দেওয়ানগঞ্জ | |
---|---|
উপজেলা | |
মানচিত্রে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা | |
স্থানাঙ্ক: ২৫°৮′৩০.১২″ উত্তর ৮৯°৪৬′৫৯.৮৮″ পূর্ব / ২৫.১৪১৭০০০° উত্তর ৮৯.৭৮৩৩০০০° পূর্ব | |
দেশ | বাংলাদেশ |
বিভাগ | ময়মনসিংহ বিভাগ |
জেলা | জামালপুর জেলা |
প্রতিষ্ঠাকাল | ০৩ নভেম্বর ১৯৮৩ |
আয়তন | |
• মোট | ২৬৬.৫৯ বর্গকিমি (১০২.৯৩ বর্গমাইল) |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• মোট | ২,৫৮,১৩৩ |
• জনঘনত্ব | ৯৭০/বর্গকিমি (২,৫০০/বর্গমাইল) |
সাক্ষরতার হার | |
• মোট | ৩২.৫% |
সময় অঞ্চল | বিএসটি (ইউটিসি+৬) |
পোস্ট কোড | ২০৩০ |
প্রশাসনিক বিভাগের কোড | ৩০ ৩৯ ১৫ |
ওয়েবসাইট | দাপ্তরিক ওয়েবসাইট |
দেওয়ানগঞ্জ বাংলাদেশের জামালপুর জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এটি ৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এটি ময়মনসিংহ বিভাগের অধীন জামালপুর জেলার ৭ টি উপজেলার একটি এবং এটি জেলার উত্তরভাগে অবস্থিত। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার উত্তরে কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলা, দক্ষিণে ইসলামপুর উপজেলা, পূর্বে বকশীগঞ্জ উপজেলা ও ভারতের মেঘালয়, পশ্চিমে গাইবান্ধা জেলার গাইবান্ধা সদর উপজেলা ও ফুলছড়ি উপজেলা।[১]
১৮৭৪ সালে জামালপুর মহকুমার অধীনে দেওয়ানগঞ্জ থানা গঠিত হয়। জামালপুর জেলা হওয়ার পর ১৯৮৩ সালের ৩রা নভেম্বর দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা জামালপুর-১ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত । এ আসনটি জাতীয় সংসদে ১৩৮ নং আসন হিসেবে চিহ্নিত।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আয়তন ২৬৬.৫৯ বর্গ কিলোমিটার[১] এবং জনসংখ্যা ২০১১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী ২,৫৮,১৩৩ জন। পুরষ ও নারীর অনুপাত ১০০ঃ৯৬, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৬৫ জন, শিক্ষার হার ৩২.৫%।[২]
ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী বিধৌত একটি প্রাচীন জনপদের নাম দেওয়ানগঞ্জ। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার শাখা নদী ও খাল-বিল বহুল এই এলাকা নদীভাঙ্গন ও বন্যাপ্রবণ। দেওয়ানগঞ্জ নামটি কীভাবে হয়েছে সে ব্যাপারে কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এ ব্যাপারে লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী থেকে জানা যায় ব্রিটিশদের আগমনের আগে দেওয়ান শাহ্ জামাল ও দেওয়ান শাহ্ জালাল নামে দুইজন সাধক এ অঞ্চলে এসে ধর্ম প্রচার করেন। তাদের নামানুসারেই এ অঞ্চলের নামকরণ দেওয়ানগঞ্জ হয়েছে বলে মনে করা হয়।
ব্রিটিশ আমলে দেওয়ানগঞ্জ পাতিলাদহ পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পশ্চিম ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলা পাতিলাদহ পরগণা গঠিত হয়েছিল। তখন এই পরগণার রাজস্ব রংপুর কালেক্টরে প্রদান করা হতো। পাতিলাদহ পরগণার জমিদার ছিলেন মহারাজা প্রদ্যুতকুমার ঠাকুর। সেসময় তার নামানুসারে এই অঞ্চলকে প্রদ্যুতনগর বলা হতো। ১৮৯৯ সালে দেওয়ানগঞ্জে রেলস্টেশন স্থাপিত হলে রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয় প্রদ্যুতনগর রেলস্টেশন। তবে পরবর্তীতে প্রদ্যুতনগর নামটি স্থায়ীত্ব পায়নি। ফলে প্রদ্যুতনগর রেলস্টেশনের নামটিও পরিবর্তীত হেয় দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন হয়েছে।
১৮৬৬ সাল পর্যন্ত দেওয়ানগঞ্জ বগুড়া জেলার অধীনে ছিল। ঐ বছর বগুড়া জেলা থেকে দেওয়ানগঞ্জকে ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৭৪ সালে জামালপুর মহকুমার অধীনে দেওয়ানগঞ্জ থানা গঠিত হয়। এর প্রায় সোয়াশ বছর পর ৩রা নভেম্বর ১৯৮৩ সালে দেওয়ানগঞ্জকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী দেওয়ানগঞ্জে প্রবেশ করে।[৩] ৫ ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়।[৪] ১৯৯৯ সালে দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ২৫°০৬´ থেকে ২৫°২৬´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৪০´ থেকে ৮৯°৫১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।[১] এর উত্তরে চর রাজীবপুর উপজেলা, দক্ষিণে ইসলামপুর উপজেলা, পূর্বে বকশীগঞ্জ উপজেলা ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য, পশ্চিমে গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলা অবস্থিত। জেলা সদর থেকে দেওয়ানগঞ্জের দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার।
উপজেলার অধিকাংশ ভূমি চরাঞ্চল। নদ-নদী, খাল, বিল পরিবৃত এই উপজেলায় প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয়। ফলে মাটি পলিসিক্ত ও উর্বর। এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে তাপমাত্রা ৩০° থেকে ৩৬° সেলসিয়াস থাকে। এখানকার মাটি বেলে-দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ প্রকৃতির। মোট কৃষিজমির পরিমান ৫০০৯০ একর, আবাদি জমির পরিমান ২৮০৭৭ একর; সংরক্ষিত বনভূমির পরিমান ৪.৯৫ বর্গকিলোমিটার।[২]
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম দেওয়ানগঞ্জ থানার আওতাধীন।[৫]
এ উপজেলায় ৩৯ টি মৌজা, ১৬৬ টি গ্রাম রয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৪ সালে জামালপুর মহকুমার অধীনে দেওয়ানগঞ্জ থানা গঠিত হয়। এর প্রায় সোয়াশ বছর পর ৩রা নভেম্বর ১৯৮৩ সালে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৯ সালে দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়। পৌরসভার আয়তন ২০.৬৫ বর্গ কিলোমিটার, ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯টি, মহল্লা ৪৩টি।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ও বকশীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে জামালপুর-১ সংসদীয় আসন গঠিত। এ আসনটি জাতীয় সংসদে ১৩৮ নং আসন হিসেবে চিহ্নিত।
নির্বাচিত সাংসদগণ:
নির্বাচন | সদস্য | দল | |
---|---|---|---|
১৯৭৩ | মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এডভোকেট | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ[৬] | |
১৯৭৯ | মোহাম্মদ আলমাস হোসেন[৭] | ||
১৯৮৬ | আব্দুস সাত্তার | জাতীয় পার্টি[৮] | |
১৯৮৮ | আব্দুস সাত্তার | জাতীয় পার্টি (এরশাদ)[৯] | |
১৯৯১ | আবুল কালাম আজাদ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ[১০] | |
ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ | এ, কে, মাইনুল হক | বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল[১১] | |
জুন ১৯৯৬ | আবুল কালাম আজাদ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ[১২] | |
২০০১ | এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত | বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল[১৩] | |
২০০৮ | আবুল কালাম আজাদ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ[১৪] | |
২০১৪ | আবুল কালাম আজাদ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ[১৫] | |
২০১৮ | আবুল কালাম আজাদ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ[১৬] |
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেওয়ানগঞ্জ ১১ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১১ সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে কর্ণেল তাহের ও মেজর
জেনারেল জিয়াউর রহমান। উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান[১৭] প্রথমে উপ-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১-এর ৩ নভেম্বর থেকে সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১২ই মার্চ বেলতলী নামক বাজারে দেওয়ানগঞ্জের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব এবং শহীদ আনোয়ারুল আজিম ছানা। তাদের পতাকা উত্তোলনের ছবি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছালে আনোয়ারুল আজিম ছানা কে পাক বাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করে। আনোয়ারুল আজিম ছানা এই অঞ্চলের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। [১৮]
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাক বাহিনীরা বাহাদুরাবাদ ঘাট দখলে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা কাঠারবিল, সানন্দবাড়ি সহ বেশ কিছু স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবাইকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ এবং দক্ষ করে তোলে। এসময় প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা চর হাতিভাঙ্গা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শামসুল আলমের নেতৃত্বে নিয়জিত ছিলেন। তারা জামালপুরের সাথে পাক বাহিনীর ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অকার্যকর করার জন্য নভেম্বর মাসের শেষ দিকে একটি সফল অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন[১৯]। এতে ৫ ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ এবং ১০ ডিসেম্বর জামালপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেওয়ানগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থাপনা পাক বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[২০] দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনের লোকোশেড, রেলস্টেশন সংলগ্ন জিআরপি থানা, আলিয়া মাদ্রাসা, জিলবাংলা সুগার মিলস্ লিমিটেড, দেওয়ানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, কাঠারবিলের গয়েরডোবা, ফারাজীপাড়া, পুরাতন বাহাদুরাবাদঘাটে এ সব স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর নির্যাতনী ক্যাম্প ছিল[২১] ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী বাহাদুরাবাদ ঘাটে ব্যপক গণহত্যা চালায়। অসংখ্য নিরীহ, সাধারণ মানুষকে এখানে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্মম শাস্তি দেওয়ার জন্য এখানে ছিল টর্চার সেল।[২২] তরুণ ছাত্রনেতা আনোয়ারুল আজিজ ছানাকে পাকিস্তানপন্থীরা ধরিয়ে দিলে ৬ মে তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে বাহদুরাবাদ ঘাটে হত্যা করা হয়। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনিই প্রথম শহিদ।
রেল শ্রমিক নেতা জয়নাল আবেদীন কে ১৯৭১ সালে ১০মে রাতে দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে গুলি করে যমুনা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে কর্মরত তোফানো শেখ কে চোখ বেঁধে, টেনে-হেঁচড়ে স্টেশনে নিয়ে আসে। পরে স্টেশনের জ্বলন্ত কয়লার ইঞ্জিনের আগুনে নিক্ষেপ করে ঢাকনার মুখ বন্ধ করে দিয়ে তাকে হত্যা করে পাক বাহিনী।[২৩]
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর দুটি বড় যুদ্ধ সংগঠিত হয়। একটি বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট যুদ্ধ, অন্যটি জিলবাংলা চিনিকল যুদ্ধ।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল যমুনা নদীর দুই পাশের জেলা গুলোর মধ্যে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। এখান থেকে রেল ও সড়ক পথে ময়মনসিংহ এবং ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাতায়াত সুবিধা চালু ছিল। পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে এই ঘাটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট দেওয়ানগঞ্জ দখলে নেয়। এখান থেকে বৃহত্তর রংপুর এবং বগুড়া সহ পাশ্ববর্তী জেলা গুলোতে পাকিস্তানি সৈন্য এবং রসদ আনা নেওয়া করত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট দখল করা আবশ্যকীয় হয়ে যায়। বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর শাফায়াত জামিল। মোট ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই ভোর পাঁচটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। অপারেশনের একেবারে শেষ দিকে নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়া গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া আর কোন মুক্তিযোদ্ধা আহত হননি। মূলত এই যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনীর মনোবল সুদৃঢ় হয় এবং পাকবাহিনীর মনোবল কমে আসে।[২৪]
জিলবাংলা চিনিকল যুদ্ধ
এ যুদ্ধেও নেতৃত্ব দেন মেজর শাফায়াত জামিল। তাঁর নেতৃত্বে ডেলটা ও আলফা কোম্পানি দেওয়ানগঞ্জ শহরে অপারেশন চালায়। ২ আগস্ট ভোর ছয়টার দিকে আলফা কোম্পানির ২টি প্লাটুন ও এফএফ কোম্পানির ১টি প্লাটুন একসাথে জিলবাংলা চিনিকলে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে চিনিকল এলাকায় অবস্থানরত পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্ত পেরে উঠতে না পেরে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়।
২০১১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২,৫৮,১৩৩ জন। পুরষ ও নারীর অনুপাত ৯৬ঃ১০০, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৬৫ জন, শিক্ষার হার ৩২.৫%। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় গারো, কোচ, আদিবাসি সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। এ উপজেলায় প্রধানত মুসলমান ও হিন্দু এই দুই সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস। অন্যান্য ধর্মের লোকসংখ্যা একেবারেই কম। এর মধ্যে মুসলমান জনগোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম ২,৫৩,৯২৭, হিন্দু ৪,০৬৪, খ্রিস্টান ৩, বৌদ্ধ ২ এবং অন্যান্য ১৩৭ জন।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৮টি উপ-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।[২৫] ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৬টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে।[২৫]
দেওয়ানগঞ্জ মূলত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। সব ধরনের ফসলই এখানে উৎপন্ন হয়। এখানে ধান, পাট, মরিচ, সরিষা, ভুট্টা, গম, ছোলা, মসুর ডাল এবং বিভিন্ন শাক-সবজি উৎপন্ন হয়। উপজেলাটিতে জিলবাংলা সুগার মিল অবস্থিত হওয়ায় এখানে প্রচুর আখ উৎপন্ন হয়।
১৯৫৮ সালে দেওয়ানগঞ্জ জিলবাংলা সুগারমিল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫১ একর জমির উপর পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের যৌথ কারিগরি প্রযুক্তি ও অর্থায়নে এই মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মিল প্রতিষ্ঠার ফলে এই অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। জিলবাংলা সুগার মিলই এই অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
অর্থনৈতিক ভাবে এই অঞ্চল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এর জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৬৮.৪৯%, অকৃষি শ্রমিক ৫.২৮%, শিল্প ০.২৭%, ব্যবসা ৯.০৭%, পরিবহন ও যোগাযোগ ১.৭৫%, চাকরি ৪.৯৪%, নির্মাণ ০.৮২%, ধর্মীয় সেবা ০.১৭%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.০৮% এবং অন্যান্য ৯.১৩%[২৬]। মূলত এখানে কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি বিরাজমান।
দেওয়ানগঞ্জে বেশ কিছু তেলকল, চালকল, আইসক্রিম কারখানা,বেকারি কারখানা রয়েছে।অনেক মানুষ মৃৎশিল্প, হস্তশিল্প,নকশিকাঁথা,বাঁশ,বেত ও কাঠের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে,এসকল পণ্য গুলো দেশ এবং দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় উল্লেখযোগ্য কিছু বড় হাট রয়েছে।এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জ হাট - বাজার, সানন্দবাড়ী হাট - বাজার,ঝালোরচর হাট - বাজার, বাহাদুরাবাদ হাট - বাজার,তারাটিয়া হাট - বাজার,কাউনিয়ারচর হাট - বাজার,কাঠারবিল হাট - বাজার,বেলতলি বাজার,উত্তর বাছেতপুর মোড়,খোটারচর মোড়,সবুজপুর বাজার,খড়মা নতুন বাজার,মিতালী বাজার,ডিগ্রীরচর বাজার,মোয়ামারি বাজার,বাঘারচর বাজার, সর্দারপাড়া বাজার, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার যোগাযোগ সড়ক ও রেল এই দুইভাবেই আছে। বর্ষাকালে সীমিতভাবে নৌপথে চলাচল করে। উপজেলার মোট সড়ক পথের দৈর্ঘ্য ৪৯৩.৪৯ কিলোমিটার; এর মধ্যে পাকা রাস্তা ১১০.৯৫ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা ৩৮২.৫৪ কিলোমিটার।[২৭] এ উপজেলায় রেলপথ আছে ৯.১ কিলোমিটার এবং নৌপথ ১৫ নটিক্যাল মাইল।[২৮]
দেওয়ানগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেল পথকেই বেছে নেয়। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা থেকে জামালপুর সদরের দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। ১৯১২ সালে জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয়। দেওয়ানগঞ্জ থেকে চলাচলকারী দুইটি আন্তঃনগর ট্রেন হল তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস। ঢাকা পর্যন্ত চলাচলকারী কমিউটার ট্রেন হল দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার, জামালপুর কমিউটার; এছাড়া ভাওয়াল এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেনেও ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করে।
সড়ক পথে বিআরটিসি, রাজিব বাস যোগে সরাসরি ঢাকা যাতায়াত করা যায়।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও জিঞ্জিরাম এখানকার প্রধান নদ-নদী। প্রতিবছর প্রচুর মাছ সংগ্রহ করা হয় নদী গুলো থেকে। কিছু সংখ্যক পরিবার মৎস্য আহরণ এবং নৌকা বেঁয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাছাড়া বেশ কিছু বড় বিল এবং খাঁল রয়েছে যেগুলো মৎস্য, কৃষি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার।এগুলোর মধ্যে ঝাপড়বিল(এলাকা:বাছেতপুর,কলাকান্দা)
গুজিমারিবিল(দেওয়ানগঞ্জ পৌর) সাপমারীবিল,কাঠারবিল,মহারানী খাল,তিলথুবা বিল ও পাকিরের বিল উল্লেখযোগ্য।[২৮]
বর্ষাকালে প্লাবিত থাকে এমন নিচু জমি এবং প্রচুর জলাশয় রয়েছে এখানে। বছরের অন্যান্য সময়ে কৃষি কাজ চললেও বর্ষাকালে এখানে প্রচুর পানিফলের চাষ হয়। এগুলো ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হয়। বর্তমানে মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত এই জলজ ফসল সমগ্র দেশের মধ্যে প্রাধনত এই অঞ্চলেই চাষ হচ্ছে[২৯]।