ করেন।[৩৫]
খালিদ দাবি করেন যে তিনি শক্তি প্রয়োগ করে জয় করেছেন। আবু উবাইদাহ তার এবং থমাসের মধ্যকার চুক্তি মোতাবেক শহরের আত্মসমর্পণ হয়েছে বলে মত দেন।[৩৫] সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন এবং খালিদকে বলেন যে শান্তিচুক্তিকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে। তারা তাদের যুক্তির ব্যাখ্যা দেন: সিরিয়ার রোমানরা যদি চুক্তি ভঙ্গের সংবাদ পায় তাহলে অন্য কোনো শহর এরপর মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। এর ফলে সিরিয়া জয় করার কাজ দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও খালিদ এই শর্তে রাজি হন।[২৫]
চুক্তির শর্তে উল্লেখ ছিল যে কাউকে দাস বানানো হবে না, মন্দিরের কোনো ক্ষতি করা হবে না, কোনো কিছু লুঠ করা হবে না। থমাস, হারবিস ও মুসলিম শাসনে থাকতে অনিচ্ছুক নাগরিকদেরকে শহর ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়। এতে এও উল্লেখ ছিল যে তিন দিন পর শান্তি অবস্থা শেষ হতে পারে এবং এরপর মুসলিমরা চুক্তিভঙ্গ না করে আক্রমণ করতে পারবে।[৩৩]
খালিদ বিন ওয়ালিদ কর্তৃক নিম্নোক্ত চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করা হয়:
আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, অশেষ দয়ালু। খালিদ বিন আল ওয়ালিদের পক্ষ থেকে দামেস্কের জনতার প্রতি। যখন মুসলিমরা শহরে প্রবেশ করবে, তারা (জনতা) তাদের সম্পত্তির, তাদের মন্দিরের ও শহরের দেয়ালের রক্ষা নিজেরা করবে, এগুলোর কিছুই ধ্বংস করা হবে না। আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, খলিফা ও মুসলিমদের পক্ষে থেকে তাদের এই নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে, যতক্ষণ তারা জিজিয়া পরিশোধ করছে ততক্ষণ তারা এ থেকে ভাল বস্তু অর্জন করবে।[৩০]
গ্রীক বংশোদ্ভূত ব্যক্তি জোনাহ, যে খালিদকে পূর্ব গেট দিয়ে শহরে ঢোকার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল, সে খালিদকে এন্টিওক যাওয়ার সংক্ষিপ্ত পথ দেখিয়ে দেয়। খালিদ একটি অশ্বারোহী দলের নেতৃত্বে দেন ও এন্টিওকের কাছে সমুদ্রতীরে তারা দামেস্ক ত্যাগ করা একটি দল আটক করেন।[৩৬] তিন দিনের সন্ধি পার হয়ে গিয়েছিল; খালিদের অশ্বারোহীরা প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে তাদের আক্রমণ করে। জনশ্রুতি অনুযায়ী পরবর্তী একটি যুদ্ধে খালিদ থমাস ও হারবিস দুজনকেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত করেন। এটি মারজুদ্দিবাজের যুদ্ধ বলে পরিচিত। মুসলিমরা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে বেশ বড় সংখ্যক ব্রোকেড লাভ করে।[৩৭] থমাসের স্ত্রী, হেরাক্লিয়াসের মেয়ে এই যুদ্ধে বন্দী হন। তৎকালীন দলিল অনুযায়ী, গ্রীক ব্যক্তি জোনাহ, যে খালিদকে এন্টিওকের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল সে তার বাগদত্তাকে ফিরে পায়, কিন্তু ঐ মেয়ে আত্মহত্যা করে। খালিদ জোনাহকে হেরাক্লিয়াসের মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে তাতে অস্বীকৃতি জানায়। খালিদ তাকে তার পিতার কাছে ফেরত পাঠান। দুই বছর পর ইয়ারমুকের যুদ্ধে জোনাহ নিহত হয়।[৩৮]
আবু বকর মদীনায় মৃত্যুবরণ করে। তিনি উমরকে তার উত্তরসুরি মনোনীত করেন। উমর খালিদকে মুসলিম সেনাবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে খালিদকে অপসারণ করেন ও আবু উবাইদাহকে এই পদে নিয়োগ দেন। সে বছর ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর রাশিদুন খিলাফত সমগ্র লেভান্ট জয় করে নেয়।[৩৯] ৬৩৯ সাল নাগাদ বাইজেন্টাইনরা আর্মেনিয়া ও মেসোপটেমিয়ার দখল বঞ্চিত হয়। সম্রাট হেরাক্লিয়াস মিশর ও আনাতোলিয়ায় প্রতিরক্ষা মজবুত করেন। বাইজেন্টাইন দুর্গ ত্যাগ করে কায়সারিয়ার পশ্চিমে তিনি বাফার-জোন প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিমরা আনাতোলিয়া আক্রমণ করেনি। ৬৪২ সাল নাগাদ বাইজেন্টাইনরা মিশর ও ত্রিপলিতানিয়া হারায়।[৪০]
আরবদের দামেস্ক শাসনের সময় শহরের অধিকাংশ অধিবাসী ইস্টার্ন অর্থোডক্স ও মনোফিসিট খ্রিষ্টান ছিল। সেসাথে মক্কা, মদীনা ও সিরিয়ান মরুভূমির বর্ধিষ্ণু আরব মুসলিমরাও ছিল।[৪১]
ইসলামিক সিরিয়ার রাজধানী হিসেবে দামেস্ককে নির্বাচিত করা হয়। শহর অধিকার করা মুসলিম সেনাপতিদের অন্যতম ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান এর প্রথম মুসলিম গভর্নর ছিলেন। ৬৪০ সালে তিনি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তার ভাই প্রথম মুয়াবিয়া তার উত্তরসুরি হন। ৬৬১ সালে সর্বশেষ রাশিদুন খলিফা আলীর মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া খলিফা হন ও উমাইয়া রাজবংশের সূচনা করেন।
পরবর্তীতে দামেস্ক উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী হয়[৪২] এবং উমাইয়া খিলাফতের বাড়তি আয় দামেস্কের কোষাগারে পাঠানো হত। আরবি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শহরের আরব সংখ্যালঘুরা গ্রীকভাষী খ্রিষ্টানদের থেকে বেশি সুবিধা লাভ করে।[৪৩]
উমাইয়াদের অধীনে দামেস্কের ব্যবসা ও অর্থনীতির সমৃদ্ধি ঘটে। ৭৫০ সালে আব্বাসীয়দের হাতে পতনের আগ পর্যন্ত এটি বিশ্বের অন্যতম ঐশ্বর্যশালী শহর ছিল। ইরাকে জাবের যুদ্ধে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের পরাজিত করার পর ৭৫০ এর ২৫ আগস্ট আব্বাসীয়রা সহজে দামেস্ক দখল করে নেয়। আব্বাসীয়দের উত্থানের পর দামেস্কের জৌলুসে ভাটা পড়ে এবং নতুন মুসলিম রাজধানী বাগদাদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।[৪৪]
^ a: According to some sources the city was captured in 635 (See Burns (2007), Damascus a history, page:99)
^ b: According to some sources the siege lasted for 6 months (See Burns (2007), Damascus a history, page:99)
^ c: Damascus City has risen 4 metres since then, so that the wall is now only 7 metres above ground level (See Akram (2004), pg.294.)
^ d: See The walls and gates of Damascus.
^ e: It is not clear which festival it was, some early Muslim sources says it was a celebration of the birth of son to the high priest of Damascus (Al-Waqidi, p.46)
|তারিখ=
(সাহায্য)|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)|তারিখ=
(সাহায্য)
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |