নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ বুগরা খান | |
---|---|
বাংলার গভর্নর; পরবর্তীতে স্বাধীন সুলতান | |
রাজত্ব | ১২৮১–১২৮৮
|
পূর্বসূরি | তুগরল তুগান খান |
উত্তরসূরি | রুকনউদ্দীন কায়কাউস |
বংশধর | মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ রুকনউদ্দীন কায়কাউস |
পিতা | গিয়াসউদ্দিন বলবন |
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ (কিংবা মুহাম্মদ) বুগরা খান (ফার্সি: ناصر الدین بغرا خان) বাংলার প্রাদেশিক শাসনকর্তা (১২৮১–১২৮৭) এবং পরবর্তীকালে বাংলার (মূলত লখনৌতির) একজন স্বাধীন সুলতান (১২৮৭–১২৯১) ছিলেন। তিনি দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের পুত্র। বাংলার গভর্নর থাকার আগে বুগরা খান ভারতের পাঞ্জাবের সামানা এবং সুমামের গভর্নর ছিলেন।[১] তারই নামানুসারে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার নামকরণ করা হয়।[২]
বুগরা খানের পিতা দিল্লির মামলুক সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে (১২৬৬—১২৮৭ খ্রি.) ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গলরা ক্রমাগত আক্রমণ চালাতে থাকে। এসময় মোঙ্গলদের ঠেকাতে সুলতান বলবন তার দুই পুত্র যুবরাজ মুহাম্মদ ও নাসিরউদ্দিন বুগরা খানকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবে অবস্থান নিয়ে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। যুবরাজ মুহাম্মদ ও বুগরা খানের উপরেই ছিল সীমান্ত রক্ষার মূল দায়িত্ব, তবে সুলতান নিয়মিত তাদের তদারকি করতেন।
সেসময় বর্তমান পাকিস্তানি পাঞ্জাবের মুলতান ও দিপালপুরের শাসনকর্তা ছিলেন বলবনের একজন সেনাপতি শের খান। তার মৃত্যুর পর বলবন যুবরাজ মুহম্মদকে মুলতান ও দিপালপুরের এবং বুগরা খানকে বর্তমান ভারতীয় পাঞ্জাবের সামানা ও সুমামের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১২৭৯ সালে মোঙ্গল বাহিনী শতদ্রু নদী অতিক্রম করে ফেললে যুবরাজ মুহম্মদ ও বুগরা খান এবং আরেক সেনাপতি মালিক মোবারকের যৌথ আক্রমণে মোঙ্গলরা পরাজয় বরণ করে। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে বুগরা খান বাংলার গভর্নর থাকাকালীন মোঙ্গল সেনাপতি তামারের আক্রমণে বুগরা খানের বড় ভাই যুবরাজ মুহাম্মদ নিহত হন।[৩]
বুগরা খান তার পিতা গিয়াসউদ্দিন বলবনকে লখনৌতির গভর্নর তুগরল তুগান খানের বিদ্রোহ দমন করতে সহায়তা করেছিলেন। বিদ্রোহ নির্মুল করতে তাদের প্রায় তিন বছর সময় লাগে। যুদ্ধে তুগান খান পরাজিত ও নিহত হন।
তারপর সুলতান বলবন তাকে বঙ্গের শাসক হিসেবে লখনৌতিতে প্রেরণ করেন। তবে দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার আগে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন বিদ্রোহীর পরিণাম কী সে সম্পর্কে বুগরা খানকে সতর্ক করে যান। নিজ পুত্রের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে না পারায় তিনি তার বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ দুজন সেনাপতিকে তার পুত্রের রাজকার্যে সাহায্য করার জন্য রেখে যান।[১] পরবর্তীতে সুলতানের জ্যেষ্ঠপুত্র তথা বুগরা খানের বড় ভাই যুবরাজ মুহাম্মদ মঙ্গোলদের সাথে এক যুদ্ধে নিহত হন। তাই সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন বুগরা খানকে দিল্লির সুলতান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে তিনি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পরিবর্তে বাংলার প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন বুগরা খানের পরিবর্তে যুবরাজ মুহম্মদের পুত্র কায়খসরুকে পরবর্তী সুলতান মনোনীত করেন।[৪][৫] কিছুদিন পরেই সুলতান বলবন মৃত্যুবরণ করেন।
১২৮৭ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পরে বুগরা খান লখনৌতি তথা বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজের স্বাধীন সুলতান হিসেবে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। অন্যদিকে দিল্লিতে সালতানাতের উজিরে আজমসহ (প্রধানমন্ত্রী) অভিজাতবর্গ বুগরা খানের ভাতুষ্পুত্র কায়খসরুর পরিবর্তে বুগরা খানের পুত্র মুইজউদ্দিন কায়কোবাদকে দিল্লির সুলতান নিযুক্ত করেন। শাসনকার্যে কায়কোবাদের অদক্ষতার কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজামউদ্দিন সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এর ফলে দিল্লিতে অরাজকতার সৃষ্টি হয়।[১]
এর ফলে বুগরা খান দিল্লির অরাজকতা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি পুত্র কায়কোবাদের নীতিবোধ জাগ্রত করতে দিল্লির দিকে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। একই সময়ে, উজিরে আজম নিজামউদ্দিন তার বাবার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মুইজউদ্দিন কায়কোবাদকেও একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত কিংবা বাধ্য করেছিলেন। দুই সেনাবাহিনী সরযূ নদীর তীরে মিলিত হয়। তবে কায়কোবাদ নিজামউদ্দিনের চাপ উপেক্ষা করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মুখোমুখি না হয়ে বিনাযুদ্ধেই সমঝোতায় পথ বেছে নেন। বুগরা খান তখন পুত্র মুইজউদ্দিন কায়কোবাদকে রাজকার্য পরিচালনা সম্পর্কে বিভিন্ন উপদেশ দেন। পিতার পরামর্শে কায়কোবাদ নাজিমউদ্দিনকে উজির আজমের পদ থেকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি পিতাকে বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তারপর বুগরা খান লখনৌতিতে ফিরে আসেন। প্রখ্যাত সুফি কবি এবং বুগরা খানের সভাকবি আমীর খসরু এই ঘটনা নিয়ে কিরান-উস-সাদাইন (দুই তারকার মিলন) গ্রন্থ লিখে ঘটনাটিকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছেন।[১] উল্লেখ্য, বুগরা খান নিজে প্রাজ্ঞ ও বিদ্বান লোক ছিলেন এবং একই সাথে বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সভাকবি আমীর খসরু তাই তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।[৬]
বুগরা খানের অধীনে বাংলার স্বাধীন সুলতানি অঞ্চল লখনৌতি ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রসারিত হয় এবং রাজ্যে একটি দৃঢ় প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলা রাজ্যের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়।[১] এসময় তিনি রাজ্যকে বিহার, সাতগাঁও, বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ) এবং দেবকোট (উত্তরবঙ্গ) এই চারভাগে বিভক্ত করে শাসন পরিচালনা করেছেন।[৭]
বুগরা খানের পুত্র মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ দুরারোগ্য পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে রাজপরিবারের অভিজাত সম্প্রদায় কায়কোবাদের পুত্র শামসউদ্দিন কায়ুমারসকে সুলতান ঘোষণা করে খলজি অভিজাত জালালউদ্দিন খলজীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু জালালউদ্দিন খলজি তা জানতে পেরে দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১২৯০ সালে কায়কোবাদ ও কায়ুমারস দুজনকেই হত্যা করে নিজেই সিংহাসন দখল করে।[৪] পুত্র ও পৌত্রের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে বুগরা খান মর্মাহত হয়ে ১৮৯১ সালে বাংলার সিংহাসন ত্যাগ করে আরেক পুত্র রুকনউদ্দীন কায়কাউসকে বাংলার সিংহাসনে বসান।[৮] এর ফলে দিল্লিতে বলবনি শাসনের অবসান ঘটলে বাংলায় স্বাধীনভাবে বলবনি শাসন টিকে থাকে।
বুগরা খানের বংশধরেরা ১৩২৪ সাল পর্যন্ত[৯] (মতান্তরে ১৩০০ সাল পর্যন্ত) লখনৌতি তথা বাংলা শাসন করেছিল। তার উত্তরসূরী রুকনউদ্দীন কায়কাউস তার মুদ্রায় নিজেকে সিকান্দার-এ-সানি (দ্বিতীয় আলেকজান্ডার) ও সুলতান ইবনে সুলতান ("সুলতানের পুত্র সুলতান") ঘোষণা করেছিলেন, যা বুগরা খানের শাসনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে।[১০]
পূর্বসূরী তুগরল তুগান খান |
বাংলার মামলুক গভর্নর এবং স্বাধীন সুলতান ১২৮১–১২৯১ |
উত্তরসূরী রুকনউদ্দীন কায়কাউস |