দ্গে-'দুন-ছোস-ফেল (তিব্বতি: དགེ་འདུན་ཆོས་འཕེལ, ওয়াইলি: dge 'dun choe 'phel) (১৯০৩-১৯৫১) একজন বিখ্যাত তিব্বতী চিত্রকর ও প্রগতিশীল তিব্বতী পণ্ডিত ছিলেন।
দ্গে-'দুন-ছোস-ফেল ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের উত্তর আমদো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আ-লাগ্স-র্গ্যাল-পো (ওয়াইলি: a lags rgyal po) একজন র্ন্যিং-মা ধর্মসম্প্রদায়ের একজন তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। তার মাতার নাম ছিল পে-মা-স্ক্যিদ (ওয়াইলি: pe ma skyid)। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় রিগ-'দ্জিন-র্নাম-র্গ্যাল (ওয়াইলি: rig 'dzin rnam rgyal)।[১]
জীবনের প্রথম দশ বছর তিনি রেব-কোং (ওয়াইলি: reb kong) নামক স্থানে গ্যা'-মা-ব্ক্রা-শিস-'খ্যিল (ওয়াইলি: g.ya' ma bkra shis 'khyil) বৌদ্ধ আশ্রমে বসবাস করে ব্যাকরণ, কাব্যশাস্ত্র, সংস্কৃত, ভারতীয় ও চীনা জ্যোতিষশাস্ত্র এবং শিল্পকলা সম্বন্ধে শিক্ষালাভ শুরু করেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তার পিতার মৃত্যু হলে লাস-রাব-গ্লিং-পা (ওয়াইলি: las rab gling pa) এবং 'জিগ্স-মেদ-ব্স্তান-পা'ই-ন্যি-মা (ওয়াইলি: 'jigs med bstan pa'i nyi ma) নামক দুই লামা তাকে রিগ-'দ্জিন-'জিগ্স-মেদ-ব্সোদ-নাম্স-র্নাম-র্গ্যাল (ওয়াইলি: rig 'dzin 'jigs med bsod nams rnam rgyal) নামক র্দো-র্জে-ব্রাগ বৌদ্ধবিহারের (ওয়াইলি: rdo rje brag dgon) একজন লামার পুনর্জন্ম রূপে চিহ্নিত করেন। তেরো বছর বয়সে তাকে দ্পাল-মি-'গ্যুর-দ্গা'-ল্দান-ব্ক্রা-শিস-ছোস-স্দিংস (ওয়াইলি: dpal mi 'gyur dga' ldan bkra shis chos sdings) বৌদ্ধবিহারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে ঐ বিহারের প্রতিষ্ঠাতা দ্গে-'দুন-ব্স্তান-'দ্জিন-র্গ্যা-ম্ত্শো (ওয়াইলি: dge 'dun bstan 'dzin rgya mtsho) নামক চতুর্থ আ-ম্দো-ঝ্বা-দ্মার (ওয়াইলি: a mdo zhwa dmar) উপাধিধারী বৌদ্ধ লামা তাকে শ্রমণের শপথ প্রদান করেন। এই বিহারে তিনি তর্কশাস্ত্র ও প্রমাণ সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্লা-ব্রাং-ব্ক্রা-শিস-'খ্যিল বৌদ্ধবিহারে (ওয়াইলি: bla brang bkra shis 'khyil) ভর্তি হয়ে ছয় বছর ধরে শিক্ষালাভ করেন। এই সময় নামক তিনি ঐ স্থানে উপস্থিত মারিওন গ্রিবেনো নামক এক মার্কিন ধর্মযাজকের নিকট হতে সামান্য ইংরেজি ও ঘড়ির যান্ত্রিক কৌশল সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি লাসা যাত্রা করে দ্রেপুং বৌদ্ধবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গোমাং মহাবিদ্যালয়ে শেস-রাব-র্গ্যা-ম্ত্শো (ওয়াইলি: shes rab rgya mtsho) নামক এক তিব্বতী বৌদ্ধ পণ্ডিতের নিকট শিক্ষালাভ করেন। এই সময় তিনি চিত্র অঙ্কন করে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করলে তিব্বতের অভিজাত মহলে তিনি বিখ্যাত হন।[১]
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে শেস-রাব-র্গ্যা-ম্ত্শোর বাসস্থানে দ্গে-'দুন-ছোস-ফেলের সঙ্গে বিখ্যাত ভারতীয় পর্যটক মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের সাক্ষাত ঘটে। রাহুল এই সময় প্রাচীন সংস্কৃত বৌদ্ধ পুঁথির সন্ধানে তার দ্বিতীয় তিব্বত যাত্রা করছিলেন। দ্গে-'দুন-ছোস-ফেলের পাণ্ডিত্য ও আধুনিকমনস্কতায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি তাকে এই যাত্রায় তার সঙ্গী হতে অনুরোধ করেন। পরবর্তী কয়েক মাস তারা দুইজনে তিব্বতের বেশ কিছু বৌদ্ধবিহার থেকে প্রাচীন তালপাতার পুঁথি ও চিত্রপট সংগ্রহ করেন। এরপর রাহুল তাকে ভারতে নিয়ে যান। ভারতে তিনি সংস্কৃত, বিভিন্ন প্রচলিত লিপি পদ্ধতি, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মহাত্মা গান্ধীর চরকা অর্থনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এই সময় তিনি বিশ্বের ইতিহাস ও ভূগোল সম্বন্ধে প্রাচীন তিব্বতী দৃষ্টিভঙ্গীগুলির সমালোচনা করে এবং তিব্বতী লিপির উৎপত্তি সম্বন্ধে তার রচনাগুলি প্রকাশ করেন। তিনি বিভিনন পশ্চিমী তিব্বতবিদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং তিনিই প্রথম তিব্বতী হিসেবে স্বীকৃতি পান যিনি ডানহুয়াং থেকে প্রাপ্ত তিব্বত সাম্রাজ্যের সময়কালের প্রাচীন ঐতিহাসিক পুঁথিপত্র পরীক্ষা করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের থিও বার্নার্ড তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আমন্ত্রণ করেন কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তার যাত্রা স্থগিত করতে হয়। এই সময় তিনি বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্রের ওপর টীকাভাষ্য রচনা করেন এবং মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। ব্লো-ব্জাং-'জাম-দ্ব্যাংস-য়ে-শেস-ব্স্তান-পা'ই-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: blo bzang 'jam dbyangs ye shes bstan pa'i rgyal mtshan) নামক পঞ্চম 'জাম-দ্ব্যাংস-ব্ঝাদ-পা (ওয়াইলি: jam-dbyangs bzhad-pa) উপাধিধারী বৌদ্ধ লামা তাকে আমদো প্রত্যাবর্তন করে একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের অনুরোধ করলেও তিনি তা গ্রহণ না করে সোয়াট উপত্যকা থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভ্রমণ করে অত্যন্ত দরিদ্র ভাবে জীবনযাপন করেন।[১] শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে এসে তিনি কুলু শহরে ওবস্থিত উরুস্বতী প্রতিষ্ঠানে বিখ্যাত রুশ চিত্রকর ও অভিযাত্রী নিকোলাস রোয়েরিখের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন এবং তার পুত্র জর্জ রোয়েরিখের সঙ্গে পঞ্চদশ শতাব্দীর তিব্বতী পণ্ডিত 'গোস-লো-ত্সা-বা-গ্ঝোন-নু-দ্পাল (ওয়াইলি: gos lo tsA ba gzhon nu dpal) রচিত দেব-থের-স্ঙ্গোন-পো (ওয়াইলি: deb ther sngon po) নামক তিব্বতের ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন যা কলকাতা থেকে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।[২] গ্রীষ্মকালগুলিতে তিনি কালিম্পং শহরে গিয়ে একটি তিব্বতী সংবাদপত্র প্রকাশে সহায়তা করতেন। কালিম্পং শহরে তিনি 'ফুন-ত্শোগ্স-দ্বাং-র্গ্যাল (ওয়াইলি: phun tshogs dbang rgyal), ল্চাং-লো-চান-কুন-ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যাল-পো (ওয়াইলি: lcang lo can kung bsod nams rgyal po), স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' (ওয়াইলি: spom mda' tshang rab dga') প্রভৃতি নির্বাসিত আদর্শবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং তদদ্বারা প্রতিষ্ঠিত নুব-বোদ-লেগ্স-ব্চোস-স্ক্যিদ-স্দুগ (ওয়াইলি: nub-bod-legs-bcos-skyid-sdug) নামক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের[৩] সদস্য হন।[৪]
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভুটান ও তাওয়াং অঞ্চল হয়ে ম্যাকমোহন রেখা সংলগ্ন অঞ্চলগুলির মধ্য দিয়ে দ্গে-'দুন-ছোস-ফেলের তিব্বত প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয় হয়। দলের তরফে তাকে এই অঞ্চলগুলিতে তিব্বতের ঐতিহাসিক সীমানা নির্দেশক মানচিত্র তৈরীর নির্দেশ দেওয়া হয়। লাসা ফিরে এলে তার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য তিব্বতের প্রগতিশীল অভিজাত পরিবারগুলি থেকে তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানানো হয় এবং বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের শিল্পকলা ও ব্যাকরণ শেখানোর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই সময় তিনি বারো বছর ধরের ভারত যাত্রা থেকে সংগৃহীত গবেষণা টীকাগুলি থেকে দেব-থের-দ্কার-পো (ওয়াইলি: deb ther dkar po) নামক তিব্বতের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনায় মন দেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে প্রাচীনপন্থী অভিজাতদের দ্বারা সাম্যবাদী চীনের গুপ্তচর সন্দেহে ও নকল মুদ্রা তৈরীর মিথ্যা অভিযোগে তাকে বেত্রাঘাত ও কারাবরণের শাস্তিপ্রদান করা হয়। তার সমস্ত গবেষণালব্ধ রচনাগুলি চুরি হয়ে যায়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে দীর্ঘ চার বছর কারাবাসের পর তাকে মুক্তি দিয়ে তাকে দেব-থের-দ্কার-পো নামক অসম্পূর্ণ গ্রন্থটি রচনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি এই গ্রন্থ রচনায় নয়ুন করে উৎসাহ দেখাননি। এই সময় তিনি চামদো অঞ্চলের একজন মহিলার সঙ্গে বসবাস করে ও পুনরায় মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এই সময়েও তার নাগার্জুনের মধ্যমক দর্শনের ওপর রচিত ক্লু-স্গ্রুব-দ্গোং-র্গ্যান (ওয়াইলি: klu sgrub dgong rgyan নামক বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থটি তিব্বতের প্রাচীনপন্থী বৌদ্ধ সমাজের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে যকৃৎ বিনষ্ট হওয়ার ফলে তার মৃত্যু ঘটে।[১]
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)