নার্সিস মন্টারিওল ই এস্টারিওল | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ সেন্ট মার্টি দ্য প্রোভিনসালস (বর্তমানে বার্সেলোনা) | (বয়স ৬৫)
পেশা | উদ্ভাবক, প্রকৌশলী, শিল্পী, রাজনীতিবিদ |
পরিচিতির কারণ | ডুবোজাহাজ প্রবক্তা. ইক্টিনেও ১ ও ইক্টিনেও ২ আবিষ্কার করেন। |
নার্সিস মন্টারিওল ই এস্টারিওল (কাতালান উচ্চারণ: [nərˈsiz muntuɾiˈɔɫ i əstəriˈɔɫ], স্পেনীয়: Narciso Monturiol y Estarriol; ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৮১৯ – ৬ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৫) একজন স্প্যানিশ বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং প্রকৌশলী। তিনিই প্রথম বিমান পরিচালনসাধ্যতা এবং অন্তর্দহ ইঞ্জিন (যা ডুবোজাহাজ চালায়) আবিষ্কার করেন।
মন্টারিওল ই এস্টারিওল স্পেনের কাতালোনিয়ার ফিগুয়েরস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন পিপানির্মাতার ছেলে ছিলেন। মন্টারিওল কার্ভেরার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং বার্সেলোনায় ১৮৪৫ সালে আইন বিভাগে ডিগ্রীলাভ করেন। তিনি ডুবো পরিভ্রমন বিষয়ক বিভিন্ন মৌলিক সমস্যার সমাধান করেন। বস্তুত মন্টারিওলই প্রথম সম্পূর্ণ মৌলিক ডুবোজাহাজ আবিষ্কার করেন।[১][২]
মন্টারিওল আইনে পাস করলেও তিনি কখনই আইন বিষয়ে কাজ করেন। বরং তিনি তার মেধাকে লেখনী ও প্রকাশনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তিনি ১৮৪৬ সালে একটি প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন এবং একই বছরে তিনি এমিলাকে বিয়ে করেন। তিনি নানাবিধ জার্নাল এবং পুস্তিকা তৈরি করেন এবং সেগুলোতে নারীবাদ, শান্তিবাদ এবং কমিউনিজম বিষয়ক তার ভিত্তিগত বিশ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি লাঁ মাদ্রে দ্য ফ্যামিলিয়া নামক সংবাদপত্রে "নারীকে পুরুষের স্বৈরশ্বাসন থেকে মুক্তি"র প্রতিজ্ঞা করেন এবং তিনি লাঁ ফ্রাটার্নিদাদ সংবাদপত্রও তৈরি করেন যা ছিল স্পেনের সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট সংবাদপত্র।
আবদো তেরাদেসের সাথে মন্টারিওলের বন্ধুত্ব তাকে প্রজাতান্ত্রিক দলে যোগদানে উৎসাহিত করে এবং তার বন্ধুতালিকায় যোগ দেয় যেমন সংগীতকার জোসেপ আনসেম ক্লেভ এবং প্রকৌশলী ও সংস্কারক ইডিফনস সিরদা। মন্টারিওল উটোপিয়ান চিন্তাবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী ইটিয়েন ক্যাবেট-এর একজন উৎসাহী সমর্থক হয়ে ওঠেন। তিনি ক্যাবেটের ল্লা ফ্রাটার্নিদাদ চিন্তাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং তার উপন্যাস ভয়েজ এন ইকারিয়েকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেন। লা ফ্রাটার্নিদাদকে ঘিরে এক চক্র গড়ে ওঠে। তারা যথেষ্ট টাকা ওঠায় এবং তাদের মধ্যে একজন ক্যাবেটের উটোপিয়ান সম্প্রদায় ইকারিয়ানস-এ যুক্ত হয়।
১৮৪৮-এর বিপ্লব-এ তার একটি প্রকাশনাকে সরকার দমন করে এবং তাকে ফ্রান্সে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৮৪৯ সালে তিনি যখন বার্সেলোনাতে ফিরে আসেন, সরকার তার কাজকর্মকে নিবারণ করে এবং তিনি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল জগতে ফিরে আসেন।
কাডাকুয়েস-এ থাকাকালীন তিনি প্রবাল কাটার মত বিপজ্জনক কাজ করতে গিয়ে একজন মানুষকে পানিতে ডুবে মরতে দেখেছিলেন। এই ঘটনা তাকে ডুবোজাহাজ নির্মাণের কথা মাথায় এনে দেয়। ১৮৫৭ সালে সেপ্টেম্বরে তিনি আবারও বার্সেলোনায় ফিরে যান এবং কাতালোনিয়া ও স্পেনের প্রথম বাণিজ্যিক সমাজ তৈরি করেন। তারাই মন্টারিওল, ফোন্ট, আল্টাডফিল ইয়ে সিয়া নামের ডুবোজাহাজ তৈরির কাজ শুরু করেন। তাদের মূলধন ছিল ১০, ০০০ পেঁসো।
১৮৫৮ সালে মন্টারিওল দ্য ইক্টিনেও অর ফিশ-শিপ নামক বৈজ্ঞানিক প্রকল্পটি উপস্থাপন করেন। বার্সেলোনার উপকূলে তার প্রথম ডুবোজাহাজ ইক্টিনেও ১, সেপ্টেম্বর, ১৮৫৯ সালে প্রথম পানিতে নামে।
ইক্টিনেও ১-এর মাত্রা ছিল ৭ মি (২৩ ফু) দৈর্ঘ্য, ২.৫ মি (৮ ফু ২ ইঞ্চি) প্রস্থ এবং ৩.৫ মি (১১ ফু) গভীর। এটি প্রবাল উৎপাদনের জন্য সহায়ক ছিল। সম্ভবত এটি ১৮৬১ সালে পানিতে নামা উইলিয়াম বাউয়ের-এর ব্রান্ডটচার-এর আদিরূপ থেকে অনুপ্রাণিত হয় কারণ মন্টারিওল ডুবোজাহাজ বিষয়ক যতরকম জ্ঞান ছিল, তার সবই অর্জন করেছিলেন। জাহাজের বা বিমানপাতের অগ্রভাগ ছিল প্রবাল কাটার নানাবিধ যন্ত্রপাতিতে পরিপূর্। ১৮৫৯ সালের গ্রীষ্মে মন্টারিওল ইক্টিনেওর মাধ্যমে ২০-এরও বেশিবার পানিতে নামেন। তার সঙ্গী ছিলেন তার ব্যবসায়িক সঙ্গী এবং জাহাজনির্মাণকর্মী। ইক্টিনেও ১ বেশ ভালভাবেই চলে, তবে এর উচ্চগতি ছিল চূড়ান্ত হতাশজনক কারণ এটি মানুষের পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করত।
এই প্রযুক্তিগত সাফল্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে কিন্তু এটি সরকার থেকে কোনরুপ সহায়তা লাভ করতে পারে না। এর ফলশ্রুতিতে মন্টারিওল "জাতির কাছে পত্র" লেখে যেন স্পেনের জনগণ এই প্রকল্পকে সমর্থন করে। এর অর্থতোলার প্রকল্প ব্যাপক সফলতা লাভ করে এবং স্পেন ও কিউবার জনগণ প্রায় ৩০০, ০০০ পেঁসো দান করে।
১৮৬২ সালের জানুয়ারিতে ইক্টিনেও ১ প্রায় পঞ্চাশবার পানিতে নামার পর একটি দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়। একটি কার্গো জলযান নোঙ্গরকৃত ইক্টিনেও ১কে ধাক্কা মারলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে চাঁদা থেকে যে টাকা ওঠে, তাতে লা ন্যাভিগেশন সাবমারিনা কোম্পানি ইক্টিনেও ২-এর কাজ শুরু করে দেয়।
বার্সেলোনার ম্যারিন জাদুঘরে ইক্টিনেও ১-এর একটি আধুনিক প্রতিরুপ (রেপ্লিকা) রাখা আছে।
২রা অক্টোবর, ১৮৬৪ সালে ইক্টিনেও ১-এর উন্নতরুপ ইক্টিনেও ২ উদ্ভাবিত হয়। ২০ই মে ১৮৬৫ সালে ইক্টিনেও ২ মানবশক্তির অধীনে তৈরি হয়। এর গভীরতা ছিল ৩০ মিটার (৯৮ ফু)। মানবক্ষমতার উপর অখুশি হয়ে মন্টারিওল তাপ ও অক্সিজেনকে মিশিয়ে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করেন। এই মিশ্রণ থেকে উৎপন্ন তাপ একটি ছোট বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করবে যা কয়লা দিয়েও চালানো যাবে।
মন্টারিওলের চূড়ান্ত প্রকল্পটি তার ইঞ্জিনের জন্য ধাতবনির্মিত নিজস্ব স্থান তৈরি করে। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার জন্য এর নির্মাণ ছিল প্রশ্নাতীত। এর পরিবর্তে তিনি কাঠনির্মিত স্থানে ইক্টিনেও ২-এর ইঞ্জিন রাখেন এবং প্রাথমিক পরীক্ষা ও উপপাদন করেন।
২২শে অক্টোবর, ১৮৬৭ সালে ইক্টিনেও ২ সর্বপ্রথম পানির নিচে যাত্রা শুরু করে গড়ে ৩.৫ নট (৪.০ মা/ঘ) এবং এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ৪.৫ নট (৫.২ মা/ঘ)। দুই মাস পর ১৪ই ডিসেম্বর, মন্টারিওল জাহাজকে ছোট করে অবাত ইঞ্জিন পরীক্ষা করেন, তবে পানিতে নয়।
২৩শে ডিসেম্বর মন্টারিওলের কোম্পানি দেউলিয়া হয় এবং আর কোন প্রকার মূলধনকে উৎসাহিত করতে পারেননি।[৩] তার প্রধান ঋণদাতা প্রদত্ত টাকা ফেরত চাইলে বাধ্য হয়েই তাকে তার সম্পূর্ণ সম্পত্তি সমর্পণ করতে হয় এমনকি তার ইক্টিনেও ২কেও। ঋণদাতা অপর এক ব্যবসায়ী এবং কর্তৃপক্ষকে সমস্তকিছু বিক্রি করে দেন এবং ট্যাক্স বিলের মাধ্যমে তার নতুন মালিক নির্ধারণ করেন। তারা ডুবোজাহাজটিকে টুকরো টুকরো করে ছেঁটে ফেলে।[৪] এর একটি প্রতিরূপ বার্সেলোনা এর উপকূলে দেখা যায়।
১৮৬৮ সালে মন্টারিওল পুনরায় রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসেন। তিনি পার্টিদো ফেডেরাল-এর সদস্য হয়ে তিনি ১৮৭৩ সালে প্রথম স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রর গণপরিষদের ডেপুটি হন এবং এর পরপরই কয়েক মাসের জন্য মাদ্রিদের ফেব্রিকা ন্যাশনাল দেল টিম্ব্রে (জাতীয় ডাকটিকিট কারখানা)র পরিচালক হন। সেখানে তিনি আঠালো কাগজ তৈরির প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়ন করেন এবং তরান্বিতও করে তোলেন। মন্টারিওলের অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যেঃ তিনি লেখা নকলের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, একটি ক্রমশ প্রকাশযন্ত্র, একটি দ্রুত-গোলানিক্ষেপণ ক্ষমতা সম্পন্ন কামান আবিষ্কার করেন। এছাড়াও তিনি বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ক্ষমতাবৃদ্ধি, একটি পাথর-কাটার যন্ত্র, মাংস সংরক্ষণের যন্ত্র এবং সিগারেট নির্মাণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন।[৫]
মন্টারিওল ১৮৮৫ সালে সেন্ট মারিয়া দ্য প্রোভেন্সালস, বর্তমান বার্সেলোনার শহরতলীতে পরলোকগমন করেন।
১৯৪০ সালের আগ পর্যন্ত কোন প্রকার অবাত পরিচালনসাধ্যতা ডুবোজাহাজ তৈরি হয়নি। ১৯৪০ সালে জার্মান নেভি একই নীতিভিত্তিক একটি পরীক্ষা করেন। পরীক্ষাটি করা হয় পরীক্ষামূলক ভি-৮০ ডুবোজাহাজ-এর উপর ওয়াল্টার ঘূর্ণযন্ত্র ব্যবহার করে। নটিলাস নামক পারমাণবিক শক্তিধারী ডুবোজাহাজে সর্বপ্রথম এই স্বাধীন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
স্পেন ১৯৮৭ সালে তার মৃত্যুর শতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি ডাকটিকিটে তাকে সম্মান জানায়।[৬]
বার্সেলোনার (এভিংগুয়্যেডা ডায়াগোনাল-ক্যারিয়ার জিরোনা) এবং ফিগুয়েরস-এর রাম্বলায় (তার জন্মগ্রহণকারী শহর, ফিগুয়েরেঙ্ক-এ সালভাদর দালির জন্য বিখ্যাত) তার দুটো ভাস্কর্য রয়েছে।
স্প্যানিশ নৌবাহিনী তার নাম অমর করে রাখার জন্য তাদের সৃষ্ট প্রথম ডুবোজাহাজ এস-৮২ নার্সিসো মন্টারিওল তার নামানুসারে রাখা হয় (নির্মাণগত কারণে এস-৮১ আইজ্যাক পিরাল চালু হয়)।