দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ (ভি.এল.সি.) হলো তথ্য যোগাযোগের এক ভিন্নধর্মী ব্যবস্থা, যেখানে ৪০০ এবং ৮০০ হার্জের মধ্যকার দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। এটি অপটিক্যাল বেতার যোগাযোগ প্রযুক্তির একটি অংশ।
এই প্রযুক্তিতে ১০ কিলোবিট/সেকেন্ডে সংকেত প্রেরণের জন্য ফ্লুরোসেন্ট বাতি (সাধারণ বাতি: তথ্য আদান-প্রদানের কোনো বিশেষ যন্ত্র নয়) অথবা স্বল্প-দূরত্বে ৫০০ মেগাবিট/সেকেন্ডে সংকেত প্রেরণের ক্ষেত্রে আলোক নিঃসারী ডায়োড ব্যবহার করা হয়। রিজনেবল অপটিক্যাল নিয়ার জয়েন্ট এক্সেস (রনজা)-এর মতো পদ্ধতিগুলো ১ থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বে পূর্ণাঙ্গ ইথারনেট গতিতে (১০ কিলোবিট/সেকেন্ড) সংকেত প্রেরণ করতে পারে।
ফটোডায়োড সংবলিত বিশেষভাবে নকশা করা বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলি সাধারণত আলোক সূত্র থেকে সংকেত গ্রহণ করে, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটি মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অথবা একটি ডিজিটাল ক্যামেরাই যথেষ্ট।[১] এই ডিভাইসগুলিতে ব্যবহৃত ইমেজ সেন্সরটি প্রকৃতপক্ষে ফটোডায়োড (পিক্সেল) এর একটি অ্যারে এবং কিছু কিছু অ্যাপ্লিকেশনে একটি একক ফটোডোডের চেয়ে এর ব্যবহার প্রাধান্য পেতে পারে। এই ধরনের সেন্সর হয় একাধিক-চ্যানেল (১ পিক্সেলের নিচে = ১ চ্যানেল) নতুবা একাধিক আলোক উৎসের স্থান-সংক্রান্ত চেতনা প্রদান করে।[২]
যোগাযোগের মাধ্যম স্বরূপ সর্বব্যাপী কম্পিউটিং এর জন্য দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ আলোক উৎপাদনকারী যন্ত্র (যেমন, ঘরে-বাইরে ব্যবহৃত বাতি, টেলিভিশন, ট্রাফিক বাতি, বাণিজ্যিক পর্দা, গাড়ির সামনের ও পিছনের বাতি, ইত্যাদি)[৩] প্রায় সকল জায়গায় ব্যবহার করা হয়। উচ্চ-ক্ষমতার ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলোতে দৃশ্যমান আলোর ব্যবহার কম বিপজ্জনক, কারণ মানুষজন এটা দেখতে পেয়ে সাম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে নিজেদের চোখ রক্ষা করতে পারে।
দৃশ্যমান আলোক যোগাযোগের (ভি.এল.সি.) ইতিহাসের সূচনা হয় ১৮৮০-র দশকে ওয়াশিংটন ডিসি-তে, যখন স্কটিশ-বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ফটোফোন আবিষ্কার করেছিলেন, যা নিয়ন্ত্রিত সূর্যালোকে কয়েকশ মিটার দূরে বার্তা প্রেরণ করে। এটি রেডিওর মাধ্যমে বার্তা প্রেরণের আগের সময়ের কাহিনী।
এ প্রযুক্তি বিষয়ক আরও সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় ২০০৩ সালে জাপানের কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাকাগাওয়া গবেষণাগারে, যেখানে আলোক নিঃসারী ডায়োড ব্যবহার করে দৃশ্যমান আলোর মাধ্যমে তথ্য প্রেরণ করা হয়। তখন থেকে দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ প্রযুক্তি কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি গবেষণা সংগঠিত হয়েছে।
২০০৬ সালে পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক ঘরের ভিতরে থাকা বৈদ্যুতিক যন্ত্রসমূহে ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদানের লক্ষ্যে পাওয়ার-লাইন যোগাযোগ এবং সাদা আলোক নিঃসারি ডায়োড সংযুক্ত করে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন।[৪] এই গবেষণা হতে ধারণা পাওয়া যায় যে, দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ ভবিষ্যতে সংযোগ গ্রহীতা পর্যায়ের নিখুঁত সমাধান হিসেবে স্থাপন করা যেতে পারে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বার্লিনে সিমেন্স এবং ফ্রাউনহোফ্যার টেলিযোগাযোগ ইনস্টিটিউট, হাইনরিখ হার্জ ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক একটি সাদা আলোক নিঃসারি ডায়োড ব্যবহার করে ৫০০ মেগাবিট/সেকেন্ডে ৫ মিটার দূরত্বে তথ্য প্রেরণ প্রদর্শন করেন; আর ৫টি আলোক নিঃসারি ডায়োড ব্যবহার করে ১০০ মেগাবিট/সেকেন্ডে আরো অধিক দূরত্বে তথ্য প্রেরণ করেন।[৫]
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলী ইনস্টিটিউট ৮০২.১৫.৭ দলের অধীনে দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ প্রযুক্তির মানীকরণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়।
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে মিনেসোটার সেন্ট. ক্লাউড শহর এল.ভি.এক্স.-এর সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এই প্রযুক্তি স্থাপনে প্রথম কোনো শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।[৬]
২০১১ সালের জুলাই মাসে টি.ই.ডি. গ্লোবাল-এ[৭] একটি উপস্থাপনা মানসম্পন্ন আলোক নিঃসারি ডায়োড ব্যবহার করে সরাসরি উচ্চ-মাত্রার ভিডিও প্রদর্শন করে এবং সেখানে দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ প্রযুক্তির এই সংস্করণকে "Li-Fi" নামে প্রস্তাব করা হয়।
সম্প্রতি দৃশ্যমান আলো যোগযোগ প্রযুক্তি নির্ভর অভ্যন্তরীণ অবস্থান নির্ণয় পদ্ধতি আলোচনার আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এ.বি.আই. গবেষণা হতে প্রাপ্ত পূর্বাভাস অনুযায়ী ৫'শ কোটি মার্কিন ডলারের অভ্যন্তরীণ অবস্থান পদ্ধতি সংক্রান্ত বাজার উন্মুক্তকরণে এই প্রযুক্তি মূল চাবিকাঠি হতে পারে।[৮] নাকাগাওয়া গবেষণাগার হতে বিভিন্ন প্রকাশনা বের হচ্ছে; বাইটলাইট ২০১২ সালে আলোক নিঃসারি ডায়োড সংবলিত ডিজিটাল অনুরণন শনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে আলোক অবস্থান নির্ণয় পদ্ধতির উপর পেটেন্টের জন্য একটি আবেদন করেছে। পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তারবিহীন আলোক প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান জুড়ে আরো বিভিন্ন গবেষক এই প্রযুক্তির উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।[৯][৯][১০][১১]
খরচ-সাশ্রয়ী ও কম-জটিল হওয়ার বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে খেলনার দুনিয়ায় এই প্রযুক্তির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে কেবলমাত্র একটি মাইক্রোকন্ট্রোলার এবং অপটিক্যাল ফ্রন্ট-এন্ড হিসেবে আলোক নিঃসারি ডায়োড প্রয়োজন হয়।
নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান আলো যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।[১২][১৩] এই ধরনের প্রযুক্তি বিশেষত শরীর সেন্সর নেটওয়ার্ক এবং ব্যক্তিগত ক্ষেত্র নেটওয়ার্ক এর ক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
সম্প্রতি অপটিক্যাল ট্রান্সিভার হিসেবে অর্গানিক এল.ই.ডি. ব্যবহার করে ১০ মেগাবিট/সেকেন্ড পর্যন্ত ভি.এল.সি. সংযোগ তৈরী করা হয়েছে।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে অ্যাক্সরটেক কোম্পানি মোমো নামে বাণিজ্যিক একটি উভমুখী লাল-সবুজ-নীল এল.ই.ডি. ভি.এল.সি. পদ্ধতি চালু করে, যেটা উপরে-নিচে ২৫ ফিট দূরত্বে ৩০ মেগাবিট/সেকেন্ডে তথ্য প্রেরণ করতে পারে।[১৪]
২০১৫ সালের মে মাসে সুপার-মার্কেট কোম্পানি ক্যারফ্যুঁ-এর সাথে ফিলিপস কোম্পানি একত্রে সাথে কাজ করে ফ্রান্সের লিলঁ-এ অবস্থিত একটি হাইপার-মার্কেটে ক্রেতাদের স্মার্টফোনে ভি.এল.সি. অবস্থান নির্ণয় প্রযুক্তি ভিত্তিক সেবা প্রদান করে।[১৫] ২০১৫ সালের জুন মাসে কুয়াং-চি এবং পিং-আন ব্যাঙ্ক নামের দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজ করে এমন একটি পেমেন্ট কার্ড উন্মোচন করে যা অনন্য দৃশ্যমান আলোর সাহায্যে তথ্য আদান-প্রদান করে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ফিলিপস কোম্পানি সর্বপ্রথম জার্মানীতে ক্রেতাদের স্মার্টফোনে ভি.এল.সি. অবস্থান ভিত্তিক সেবা সংস্থাপন করে। ডুসেলডর্ফ এর ইউরোশপ-এ ইনস্টলেশন উপস্থাপন করা হয়। জার্মানির প্রথম সুপার-মার্কেট হিসেবে ডুসেলডর্ফে অবস্থিত এদেকা সুপারমার্কেট এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে, যা ৩০ সেন্টিমিটারের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে অবস্থান নির্ণয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করে, যার ফলে খুচরা পণ্য বিক্রির বিশেষ চাহিদা পূরণে সক্ষম হওয়া যায়। ভি.এল.সি. নির্ভর অভ্যন্তরীণ অবস্থান নির্ণয় পদ্ধতি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা যায়; যেমন, হাসপাতাল, বয়স্ক-পুনর্বাসন কেন্দ্র, গুদাম এবং বড়ো উন্মুক্ত অফিসে মানুষজনের অবস্থান নির্ণয় এবং অভ্যন্তরীণ রোবটিক যান নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।[১৫][১৬][১৭]
এমন বেতার নেটওয়ার্ক আছে যা তথ্য আদান-প্রদানের জন্য দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করে এবং আলোক উৎসের প্রবলতা নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে না। এক্ষেত্রে তথ্য আদান-প্রদানের উপায় হলো আলোক উৎসের পরিবর্তে কম্পন উৎপাদনযন্ত্র ব্যবহার করা।[১৮]
আই.ই.ই.ই. ৮০২.১৫.৭ এ বর্ণিত রং পরিবর্তনের চাবিকাঠি (সি.এস.কে.), ভিএলসির জন্য তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক একটি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। সি.এস.কে তীব্রতা-ভিত্তিক, কারণ সংশোধিত সিগন্যালটি তিনটি আলোক নিঃসারী ডায়োড এর (লাল/সবুজ/নীল) তাৎক্ষণিক তীব্রতার সম্মিলিত ভৌত রূপের সমান তাৎক্ষণিক রঙ ধারণ করে। এই পরিবর্তিত সংকেতটি বিভিন্ন দৃশ্যমান রঙ জুড়ে প্রতীক থেকে প্রতীকে তাৎক্ষণিকভাবে উঠা-নামা করে; অতএব, সিএসকে স্পন্দন পরিবর্তনের একটি রূপ হিসাবে গণ্য হতে পারে। তবে সংশ্লেষিত রঙের এই তাৎক্ষণিক স্পন্দন মানষের জন্য অনুধাবনযোগ্য নয়, কারণ মানুষের চোখ সীমিত সাম্প্রতিক সংবেদনশীলতা - "ক্রিটিকাল ফ্লিকার ফিউশন থ্রেশহোল্ড" (সি.এফ.এফ.) এবং "ক্রিটিকাল কালার ফিউশন থ্রেশহোল্ড" (সি.সি.এফ.), উভয়ই যার মধ্যে ০.০১ সেকেন্ডের চেয়ে কম সময়ের অস্থায়ী পরিবর্তন বিদ্যমান তা শনাক্ত করতে পারে না। এল.ই.ডি.'র তথ্য প্রেরণ তাই সময়-গড়ের (সি.এফ.এফ. এবং সি.সি.এফ.-এর ওপরে) একটি নির্দিষ্ট সময় ধ্রুবক বর্ণের উপর পূর্বেই নির্ধারিত থাকে। মানুষ এইভাবে কেবলমাত্র এই পূর্বনির্ধারিত রঙটি বুঝতে পারে যা সময়ের সাথে ধ্রুব বলে মনে হয়, তবে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল তাৎক্ষণিক রঙটি বুঝতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায়, সি.এস.কে. ট্রান্সমিশন একটি ধ্রুব সময়-গড় লুমিনাস ফ্লাক্স বজায় রাখে, এমনকি এর সংকেত ক্রমটি ক্রোমাটিসিটিতে দ্রুত পরিবর্তিত হয়।[১৯]
|তারিখ=
(সাহায্য)
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)