দেব(Deva)(সংস্কৃত: देव, আইএএসটি: Devá) অর্থ ‘স্বর্গীয়, ঐশ্বরিক, এমন কিছু যা অসামান্য বা অসাধারণ’ এবং হিন্দু ধর্মে পবিত্র সত্তা বা শ্বর বোঝায়।[১] দেব শব্দটি পুরুষবাচক যার স্ত্রীবাচক রূপ দেবী। শব্দটি জরাথ্রুস্টবাদের দেইব থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়।[২][৩][৪][৫]
বৈদিক সাহিত্যে সমুদয় অলৌকিক সত্তাকে অসুর শব্দ দ্বারা নির্দেশ করা হয়। [৬][৭] প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে কল্যাণকারী সত্তাদের দেব-অসুর নামে ভূষিত করা হতো। বেদ পরবর্তী যুগে, পুরাণে ও হিন্দু ইতিহাসে দেব শব্দটি ভাল এবং অসুর শব্দটি মন্দ বুঝিয়ে থাকে। [৮][৯]
কতিপয় মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাহিত্যে দেবগণ ‘সুর’ নামে পরিচিত হন এবং একই পিতার ঔরসে জন্মলাভ করা (মাতা ভিন্ন) সমক্ষমতাপন্ন ভ্রাতৃগণ ‘অসুর’ নামে পরিচিত হন। [১০] দেব ও অসুর ছাড়াও যক্ষ এবং রাক্ষসও হিন্দু পুরাণের অংশ, তবে হিন্দুধর্মে বিশ্বতত্ত্বে দেবগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।[১১][১২]
দেব একটি সংস্কৃত শব্দ, যা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের সময় বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। মনিয়ের উইলিয়াম শব্দটির অর্থ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন- “স্বর্গীয়, দিব্য, অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ পার্থিব বস্তু, মহিমাময় এবং উজ্জ্বল”। [১][১৩] এই ধারণাটি অলৌকিক সত্তা বা স্রষ্টা অর্থেও প্রয়োগ করা হয়।[১]
সংস্কৃত দেব শব্দটি ইন্দো ইরানিয়ান দেব্ হতে এসেছে যা প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় দেইয়োস, মূলত একটি বিশেষণ পদ যার অর্থ স্বর্গীয় বা উজ্জ্বল। দিব্ ধাতুর আদিস্বর প্রত্যয়ের নিয়মে বৃদ্ধি পেয়ে দেব শব্দটি গঠন করেছে। দিব্ ধাতুর অর্থ দীপ্তি বা জ্যোতির প্রকাশ। দেইয়োস এর স্ত্রীবাচক রূপ দেইয়িহ, যা থেকে ভারতীয় ভাষার দেব এর স্ত্রীবাচক রূপ দেবী শব্দের উদ্ভব। দেব শব্দের সমার্থক ও দেইয়োস উদ্ভূত আরও কিছু শব্দ হল লিথুয়ানিয়ান দেইভাস, ল্যাটিভান দেইভস, পারসিয়ান দেইয়াস, জার্মানিক তিওয়াজ, ল্যাটিন দেউস(স্রষ্টা) ও দিভুস(স্বর্গীয়), ইংরেজি devine ও deity, ফ্রেঞ্চ দিয়েউ, পর্তুগিজ দেউস, স্প্যানিশ দিয়োস, ইতালীয় দিও এবং গ্রিক দেবরাজার নাম জেউস।
মূল শব্দটি ‘স্বর্গীয় দ্যুতিময় পিতা’ অথবা আকাশপিতা অর্থপ্রকাশ করে অর্থাৎ ইন্দো-ইউরোপিয়ান দেবমণ্ডলে দ্যুলোকনিবাসী দেববৃন্দের প্রধান দ্যৌষ পিতা(আকাশপিতা)।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ডগলাস হার্পারের মতে দেব অর্থ দীপ্যমান বা দ্যুতিমান, দিব্ ধাতুর মানে দ্যুতি প্রকাশ হওয়া এবং শব্দটি গ্রিক দিওস (স্বর্গীয়), জেউস ও লাতিন গড শব্দের সমগোত্রীয়।[১৪]
দেব পুরুষবাচক, যার স্ত্রীবাচক রূপ দেবী। ব্যুৎপত্তিগতভাবে লাতিন দেয়া এবং গ্রিক থেয়া, দেবী শব্দের সগোত্র। ব্যাপক অর্থে, দেবী বা মাতা শব্দ হিন্দুধর্মে জগৎজননী অর্থ প্রকাশ করে। এছাড়া দেবকে দেবতা [১৩] এবং দেবীকে দেবিকা পদেও অভিহিত করা হয়।[১৫]
ভারতীয় সমাজে দেব শব্দটি ব্যক্তিবিশেষের নাম রূপেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যার অর্থ ‘যে বাধা অতিক্রম করার সংকল্প করে’ অথবা ‘প্রভু বা শ্রেষ্ঠ’।[১]
বেদ এর প্রাচীনতম অংশ সংহিতায় হিসাব অনুযায়ী ৩৩ জন দেব (ত্রিভুবনের প্রতি ভুবনের জন্য ১১ জন) অথবা ব্রাহ্মণ অংশে দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু ও দুইজন অশ্বিন রয়েছেন। [১৮][১৯] ঋগবেদ এর ১.১৩৯.১১ মন্ত্র অনুযায়ী: {{Quote|
ये देवासो दिव्येकादश स्थ पृथिव्यामध्येकादश स्थ ।
अप्सुक्षितो महिनैकादश स्थ ते देवासो यज्ञमिमं जुषध्वम् ॥११॥[২০]
হে স্বর্গনিবাসী একাদশ দেবতা, হে একাদশ দেবতা যারা পৃথিবীতে অবস্থান করেন,
এবং হে সলিলনিবাসী একাদশ দেবতা, আপনারা সানন্দে এই উৎসর্গ গ্রহণ করুন।
– অনুবাদ: রাফ টি. এইচ. গ্রিফিথ[২১]
যে একাদশ দেবতা স্বর্গে আছেন; যে একাদশন জন পৃথিবীতে;
এবং যে একাদশ দেবতা অন্তরীক্ষে বাস করেন; তাঁরা সকলে এই উৎসর্গে প্রসন্ন হোন।.
– অনুবাদ: এইচ. এইচ. উইলসন[২২]
কিছু দেবতা প্রাকৃতিক শক্তি প্রকাশ করেন (বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি) আবার কিছু দেবতা নৈতিক জ্ঞান প্রকাশ করেন যেমন আদিত্য, বরুণ, মিত্র। প্রত্যেক দেবতাই বিশেষ জ্ঞান, সৃজনশক্তি, মাহাত্ম্যপূর্ণ অলৌকিক শক্তি(সিদ্ধি) প্রভৃতির ধারণকারী।[২৩][২৪] ঋগবেদে বহুল উল্লিখিত দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র, অগ্নি ও সোম প্রধান। অগ্নিকে সকলের মিত্র ভাবা হয়। বিভিন্ন হিন্দুধর্মীয় কৃত্যে যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় অগ্নি ও সোম বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। সবিতৃ, বিষ্ণু, রুদ্র(পরবর্তীকালের শিব) এবং প্রজাপতি(পরবর্তীকালের ব্রহ্মা) হলেন ভগবান তথা দেব। সরস্বতী ও ঊষা হলেন দেবী। অনেক দেবসত্তাই একত্রে বিশ্বেদেব রূপে পূজিত হন। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
বৈদিক সাহিত্যে দেব একেশ্বর নয়, ‘অতিপ্রাকৃত ও স্বর্গীয়’ যা বিভিন্ন ধারণা ও জ্ঞানকে প্রতিফলিত করে, সকল উৎকর্ষ কেন্দ্রীভূত করে, দুর্বলতার সাথে সংগ্রাম করে, প্রশ্ন রাখে,যাদের নায়কোচিত বেশ ও চালচলন রয়েছে এবং তারা আবেগ ও আকাঙ্ক্ষায় আবদ্ধ।[২৪][২৫]
মাক্স মুলার বলেন, বৈদিক মন্ত্রে দেখা যায় প্রত্যেক দেবই ‘একমাত্র, সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ’।[১৩] মুলার মনে করেন বৈদিক ধারণাকে বহু-ঈশ্বরবাদ অথবা একেশ্বরবাদ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না; এটি বরং একত্ববাদ যেখানে দেববৃন্দ পরস্পরের তুল্য, বিভিন্ন দেব বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ, বিবিধ উপাসনাপদ্ধতি ও বিবিধ আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ, এবং ঋত ও নিরঞ্জন (ধর্ম) এর নীতি দ্বারা একত্রীভূত।[১৩][২৬]
আনন্দ কুমারস্বামী মনে করেন বৈদিক দেব ও অসুর, যথাক্রমে গ্রিক পুরাণের দ্বাদশ অলিম্পিয়ান ও তিতান এর অনুরূপ; উভয়েই শক্তিশালী কিন্তু তাদের স্বভাব ও প্রবৃত্তি ভিন্ন, হিন্দুপুরাণে দেবগণ আলোকের এবং অসুরগণ অন্ধকারের শক্তি।[২৭][২৮] কুমারস্বামীর ব্যাখ্যানুযায়ী, প্রতি মানুষের হৃদয়ে এই উভয়প্রকার প্রবৃত্তি নিহিত থাকে, সবার মাঝেই রয়েছে অত্যাচারী ও পরোপকারী দ্বিবিধ সত্তা, এই উত্তম ও অধম চরিত্রদ্বয় নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে পরস্পর লড়াই করে, হিন্দুপুরাণের দেবাসুর দ্বন্দ্ব প্রত্যেকের ভিতরের এই ভালমন্দের কলহের প্রতীক।[২৯][৩০]
“দেব আর অসুর, এঞ্জেল আর তিতান, ঋগবেদ এর আলোকিত শক্তি আর অন্ধকার শক্তি, যদিও কার্যকলাপে ভিন্ন ও বিপরীতমুখী, আসলে এরা পরস্পরের তুল্য, এদের সত্তায় কোন পার্থক্য নেই পার্থক্য কেবল প্রবণতায়, বিপ্লবে ও রূপান্তরে। এক্ষেত্রে, তিতান মূলত একজন এঞ্জেল আবার এঞ্জেলও স্বভাবতই তিতান, অন্ধকারেই আসলে রয়েছে আলো আর আলোর ক্ষমতা রয়েছে অন্ধকারে; যখন দেব আর অসুর কোন ব্যক্তিকে নির্দেশ করে বলা হয়, তার কাজের ধরন অনুযায়ী, যেমন ঋগবেদের ১.১৬৩.৩ মন্ত্রে, "Trita art thou (Agni) by interior operation"
— Ananda Coomaraswamy, Journal of the American Oriental Society[৩১]
-আনন্দ কুমারস্বামী, জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি
প্রাচীর বৈদিক লেখায়, ভাল বা মন্দ সকল শক্তিধর সত্তাকে অসুর বলা হত। ঋগবেদের একটি বহুল পঠিত মন্ত্র হল দেবব অসুরঃ (যে অসুর দেব হয়েছে)যা অসুর অদেবাঃ(যে অসুর দেব নয়) অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। [৩২][৩৩] তারা সবাই একই পিতা, আদিপিতা প্রজাপতির ঔরসে জন্মলাভ করেছে- জ্যেষ্ঠরা অসুর এবং কনিষ্ঠরা দেব নামে পরিচিত।[৩৪] তারা সবাই একস্থানে বসবাস করে(লোক), একসঙ্গে আহার করে এবং পান করে (সোমরস), তাদের রয়েছে সহজাত শক্তি জ্ঞান ও হিন্দুপুরাণে বিশেষ ক্ষমতা; ‘(যে অসুর দেব হয়েছে’ আর ‘যে অসুর দেব নয়’ তাদের একমাত্র পার্থক্য হল তাদের পৌরাণিক জীবনের কর্মকাণ্ড ও রুচি।[৩০][৩৫]
প্রাচীন উপনিষদে দেব ও দেবাসুর সংগ্রামের উল্লেখ দেখা যায়। কৌষীতকী উপনিষদ এর চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে “ইন্দ্র অসুরদের তুলনায় দুর্বল ছিলেন কারণ তিনি নিজের আত্মা সম্পর্কে জানতেন না। [৩৯] আত্মজ্ঞান লাভের পর ইন্দ্র স্বাধীন, সার্বভৌম ও অসুরবিজেতা হয়ে উঠলেন।” অনুরূপভাবে, কৌষীতকী উপনিষদের মতে যে ব্যক্তি নিজের অন্তর্নিহিত জ্ঞান জানতে পারে সে স্বাধীন সার্বভৌম হয় ও শত্রুস্পর্শমুক্ত থাকতে পারে। [৩৯]
ছান্দোগ্যোপনিষদ্ এর ১.২ পরিচ্ছদে বিবিধ ইন্দ্রিয় শক্তির ক্ষমতা নিয়ে দেব ও অসুরদের যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। [৪০] দেব ও অসুরের যুদ্ধে কোন পক্ষই বিজয়ী হতে পারেনি এবং তা অনুভবময় মহাজগতে প্রকাশিত হয়, যেমন মানুষ ভাল ও মন্দ দেখে, যেমন ভাল ও মন্দ কথা বলা হয়, যেমন প্রকৃতিতে সুগন্ধ ও দুর্গন্ধ থাকে, যেমন ভাল ও খারাপ অভিজ্ঞতা হয়, যেমন সব মানুষের মাঝে ভাল ও খারাপ চিন্তা থাকে। ছান্দোগ্য উপনিষদের মতে অবশেষে দেবাসুর সংগ্রাম আত্মাকে লক্ষ্য করে, তবে অসুররা ব্যর্থ হয় ও দেবগণ সফল হয়, কারণ আত্মশক্তি নির্মল ও সহজাতভাবেই ভাল।[৪০]
বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ এর ৩.৫.২ অধ্যায় অনুযায়ী নর, দেব ও অসুর সকলে আদিপিতা প্রজাপতির সন্তান।[৪১] সকলেই প্রজাপতির নিকট উপদেশ প্রার্থনা করলেন। প্রজাপতি দেবগণকে ইন্দ্রিয়দমন (দম) করতে, নরগণকে সাহায্য(দান) করতে এবং অসুরগণকে সমবেদনাশীল (দয়া) হতে উপদেশ দেন। অধ্যায়ের শেষে উপনিষদে বলা হয়েছে দেব নর ও অসুর দের এই তিনটি প্রধান গুণ সর্বদা লালন করা উচিত। [৪১]
মধ্যযুগের পণ্ডিতগণ উপনিষদের ভাষ্যে মত দিয়েছেন যে উপনিষদে দেব ও অসুরের আলোচনা মূলত প্রতীকী; যা প্রতি মানুষের অভ্যন্তরে ভাল ও মন্দের দ্বন্দ্বকে বোঝায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদের আলোচনায় আদি শঙ্কর বলেন দেব হল সেই নর যে পবিত্র ও পারমার্থিক; অন্যদিকে অসুর হল সেই নর যে জাগতিক আকাঙ্ক্ষায় আসক্ত।[৪২] এডেলম্যান ও অন্যান্য আধুনিক পণ্ডিতগণও উপনিষদের দেবাসুর সংগ্রামকে প্রতীকী হিসেবেই বিবেচনা করেন।[৪৩][৪৪]
পরবর্তীকালের প্রাথমিক উপনিষদ লেখায় দেখা যায় যে দেব ও অসুর আলোচনা করে এবং বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান লাভ করতে চান। উদাহরণস্বরূপ, একদা তারা তাদের পিতা প্রজাপতির কাছে আত্মজ্ঞান (আত্মা) সম্পর্কে জানতে চান এবং কীভাবে তা অনুভব করা যায় তা জানতে চান। প্রজাপতি প্রথমে সরল উত্তর দেন, অসুররা তা শুনে চলে যায়। কিন্তু ইন্দ্রের নেতৃত্বে আগত দেববৃন্দ এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে তৃপ্ত হলেন না কেননা ইন্দ্র উত্তরের সম্পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারেননি এবং উত্তর অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।[৪৫] এডেলম্যান মনে করেন এখানে প্রতীকীভাবে বলা হয়েছে যে মানুষের উচিত হবে বিদ্যমান ধারণাসমূহ নিয়ে নিরন্তর চিন্তা করা, পুরো প্রক্রিয়া শিক্ষালাভ করা এবং প্রচেষ্টার মধ্যেই দেবপ্রকৃতি নিহিত থাকে।[৪৫]
পুরাণে, ইতিহাসে ও ভাগবত গীতায় দেবগণ ভাল আর অসুরগণ মন্দ বিষয়ের প্রতিভূ।[৮][৯]ভগবদ্গীতা (১৬.৬-১৬.৭) অনুযায়ী মহাজগতের প্রতিটি সত্তার মাঝেই স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্য (দৈবী সম্পদ) ও শয়তানের বৈশিষ্ট্য (আসুরী সম্পদ) রয়েছে। [৯][৪৬] ভগবদগীতার ষোড়শ অধ্যায় অনুসারে বিশুদ্ধ দেবস্বভাব ব্যক্তি আর বিশুদ্ধ আসুরিকভাবসম্পন্ন ব্যক্তি উভয়ই দুর্লভ; অধিকাংশ মানুষই দোষগুণের সমন্বয়ে মিশ্রচরিত্রের অধিকারী।[৯] জিনিন ফউলারের মতে গীতায় বলা হয়েছে আকাঙ্ক্ষা, বিরাগ, লোভ, অভাব, আবেগ প্রভৃতি সাধারণ জীবনের বিবিধ রূপ; যখন এসব লালসা, ঘৃণা, উচ্চাশা, অহংকার, দম্ভ, ক্রোধ, রূঢ়তা, কপটতা, হিংসা, ক্রূরতা ও নেতিবাচকতায় রূপ নেয় তখন মনুষ্যচরিত্র আসুরিক স্বভাবে পরিবর্তিত হয়।[৯][৪৬]
একই পিতার ঔরসে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকেই প্রথমে অসুর নামে অভিহিত হয়। ‘অসুর হয়ে থাকা অসুর’ বলতে বোঝায় যেসকল শক্তিশালী সত্তা আরও ক্ষমতা, সম্পদ এর জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, যারা অভিমানী, ক্রোধযুক্ত, নীতিবিহীন, পেশীশক্তিসর্বস্ব ও সহিংস।[৪৭][৪৮] পক্ষান্তরে ‘দেব হওয়া অসুর’ হল তারা যারা সত্যবাদী, যারা অথপূর্ণভাবে সব বুঝতে চায় এবং সংযম, নীতি, আদর্শ, জ্ঞান ও শৃঙ্খলা পছন্দ করে।[৪৭][৪৮] উভয়ের এই বিভেদমূলক বৈশিষ্ট্য অধিকাংশ হিন্দু মহাকাব্য ও পুরাণের গল্পগাথার উৎস; তবে বহু রচনায় এই প্রভেদ একমুখী দোষারোপ ব্যতীত নিরপেক্ষভাবে বর্ণিত হয়েছে।[৩৫] এমন কিছু কাহিনি প্রধান প্রধান হিন্দু পার্বণের উৎস যেমন রামায়ণ এর দেব রাম ও অসুর রাবণের যুদ্ধকাহিনি এবং অসুর হিরণ্যকশিপু ও দেব বিষ্ণুর(নরসিংহ)[৩৫] যুদ্ধ থেকে পরবর্তীকালে যথাক্রমে হোলিকা ও হোলি নামক বসন্তকালীন উৎসবের জন্ম হয়।[৪৯]
ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মার দশজন পুত্র ছিল, যথা মারীচী, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ, দক্ষ ও নারদ।[৫০] মারীচীর কশ্যপ নামে এক পুত্র ছিল। কশ্যপের ছিল ১৩ জন স্ত্রী, অদিতি, দিতি, দনু, কদ্রু প্রভৃতি। [৫১] অদিতির পুত্রগণ আদিত্য[৫২] নামে পরিচিত,দিতির পুত্রগণ দৈত্য[৫৩] নামে পরিচিত এবং দনুর পুত্রগণ দানব[৫৪] নামে পরিচিত। অঙ্গিরার পুত্র বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু। ভৃগুমুনির পুত্র শুক্রচার্য অসুর বা দানবগণের গুরু।
এডলম্যান বলেন হিন্দু পৌরাণিক সাহিত্যে উল্লিখিত এসব প্রভেদ মূলত আধ্যাত্মিক ধারণার প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ একদা দেব ইন্দ্র ও অসুর বিরোচন আত্মজ্ঞান সম্পর্কে এক মুনিকে জিজ্ঞাসা করেন।[৪৫] প্রাথমিক উত্তর পেয়েই বিরোচন মনে করেন তিনি এই জ্ঞানকে অস্ত্ররূপে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং চলে যান। পক্ষান্তরে ইন্দ্র মুনিকে পুনঃপুন প্রশ্ন করতে থাকেন, ধারণাগুলোকে আলোচনা করেন এবং অন্তরস্থ সুখ ও ক্ষমতা সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেন। এডলম্যান বলেন দেব ও অসুর এই দ্বিবিধ সত্তাকে “মানবহৃদয়ের প্রবণতাসমূহের ব্যাখ্যামূলক চিত্রায়ণ” হিসেবে দেখা যেতে পারে।[৪৫]
এডলম্যান আরও মনে করেন দেব ও অসুর প্রতীকীভাবে প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিকে চালিত করে এমন সাংঘর্ষিক চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করে, আর এভাবেই দেবাসুর দ্বন্দ্ব কোন সত্তা প্রকাশ না করে একটি আধ্যাত্মিক ধারণা প্রকাশ করে থাকে।[৫৫] ভাগবত পুরাণে, সাধক ও দেবস্বভাব ব্যক্তিকে অসুরকুলে জন্মগ্রহণ করতে দেখা যায় যেমন মহাবলী ও প্রহ্লাদ; এটি একধরনের প্রেরণা, বিশ্বাস ও কর্ম প্রকাশ করে, কারও জন্মস্থান, পরিবার বা পারিপার্শ্বিকতা ঠিক করে না যে সে দেবস্বভাব হবে না অসুরস্বভাব হবে।[৫৫]
প্রাকৃতিক দেবগণ বিভিন্ন পরিবেশগত উপাদানের দেবতা যেমন আগুন, বাতাস, বৃষ্টি, বৃক্ষ প্রভৃতি- পরবর্তীকালে এমন অধিকাংশ দেবতার ভূমিকা হিন্দুধর্মে গৌণ হয়ে আসে। তবে কতিপয় দেবতা প্রাধান্যলাভ করে। উচ্চশ্রেণির দেবগণ, মহাজাগতিক ক্রিয়াকাণ্ড পরিচালনা ও সৃষ্টিকুলের উৎকর্ষ সাধন প্রভৃতি জটিল কার্য সম্পাদন করে থাকেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব কে মিলিত করে ত্রিমূর্তি গঠন করা হয়। (উল্লেখ্য মহাদেব বলতে শিবকে বোঝায়)
এছাড়াও হিন্দুধর্মে দেব এর নিম্নশ্রেণিবিশিষ্ট কয়েকটি সত্তা আছে যেমন গন্ধর্ব(স্বর্গের পুরুষ গায়ক) এবং অপ্সরা(স্বর্গের নর্তকী)। তারা পরস্পর বিয়ে করতে পারত।
বাতাসের দেবতা বায়ু একজন গুরুত্বপূর্ণ দেব। মৃত্যুর দেবতা হলেন যম। হিন্দুধর্মে দেববৃন্দ অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্তা।
তামিল ভাষার সঙ্গম সাহিত্যে (৩০০ খ্রিস্টপূর্ব-৩০০ খ্রিস্টাব্দ) দেবগণের স্তুতি ও অর্ঘ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তামিল ভাষার পাঁচটি মহাকাব্যের অন্যতম ইলাঙ্গো আদিগল বিরচিত শিলপদিকরম গ্রন্থে চার প্রকার দেবতার জন্য অর্ঘ্যের কথা বলা হয়েছে।[৫৬]
হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |