দ্য লাস্ট ডেজ অব পম্পেই (ইংরেজি - The Last Days of Pompeii) হল এডওয়ার্ড জর্জ আর্ল বুলওয়ার-লিটন লিখিত একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।[১] তিন খণ্ডে প্রকাশিত এ উপন্যাসের প্রথম প্রকাশক ছিলেন রিচার্ড বেন্টলি। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ অগ্নুৎপাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ইতালির প্রাচীন নগরী পম্পেই'এর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে লিখিত এই উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রকাশিত এর পেপারব্যাক সংস্করণ প্রথম যুগের রেলওয়ে উপন্যাস হিসেবে একে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে।
খ্রিস্ট পরবর্তী প্রথম শতাব্দীর রোমান জীবনযাত্রার বেশ কিছু জীবন্ত চিত্রণ এই উপন্যাসের অন্যতম সম্পদ।[১] উপন্যাসের খলনায়ক আরবাসেস (Arbaces) এই উপন্যাসের সবচেয়ে জোরালো ও স্মরণীয় চরিত্র।[১] উপন্যাসের আরও একটি স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল এক অন্ধ ফুল বিক্রেতা বালিকা নিডিয়া (ইং: Nydia), । মার্কিন স্থপতি র্যানডলফ রজার্স ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই চরিত্রটিকেই তাঁর বিখ্যাত স্থাপত্য নিডিয়া, দ্য ব্লাইন্ড ফ্লাওয়ার গার্ল অব পম্পেই-এর বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর রজনী উপন্যাসের নামভূমিকা চরিত্র রজনীর চরিত্রাঙ্কনে এই নিডিয়ার চরিত্র দ্বারা অনেকাংশেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
পম্পেই ও হেরকুলেনিয়াম ছিল ইতালির দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আধুনিক নেপলস বা নাপোলি শহরের কাছে অবস্থিত দু'টি প্রাচীন রোমান শহর। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্নুৎপাতে শহরদু'টি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় ও প্রায় ৪ - ৬ মিটার আগ্নেয় ছাই'এর তলায় চাপা পড়ে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে একটি খাল খননের সময়ে আর্কিটেক্ট দোমেনিকো ফনতানা এখানে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পান। তবে সেই সময়েও তাকে যথাযথ গুরুত্বপ্রদান করা হয়নি। পরবর্তীকালে পুনরায় খননকার্য চালিয়ে ১৭৩৮ সালে হেরকুলেনিয়াম ও ১৭৪৮ সালে পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ পুনরাবিস্কৃত হয়।[২]
১৮৩০'এর দশকে, যখন বুলওয়ার-লিটন ইতালিতে যান, তখন ব্যাপক খননকার্যের ফলে পুনরাবিস্কৃত পম্পেই নগরী ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিখ্যাত। বুলওয়ার-লিটনেরও তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানা যায়, এই সময় মিলানে রুশ চিত্রকর কার্ল ব্রিউলভ'এর একটি বিখ্যাত চিত্র দ্য লাস্ট ডে অব পম্পেই দেখে তিনি এই বিষয়ে প্রথম আকর্ষণ বোধ করেন।[৩] এরপর তিনি পম্পেই'এর ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষ করেন ও এই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর মানুষের জীবন কল্পনায় নূতন করে সৃষ্টিতে আগ্রহবোধ করেন। তাঁর উপন্যাসের ভূমিকায় তাঁর এই সময়ের অনুভূতির কথা তিনি নিজেই লিপিবদ্ধ করেছেন -
"On visiting those disinterred remains of an ancient City, ... on viewing, still fresh and vivid, the houses, the streets, the temples, the theatres of a place existing in the haughtiest age of the Roman empire it was not unnatural, perhaps, that a writer who had before laboured, however unworthily, in the art to revive and create, should feel a keen desire to people once more those deserted streets, to repair those graceful ruins, to reanimate the bones which were yet spared to his survey; to traverse the gulf of eighteen centuries, and to wake to a second existence the City of the Dead! Pompeii!"[৪]
(সেই মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা প্রাচীন নগরীর ধ্বংসস্তূপে উপস্থিত হয়ে, ... রোমান সাম্রাজ্যের সেই উত্তুঙ্গ সময়ের বাড়িঘরদোর, রাস্তাঘাট, উপাসনালয়, নাট্যশালা, এখনও এত পরিষ্কার চোখের সামনে দেখতে পেয়ে, এটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয় যে একজন লেখক, যিনি এর আগেও, তা সে যত অযোগ্য হাতেই হোক না কেন, নিজ সৃষ্টির মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন পুরনো ইতিহাসকে আবার জীবনদানের, তাঁকে এক দুর্নিবার আকাঙ্খায় পেয়ে বসবে ঐসব পরিত্যক্ত পথঘাট আবার মানুষজনে ভরিয়ে তোলার, মহিমাণ্বিত ঐসব ধ্বংসস্তূপকে পুনরায় আগের রূপ ফিরিয়ে দেবার, চোখের সামনে পড়ে থাকা হাড়গুলিতে আবার জীবনসঞ্চারের; আঠারো শতাব্দীর দূরত্ব পেরিয়ে গিয়ে আরেকবার জীবন ফিরিয়ে দিতে সেই মৃতের শহরকে! পম্পেইকে!) উপন্যাসের মুখবন্ধে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ১৮৩৩ সালের শীতকালে, যখন তিনি ইতালির নেপলস শহরে ছিলেন, তখনই তিনি এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ করেন।[৪]
৭৯ খ্রিস্টাব্দ। গ্লকাস, এক ধনী অভিজাত আমুদে গ্রিক তরুণ, দ্বিতীয়বারের জন্য এসে পা রাখে এই ঘনবসতিপূর্ণ ব্যস্ত ছোট্ট পম্পেই নামক রোমক শহরে। হাতে প্রচুর টাকা; সময়ও অনেক। যথারীতি এ শহরে তার অনেক বন্ধু জুটে যায়: যেমন অভিজাত জুয়ারি ক্লডিয়াস, ধনী ব্যবসায়ী ডিওমিড ও আরেক ধনী রোমান স্যালাস্ট। কিন্তু তার জীবনের এই অলস নির্ঝঞ্ঝাট সহজ ছন্দ হঠাৎই বদলে যায় গভীর প্রেমে, যখন সে আয়োনির সংস্পর্শে আসে। আয়োনিও এক প্রবাসী গ্রিক তরুণী; কিন্তু ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে সে এবং তার ভাই অ্যাপিসাইডিস বেড়ে ওঠে আরবাসেস'এর অভিভাবকত্বে। আরবাসেস ছিল পম্পেই'এ অত্যন্ত জনপ্রিয় মিশরীয় দেবী আইসিসের মন্দিরের এক উচ্চ পুরোহিত, নিজেও মিশরীয় ও উচ্চবংশজাত। তার প্রভাবে অ্যাপিসাইডিসও আইসিসের মন্দিরের পুরোহিতের কাজে যোগ দেয়। কিন্তু সেখানে নানা কৌশলে মানুষকে বোকা বানানোর প্রবণতা ও বিভিন্ন অনৈতিক কাজকর্মের স্বরূপ তার সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ায় সে খুবই আশাহত হয়ে পড়ে ও পম্পেই'এর গোপন খ্রিস্টিয় সংঘের এক অন্যতম প্রধান ওলিন্থাস-এর সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
গ্লকাস ও আয়োনি প্রথম দর্শনেই পরস্পরে প্রতি আকৃষ্ট হয় ও সেই আকর্ষণ খুব দ্রুতই বদলে যায় গভীর প্রেমে। কিন্তু সে' প্রেমের পথে কাঁটাও বড় কম ছিল না। আয়োনির প্রাক্তন অভিভাবক আরবাসেস আগে থেকেই আয়োনির প্রতি আকৃষ্ট ছিল। যে মুহূর্তে সে গ্লকাসের কথা জানতে পারে, সে' মুহূর্ত থেকেই সে তার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ডিওমিডের কন্যা, ধনীর দুলালী, অর্থ ও রূপাহঙ্কারী জুলিয়া আগেরবার গ্লকাসের পম্পেই আগমণের সময় থেকেই তার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। এবার আয়োনির ভাগ্য তাকে ঈর্ষাণ্বিত করে তোলে। সে আরবাসেসের কাছে উপস্থিত হয় এমন এক জাদুপানীয়ের আকাঙ্খায়, যা গ্লকাসকে ফিরিয়ে দেবে তার কাছে। সুযোগ বুঝে আরবাসেস তার হাতে গ্লকাসকে দেওয়ার জন্য জাদুপানীয়ের বদলে তার অনুগত এক বৃদ্ধা জাদুকরীর মারফৎ তুলে দেয় এক মারাত্মক বিষ। অন্যদিকে গ্লকাসের আগেরবার পম্পেই'এ আসার সময় থেকেই অন্ধ ফুলবালিকা ক্রীতদাসী নিডিয়ার সাথেও তার একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হয়। তার নিষ্ঠুর অত্যাচারী মালিকের হাত থেকে গ্লকাস তাকে উদ্ধার করলে (কিনে নিয়ে) সেও গোপনে গ্লকাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আয়োনির প্রতি ঈর্ষা থেকে সেও জুলিয়ার সাথে সহযোগিতা করে ও সুযোগ বুঝে শেষে সেই জাদুপানীয় তার কাছ থেকে চুরি করে, যাতে তার সাহায্যে গ্লকাসকে জুলিয়ার বদলে সে নিজেই জিতে নিতে পারে।
নিডিয়ার হাতে সেই বিষ খুব অল্প পরিমাণ পান করেই গ্লকাস প্রায় সমস্ত বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলে বাইরে বেরিয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ে এক নির্জন পথে আরবাসেসের সাথে অ্যাপিসাইডিসের দেখা হলে অ্যাপিসাইডিস আইসিসের মন্দিরের সমস্ত অনৈতিক কাজকর্ম ও তার সাথে আরবাসেসের সম্পর্ক জনসমক্ষে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেয়। বিপদ বুঝে ও চারিদিকে কাউকে না দেখতে পেয়ে আরবাসেস সাথে সাথে কোমরের স্টাইলাস (লেখার জন্য ব্যবহৃত বড় কাঁটা) দিয়ে অ্যাপিসাইডিসকে কুপিয়ে হত্যা করে। ঠিক তখনই বিষের প্রভাবে একরকম বাহ্যজ্ঞানরহিত গ্লকাস সেখানে এসে উপস্থিত হলে সে চিৎকার করে লোক ডেকে সেই খুনের দায় গ্লকাসের উপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু তার অজান্তেই সেই খুনের এক সাক্ষী থেকে যায় - আইসিসের মন্দিরের এক লোভী পুরোহিত, কালেনাস। গ্লকাস গ্রেপ্তার হয়, তার সাথে গ্রেপ্তার হয় ঘটনাস্থলে অনতিপরে এসে উপস্থিত হওয়া ওলিন্থাসও। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ধর্ম অবমাননার। বিচারে দুজনেই দোষী সাব্যস্ত হয় ও শাস্তি হিসেবে তাদের অ্যাম্ফিথিয়েটারে খেলার সময় বাঘ ও সিংহের সামনে নিক্ষেপ করার কথা স্থির হয়।
এদিকে আরবাসেস যারা যারা গ্লকাসের পক্ষে কোনওরকম সাক্ষ্য দিতে পারে, নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও গ্লকাসের প্রতি তার প্রতিশোধস্পৃহার চরিতার্থতায় একে একে সবাইকেই তার নিজ গৃহে বন্দী করে। সে নিজেকে আয়োনির আইনি অভিভাবক ঘোষণা করে নিরাপত্তা ও দেখভালের নামে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় ও বন্দী করে ফেলে। নিডিয়াকেও সে বন্দী করে; শেষে কালেনাস তার কাছে গিয়ে তার সাক্ষ্য প্রকাশ করার ভয় দেখালে তাকেও সে বিপুল অর্থের লোভ দেখিয়ে এক অন্ধ কুঠুরিতে নিয়ে গিয়ে সেখানে তাকে আটকে রাখে। কিন্তু গ্লকাসকে না জেনে বিষদানে প্রবল অনুতপ্ত ও তাকে বাঁচাতে উদ্গ্রীব নিডিয়া বিষয়টি জানতে পেরে একটি চিঠির মাধ্যমে গ্লকাসের বন্ধু স্যালাস্টের সাহায্য চায়।
নির্জন কারাগারে গ্লকাস ও ওলিন্থাস কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পায় ও তাদের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। গ্লকাসও খ্রিষ্টধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। যথাসময়ে তাকে অ্যাম্ফিথিয়েটারে হাতে শুধুমাত্র একটি স্টাইলাস দিয়ে সিংহের সামনে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু আসন্ন অগ্নুৎপাত টের পেয়ে সিংহটি তাকে আক্রমণ না করে ভয়ে আবার নিজের খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এমনসময় স্যালাস্ট নিডিয়া ও কালেনাসকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে আরবাসেসের চক্রান্তের কথা সকলের সামনে ফাঁস করে দিলে উপস্থিত ক্রীড়োন্মাদ রক্তলোলুপ জনতা গ্লকাসের বদলে তক্ষুনি আরবাসেসকে সিংহের মুখে নিক্ষেপের দাবি তোলে।
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ভিসুভিয়াস শুরু করে তার ভয়াল অগ্নুৎপাত। প্রবল আতঙ্ক ও দিশাহিনতার মধ্যে সুযোগ বুঝে আরবাসেস পালায়, কিন্তু একটি স্তম্ভ তার উওর ভেঙে পড়লে তার মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে সেই আতঙ্ক ও কেওসের মধ্যেই নিডিয়া গ্লকাস, আয়োনি ও স্যালাস্টকে বন্দরের দিকে নিয়ে গিয়ে একটি জাহাজে তুলে দেয়। ফলে তারা বেঁচে যায়। কিন্তু গ্লকাসকে সে নিজে কোনওদিনই পাবে না বুঝে অপূরিত ভালোবাসার হতাশা ও জ্বালায় নিজে জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে ক্লডিয়াস, জুলিয়া, কালেনাসসহ হাজার হাজার উদভ্রান্ত মানুষের উত্তপ্ত লাভাস্রোত ও জ্বলন্ত ছাইয়ের তলায় জীবন্ত সমাধি রচিত হয়।
দশ বছর কেটে যায়। গ্লকাস এথেন্স থেকে চিঠি লিখে রোমে স্যালাস্টকে জানায় যে সে আর আয়োনি সেখানে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। নিডিয়ার স্মৃতিতে তারা সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও তৈরি করেছে।