এই নিবন্ধটির তথ্যসূত্র উদ্ধৃতিদানশৈলী ঠিক নেই।(অক্টোবর ২০২০) |
'দেমোগজাং' শব্দটি ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান কাঠের আর্কিটেকচারকে এবং বিশেষত কাষ্ঠশিল্পীদের বোঝায় যারা ঐতিহ্যবাহী কাঠের কাঠামোগত কৌশল ব্যবহার করে। এই অনুশীলনকারীদের ক্রিয়াকলাপ ঐতিহাসিক ভবনগুলির রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও পুনর্গঠন পর্যন্ত প্রসারিত, ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান গৃহ থেকে শুরু করে কাঠের প্রাসাদ ও মন্দির পর্যন্ত। প্রাচীন কোরিয়াতে সমস্ত গৃহই সর্বতোভাবে কাঠের নির্মিত ছিল। কাঠ ছিল সাবেক করিয়ার স্থাপত্যশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। উপর্যুপরি একটি গৃহ বা আলয়-এর গঠনও সেই ব্যক্তির সমাজে তাঁর প্রতিপত্তির নির্দেশক। সে কারণেই পূর্বে রাজ-আলয়, সরকারি পদস্থ ব্যক্তি এবং দেবালয়গুলি সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের তুলনায় বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণভাবে তৈরি করা হত।
এই বিশেষভাবে নির্মিত সাবেক গৃহগুলি যেমন, হানোক ইত্যাদির নির্মাণকার্যটি এক বিস্তৃত পদ্ধতির মধ্যদিয়ে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হত। তাই প্রথমেই প্রয়জনীয় কাঠ নির্বাচন ও গৃহ নির্মাণের পরিকল্পনা ও গঠন সম্বন্ধীয় খসড়া তৈরি হত। এরপর কাঠগুলি নান আকারে চেরাই করে একটি আয়তকার কাঠামো খাড়া করা হত। তারপর ধাপে ধাপে মেঝে তৈরি, দেওয়াল তোলা, লেপনের কাজ, টালির ছাত নির্মাণ এবং সব শেষে গৃহের নানা আংশের রঞ্জন, অলঙ্করণ, চিত্রাঙ্কন-এর কাজের মধ্য দিয়ে নির্মাণটি সম্পন্ন হত। সমগ্র কার্যনির্বাহটিতে একটি বিশাল কারিগর গোষ্ঠী যুক্ত থাকতেন। নির্মাণকার্যটি নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি বিশেষ অংশের কাজই একজন করে বিশেষ তত্ত্বাবধায়কের অধীনে কারিগররা কাজ করতেন।
কাঠামো তৈরির কাজে যে ব্যক্তি তত্ত্বাবধান করতেন তিনি হলেন সোমোগজাং(소목장)। মেঝে নির্মাণের প্রধান হলেন সগজাং(석장), ছাত নির্মাণের কাজে প্রধান হলেন ওয়াজাং (와장), দেওয়াল নির্মাণ ও লেপন-এর কাজের প্রধান মিজাং(미장), রঞ্জন এবং অলঙ্করণ, চিত্রাঙ্কনের প্রধান হলেন দাঞ্ছনজাং(단천장)। এই সমগ্র কার্যনির্বাহটি যে একক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হত সেই ব্যক্তি দেমোগজাং(대목장) নামে পরিচিত ছিলেন।
দেমোগজাং (대목장) শব্দটি মোগজাং(목장) বা মোগসু (목수) থেকে উদ্ভূত। মোগজাং হলেন যিনি কাঠের কাজে পারদর্শী বা কাঠমিস্ত্রি এবং এদের প্রধান যিনি তিনি হলেন দেমোগজাং(পরোক্ষ ভাবে এই বিশেষ পদ্ধতিটিও একত্রে দেমোগজাং হিসেবে পরিচিত)।
দেমোগজাং আজকের ধারণায় এমন একজন সক্ষম স্থপতি যিনি কাঠের স্থাপত্য নির্মাণ এবং তার নকশা প্রস্তুত করতে সিদ্ধহস্ত। একজন ব্যক্তিকে এই বিশেষ কাঠের কাজটিতে নির্মাণের খুঁটিনাটি কলাকৌশল এবং কাঠের অংশগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত করার দক্ষতা অর্জন করতে হত। সেই দক্ষতা তৈরি হত বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণ এবং কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। একজন দেমোগজাং সঠিক কাঠ নির্বাচন থেকে শুরু করে গৃহের নকশা, প্রতিটি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের আধিকারী হতেন। এই ব্যক্তিরা সমাজে বিশেষ সম্মানীয় এমনকি রাজ দরবারে সরকারি পদের অধিকারী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতানুসারে কোরিয়াতে জোসন রাজবংশের(대조선국) সময়কালে এই বিশেষ স্থাপত্য নির্মাণ পদ্ধতিটি ও পদটির প্রচলন ঘটে। কিন্তু এই রাজবংশের শেষের দিকে আনুমানিক ১৮শ শতকের সময়কালে এই পদটির বিলোপ ঘটান হয়। তার পরিবর্তে তাঁদের পূর্ব উপাধি পরিবর্তন করে ফিয়ংসু করা হয় এবং অন্যান্য কারিগররা দোফিয়ংসু বলে পরিচিত হন। তাঁদের কাজ ছিল সরকারি ইমারত এবং মন্দির নির্মাণে নির্দেশনা দেওয়া। তারফলে এই স্থপতিদেরও সামাজিক পদমর্যাদা বহু গুণে লঘু হয়ে যায়। অনুমান করা হয় সেই সময় জোসন রাজারা কনফুসীয় ভাবধারার অনুগামী হয়ে পড়েন। যার ফলস্বরূপ এই ব্যবহারিক দক্ষতা ও মার্শাল আর্টস-এর পরিবর্তে পুঁথিগত বিদ্যার প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। এই বিরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও স্থপতিগন এবং বাকি কারুশিল্পীগন নিজেদের কাজের উৎকর্ষতার সঙ্গে কখনোই আপস করেননি এবং বহু কালজয়ী স্থাপত্যকীর্তি রেখে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
এই কারণেই এই অসাধারণ স্থাপত্য নির্মাণ পদ্ধতিটি পৃথিবীর অন্যতম মানবতার অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (Intangible Cultural Heritage of humanity) তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই অন্তর্ভুক্তিকে আরও বিশেষতা দান করেছে এই বিশেষ প্রশিক্ষিত স্থপতিদের বিশ্বস্থাপত্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাংদক প্রাসাদ (창덕궁) এবং গিয়ংবোগ প্রাসাদের (경복궁) প্রধান প্রবেশদ্বার গোয়াংহোয়ামুন-এর (광화문) অবিশ্বাস্যময় পুনরুদ্ধার ও সংস্কার করা। এছাড়াও এঁরা পুরনো সউল শহরের (서울) দক্ষিণের প্রবেশদ্বার সুংনেমুন-এর(숭례문) পুনরুদ্ধারের কাজটিও যথাযথভাবে সম্পাদন করেন।
বর্তমানে কোরিয়াতে মাত্র তিনজন বিশিষ্ট স্থপতি জীবিত আছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চৈ-জি-ইয়ং (Choi Gi-young)। ঐতিহাসিক বৌদ্ধমঠগুলি পুনরুদ্ধারের প্রকল্পের কাজে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর এই বিশেষ কাজের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার তাঁকে Intangible Cultural Heritage উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
চৈ-এর প্রথম জীবন খুব একটা সুখের ছিলনা। তাঁর জন্ম হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। যে সময় কোরিয়া সবে মাত্র জাপানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু দুই বিভক্ত কোরিয়ার পারস্পরিক যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া বিধ্বস্ত। পিতৃহীন চৈ পরিবারের অন্ন সংস্থানের তাগিদেই রাজমিস্ত্রীর পেশাটিকে বেছে নেন। কার্য ক্ষেত্রে তিনি কিম দক-হি (Kim Deok-hee) এবং কিম জাং-হি (Kim Chung-hee) -এর মত স্থপতির সান্নিধ্য লাভ করেন। গুরুদের প্রতিটি নির্দেশনা তিনি মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করেন এবং কঠোর অধ্যবসায়ের জোরে তিনি সফলতার পথটি সুগম করতে সক্ষম হন। গুরুদের তত্ত্বাবধানে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য সংস্করণ করেছেন। যেমন, গাঙউওন প্রদেশের অন্তর্গত উওলজংসা মঠ ( Woljeongsa Temple in Gangwon-do Province), দকসুগুং প্রাসাদ(Deoksugung Palace in Seoul) ইত্যাদি।
চৈ বলেন, তিনি তাঁর শিক্ষকদের প্রতিটি কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতেন। সমস্ত যন্ত্র ব্যবহারের কৌশলগুলি পর্যবেক্ষণ করতেন। যা হল এই বিশেষ কাজের মূলমন্ত্র। তাঁর শিক্ষকরা সন্ধেবেলায় একত্র বসে সমগ্র স্থাপত্যটির একটি নকশা প্রস্তুত করতেন হাঞ্জি কাগজের(traditional handmade Korean paper) উপর। সেই নকশার প্রতিটি খুঁটিনাটি অংশ ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং আত্মস্থ করে সমগ্র সংস্করণের কাজটি সম্পন্ন করতে হত।
চৈ আরও বলেন যে, কেউ যদি সাধারণভাবে উপর থেকে দেখে কাজটি শেখে তবে সে শুধুমাত্র একজন সাধারণ রাজমিস্ত্রি হয়ে উঠবে। তিনি যখন কাজ শুরু করেন তখন সেই দলে মোট পঞ্চাশ জন কারিগর ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যকই পূর্ণজ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। কারণ তাঁরা তাঁদের কাজগুলি নিয়ে নানাভাবে বারংবার চিন্তাভাবনা করেছেন যখন অন্যরা রাতের অন্ধকারে বাকিরা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। এঁদের কাছে কাজই ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে। একজন সুদক্ষ স্থাপত্যকার হতে গেলে একটি ইমারতের কড়িকাঠ থেকে শুরু করে তার উচ্চতা, পরিধি, মাপকরা ইত্যাদি ছোটবড় বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে হয়।
বোংজংসা মন্দিরের জিউংনাকজন হল (Geungnakjeon Hall at Bongjeongsa Temple in Andong, Gyeongsangbuk-do Province) যেটি আনুমানিক ১২০০ শতাব্দীতে নির্মিত হয় এবং এটি জাতীয় সংরক্ষিত স্থাপত্যের অন্যতম। এটির কাঠের ভবনটিকে ভেঙ্গে চৈ নতুন করে সংস্করণ করেন।
এই বিশেষ কার্যনির্বাহটির পদ্ধতি সম্পর্কে চৈ একটি সম্যক ধারণা দেন। তিনি বলেন, অক্টোবরের পর অর্থাৎ শীতকালই ছিল স্থাপত্যকারদের কাছে হানক তৈরির উপযুক্ত সময়। নির্মাতাদের কাজ ছিল বরফ জমতে শুরু করার আগেই মেঝের সমস্ত কাজ সমাপ্ত করা, তার সঙ্গে কাঠ চেরাই এবং শুকনো করা। বর্ষার আগেই আবার ছাতের টালি বসানোর কাজ সম্পন্ন করে নেওয়া হত। প্লাস্টারর উপযুক্ত সময় হল আগস্ট অর্থাৎ কোরিয়ান ছুটির মরশুম শুরুর আগে। এই সময় প্রত্যহ সকালের শিশির দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকত এবং সারা দিন ধরে তা শুকনো হত যার ফলে দেওয়ালে ফাটল ধরার সম্ভাবনা কমে যেত অন্য সময়ের তুলনায়। হানক ইত্যাদি কাঠের স্থাপত্যগুলি প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত। প্রথমত সমস্ত উপাদান প্রকৃতি থেকে আসা। দ্বিতীয়ত, এটি এমন শিল্পীরা তৈরি করেছেন যারা নীতিগুলি এবং মৌলিক বিষয়গুলি মেনে চলেন। কোরিয়ান পাইন, মাটি, পাথর, টাইলস এবং উইন্ডো পেপার সবই প্রকৃতির। এমনকি যদি সেগুলি কাটাও হয় তবে তারা জীবিত থাকে এবং শ্বাস নিতে থাকে। পাইনউড শ্বাস নিতে থাকে। পাইন রজন একটি হনোকের মধ্যে প্রবাহিত হয়। ঘরটি প্রাকৃতিকভাবে শ্বাস নেয় ঠিক তেমনি শ্বাস নেয়। অবশ্যই সময়ের সাথে সাথে, এমনকি সেরা নির্মিত হানোক তার মাটির দেয়াল এবং কাঠের ফাটল তৈরি হয়। তবুও যদি তাতে মানুষ বাস করে এবং এটির যত্ন নেয় তবে হনোক হাজার বছর ধরে খুব বেশি অসুবিধা ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারেন এবং তার বংশধররা বহু প্রজন্ম ধরে এটি লালন করতে পারে। সমগ্র কর্মপ্রক্রিয়াটিই একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হত।এই কারণেই তাঁদের এই অসাধারণ নির্মাণগুলি আজও স্ব মহিমায় দন্ডায়মান হয়ে রয়েছে।
2. Traditional Korean Wooden Architecture and Building: Daemokjang | ProTradeCraft ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ মে ২০২১ তারিখে
3. Daemokjang, traditional wooden architecture - intangible heritage - Culture Sector - UNESCO
4. Daemokjang : traditional wooden architecture = Taemokchang in SearchWorks catalog
5. [Monthly KOREA] Art-chitecture : Korea.net : The official website of the Republic of Korea