দোলযাত্রা | |
---|---|
![]() | |
অন্য নাম | দোল, দোলপূর্ণিমা, বসন্তোৎসব, হোলি |
পালনকারী | হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ও অন্যান্য |
ধরন | ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বসন্ত উৎসব |
তাৎপর্য |
|
উদযাপন | হোলির আগের রাতে: হোলিকা দহন, রঙিন রং বা আবির দিয়ে খেলা, নাচ, শুভেচ্ছা, উৎসবের সুস্বাদু খাবার |
তারিখ | ফাল্গুনী পূর্ণিমা |
সংঘটন | বার্ষিক |
সম্পর্কিত | গৌর পূর্ণিমা, শিগমো, ইয়াওসাং |
দোলযাত্রা বা হোলি হলো একটি জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ হিন্দু উৎসব, যা বসন্ত, প্রেম এবং রঙের উৎসব নামেও পরিচিত ৷[১][১][২][৩] এটি রাধা ও কৃষ্ণের শাশ্বত ও ঐশ্বরিক প্রেম উদযাপন করে।[৪][৫] হোলিকা দহন অশুভ শক্তির বিপরীতে শুভের জয় নির্দেশিত করে।[৬][৭] এটির উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে হওয়ায় সেখানে বেশি উদযাপিত হয়, তবে দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীদের মাধ্যমে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল এবং পশ্চিমা বিশ্বের বেশকিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ছে।[৮][৯][১০][১১][১২][১৩]
হোলি ভারত উপমহাদেশে বসন্তের আগমন, শীতের শেষে এবং প্রেমের প্রস্ফুটিত উদযাপন করে।[৮][১৪] এটি এক রাত এবং এক দিন স্থায়ী হয়, যা হিন্দু পঞ্জিকার ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এবং গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার মার্চের মাঝামাঝি সময়ে পড়ে ।
হোলি ( হিন্দি: होली , গুজরাতি: હોળી , কন্নড়: ಹೋಳಿ , মারাঠি: होळी , নেপালি: होली , গুরুমুখী: ਹੋਲੀ , তেলুগু: హోళి ) দোল যাত্রা (দোল উৎসব") এবং বসন্ত উৎসব ( বাংলা: বসন্ত উৎসব নামেও পরিচিত ) ("বসন্ত উৎসব") বাংলায় ( পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ ), ফাকুয়া ( অসমীয়া: ফাকুৱা ) এবং দোলযাত্রা ( অসমীয়া: দ’ল যাত্ৰা ) আসামে, ফাগু পূর্ণিমা ( নেপালি: फागु पूर्णिमा ) নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলে, দোলা যাত্রা ( ওড়িয়া: ଦୋଳଯାତ୍ରା ) ওড়িশা, ফাগুয়া বা ফাগুয়া ( টেমপ্লেট:Lang-bho ) পূর্ব উত্তর প্রদেশে, পশ্চিম বিহার এবং উত্তর-পূর্ব ঝাড়খণ্ডে, ফাগওয়া ( ক্যারিবিয়ান হিন্দুস্তানি : पगवा) ক্যারিবিয়ান (যেমন ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো, গায়ানা, সুরিনাম এবং জ্যামাইকা ), এবং ফাগুয়া ( টেমপ্লেট:Lang-hif ) ফিজিতে ।
উদযাপনের প্রধান দিন "হোলি", "রাংওয়ালী হোলি", " দোল পূর্ণিমা ", "ধুলেটি", "ধুলান্দী",[১৫] "উকুলি", "মঞ্জল কুলি", " ইয়াওসাং ", " শিগমো ",[১৬] "ফাগওয়াহ",[১৭] বা "জাজিরি" নামে পরিচিত। [১৮]
হোলি উৎসব হল একটি প্রাচীন হিন্দু উৎসব যার নিজস্ব সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে, যা গুপ্ত যুগের আগে উদ্ভূত হয়েছিল। [১৯] নারদ পুরাণ এবং ভবিষ্য পুরাণের মতো প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে আরও বিশদ বিবরণ সহ জৈমিনীর পূর্ব মীমাংসা সূত্র এবং কথক- গৃহ্য - সূত্রের মতো রচনাগুলিতে রঙের উত্সবের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা হর্ষের ৭ম শতাব্দীর রচনা রত্নাবলীতেও "হলিকোৎসব" উৎসবের উল্লেখ করা হয়েছে। [২০] এটি দণ্ডীর দশকুমার চরিত পুরাণে এবং কবি কালিদাস চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে উল্লেখ করা হয়েছে। [১৯]
৭ম শতাব্দীর সংস্কৃত নাটক রত্নাবলীতেও হোলি উদযাপনের উল্লেখ আছে। [২১] হোলির উত্সব ১৭ শতকের মধ্যে ইউরোপীয় ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মচারীদের মুগ্ধ করে। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে বিভিন্ন পুরানো সংস্করণে এটি উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন, উচ্চারণগতভাবে উদ্ভূত বানান: Houly (১৬৮৭), Hooly (১৬৯৮), Huli (১৭৮৯), Hohlee (১৮০৯), Hoolee (১৮২৫) এবং ১৯৯০-এর পরে প্রকাশিত সংস্করণগুলিতে Holi । [২২]
ভারতের ব্রজ অঞ্চলে, যেখানে কৃষ্ণ ছোট থেকে বড় হয়, সেখানে রাধা ও কৃষ্ণের স্বর্গীয় ভালোবাসার স্মৃতি হিসেবে দিনটি রাঙা পঞ্চমী হিসেবে উদযাপিত হয়। বসন্তের সূচনার সাথে হোলি প্রেমের উৎসব হিসেবে দিনটি পালিত হয়। ঋষি গর্গের রচিত গর্গ সংহিতায় ছিল সাহিত্যের প্রথম কাজ যেখানে রাধা ও কৃষ্ণের হোলি খেলার বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে।[২৩] হোলিকে ফাগওয়া (Phagwah)-ও বলা হয় এবং এক্ষেত্রে হোলিকাকে বলা হয় পূতনা। কৃষ্ণের মামা রাজা কংস তার শিশু ভাগ্নে কৃষ্ণকে নিজের জীবনের জন্য সংকট বলে মনে করে। কংস রাক্ষসী পুতানাকে, নারীর বেশে কৃষ্ণকে হত্যা করতে পাঠায়, যেখানে পুতানা রাক্ষসী কৃষ্ণকে স্তন্যদান করাতে গিয়ে বিষ প্রয়োগ করে কৃষ্ণকে হত্যা করবে।[২৪] কিন্তু শিশু কৃষ্ণ কেবল পুতনার বিষাক্ত দুধই পান করেনি, সেইসাথে পুতানার রক্তও পান করে। এরফলে পুতনা একজন রাক্ষসীতে পরিণত হয়। এরপর পুতানা পালিয়ে যায় ও আগুনে জ্বলে ওঠে, এবং কৃষ্ণের গায়ের রঙ ঘন নীল হয়ে যায়।
ফাগওয়া (Phagwah) উদ্যাপনের আগের রাতে পুতনার দহন উদযাপিত হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণ তার যৌবনে হতাশ হয়ে ভাবে, উজ্জ্বল বর্ণের রাধা ও অন্যান্য গোপিরা তার শ্যাম বর্ণের কারণে পছন্দ করবে কিনা। এতে কৃষ্ণের মা কৃষ্ণের হতাশায় ক্লান্ত হয়ে তাকে বলেন, রাধার কাছে গিয়ে সে রাধার মুখমণ্ডলকে যেকোন রঙ দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিতে পারে। কৃষ্ণ তাই করে, এবং এরপর রাধা ও কৃষ্ণ জুড়ি হয়ে যায়। রাধা ও কৃষ্ণের এই রঙ নিয়ে খেলাই হোলি বা দোলযাত্রা হিসেবে পালিত হয়।[২৫][২৬][২৭][২৮] মরিশাসেও এই দিন পালন করা হয়।[২৯]
ভাগবত পুরাণ এর সপ্তম অধ্যায় অনুসারে,[৩০][৩১][৩২][৩৩][৩৪] অসুর রাজা হিরণ্যকশিপু অমর হতে চান। এজন্য ব্রহ্মার নিকট হতে অমরত্বের বরপ্রাপ্তির জন্য তিনি কঠোর ধ্যানে নিমগ্ন হন। কিন্তু দেবতারা খুব কমই অমরত্ব দান করে। কিন্তু হিরণ্যকশিপু এমন বর চান যাতে তাঁর মনে হয় যেন পরোক্ষভাবে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনি যে বর লাভ করেন তাতে তিনি পাঁচটি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হন। এগুলো হচ্ছে, তাকে মানুষও হত্যা করতে পারবে না, কোন প্রাণীও হত্যা করতে পারবে না; তাকে ঘরেও হত্যা করা যাবে না, আবার বাইরেও হত্যা করা যাবে না; তাকে দিনেও হত্যা করা যাবে না আবার রাতেও হত্যা করা যাবে না; তাকে অস্ত্রের (যা ছুড়ে মারা হয়) দ্বারাও হত্যা করা যাবে না আবার সস্ত্রের (যা হাতে থাকে) দ্বারাও হত্যা করা যাবে না; তাকে স্থল, জল বা বায়ু কোথাও হত্যা করা যাবে না। এই বর লাভ করে হিরণ্যকশিপু অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে ওঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কেবল তাকেই দেবতা হিসেবে পূজা করা হবে। কেউ তার আদেশ পালন না করলে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন বা হত্যা করবেন।[৩০] তার পুত্র প্রহ্লাদ তার সাথে সম্মত হয়নি। তিনি একজন বিষ্ণুভক্ত ছিলেন,[৩১] তার পিতাকে দেবতা হিসেবে পূজা করতে তাই তিনি অস্বীকার করেন। প্রহ্লাদ বিষ্ণুকেই পূজা করা চালিয়ে যান।
এতে হিরণ্যকশিপু খুব রাগান্বিত হন এবং প্রহ্লাদকে হত্যা করার বিভিন্ন চেষ্টা করেন। এগুলোর মধ্যে একবার হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছে সাহায্য চান। হোলিকার একটি বিশেষ পোশাক ছিল যা তাকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করত। হিরণ্যকশিপুকে তিনি তার কোলে বসতে বলেন, আর হিরণ্যকশিপু তার কোলে বসলে তিনি প্রহ্লাদের উপর আগুন জ্বালিয়ে দেন।[৩০] এতে প্রহ্লাদ আগুনে পুড়ে মারা যাবে কিন্তু হোলিকার কাছে থাকা বিশেষ বস্ত্রের জন্য তার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু সেই আগুন জ্বলতেই হোলিকার শরীর থেকে সেই বস্ত্র খুলে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীরকে আবৃত করে।[৩১] এতে হোলিকা আগুনে পুড়ে যায়, আর প্রহ্লাদ ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়।[৩০][৩১]
বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার (অর্ধমানব-অর্ধসিংহ) রূপে গোধূলি লগ্নে (দিন ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে) আবির্ভূত হন, হিরণ্যকশিপুকে ঘরের চৌকাঠে (না বাইরে না ঘরে) নিয়ে যান, তাকে নিজের কোলে (না বায়ুতে, না স্থলে) স্থাপন করেন, ও এরপর হিরণ্যকশিপুর নাড়িভুড়ি বের করে ও তার থাবা দিয়ে (না অস্ত্র না সস্ত্র) তাকে হত্যা করেন।[৩৫] এভাবে হিরণ্যকশিপুর লাভ করা বর তাকে বাঁচাতে পারেনি। প্রহ্লাদ ও মানব জাতি বাধ্যবাধকতা ও ভয় থেকে মুক্তি পায়। নৃসিংহের দ্বারা হিরণ্যকশিপু বধ এর এই কাহিনী অশুভ এর উপর শুভের জয়কে নির্দেশ করে।[৩৬] হোলিকা দহন বা নেড়াপোড়া উৎসব এই ঘটনাটিকেই নির্দেশ করে।[৩২] হোলিকার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনিই দোলের পূর্বদিনে অনুষ্ঠিত হোলিকাদহন বা চাঁচর উৎসবের সঙ্গে যুক্ত।[৩৭] স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুনমাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে।
অন্যান্য হিন্দু ঐতিহ্য যেমন শৈবধর্ম এবং শাক্তধর্মের মধ্যে, হোলির কিংবদন্তি তাৎপর্য যোগ এবং গভীর ধ্যানের সাথে শিবের সাথে যুক্ত । পার্বতী শিবকে যোগ ও ধ্যান থেকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনবার জন্য বসন্ত পঞ্চমীর দিনে প্রেমের দেবতা কামদেবের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কামদেব (প্রেমের দেবতা) এবং তার স্ত্রী রতি (প্রেমের দেবী) পার্বতীকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন যাতে পার্বতী শিবকে তার স্বামী রূপে অর্জন করতে সক্ষম হন।[৩৮] শিব যোগাসনে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কামদেব ও রতি শিবের ধ্যান ভঙ্গ করে পার্বতির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করানোর জন্য তার দিকে তীর ছোড়ে। কিন্তু ধ্যানে এই বিঘ্ন ঘটবার কারণে শিব তার তৃতীয় চক্ষু খোলেন এবং সেই চোক্ষুর তেজদীপ্ত চাহনিতে কামদেব দগ্ধ হয়ে ছাইয়ে পরিণত হয়। এই ঘটনায় কামদেবের স্ত্রী রতির বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তাদের তীর কাজ করেনি, বরং শিবকে বিদ্ধ করার আগেই এগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তিতে শিব ও পার্বতির বিবাহ হয়। এই বিবাহের সময় রতি শিবের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে কামদেবকে তার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। শিব সম্মত হন, এবং কামদেবকে সত্যিকারের আবেগ এর একটি অবাস্তব সত্তা হিসেবে তাকে ফিরিয়ে দেন। প্রেমের দেবতার এই ফিরে আসা বসন্ত পঞ্চমি উৎসবের চল্লিশ দিন পর হোলি হিসেবে পালিত হয়।[৩৯][৪০] এই কামদেবের কিংবদন্তি ও হোলি উৎসবে এর তাৎপর্যের বিভিন্ন প্রকরণ আছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে এই কিংবদন্তির বিভিন্ন রূপ দেখা যায়।[৪১]
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে হোলি উৎসবের একটি সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। এটি অতীতের ত্রুটিগুলি শেষ করার এবং নিজেকে পরিত্রাণ দেওয়ার, অন্যদের সাথে দেখা করে দ্বন্দ্ব শেষ করার, ভুলে যাওয়ার এবং ক্ষমা করার একটি দিন। লোকেরা ঋণ পরিশোধ করে বা ক্ষমা করে, সেইসাথে তাদের জীবনে তাদের সাথে নতুন করে শুরু করে এবং হোলি বসন্তের সূচনাকেও চিহ্নিত করে লোকেদের পরিবর্তিত ঋতু উপভোগ করার ও নতুন বন্ধু তৈরি করার একটি উপলক্ষ।[৩২][৪২]
ব্রজ অঞ্চলে হোলির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যগতভাবে রাধা কৃষ্ণের সাথে যুক্ত স্থানগুলি : মথুরা, বৃন্দাবন, নন্দগাঁও, বারসানা এবং গোকুল, যা হোলির মৌসুমে পর্যটন হয়ে ওঠে।[৪৩]
নবদ্বীপে দোল দীর্ঘতম উৎসবের আকার নেয়। বিভিন্ন মন্দিরে দোল পূর্ণিমার পরেও চলে তৃতীয় দোল, চতুর্থ দোল, পঞ্চম দোল,সপ্তম দোল, দশম দোল। পূর্ণিমার পর থেকে যে মন্দির যে তিথিতে দোল উদযাপিত হয় সেই তিথি অনুসারে তৃতীয়, পঞ্চম, দশম দোল ইত্যাদি নামকরণ।[৪৪]
নদিয়ার শান্তিপুরে পূর্ণিমার দোল ছাড়াও উদযাপিত হয় প্রতিপদ, পঞ্চমদোল, সপ্তমদোল। রামনবমীতেও শান্তিপুরে দোল উৎসব পালিত হয়।[৪৫] শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরগুলি মধ্যে অন্যতম শ্যামচাঁদ মন্দির এবং গোকুলচাঁদ মন্দিরের দোল উজ্জ্বল তার নিজস্বতায় :
"শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের দোলের মধ্যে অন্যতম শ্যামচাঁদ ও গোকুলচাঁদের মন্দিরের দোল। শ্যামচাঁদের দোল হয় পূর্ণিমার পরের দিন প্রতিপদে। দোলের সন্ধ্যায় হয় চাঁচর অনুষ্ঠান। পরের দিন বিশেষ পুজো, ভোগ, নামসংকীর্তন শেষে সন্ধ্যায় শ্যামচাঁদ আলোকসজ্জা-সহ শোভাযাত্রায় বের হয়ে নগর পরিক্রমা করেন। এই দৃশ্য দেখতে রাস্তার দু’ধারে ভিড় করেন অসংখ্য ভক্ত। এই শোভাযাত্রা যায় ওড়িয়া গোস্বামীবাড়িতে, সেখানে হয় ডালিধরা উৎসব। সমস্ত বারোয়ারি পুজোও এখানে গিয়ে ডালি নিবেদন করেন। ডালিতে থাকে পাঁচ রকমের ফল, পৈতে ইত্যাদি। শুধু তাই নয়। এ দিন সমস্ত বারোয়ারি পুজোর বিগ্রহগুলিকে শোভাযাত্রা করে ওড়িয়া গোস্বামীবাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়। এটা একটা প্রচলিত রীতি। গোকুলচাঁদের দোল হয় পূর্ণিমায়। উঁচু দোলমঞ্চে গোকুলচাঁদের দারুবিগ্রহ স্থাপন করে বিশেষ পূজার্চনা করা হয়। এ দিন দোলমঞ্চে গিয়ে দেবতাকে আবির দেওয়ার সুযোগ পান ভক্তেরা।"
শান্তিপুরের প্রাচীন বিগ্রহবাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম বড় গোস্বামীবাড়ির দোল। এখানে পূর্ণিমায় হয় রাধারমণ ও শ্রীমতীর দোল।[৪৭] এর পাঁচ দিন পরে পঞ্চমদোলে বড় গোস্বামী বাড়িতে মদনমোহন-শ্রীমতি দোল হয় একই নিয়মে।[৪৮] পঞ্চম দোলে গোপালপুর অঞ্চলে সাহা বাড়িতে রাধাকান্ত জিউর দোল, নতুনপাড়ায় সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির জেঠা-গোপীনাথের পঞ্চমদোল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়।[৪৯] সপ্তম দোল শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের দোল নামেও পরিচিত। বড় গোস্বামী বাড়িতে শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের বিশেষ পূজা-অর্চনা হয় এই উপলক্ষে। ভক্তের ঢল নামে বাবলায়। এই উপলক্ষেই হয় সীতানাথের দোল।[৫০]
কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলাতেও নামে জনস্রোত। এই মেলাটি মূলত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের। একটি কাহিনি অনুসারে আউলেচাঁদ বা আউলচন্দ্র রামশরণ পাল-সহ একুশ জনকে দীক্ষা দেন। এই রামশরণের স্ত্রীর সরস্বতী দেবীই ‘সতীমা’।[৫১] প্রচলিত বিশ্বাস আউলচাঁদই নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল।[৫২] ইনিই হলেন কর্তাভজাদের কর্তা। সতীমার গর্ভে জন্ম নেন দুলালচাঁদ। এক সময় লোকবিশ্বাসে এই দুলালচাঁদই হয়ে ওঠেন নবদ্বীপের নিমাইচাঁদের অবতার।[৫৩] এই উপলক্ষে -
"ভক্তরা ডালিমতলায় মানত করেন, হিমসাগরের জলে স্নান করে পুণ্যার্জন করেন, সতী মায়ের সমাধিতে সিঁদুর আর নোয়া দেন। আর মনস্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডি কেটে কিংবা ভাবের গান গেয়ে জানিয়ে যান কৃতজ্ঞতা। ডালিমতলার চারপাশে অসংখ্য ডালার দোকান। পুজোর উপকরণ বলতে মাটির সরায় খই-বাতাসা কিংবা মট। এই হল পুজোর ডালি। পুজো দিয়ে ভক্তেরা এই মহার্ঘ্য প্রসাদটুকু নিয়েই ঘরে ফিরে যায়।"
লঘিমাসিদ্ধ মহাসাধক ভাদুড়ি মহাশয় - মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের প্রবর্তিত যোগ - ভক্তি মার্গের অনুরাগী এবং অনুগামীদের কাছেও দোল বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ভক্ত শিষ্যদের চোখে নগেন্দ্রনাথ ছিলেন - বহিরঙ্গে শিব, অন্তরঙ্গে বিষ্ণু। সনাতন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ১৮৯১- তে সনাতন ধর্মপ্রচারিণী সভা নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। মহর্ষি যেখানে থাকতেন সেখানেই এর সভা চলত। পরে তাঁর শিষ্য-ভক্তরা তাঁকে স্থায়ী আবাসের কথা বলেন। মহর্ষি প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত শিষ্য- ভক্তদের ক্রমাগত অনুরোধে রাজি হন এবং কলকাতার গড়পার অঞ্চলে রামমোহন রায় রোডে একটি স্থায়ী আবাস গৃহ নির্মিত হয়। ১৯১৬ সালের দোল পূর্ণিমার দিনে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠিত হয়।[৫৫] এই গৃহে পরবর্তীতে ১৯২৬- এ শ্রীশ্রী নগেন্দ্র মঠ গড়ে ওঠে। এই মঠ তৈরির উদ্দেশ্য ছিল - মহর্ষিদেবের বাণী, সাধনা ও আদর্শের প্রচার এবং প্রসার। এখানেই মহর্ষিদেবের অস্থিকলস মাটিতে পুঁতে দিয়ে তার ওপর সমাধি মন্দির নির্মিত হয়। তাঁর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এবং পাদুকাও তাঁর বসবাসের ঘরে সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা হয়।[৫৬] ২০০৫-এ গড়ে ওঠে নগেন্দ্র মিশন। যেহেতু দোল পূর্ণিমার দিনটি মহর্ষির শেষ জীবনের সাধন ভূমিতে পদার্পণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাই তাঁর অনুরাগী ও অনুগামীদের কাছে এই দিনটি বিশেষ দিন হিসেবে পরিগণিত হয়।
ভারত ও নেপালের বাইরে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের হিন্দুরা এবং সারা বিশ্বের ভারত থেকে আসা বৃহৎ প্রবাসী জনসংখ্যার দেশগুলিতে হোলি পালন করে। হোলি আচার এবং রীতিনীতি স্থানীয় অভিযোজনের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে।
ঐতিহ্যগতভাবে এই উৎসবটিকে অ-হিন্দুদের মধ্যে, যেমন জৈন[৫৭] এবং নেপালের নেওয়ার বৌদ্ধদের মধ্যেও দেখা যায়।[৫৮]
মুঘল ভারতে, হোলি এমন উচ্ছ্বাসের সাথে উদযাপন করা হয়েছিল যে সমস্ত বর্ণের লোকেরা সম্রাটের গায়ে রঙ ছুঁড়তে পারে।[৫৯] শর্মা (২০১৭) অনুসারে, "হোলি উদযাপনকারী মুঘল সম্রাটদের বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম রয়েছে"।[৬০] হোলির গ্র্যান্ড উদযাপন লাল কিলায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে উৎসবটি ঈদ-ই-গুলাবি বা আব-ই-পাশি নামেও পরিচিত ছিল । দিল্লির প্রাচীর ঘেরা শহর জুড়ে মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে অভিজাত এবং ব্যবসায়ীরা একইভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে এর পরিবর্তন হয়। তিনি ১৬৬৫ সালের নভেম্বর মাসে ফরমান ইস্যু ব্যবহার করে হোলি উদযাপন নিষিদ্ধ করেন[৬১] বাহাদুর শাহ জাফর নিজেই উৎসবের জন্য একটি গান লিখেছিলেন, যখন আমির খসরু, ইব্রাহিম রাসখান, নাজির আকবরাবাদী এবং মেহজুর লখনভির মতো কবিরা তাদের লেখায় এটিকে উপভোগ করেছিলেন।[৫৯]
শিখরা একে ঐতিহ্যগতভাবে উৎসব হিসেবে পালন করে।[৬২] ঐতিহাসিক শিখ গ্রন্থে এটিকে হোলা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।[৬৩] শিখদের শেষ মানবগুরু গুরু গোবিন্দ সিং হোলিকে পরিবর্তন করে তিন দিনের হোলা মহল্লা উৎসবে পরিণত করেছিলেন, যেখানে হোলি উৎসব বর্ধিত হয়ে এতে মার্শাল আর্টও অন্তর্ভুক্ত হয়। আনন্দপুর সাহিব এর উৎসবের পর হোলি উৎসবের এই বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। এই আনন্দপুর সাহিবে শিখ সৈন্যরা একটি নকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ, ঘোড়দৌড়, শরীরচর্চা, তীর চালানো ও সামরিক-চর্চা করে।[৬৪][৬৫][৬৬]
মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সময় শিখ সাম্রাজ্যে হোলি খেলা হয় এবং সেই উৎসবের সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তানের উত্তর অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ট্রিবিউন ইন্ডিয়া এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, শিখ দরবারের একটি নথি বলছে, ১৮৩৭ সালে লাহোরে রঞ্জিত সিংহ ও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ৩০০ মাউন্ড এর রঙ ব্যবহার করেছিলেন। রঞ্জিত সিংহ বিলাবল বাগানে অন্যদের সাথে হোলি উৎসব উদ্যাপন করেছিলেন, যেখানে বিভিন্ন সজ্জিত তাবু খাটানো হয়। ১৮৩৭ সালে স্যার হেনরি ফেন, যিনি তদকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন, তিনি রঞ্জিত সিংহের আয়োজিত হোলি উৎসবে যোগদান করেছিলেন। রঞ্জিত সিংহের উদ্যোগে লাহোর দুর্গে একটি দেয়াল চিত্র তৈরি করা হয়, যেখানে কৃষ্ণকে গোপিদের সাথে হোলি খেলতে দেখা যায়। রঞ্জিত সিংহের মৃত্যুর পর, তার শিখ পুত্রেরা এবং অন্যেরা রঙ দিয়ে আরম্বরপূর্ণভাবে হোলি উৎসব পালন করা চালিয়ে যান, এবং এই উৎসবগুলোতে ব্রিটিশ কর্মকর্তাগণও যোগদান করতেন।[৬৭]
Holi celebrates love, forgiveness, and triumph of good over evil
![]() |
হিন্দুধর্ম বিষয়ক এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |