নারীবাদী বিজ্ঞানদর্শন (Feminist philosophy of science) হচ্ছে নারীবাদী দর্শন এর একটি শাখা যা জানার চেষ্টা করে, কীভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জ্ঞানার্জন সমাজে লিঙ্গ ও লৈঙ্গিক ভূমিকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। নারীবাদী বিজ্ঞান দার্শনিকগণ প্রশ্ন করেন, কীভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জ্ঞান নিজেই প্রভাবিত হয়, এবং সামাজিক ও পেশাগত কাঠামোতে এতে আপোশ করা হয়, যেই কাঠামোতে গবেষণা ও জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত ও অস্তিত্ববান হয়ে থাকে। নারীবাদী বিজ্ঞানদর্শনকে বিজ্ঞানদর্শন এবং নারীবাদী বিজ্ঞান পাণ্ডিত্যের সাধারণ ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়,[১] এবং ১৯৭০ এর দশকে এটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় মনোযোগ আকর্ষণ করে।
নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্ব প্রায়ই "অবস্থিত জ্ঞান" (situated knowledge) এর উপরে জোড় দেয়,[২] যা কোন বিষয়ের উপর কোন ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। নারীবাদী দার্শনিকগণ প্রায়ই শিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রে নারী বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানে নিম্ন-প্রতিনিধিত্ব এবং বর্তমান বিজ্ঞানের পুরুষকেন্দ্রিক পক্ষপাতের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোকে পুরুষের জ্ঞানীয় রীতি ও যৌক্তিক রীতির সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হবার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্ব প্রস্তাব করে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোতে নারীসুলভ চিন্তাধারা এবং বিচারধারাকে যুক্ত করলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত হবে, যেখানে এই নারীসুলভ চিন্তাধারা ও বিচারধারা বর্তমান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহে অবমূল্যায়িত। নারীবাদী বিজ্ঞানদর্শনের সমর্থনকারীগণ বলেন, এটি এমন বিজ্ঞানদর্শন তৈরিরও পথ নির্দেশনা দিতে পারে যা জনসাধারণের কাছে বিজ্ঞানদর্শনকে আরও ভাল করে তুলে ধরবে এবং জনসাধারণ এর ফলে আরও বেশি করে বিজ্ঞানদর্শনের আলোচনায় প্রবেশাধিকার লাভ করবে। নারীবাদী বিজ্ঞানদর্শন এর চর্চাকারীগণ বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রগুলোতে লৈঙ্গিক সমতাকে উৎসাহিত করতে এবং নারী বিজ্ঞানীদের অর্জনগুলোর অধিক স্বীকৃতি দেবার উপায় অনুসন্ধান করেন।
সমালোচকগণ বলেন, নারীবাদী বিজ্ঞানদর্শনের সমর্থনকারীদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিসমূহ আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠতা বা বিষয়গততার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।[৩] সমালোচকগণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সর্বজনবিহিত বস্তুনিষ্ঠতা এবং জ্ঞান তৈরির "মূল্য-বিহীন"[৪] পদ্ধতির জন্য এর সফলতাকে জোড় দেন।
১৯৬০ এর দশকে নারীবাদী বিজ্ঞান শাস্ত্র থেকে নারীবাদী বিজ্ঞান দর্শন জন্মলাভ করে। যাই হোক, ১৯৮০ এর দশকে নারীবাদী বিজ্ঞান দর্শন নিজস্ব পরিচয়ের বিকাশ ঘটে। নারীবাদী বিজ্ঞান দর্শন নিয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল "সাইনস" ("signs") নামের নারীর একটি একাডেমিক জার্নাল থেকে, যার শিরোনাম ছিল "নারী, বিজ্ঞান, এবং সমাজ" ("নারী, বিজ্ঞান, এবং সমাজ")।[৫] ১৯৭৮ সালে ক্যাথেরিন স্টিম্পসন এবং জোয়ান বারস্টিন এটি প্রকাশ করেন। আজ যা নারীবাদী বিজ্ঞান শাস্ত্র হিসেবে স্বীকৃত তা তিনটি ক্ষেত্রে আলোচনা করত: বিজ্ঞানে লৈঙ্গিক পক্ষপাত, বিজ্ঞানে নারীর ইতিহাস, এবং বিজ্ঞানে নারীর মর্যাদা বিবেচনা করে সামাজিক বিজ্ঞানগত উপাত্ত এবং জননীতি।[৬] এই তিনটি বিষয় আধুনিক সময়ের নারীবাদী বিজ্ঞান আলোচনায়ও প্রধান বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।
১৯৮০ এর দশকে নারীবাদী বিজ্ঞান শাস্ত্র আরও বেশি দার্শনিক ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে, এবং বিজ্ঞানের মূল জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণাগুলোকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে। নারীবাদী বিজ্ঞান শাস্ত্রের এই পরিবর্তনের কারণ ছিল শিক্ষায়তনিক নারীবাদের অনেক ক্ষেত্রেই এরকম পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে নারীবাদে বিজ্ঞান শাস্ত্রে "বিজ্ঞানে নারী" এবং "বিজ্ঞানের নারীবাদী সমালোচনা" নামে দুটো শাখার সৃষ্টি হয়। নারীবাদী শিক্ষায়তনিক হেলেন লংগিনো এবং এভেলিন হ্যামন্ডস দ্বারা রচিত ১৯৯০ সালের গ্রন্থ "কনফ্লিক্টস এন্ড টেনশনস ইন দ্য ফেমিনিস্ট স্টাডি অফ জেন্ডার এন্ড সায়েন্স"-এ এই বিষয়গুলো নথিবদ্ধ রয়েছে।
৯০ এর দশকের শেষ নাগাদ, নারীবাদী বিজ্ঞান শাস্ত্র ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই শিক্ষায়তনিক শাখায় অনেক বিশিষ্ট পণ্ডিতের উপস্থিতি ছিল। দার্শনিক জন সার্ল ১৯৯৩ সালে নারীবাদকে "শিক্ষার একটি পরিসরের" চেয়ে আরও বেশি করে "অগ্রসর হবার একটি কারণ" হিসেবে চিহ্নিত করেন।[৭]