একটি দৈহিক নকশা, Body plan, Bauplan (জার্মান বহুবচন Baupläne), অথবা Ground plan হল একটি প্রাণি পর্বের কতকগুলো সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি সেট।[১] মেরুদণ্ডীদের দৈহিক নকশা অনেকের মধ্যে একটি: অমেরুদণ্ডীরা অনেকগুলো পর্ব নিয়ে গঠিত।
এই শব্দটি, সাধারণত প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। শব্দটি দ্বারা প্রতিসাম্য, খণ্ডকায়ন এবং উপাঙ্গের বিন্যাসের মতো বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত কারী একটি "নীলনকশা" বোঝায়। বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান বিভিন্ন দৈহিক নকশার উৎস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।
দৈহিক নকশা ঐতিহাসিকভাবে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের এক ঝলকে বিকশিত হয়েছিল বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু প্রাণী বিবর্তনের আরও সূক্ষ্ম বোধগম্যতা ইঙ্গিত দেয় যে দৈহিক নকশাগুলোর বিকাশ প্রারম্ভিক প্যালিওজোয়িক জুড়ে ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়েছে।
দৈহিক নকশাগুলোর আবিষ্কারের ইতিহাসকে মেরুদন্ডী প্রাণি কেন্দ্রিক একটি বিশ্বদর্শনের আন্দোলন হিসেবে দেখা যেতে পারে, মেরুদণ্ডী বা কর্ডেটদের অন্যতম একটি পর্বীয় দৈহিক নকশা হিসেবে দেখার জন্য। অগ্রণী প্রাণিবিদদের মধ্যে লিনিয়াস মেরুদণ্ডীদের বাইরে দুটি দৈহিক নকশা চিহ্নিত করেছিলেন; কুভিয়ার তিনটি; এবং হেকেল চারটি, পাশাপাশি আরও আটটি প্রোটিস্টা সহ মোট বারোটি। তুলনা করার জন্য, আধুনিক প্রাণিবিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত পর্বের সংখ্যা বেড়ে ছত্রিশে এসে দাঁড়িয়েছে।[১]
১৭৩৫ সালের তাঁর সিস্টেমা ন্যাচারাই বইতে, সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী লিনিয়াস প্রাণিদেরকে চতুষ্পদী, পাখি, "উভচর" (কচ্ছপ, গিরগিটি এবং সাপ সহ), মাছ, "পোকামাকড়" (কীট-পতঙ্গ, যাতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন অ্যারাকনিড, ক্রাস্টাসিয়ান এবং সেন্টিপিডদের ) এবং "কৃমি" (ভার্মিস) তে শ্রেণীবদ্ধ করেন। লিনিয়াসের ভার্মিস কার্যকরভাবে অন্যান্য সমস্ত প্রাণী গোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল, কেবল ফিতা কৃমি, কেঁচো বা জোঁকই নয় বরং মল্লাস্কা পর্বের প্রাণী, সামুদ্রিক অর্চিন এবং তারামাছ, জেলিফিশ, স্কুইড ও কাটলফিশ।[২]
ফরাসি প্রাণিবিজ্ঞানী জর্জেস কুভিয়ার, ১৮১৭ সালে তাঁর রচয়িত "প্রাণি জগৎ" (Le Règne Animal) বইতে, প্রাণী জগৎকে চারটি দৈহিক নকশায় বিভক্ত করার জন্য তুলনামূলক অ্যানাটমি এবং জীবাশ্ম বিজ্ঞান[৩] থেকে প্রমাণাদি সম্মিলিত করেন। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রধান অঙ্গব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে যা রক্ত সঞ্চালন এবং পরিপাক তন্ত্রের মতো অন্য সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, কুভিয়ার চারটি দৈহিক নকশা বা embranchements পৃথক করেনঃ[৪]
: এই দৈহিক নকশা প্রাণীগুলো চার শাখাতে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, যথা- মেরুদন্ডী, মলাস্কা, আর্টিকুলাটা (পোকামাকড় এবং এনিলিড সহ) এবং জুওফাইট বা রেডিয়াটা।
আর্নস্ট হেকেল, ১৮৮৬ সালের "জীবের সাধারণ অঙ্গসংস্থান" (Generelle Morphologie der Organismen) বইতে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিলেন যে উদ্ভিদ, প্রোটিস্টা এবং প্রাণীতে বিভক্ত সমস্ত জীবজন্তু হল মনোফাইলেটিক (একক বিবর্তনীয় উৎস থেকে আগত)। তাঁর প্রোটিস্টা মোনেরেস, প্রোটোপ্লাস্টস, ফ্ল্যাজেলেটস, ডায়াটমস, মিক্সোমাইসেটিস, মিক্সোসিসটোডস, রাইজোপডস এবং স্পঞ্জে বিভক্ত ছিল। তাঁর প্রাণীগুলি পৃথক পৃথক দৈহিক নকশা বিশিষ্ট বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল: তিনি এদের নাম রেখেছিলেন পর্ব। হেকেলের প্রাণী পর্বগুলো ছিল সিলেনটারেটস, একাইনোডার্মস এবং (কুভিয়ারের অনুসরণ করে) আর্টিকুলেটস, মল্লাস্কাস এবং ভার্টিব্রেটস।[৫]
স্টিফেন জে গোল্ড এই ধারণাটি অনুসন্ধান করেছিলেন যে দৈহিক নকশা, যা তাদের স্থায়ী অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, তার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্ব অনুধাবন করা যেতে পারে। যাইহোক, পরে তিনি বিরতিযুক্ত ভারসাম্যের পক্ষে এই ধারণা ত্যাগ করেছিলেন।[৬]
৩৬ টি দৈহিক নকশার মধ্যে ২০ টি ক্যামব্রিয়ান যুগে,[৭]"ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণে" উদ্ভূত হয়েছিল [৮] তবে, অনেক পর্বের সম্পূর্ণ দৈহিক নকশা অনেক পরে প্যালিওজোয়িক যুগে বা তারও পরে আবির্ভূত হয়।[৯]
দৈহিক নকশার বর্তমান পরিসীমা সমগ্র জীবনের সম্ভাব্য নিদর্শনগুলো থেকে অনেক দূরে: প্রাক-ক্যামব্রিয়ান এডিয়াকারান বায়োটায় অন্তর্ভুক্ত দৈহিক নকশা বর্তমানে জীবিত প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় এমন কোনটার সাথেই মিল নেই, যদিও অসম্পর্কিত আধুনিক ট্যাক্সার সামগ্রিক বিন্যাস একেবারে অনুরূপ।[১০] তাই ধারণা করা হয় ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণটি এর পূর্বে বিদ্যমান দৈহিক নকশার পরিসীমাটিকে কমবেশি পুরোপুরি প্রতিস্থাপিত করেছে।[৭]