দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শান (তিব্বতি: དོལ་པོ་པ་ཤེས་རབ་རྒྱལ་མཚན་, ওয়াইলি: Dol-po-pa shes-rab rgyal-mtshan) (১২৯২–১৩৬১) তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের জো-নাং ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত।
দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শান বর্তমান নেপালের দোলপো নামক অঞ্চলে ১২৯২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরে তিনি র্ন্যিং-মা ধর্মসম্প্রদায়ের তন্ত্র সম্বন্ধে অধ্যয়ন করেন। ১৩০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুস্তাং অঞ্চলে যাত্রা করে[১]:১১ স্ক্যি-স্তোন-'জাম-দ্ব্যাংস-গ্রাগ্স-পা-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: skyi ston 'jam dbyangs grags pa rgyal mtshan) নামক বৌদ্ধ পন্ডিতের নিকট অভিধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। ১৩১২ খ্রিষ্টাব্দে স্ক্যি-স্তোন-'জাম-দ্ব্যাংস-গ্রাগ্স-পা-র্গ্যাল-ম্ত্শান তিব্বতের ত্সাং অঞ্চলে অবস্থিত সা-স্ক্যা বৌদ্ধবিহার যাত্রা করলে দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শান তার সঙ্গ নেন। সেখানে তিনি তার নিকট হতে কালচক্র ও অন্যান্য বৌদ্ধ তত্ত্ব সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। তিনি সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের একাদশ সা-স্ক্যা-খ্রি-'দ্জিন ব্দাগ-ন্যিদ-ছেন-পো-ব্জাং-পো-দ্পালের নিকটে শিক্ষালাভ ছাড়াও কুন-দ্গা'-ব্সোদ-নাম্স (ওয়াইলি: kun dga' bsod nams) নামক বৌদ্ধভিক্ষুর নিকট মার্গফল ও হেবজ্র এবং কুন-স্পাংস-গ্রাগ্স-পা-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: kun spangs grags pa rgyal mtshan) নামক বৌদ্ধভিক্ষুর নিকট কালচক্র তত্ত্বের ওপর বিমলপ্রভা নামক টীকাভাষ্য অধ্যয়ন করেন।[২]
১৩১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্য তিব্বতের বহু বৌদ্ধবিহারে ভ্রমণ করেন এবং সহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার ওপর জ্ঞানের জন্য কুন-ম্খ্যেন (ওয়াইলি: kun mkhyen) উপাধিলাভ করেন। এই সময় তিনি ম্খান-ছেন-ব্সোদ-নাম্স-গ্রাগ্স-পা (ওয়াইলি: mkhan chen bsod nams grags pa) নামক ছোস-লুং বৌদ্ধবিহারের প্রধান তাকে ভিক্ষুর শপথ দান করেন।[১]:১৫,১৬ ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দে ম্ত্শুর-ফু বৌদ্ধবিহারে রাং-'ব্যুং-র্দো-র্জে নামক ব্কা'-ব্র্গ্যুদ ধর্মসম্প্রদায়ের কার্মা-ব্কা'-ব্র্গ্যুদ ধর্মীয় গোষ্ঠীর তৃতীয় র্গ্যাল-বা-কার্মা-পার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তিনি গ্ঝান-স্তোং তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করেন।।[১]:১৭,৪৭-৪৮,৫১-৫২,৬১ ১৩২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি য়োন-তান-র্গ্যা-ম্ত্শো নামক জো-নাং বৌদ্ধবিহারের বৌদ্ধভিক্ষুর নিকট কালচক্র, মার্গফল, গুহ্যসমাজতন্ত্র, চক্রসম্বর, ছেদ সাধনা সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে য়োন-তান-র্গ্যা-ম্ত্শো তাকে জো-নাং বৌদ্ধবিহারে্র প্রধানপদ অলঙ্কৃত করার অনুরোধ জানালে পরের বছর তিনি তার অনুরোধ রক্ষা করেন। পরের বছর য়োন-তান-র্গ্যা-ম্ত্শো মৃত্যুবরণ করলে দোল-পো-পা তার সম্মানার্থে একটি বিশালাকার স্তূপমন্দির বা স্কু-'বুম নির্মাণ শুরু করেন, যার নির্মাণকাজ ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর শেষ হয়।[১]:১১,২০,২১ এর পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে ধ্যান ও শিক্ষাদান করে অজীবন অতিবাহিত করেন। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জো-নাং বৌদ্ধবিহারের পরবর্তী প্রধান রূপে ব্লো-গ্রোস-দ্পাল নামক এক বৌদ্ধভিক্ষুকে নির্বাচিত করেন।[১]:২৮[২]
১৩৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলিয়ার সম্রাট তোঘোন তেমুর তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি ঐ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের উদ্দেশ্যে পরবর্তী চার বছর একাকী সাধনার পথ বেছে নেন। ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্য তিব্বতে তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে গ্নাস-গ্সার এবং ছোস-লুং বৌদ্ধবিহারে এক বছর করে কাটিয়ে শিক্ষাদান করেন। এইসময় সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের চতুর্দশ সা-স্ক্যা-খ্রি-'দ্জিন ব্লা-মা-দাম-পা-ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যাল-ম্ত্শান তার সঙ্গে দেখা করে ব্কা'-ব্স্দু-ব্ঝি-পা (ওয়াইলি: bka' bsdu bzhi pa) নামক তার বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করতে অনুরোধ করেন। ১৩৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লাসা শহরে ছয় মাস শিক্ষাদান করে শহরবাসীর নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যান। পরের বছর তাকে জো-নাং বৌদ্ধবিহারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক প্রতিনিধিদল এলে লাসা শহরের অধিবাসীরা তাকে বিদায় দিতে রাজি হননি। তবুও তিনি রা-লুং এবং গ্নাস-র্ন্যিং বৌদ্ধবিহার হয়ে জো-নাং বৌদ্ধবিহারে ফিরে আসেন।[২]
শূন্যতা সম্বন্ধে বিতর্কিত ও দ্বৈত সংজ্ঞা এবং মহাপরিনির্বাণসূত্র, অঙ্গুলিমাল্যসূত্র এবং শ্রীমালাসূত্রের নির্দিষ্ট কিছু তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে আত্মন ধারণাটিকে একমাত্র সত্য বলে উপস্থাপন করে দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শান বিতর্কের জন্ম দেন।[৩] র্ন্যিং-মা, ব্কা'-ব্র্গ্যুদ ও জো-নাং ধর্মসম্প্রদায়ের বৌদ্ধরা তার এই তত্ত্বটিকে গ্রহণ করলেও[n ১] অন্যান্য তিব্বতী বৌদ্ধধর্মসম্প্রদায় এই ধারণাকে পছন্দ করেনি। গ্ঝান-স্তোং তত্ত্বের প্রচারক হিসেবে দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শান গৌতম বুদ্ধকে শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়, চিরস্থায়ী এবং অবস্থা নিরপেক্ষ রূপে কল্পনা করেছেন।[n ২] শাশ্বত সত্য সম্বন্ধে তার এই তত্ত্বের সমর্থনে তিনি সমস্ত সূত্র ও তন্ত্র থেকে প্রমাণের সন্ধান করেছেন।[n ৩] তার মতে, সকল জীব সুখ ও স্থায়িত্বের অধিকারী বলে নিজেদের মনে করলেও তারা ভুল পথে এর সন্ধান করেন। অপরদিকে আধ্যাত্মিক পুরুষেরা সঠিক পথে ও অর্থপূর্ণ ভাবে এই গুণগুলির সন্ধান করেন।[n ৪] জ্ঞানলাভ করে বুদ্ধত্ব লাভ সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন।[n ৫] দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শান রত্নগোত্রবিভাগের ওপর একটি টীকাভাষ্য রচনা করেন এবং পরবর্তী সময়ে তারানাথ নামক জো-নাং ধর্মসম্প্রদায়ের এক বৌদ্ধ লামা তার মতকে সমগ্র তিব্বতে প্রচার করেন।[n ৬]
তিব্বতের পরবর্তীকালের প্রধান ধর্মীয় শক্তি রূপে পরিচিত দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায় রাজনৈতিক ও আদর্শগত কারণে দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শানের সমস্ত রচনাকে অবদমিত করে রাখে। সপ্তদশ শতাব্দীতে পঞ্চম দলাই লামার অধীনে দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায় তিব্বতের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করলে জো-নাং ধর্মসম্প্রদায়ের সমস্ত বৌদ্ধবিহার ও সম্পত্তি দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের হস্তগত হয়ে পড়ে। দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত গ্ত্সাং প্রদেশের শাসকেরা জো-নাং ধর্মসম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে এই অবদমনের পেছনে আদর্শগত কারণের চেয়েও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা দোল-পো-পা-শেস-রাব-র্গ্যাল-ম্ত্শানের রি-ছোস-ঙ্গেস-দোন-র্গ্যা-ম্ত্শো সহ অন্যান্য রচনাগুলিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে দেন।[n ৭]