ধর্মপাল | |
---|---|
মহারাজাধিরাজ বঙ্গপতি | |
রাজত্ব | ৭৭৭-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ |
পূর্বসূরি | গোপাল |
উত্তরসূরি | দেবপাল |
দাম্পত্য সঙ্গী | রন্নাদেবী (রাষ্ট্রকূট রাজকুমারি) |
রাজবংশ | পাল |
পিতা | গোপাল |
ধর্ম | বৌদ্ধধর্ম |
ধর্মপাল (সিদ্ধমাতৃকা লিপি: [১]) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলের পাল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক। তিনি ছিলেন পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী। রাষ্ট্রকুট সাম্রাজ্যের শাসক মহারাজ তৃতীয় গোবিন্দের নেসারী তাম্রশাসনে মহারাজ ধর্মপালকে বাঙ্গালার রাজা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।[২] মহারাজ ধর্মপাল তাঁর পৈত্রিক রাজত্বের সীমানা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেন এবং বাংলার পাল সাম্রাজ্যকে উত্তর ও পূর্ব ভারতের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন।
রামধনপুরে আবিষ্কৃত রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে ৭০৩ শকাব্দের শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার পূর্বে বা ৮০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুলাইয়ের পূর্বে তৃতীয় গোবিন্দ গুর্জ্জর রাজকে পরাজিত করেন।[n ১] তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষের একটি তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, তৃতীয় গোবিন্দ দ্বিতীয় নাগভট নামক গুর্জর রাজকে পরাজিত করেন এবং ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ তার নিকট নতশির হয়েছিলেন।[৪] কিন্তু কাম্বে নগরে আবিষ্কৃত তৃতীয় গোবিন্দের তাম্রশাসন থেকে দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর অনুমান করেছিলেন যে, ধর্মপাল দশম শতাব্দীর সময়কালের শাসক ছিলেন,[৫] যদিও ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্মপাল দ্বিতীয় নাগভট এবং তৃতীয় গোবিন্দের সমসাময়িক ছিলেন।[৬] প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের মতে ধর্মপাল ৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন[৭] বলে মনে করলেও মহারাষ্ট্রের সিরুর[৮] ও নীলগুণ্ড[৯] নামক স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপি এই মত খণ্ডন করে তাকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করে যেখান থেকে জানা যায়, ৭৮৭ শকাব্দে বা ৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষের রাজত্বের বাহান্ন বছর পূর্ণ হয়, অর্থাৎ তৃতীয় গোবিন্দ আনুমানিক ৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ধর্মপাল তার সমসাময়িক হলে তিনি ৮০৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেই সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ৭৯০ থেকে ৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ধর্মপালের সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল হিসেবে অনুমান করেছেন[১০]:১১২ এবং নীহাররঞ্জন রায়ের মতে তিনি ৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনারূঢ় হন।[১১]:৩৮৫। এছাড়া রমেশচন্দ্র মজুমদার ৭৭০ থেকে ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে[১২], আবদুল মোমিন চৌধুরী ৭৮১ থেকে ৮২১ খ্রিষ্টাব্দে[১৩], বিন্দেশ্বরী প্রসাদ সিনহা ৭৮৩ থেকে ৮২০ খ্রিষ্টাব্দে[১৪] এবং দীনেশচন্দ্র সরকার ৭৭৫ থেকে ৮১২ খ্রিষ্টাব্দে[১৫] ধর্মপালের রাজত্বের সময়কালকে নির্ণয় করেছেন।
পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম গোপাল ও তার স্ত্রী দেদ্দাদেবীর পুত্র ধর্মপাল পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্মপাল প্রতিহার বংশীয় বৎস্যরাজের নিকট পরাজিত হন। বৎস্যরাজ এবং ধর্মপালও অনতিকাল পরেই রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব ধারাবর্ষের নিকট পরাজিত হন। কিন্তু যুদ্ধের পর ধ্রুব ধারাবর্ষ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে প্রতিহারদের পরাজয়ের সুযোগ নিয়ে ধর্মপাল তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে নেন।[১১]:৩৮৫ এরপর তিনি কান্যকুব্জ আক্রমণ করে ইন্দ্ররাজ বা ইন্দ্রায়ুধের পরিবর্তে চক্রায়ুধকে ঐ রাজ্যের সিংহাসনে আসীন করেন,[n ২] যার ফলে ভোজ, মৎস্য, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গান্ধার, কীর প্রভৃতি জনপথের রাজারা তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এরফলে তার অধিকার বর্তমান মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের সিন্ধু নদ উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।[n ৩] কিন্তু এরপরেই গুর্জ্জর রাজ দ্বিতীয় নাগভট প্রথমে চক্রায়ুধ ও পরে ধর্মপালকে পরাস্ত করলে, [n ৪] ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ গুর্জ্জরদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। ৮০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুলাইয়ের পূর্বে তৃতীয় গোবিন্দ গুর্জর রাজকে পরাজিত করলে,[৩] ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ তার নিকট নতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন।[৪] কিন্তু এরপর গুর্জর রাজ তৃতীয় গোবিন্দের সঙ্গে কোন কারণে বঙ্গপতি ধর্মপালের বিবাদ উপস্থিত হলে তৃতীয় গোবিন্দ তাকে পরাজিত করেন।[n ৫] তৃতীয় গোবিন্দ দক্ষিণাপথে ফিরে গেলে মহারাজ ধর্মপাল সমগ্র উত্তরাপথের অধীশ্বর হন এবং বঙ্গপতি মহরাজ ধর্মপালের সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।[n ৬]
ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট রাজবংশের পরবেলের কন্যা রণ্ণাদেবীকে বিবাহ করেন। মধ্য ভারতে পথারি নামক স্থানে পরবেলের রাজত্বকালে ৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, পরবেলের পিতার নাম ছিল কক্করাজ এবং পিতামহের নাম ছিল জেজ্জ।[২১] পরবেল নবম শতাব্দীর তৃতীয় ভাগেও জীবিত ছিলেন বলে রামপ্রসাদ চন্দ মনে করেন যে, ধর্মপাল প্রৌঢ়াবস্থায় রণ্ণাদেবীকে বিবাহ করেছিলেন,[২২] কিন্তু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই মতে সংশয় প্রকাশ করেছেন।[১০]:১১৫ বর্তমান দিন পর্যন্ত ত্রিভুবনপাল ও দেবপাল নামক তার দুই পুত্রের নাম পাওয়া গেছে। জ্যেষ্ঠ পুত্র ত্রিভুবনপাল[২৩], পিতার রাজত্বকালেই মৃত্যুবরণ করেন এবং কনিষ্ঠ পুত্র দেবপাল পিতার উত্তরাধিকারী হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
ধর্মপাল ছিলেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তিনি বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় পরে এক উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়।[২৪] তিনি সোমপুর ও পাহাড়পুর মহাবিহারও প্রতিষ্ঠা করেন। বিহারের ওদন্তপুরীতে তিনি এক দর্শনীয় মঠও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি পঞ্চাশটি বৌদ্ধ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।[২৫]
ইতিহাসবিদদের মতে এই কৌলীন্য প্রথা হর্ষবর্ধনের সময়কাল হতে শুরু হয়েছে। কনৌজকে কেন্দ্র করে তিনটি সাম্রাজ্যের স্থাপনা হয়েছিলো। রাজ্যসীমার দক্ষিণ দিকে ছিল রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য, পূর্ব দিকে ছিল পাল সাম্রাজ্য এবং গুর্জর-প্রতিহার শাসক বৎসরাজার হাতে।[২৬] পাল সম্রাট ধর্মপাল সর্বপ্রথম বাংলায় কৌলীন্য প্রথা প্রচলন করেছিলেন[২৭]। তাই তাকে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনকারী হিসেবে ইতিহাসবিদগণ আখ্যায়িত করেন। এসময় অবিভক্ত বঙ্গে রাঢ় ও বরেন্দ্র এই দুই অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন কুলীনরা বসবাস করতেন।
পূর্বসূরী প্রথম গোপাল |
পাল সম্রাট ধর্মপাল |
উত্তরসূরী দেবপাল |