যখন একটি নিউক্লিয় বিক্রিয়ার কারণে পরবর্তীতে আরও এক বা একাধিক বিক্রিয়া ঘটে এবং এই বিক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হয় তখন তাকে নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া বলে। ভারি আইসোটোপ(যেমন- ২৩৫U) এর বিভাজন এক ধরনের নিউক্লিয় বিক্রিয়া। যেকোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার চেয়ে নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়ায় কয়েক লক্ষ গুণ বেশি শক্তি নির্গত হয়।
জার্মান রসায়নবিদ ম্যাক্স বডেনস্টেইন ১৯১৩ সালে প্রথম রাসায়নিক শৃঙ্খল বিক্রিয়া প্রস্তাব করেন যা নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া প্রবর্তনের আগেই বোঝা গিয়েছিল ।[১] রাসায়নিক বিস্ফোরণের সময় যে ক্রমবর্ধিত উচ্চহারে বিক্রিয়া সংঘঠিত হয় তার জন্য যে রাসায়নিক শৃঙ্খল বিক্রিয়াই দায়ী তা আগেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন।
বলা হয়ে থাকে হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী লিও সিলার্ড ১৯৩৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর প্রথমে নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়ার ধারণা অনুমান করেছিলেন।[২] এর কিছুদিন আগে ১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়। সিলার্ড বুঝতে পেরেছিলেন যে যদি একটি নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় নিউট্রন উৎপন্ন হয় এবং তা পরবর্তীতে আরো নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটায় তবে এই প্রক্রিয়াটি একটি স্ব-অবিরাম প্রক্রিয়া । যেহেতু তখনো ফিশন বিক্রিয়া আবিষ্কৃত হয় নি তাই সিলার্ড তার রাসায়নিক বিক্রিয়ার কৌশল হিসেবে ফিশনকে প্রস্তাব করেননি। এর পরিবর্তে সিলার্ড হালকা আইসোটপের মিশ্রণ প্রস্তাব করেন যা প্রচুর পরিমাণে নিউট্রন উৎপন্ন করে । পরের বছরে তিনি তার সরল পারমাণবিক চুল্লীর জন্য একটি পেটেন্ট দায়ের করেন। [৩]
১৯৩৬ সালে সিলার্ড বেরিলিয়াম ও ইন্ডিয়াম দিয়ে শৃঙ্খল বিক্রিয়া তৈরির ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালান । ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে বিজ্ঞানী অটো হান এবং ফ্রিজ স্ট্রসম্যান পারমাণবিক ফিশন আবিষ্কার ও প্রমাণ করেন।[৪] ১৯৩৯ সালে সিলার্ড এবং এনরিকো ফার্মি ইউরেনিয়ামে নিউট্রন বহুলিপিকরণ আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন যে এই কৌশলে পারমাণবিক শৃঙ্খল বিক্রিয়া সম্ভব।[৫] এই আবিষ্কার আইনস্টাইন-সিলার্ড পত্র প্রেরণে সিলার্ডকে উৎসাহিত করে। এই পত্র ছিল সিলার্ড কর্তৃক প্রেরিত ও আলবার্ট আইনস্টাইন স্বাক্ষরিত যা মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে নাৎসি জার্মানি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে এই মর্মে প্রেরিত সতর্কতা পত্র ।[৬][৭]
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাগ ফিল্ডের পাদদেশে র্যাকেট খেলার কোর্টে ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বরে এনরিকো ফার্মির নেতৃত্বে একটি দল শিকাগো পাইল-১ (সিপি-১) পরীক্ষামূলক চুল্লী দ্বারা প্রথম কৃত্রিম ও টেকসই নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া তৈরি করে। ফারমির পরীক্ষাগুলো ছিল আর্থার এইচ. কম্পটন এর ধাতুবিদ পরীক্ষাগারের ম্যানহাটান প্রকল্পের অংশ। পরবর্তীতে এই পরীক্ষাগারের নাম দেয়া হয় আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি এবং এটি হারনেসিং ফিশনের উপর গবেষণা চালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।[৮]
১৯৫৬ সালে আরকানাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পল কুরোদা এই স্বীকার্য দেন যে প্রাকৃতিক ফিশন চুল্লীর অস্তিত্ব থাকতে পারে। যেহেতু পারমাণবিক শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটতে পানি এবং ইউরেনিয়াম এর মত শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পদার্থের প্রয়োজন হয়,সেহেতু পৃথিবীর ভূত্বকে এসব শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটা সম্ভব। কুরোদার অনুমান যে সত্যি তা প্রমাণিত হয় ১৯৭২ সালে আফ্রিকার গ্যাবনের অকলোতে প্রাকৃতিক নিউক্লিয় ফিশন বিক্রিয়া আবিষ্কার হওয়ার পর। [৯]
নিউট্রন এবং বিভাজ্য আইসোটোপ(যেমন-235U) এর মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার ফলে ফিশন চেইন বিক্রিয়া ঘটে। এই চেইন বিক্রিয়া ঘটতে বিভাজ্য আইসোটোপ থেকে উৎপন্ন নিউট্রনের সাথে সাথে পরবর্তীতে এইসব নিউট্রন শোষণের জন্য আরো বিভাজ্য আইসোটোপ প্রয়োজন। যখন একটি পরমাণুতে নিউক্লিয় ফিশন ঘটে,তখন বিক্রিয়া থেকে বেশ কিছু নিউট্রন বের হয়ে যায়। এসব নিউট্রন চারপাশের মাধ্যমের সাথে ক্রিয়া করে এবং আরো বিভাজ্য জ্বালানির থাকলে, সেখানে শোষিত হয় এবং আরো ফিশন ঘটায়। এভাবে এই চক্র চলতে থাকে এবং এটি একটি স্ব-স্থিতিশীল প্রক্রিয়া।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লীতে কয়েকটি অনাবশ্যক ধাপে অত্যন্ত নিরাপত্তার সাথে পারমাণবিক বিক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাছাড়া পারমাণবিক চুল্লীর মজ্জায় বেশকিছু উপযুক্ত পদার্থ এবং ইউরেনিয়াম সংরক্ষণে অতিরিক্ত পদক্ষেপের কারণে সকল নিরাপত্তা বেষ্টনী নষ্ট হয়ে গেলেও কোন বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। অন্যদিকে পারমাণবিক অস্ত্র এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে উচ্চ গতি এবং তীব্রতায় বিক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং একবার শুরু হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ভালোভাবে ডিজাইন করা হলে, এই অনিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়া বিস্ফোরণ সহকারে শক্তির নির্গমন ঘটায়।
বিস্ফোরণাকারে শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য উচ্চমানের জ্বালানিকে তার অতিক্রান্ত আকারের চেয়ে(আসলে অতিক্রান্ত ভর) বড় আকারে সমৃদ্ধ করে পারমাণবিক অস্ত্র বানানো হয়। অন্যদিকে শক্তি গ্রহণের নিমিত্তে বানানো নিউক্লিয় ফিশন চুল্লীগুলোতে সাধারণত নিম্নমানের জ্বালানি অর্থাৎ স্বল্প ইউরেনিয়াম যুক্ত অক্সাইড যৌগ(যেমন-UO2) ব্যবহার করা হয়।
যখন কোন ভারী পরমাণুতে ফিশন ঘটে,তখন এটি দুই বা ততোধিক ভগ্নাংশে পরিণত হয়। এর সাথে কয়েকটি মুক্ত নিউট্রন, গামা রশ্মি, নিউট্রিনো এবং অনেক বেশি পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়। ফিশন ভগ্নাংশ এবং নির্গত নিউট্রনগুলোর মোট স্থির ভর মূল পরমাণু ও তার উপর আপতিত নিউট্রনের মোট স্থির ভরের(অবশ্য ফিশন ভগ্নাংশগুলো স্থির অবস্থায় থাকে না) তুলনায় কম হয়। এই ভরের পার্থক্যটুকু E=Δmc² এই সমীকরণ অনুযায়ী শক্তিতে পরিণত হয়।
নির্গত শক্তি =
আলোর গতি,c, অনেক উচ্চ হওয়ার কারণে খুব অল্প ভর পার্থক্যেই অনেক বেশি পরীমাণে সক্রিয় শক্তি(যেমন-ফিশন ভগ্নাংশগুলোর গতি শক্তি) নির্গত হয় । এই শক্তি(বিকিরণ ও তাপরূপে) হারানো ভরকে বহন করে অর্থাৎ যখন তা বিক্রিয়ার আধার ত্যাগ করে, তখন এর ভর সংরক্ষিত হয়। সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়া কয়েক eV শক্তি(যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুতে ইলেক্ট্রনের বাঁধাই শক্তি ১৩.৬ eV) নির্গত হয়। কিন্তু পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ায় কয়েক লক্ষ eV শক্তি নির্গত হয়।
গড় নির্গত শক্তি এবং নির্গত নিউট্রন সংখ্যাসহ দুটি প্রচলিত ফিশন বিক্রিয়া নিচে দেয়া হলঃ
উল্লেখ্য এই সমীকরণগুলো কেবল স্বল্পগতির নিউট্রনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । গড় নির্গত শক্তি এবং নির্গত নিউট্রনের সংখ্যা আপতিত নিউট্রনের বেগের ফাংশন। [১০] এছাড়া, এই সমীকরণগুলোতে নিউট্রিনোর শক্তি বাদ দেয়া হয়েছে কারণ এই অতিপারমাণবিক কণাগুলো খুবই নিস্ক্রিয় এবং সাধারণত সিস্টেমে শক্তি নির্গমন করে না।
উত্তেজিত নিউট্রনের আয়ুষ্কাল,I, বলতে নিউট্রন নির্গমনের গড় সময়কালকে বোঝায়। অর্থাৎ নিউট্রন শোষণ অথবা সিস্টেম থেকে বেরিয়ে যেতে তার যে সময় লাগে তাই উত্তেজিত নিউট্রনের আয়ুষ্কাল। এখানে আয়ু বা জীবনকাল শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে কারণ অনেক সময় নিউট্রন নির্গমনকে জন্ম এবং পরবর্তীতে শোষণকে বলা হয় মৃত্যু। তাপীয়(স্বল্পগতির নিউট্রন) ফিশন চুল্লীতে উত্তেজিত নিউট্রনের আয়ুষ্কাল ১০−৪ সেকেন্ডের কাছাকাছি হয় এবং দ্রুতগতির ফিশন চুল্লীর ক্ষেত্রে তা ১০−৭ সেকেন্ডের ক্রমে পৌছায়। [১০] এত অতি ক্ষুদ্র আয়ুষ্কাল এমন যে ১ সেকেন্ডে, ১০,০০০থেকে ১০,০০০,০০০ নিউট্রনের আয়ু শেষ হয়ে যেতে পারে। চুল্লীতে গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন সকল ধরনের নিউট্রনকে হিসাবে নিয়ে এই গড় উত্তেজিত নিউট্রনের আয়ুষ্কাল হিসাব করা হয়। অন্যদিকে মোটামুটিভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিউট্রনকে হিসাবে নিয়ে কার্যকর উত্তেজিত নিউট্রনের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হয়।[১১]
ফিশনের ফলে উৎপন্ন নিউট্রনের গড় সময়কালকে গড় উৎপাদনকাল, Λ বলে। [১০] গড় উৎপাদনকাল, উত্তেজিত নিউট্রনের আয়ুষ্কাল থেকে ভিন্ন কারণ গড় উৎপাদনকাল হিসাব করা হয় শুধুমাত্র সেসকল নিউট্রনকে নিয়ে যেগুলো ফিশন বিক্রিয়া ঘটায়। এই দুই সময়কালকে নিচের সমীকরণ দ্বারা সম্পর্কযুক্তঃ
এখানে, k হল কার্যকর নিউট্রন গুণক, যা পরবর্তীতে বর্ণিত হয়েছে।
কার্যকর নিউট্রন গুণক, k, হল ফিশন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন গড় নিউট্রন সংখ্যা যেগুলো আরো ফিশন ঘটায়। বাকি নিউট্রনগুলো হয় ফিশন বহির্ভূত বিক্রিয়া দ্বারা শোষিত হয় অথবা শোষিত না হয়ে সিস্টেম থেকে বের হয়ে যায়। একটি নিউক্লিয় চেইন বিক্রিয়া কীভাবে ঘটছে তা k এর মান নির্ধারণ করেঃ