নিডারমাইয়ার–হেন্টিগ অভিযান

মহেন্দ্র প্রতাপ (কেন্দ্রে)-এর সাথে বৈঠকে (বাঁ থেকে ডানে, যথাক্রমে), মৌলভি বরকতুল্লাহ, ওয়ার্নার অটো ফন হেন্টিগ, কাজিম বে এবং ওয়াল্টার রোর। কাবুল, ১৯১৬।

"নিডারমায়ার-হেন্টিগ অভিযান" ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কেন্দ্রীয় শক্তি কর্তৃক আফগানিস্তানে প্রেরিত একটি কূটনৈতিক অভিযাত্রা, যা সংগঠিত হয় ১৯১৫-১৯১৬ সালে। এর উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে এবং কেন্দ্রীয় শক্তির অংশগ্রহণ করতঃ ভারতের ব্রিটিশ রাজকে আক্রমণ করতে তাদের অনুপ্রাণিত করা। এই অভিযানটি ছিল "হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের" অংশবিশেষ, যেটি ছিল ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানোর লক্ষ্যে একটি ভারত-জার্মান যৌথ পরিকল্পনা। কাগজে-কলমে এর নেতৃত্বে ছিলেন নির্বাসিত ভারতীয় যুবরাজ রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ। অভিযানটি ছিল জার্মানিউসমানীয় খেলাফতের একটি যৌথ উদ্যোগ, এবং এর নেতৃত্ব দান করেন জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদ্বয় অস্কার নিডারমায়ার এবং ওয়ার্নার অটো ফন হেন্টিগ। এই প্রতিনিধি দলের অন্যেরা ছিলেন "বার্লিন কমিটি" নামক একটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী দলের সদস্যগণ, যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মৌলভি বরকতুল্লাহ এবং চম্পকরাম পিল্লাই। তুর্কী প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন কাজিম বে, যিনি তুরস্কের রাজনৈতিক নেতা এনভার পাশার একজন বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন।

ব্রিটেন এই অভিযানকে তাদের সাম্রাজ্যের জন্যে একটি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ মনে করে। ১৯১৫ সালের গ্রীষ্মে এই অভিযানের সদস্যগণ পারস্যের মধ্য দিয়ে গমন করার সময়, ব্রিটেন ও তাদের মিত্র রুশ সাম্রাজ্য তাঁদের পাকড়াও করার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। অতঃপর ব্রিটিশরা গোপনে গোয়েন্দা তত্পরতা ও কূটনৈতিক অভিযান শুরু করে। ভারতের তৎকালীন বড়লাট, চার্লস হার্ডিঞ্জ ও রাজা ৫ম জর্জ ব্যক্তিগতভাবে আফগানিস্তানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার তত্পরতা চালান।

এই অভিযানটি এর মূল লক্ষ্য অর্জনে, তথা জার্মানি ও তুরস্কের পক্ষে আমির হাবিবুল্লাহ খানের নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানকে যুদ্ধে অবতীর্ণ করতে ব্যর্থ হলেও, এর ফলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সূত্রপাত হয়। এই অভিযানের ফলশ্রুতিতে আফগানিস্তানে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক গোলযোগ ও সংস্কার কর্মসূচি, যার চূড়ান্ত ফলাফলস্বরূপ ১৯১৯ সালে আমির একজন আততায়ীর হাতে খুন এবং এতে করে ৩য় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। এর ফলে উদীয়মান বলশেভিক রাশিয়া তাদের "কালমিক কর্মসূচি" আরম্ভ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া মহাদেশে সমাজতান্ত্রিক অভ্যূত্থানের গোড়াপত্তন করা এবং ব্রিটিশ রাজের অবসান ঘটানো। নিডারমায়ার-হেন্টিগ অভিযানের আরেকটি ফলাফল ছিল, ভারতীয় জনগণের মধ্যে যে স্বাধীনতার চেতনার উদ্ভব হয়েছে তা খতিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক "রাওলাত কমিটি" গঠন; এছাড়াও এ অভিযানের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভিন্ন চোখে দেখতে থাকে।

পটভূমি

[সম্পাদনা]

১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয় যখন যুদ্ধরত সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির প্রতি মৈত্রীতা থেকে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। তদুপরি জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম অনুপ্রবেশ করলে তার ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একের পর এক সামরিক ঘটনাপ্রবাহে এবং জার্মানি ও উসমানীয় খেলাফতের মধ্যকার মৈত্রীকে কেন্দ্র করে, নভেম্বর মাসে রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তুরস্ক তখন কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে এবং "এন্টেন্ট"-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ জার্মানি ও তুরস্ক তাদের শত্রুপক্ষকে দূর্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যসমূহকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে, যার অন্তর্গত ছিল রাশিয়ার কর্তৃত্বে থাকা তুর্কেস্তান ও ব্রিটিশদের শাসনাধীন ভারত। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা এসমস্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক আলোড়নের সূত্রপাত করে।[]

ভারতীয় জাতীয়তাবাদীগণ বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে, তাদের ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের জন্যে জার্মানি, তুরস্ক, পারস্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহে তাদের ঘাঁটি গড়ে। ভারতের জাতীয়তাবাদীগণের সাথে একারণে জার্মানির সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, যাকে জার্মানি যুদ্ধের সময় কাজে লাগায়। ১৯১৩ সাল থেকেই জার্মানিতে প্রকাশনা শুরু হয় বিভিন্ন বিপ্লবী প্রকাশনা ও প্রচারণা, যাতে জার্মানির সাথে ব্রিটিশদের চলমান যুদ্ধের কথা বর্ণিত হয় এবং একথাও উল্লেখ করা হয় যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জার্মানি সমর্থন দান করতে পারে।[] যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরেই জার্মানির বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয়দের বিভিন্ন দুঃখ-দুর্দশা ও তাদের ওপর ব্রিটিশদের শোষণ-নিপীড়নের খবর প্রকাশিত হতে থাকে।[]

জার্মানির চ্যান্সেলর থিওবল্ড ফন বেথম্যান-হোলওয়েগ উক্ত কর্মকাণ্ডে উত্সাহ প্রদান করেন।[] এই কর্মসূচিটির নেতৃত্ব দান করছিলেন প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ ম্যাক্স ফন ওপেনহাইম, যিনি জার্মানির "প্রাচ্য গোয়েন্দা সংস্থার" প্রধান ছিলেন এবং "বার্লিন কমিটিরও" সদস্য ছিলেন, পরি যার নামকরণ করা হয় "ভারতীয় স্বাধীনতা কমিটি"। হিন্দু-জার্মান যৌথ পরিকল্পনা মোতাবেক "বার্লিন কমিটি" নির্বাসনে থাকা ভারতীয় স্বাধীনতাবাদীদের অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক উপদেষ্টা সরবরাহ করে সাহায্য করে, যা সরবরাহ করে জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর; সাহায্যপ্রাপ্ত ভারতীয় দলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল উত্তর আমেরিকায় তত্পর থাকা "গদর পার্টি"। এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল পাচার করে ভারতীয় স্বাধীনতাবাদীদের সাহায্য করার পরিকল্পনা করা হয়।[][][][]

তুরস্কের সুলতান ৫ম মেহমেদ, যাঁকে মুসলিম বিশ্বের বহু জনগণ তাঁদের খলিফা বলে গণ্য করতেন।

তুরস্ক ও পারস্যে ১৯০৯ সালে জাতীয়তানবাদীদের কার্যকলাপের সূচনা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সর্দার অজিত সিং ও সুফি আম্বা প্রসাদ।[] ১৯১০ সালের রিপোর্টসমূহ থেকে প্রমাণ মেলে যে, জার্মানি তখন থেকেই তুরস্ক, পারস্য ও আফগানিস্তান হয়ে ব্রিটিশ ভারতে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই জার্মানি তুরস্ক ও পারস্যের সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নয়ন করা আরম্ভ করে। ফন ওপেনহাইম একজন গুপ্তচর হিসেবে তুরস্ক ও পারস্যের অভ্যন্তরীণ মানচিত্র অঙ্কন করতে থাকেন।[] ১৮৯৮ সালে জার্মানির কাইজার ইস্তাম্বুল, দামেস্ক ও জেরুসালেম ভ্রমণে যান, যাতে জার্মান-তুরস্ক সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়, এছাড়াও নিজেকে তিনি ইসলামের মিত্র হিসেবে তুলে ধরেন, উল্লেখ্য যে, তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ভারতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনগণের বসবাস ছিল। এসকল মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় জার্মান "প্রাচ্য গোয়েন্দা সংস্থা" কাইজার উইলহেমকে "হাজি উইলহেম" বলে প্রচার করতে থাকে, এতে করে মুসলমানদের মধ্যে এ কথা রটে যায় যে, কাইজার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন এবং পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্জ পালন করেছেন।[]

১৯১৩ সালে এনভের পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে সেনাবিপ্লব সংঘটিত হয়, যাতে সুলতান ৫ম মেহমেদ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ এসে পড়ে সামরিক জান্তার হাতে। এই নতুন সরকার ধর্মনিরপেক্ষ হলেও, মুসলিম বিশ্বের ওপর তুরস্ক ঐতিহ্যগতভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ১৯১৬ সালের আরব বিদ্রোহে তুরস্ক হেজাজ ও সেই সাথে পবিত্র মক্কা নগরীর নিয়ন্ত্রণ হারায়। সুলতানের "খলিফা" পদবীকে বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমানই ন্যায্য বলে মনে করতেন, যার মধ্যে অন্তর্গত ভারত ও আফগানিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠী।[]

বিশ্বযুদ্ধ তুরস্ক জার্মানির পক্ষ গ্রহণ করে এবং "এন্টেন্ট শক্তি" (ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া) ও এদের দখলকৃত বিস্তর মুসলিম ভূখণ্ডকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানায়। এনভের পাশার পরামর্শে সুলতান জিহাদ ঘোষণা করেন।[] তাঁর আশা ছিল এতে করে মুসলিম বিশ্বে একটি বৃহদাকার অভ্যুত্থানের সূচনা হবে, বিশেষ করে ভারতে। এ ঘোষণার অনুবাদ বার্লিনে প্রচারকার্যের জন্যে প্রেরিত হয়, যেখান থেকে ব্রিটিশ, ফরাসি ও রুশ নিয়ন্ত্রিত মুসলিম সেনাদের মাঝে এই জিহাদের ঘোষণা প্রচার করা হয়।[] তবে, এই ঘোষণা শোনার পরেও মুসলিম বিশ্বে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি, তুরস্ক ও কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে সারাবিশ্বের মুসলিম জনগণ একজোট হয়নি।

যুদ্ধের প্রথমভাগে, আফগানিস্তানের আমির জহির শাহ্ তাঁর রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা ঘোষণা করেন।[] আমির আশঙ্কা করেন যে, সুলতানের জিহাদের আহ্বান তাঁর প্রজাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে তুরস্কের যুদ্ধে অংশগ্রহণে আফগানিস্তান ও পারস্যে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মনোভাব জাগ্রত হয়।[] ১৯০৭ সালের ইঙ্গ-রুশ মৈত্রীজোট আফগানিস্তানকে ব্রিটিশ প্রভাব বলয়ের অন্তর্গত বলে মনস্থির করে এবং আমির ব্রিটিশদের তরফ থেকে আর্থিক সাহায্য প্রাপ্ত হন। যদিও, আফগানিস্তানের ওপর ব্রিটিশদের বাস্তবিক কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আফগানিস্তানই একমাত্র রাষ্ট্র যার দ্বারা ভারত আক্রমণের আশঙ্কা ছিল, অন্তত ব্রিটিশরা এই ধারণা পোষণ করত। আফগানিস্তানকে তাই তারা হুমকিস্বরূপ মনে করত।[১০]

আফগানিস্তানে প্রথম অভিযাত্রা

[সম্পাদনা]

১৯১৪ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে, জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাগণ নিথিল-ইসলামি আন্দোলনকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে দূর্বল করে দেয়া এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।[] দুই সপ্তাহ পরে, বার্লিনে এই সিদ্ধান্তকে জোরালো সমর্থন দেন জার্মানপ্রেমী সুইডিশ পরিভ্রাজক স্‌ভেন হেডিন। আগস্টে সাধারণ সভার স্মারকপত্রে এই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতার সপক্ষে মত দেয়া হয়, এ ধারণা পোষণ করা হয় যে, আফগানিস্তান থেকে সম্ভাব্য হামলা পরিচালনা করলে তা ভারতে একটি বিপ্লব সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারে।[]

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ভারতে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে থাকে। কতিপয় হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁদের বিদ্রোহে সহায়তা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে গোপনে কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেন।[][১০] নিখিল ভারতীয় ইসলামী আন্দোলন, বিশেষতঃ দারুল উলুম দেওবন্দ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একটি সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনার পরিকল্পনা করেন, যার সহায়তা করার কথা আফগানিস্তান ও কেন্দ্রীয় শক্তির।[১১][১২] দেওবন্দী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান, হেজাজের তুর্কী গভর্নর গালিব পাশার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন। আরেক দেওবন্দী নেতা মাওলানা ওবায়েদুল্লাহ সিন্ধী, কাবুলে আফগানিস্তানের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল মদীনা নগরীতে একটি ইসলামী সেনাসদর দপ্তর স্থাপন করবেন এবং এর ভারতীয় বিভাগ অবস্থান করবে কাবুলে। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন মাহমুদুল হাসান।[১২] কাবুলে অবস্থানকালীন মাওলানা ওবায়েদুল্লাহ এই সিদ্ধান্তে অবতীর্ণ হন যে, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে মনোনিবেশ করলে তা মূলতঃ বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের জন্যে সহায়ক হবে।[১৩] মাওলানা ওবায়েদুল্লাহ আফগানিস্তানের আমিরকে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তাব করেন।[১৪][১৫] ১৯১৬ সালে আটক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাওলানা আবুল কালাম আজাদও এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[১১]

১৯১৪ সালে এনভার পাশা আফগানিস্তান অভিযানের পরিকল্পনা করেন। তিনি এ অভিযানকে বৈশ্বিক ইসলামী আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখেন, যাতে কিছু জার্মান সহায়তা রয়েছে। এ অভিযানে জার্মান প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ছিলেন অস্কার নিডারমায়ার এবং উইলহেম ওয়াসমাস, যাঁদের বাছাই করেন ওপেনহাইম ও জিমারম্যান।[] প্রায় এক হাজার তুর্কি সৈন্য ও জার্মান উপদেষ্টা সংবলিত দলটি পারস্য হয়ে আফগানিস্তান অভিমুখে যাত্রা করে, যেখানে তারা স্থানীয় গোষ্ঠীসমূহকে ইসলামী জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে।[১৬]

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির স্থলভাগ হয়ে তুরস্কে পৌঁছানোর জন্যে জার্মান প্রতিনিধি দলটি একটি কৌশলের আশ্রয় নেয়, নিরপেক্ষ রোমানিয়া অতিক্রম করার সময় তারা একটি ভ্রমণকারি সার্কাস-দলের ছদ্মবেশ ধারণ করে। তবে তাদের এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় যখন তাদের "তাঁবুর খুঁটির" মধ্য থেকে রেডিও সরঞ্জাম বেরিয়ে পড়ে, ফলে রোমানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রেডিওসহ ইত্যাদি সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে।[১৬] এরপর এসকল সরঞ্জাম নতুন করে সরবরাহ করতে কয়েক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে যায়, এ পুরো সময়ে ইস্তাম্বুলে প্রতিনিধি দল অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। জার্মান প্রতিনিধিদেরকে প্রস্তাব দেয়া হয় তুর্কি পোশাক পরিধান করার, যাতে তাদের ইসলামি পরিচয়কে অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরা যায়, তবে জার্মানগণ এ প্রস্তাব মানতে নারাজ হন, যা অভিযানের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।[১৭] এই অভিযানটি শেষ পর্যন্ত বাতিল ঘোষণা করা হয়।

তবে এই অভিযানের উদ্যোগটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে, ওয়াসমাস পারসীয় গোত্রসমূহকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে ইস্তাম্বুল ত্যাগ করেন। পারস্যে ব্রিটিশদের নজর এড়াতে গিয়ে, ওয়াসমাস নিজের সংকেত-বইটি হারিয়ে ফেলেন। ব্রিটিশরা উক্ত সংকেত বইটি উদ্ধার করাতে তারা জার্মানদের সকল গোপনীয় বার্তার মর্মোদ্ধারে সক্ষম হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯১৭ সালের বিখ্যাত "জিমারম্যান টেলিগ্রাম"। ওয়াসমাসের বিদায়ের পর নিডারমায়ার প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দান করেন।[১৭]

দ্বিতীয় অভিযাত্রা

[সম্পাদনা]

১৯১৫ সালে দ্বিতীয় একটি অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়, যাতে অংশ নেয় জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর ও ভারতীয় "বার্লিন কমিটির" নেতৃবৃন্দ। এ পর্যায়ে জার্মানি হিন্দু-জার্মান পরিকল্পনায় জোরালোভাবে জড়িত ছিল এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অস্ত্র ও অর্থসাহায্য প্রদার করে সহায়তা করছিল। জার্মানির সঙ্গে ভারতের যোগসাজশ স্থাপনকারী ভারতীয় মৌলবাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে লালা হর দয়ালকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল এই অভিযানে ভারতের প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব প্রদান করার। তিনি এতে অসম্মতি জানালে, ভারতীয় যুবরাজ রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে এর নেতা ঘোষণা করা হয়।[১৮]

সদস্যবৃন্দ

[সম্পাদনা]

মহেন্দ্র প্রতাপ ছিলেন ভারতীয় রাজ্য মুর্সান ও হাথরসের রাজ্যপ্রধান। ১৯০০ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন, এবং ১৯০৬ সালের কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি যোগদান করেছিলেন। ১৯০৭ ও ১৯১১ সালে তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হন, এবং ১৯১২ সালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকা আন্দোলনে বিপুল পরিমাণে অর্থ সাহায্য প্রদান করেন।[১৯] যুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে মহেন্দ্র প্রতাপ জেনেভা গমন করেন, সেখানে তিনি বার্লিন কমিটির বীরেন্দ্রনাথ চট্টপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের উত্সাহে ও কাইজার কর্তৃক লিখিত একটি পত্রপাঠ করে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তা করতে রাজি হন[২০] এই শর্তে যে, তাঁর সাথে চুক্তি হবে স্বয়ং কাইজারের। মহেন্দ্র প্রতাপের সাথে কাইজারের একটি গুপ্ত বৈঠকের আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রতাপ অভিযানটির নামমাত্র নেতৃত্ব দানে রাজি হন।[২১][২২]

জার্মান প্রতিনিধিদলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নিডারমায়ার ও ফন হেন্টিগ।[১৭] ফন হেন্টিগ ছিলেন একজন প্রুশিয়ান সামরিক কর্মকর্তা, যিনি ১৯১০ সালে বেইজিং-এ এবং ১৯১২ সালে ইস্তাম্বুলে প্রেরিত সামরিক কূটনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন। তিনি ফার্সি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন, ১৯১৩ সালে তেহরানে তিনি জার্মান রাষ্ট্রদূতের সচীব হিসেবে নিযুক্ত হন। ফন হেন্টিগ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গনে "৩য় প্রুশিয়ান ক্যুরাসিয়ার বাহিনীর" একজন লেফটেনেন্ট হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, সেখান থেকে ফেরত এনে তাঁকে এই অভিযানে প্রেরণ করা হয়।

ফন হেন্টিগের ন্যায় নিডারমায়ারও যুদ্ধের পূর্বে ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত ছিলেন এবং তিনিও ফার্সি ও স্থানীয় ভাষাসমূহে সাবলীল ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্যাভারিয়ান গোলন্দাজ বাহিনীর একজন সামরিক কর্মকর্তা এবং তিনি জার্মানির "এরল্যাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের" একজন স্নাতক ছিলেন। যুদ্ধের দুই বছর পূর্বে তিনি পারস্য ও ভারত সফর করেন।[১৭] প্রথম আফগান অভিযাত্রা বাতিল হবার পর তিনি পারস্যে ফিরে এসে আদেশের অপেক্ষায় থাকেন।[১৭] নতুন অভিযানের সামরিক প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন নিডারমায়ার, এ অভিযানটি পরিচালিত হয় বিপজ্জনক পারসীয় মরুভূমি এলাকা দিয়ে, যে অঞ্চলটি শত্রুপক্ষ ব্রিটেন ও রাশিয়ার কর্তৃত্বে ছিল।[১৯][২২][২৩] এ অভিযানে এছাড়াও যোগ দেন জার্মান কর্মকর্তা গুন্টার ভোইট ও কার্ট ওয়াগনার।

মহেন্দ্র প্রতাপকে সঙ্গ দেন বার্লিন কমিটির ভারতীয় সদস্যগণ, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চম্পকরাম পিল্লাই এবং ইসলামী পণ্ডিত ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মৌলভি বরকতুল্লাহ। বরকতুল্লাহ বহুকাল ধরে ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, ১৯০৩ সাল থেকে তিনি লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের ভারতীয় ছাত্র সংগঠন "ইন্ডিয়া হাউসের" সাথে তিনি কাজ করেন। ১৯০৯ সালে তিনি জাপান গমন করেন এবং সেখানে তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী তত্পরতা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দুর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। ১৯১১ সালে তিনি ইস্তাম্বুল গমন করেন। তবে, ব্রিটেনের কূটনৈতিক চাপে টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ১৯১৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন, পরে তিনি বার্লিনে গিয়ে বার্লিন কমিটিতে যোগদান করেন। ১৮৯৫ সালে আফগানিস্তানের আমির হাবিবুল্লাহ খানের ভ্রাতা নসরুল্লাহ খানের সাথে সাক্ষাৎ হয় মৌলভি বরকতুল্লাহ্‌র।[২৪]

মহেন্দ্র প্রতাপ জার্মানির জোসেন নগরীর সৈন্যশিবির থেকে তাঁর সহচর হিসেবে আফ্রিদি গোত্রের ছয়জন হিন্দু সদস্য ও পাঠান স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের বাছাই করেন।[২৪] বার্লিন থেকে এই অভিযাত্রী দল যাত্রা শুরু করার পূর্বে তাদের সাথে যোগদান করেন আরো দুইজন জার্মান: মেজর ডক্টর কার্ল বেকার, যিনি ক্রান্তীয় এলাকার রোগব্যাধি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং ফার্সিতে কথা বলতে পারতেন, এবং দ্বিতীয়জন হলেন ওয়াল্টার রোর, একজন নবীন বণিক, যিনি তুর্কি ও ফার্সিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন।[২৫]

সংগঠন

[সম্পাদনা]

অভিযাত্রী দলটির নামমাত্র প্রধান ছিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ, এবং জার্মানির কাইজারের প্রতিনিধি ছিলেন ফন হেন্টিগ। মহেন্দ্র প্রতাপকে সঙ্গে যাত্রা করা ও আফগান আমিরের নিকট জার্মানির কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করা ছিল হেন্টিগের দায়িত্ব।[১৭][২২] অভিযানটির অর্থায়নে ইস্তাম্বুলের "ডইচ ব্যাংকের" একটি হিসাবে ১,০০,০০০ পাউন্ড স্টার্লিং সমমূল্যের স্বর্ণ গচ্ছিত করা হয়। এছাড়াও আমিরের জন্যে উপহার হিসেবে স্বর্ণ ও অন্যান্য উপহারসামগ্রী প্রেরণ করা হয়, যার মধ্যে ছিল রত্নখচিত হাতঘড়ি, স্বর্ণের ঝর্ণা কলম, রত্নখচিত রাইফেল, দূরবীন, ক্যামেরা, আলোকচিত্র-প্রক্ষেপন যন্ত্র (প্রোজেক্টর) এবং একটি অ্যালার্ম ঘড়ি।[২২][২৫]

অভিযানটি তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব অর্পিত হয় তুরস্কে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত, হান্স ফন ওয়াঙ্গেনহাইমের ওপর। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় তাঁর হয়ে এ দায়িত্ব পালন করেন যুবরাজ জু হোয়েনলোয়া-ল্যাঙ্গেনবার্গ।[১৯] ১৯১৫ সালে ওয়াঙ্গেনহাইমের মৃত্যুর পর, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন কাউন্ট ফন উল্ফ-মেটারনিচ। তবে অভিযাত্রার সঙ্গে তাঁর কোন যোগাযোগই ছিল না।[১৯]

যাত্রা

[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ এবং রুশ গোয়েন্দাদের নজর এড়ানোর জন্য দলটি ভাগ হয়ে যায় এবং ভিন্ন ভিন্ন দিনে যাত্রা করে পৃথকভাবে ইস্তাম্বুলে পৌঁছে।[২৫] প্রতাপ এবং হেন্টিগ ১৯১৫ এর বসন্তের শুরুতে একজন জার্মান আর্দালী এবং একজন ভারতীয় পাচককে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, বুখারেস্ট, সোফিয়া এবং আদ্রিয়ানোপল হয়ে তাঁরা ইস্তাম্বুলে পৌঁছান। ভিয়েনায় তাঁরা মিশরের পদচ্যুত গভর্নর আব্বাস হিলমির সাথে মিলিত হন।[২৫]

পারস্য এবং ইস্পাহান

[সম্পাদনা]

ইস্তাম্বুলে ১৭ এপ্রিলে পৌঁছে, ভ্রমণের পরবর্তী প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটি পেরা প্যালেস হোটেলে সপ্তাহ তিনেক অপেক্ষা করে। এই সময়টায় প্রতাপ এবং হেন্টিগ এনভার পাশার সাথে দেখা করেন এবং সুলতানের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ করেন। এনভার পাশার আদেশে একজন তুর্কী সেনা কর্মকর্তা, লেফটেন্যান্ট কাসিম মে, অভিযানে তুর্কী প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। কাসিম বে মারফত আফগান আমির এবং ভারতীয় দুটি রাজ্যের রাজ পরিবার বরাবর দাপ্তরিক চিঠি পাঠানো হয়[২৬]। অভিযানে আমেরিকা থেকে আগত দুইজন আফগানও যোগদান করেন।[২৬]

প্রায় ২০ জন সদস্যের দলটি ইস্তাম্বুল ছাড়ে ১৯১৫ সালের মে মাসের শুরুর দিকে। নির্মানাধীন বাগদাদ রেলপথ ধরে বাগদাদ পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তারা বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করেন। হেন্টিগের মতে, তাঁরা ঘোড়সওয়ারে টরাস পর্বতের মধ্য দিয়ে যেই পথটি ধরে যাত্রা করেছিলেন, সেপথে ইতোপূর্বে গ্রিক সেনাপতি আলেক্স্যান্ডার, সন্ত পল এবং প্রুশিয়ার সম্রাট প্রথম ফ্রেডরিক যাত্রা করেছিলেন।[২৬] ভরা বন্যার মধ্য দিয়ে ফুরাত নদী পার করে অবশেষে মে মাসের শেষের দিকে দলটি বাগদাদে পৌঁছে।[২৬]

বাগদাদের ওপর ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর সুসংবদ্ধ হওয়ার কারণে দলটি এখানে এসে আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতাপ এবং হেন্টিগের দলটি জুনের পয়লা তারিখেই পারস্যের সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করে। ৮ দিন পরে তুর্কী সেনাপতি রউফ ওরবায় তাদেরকে পারস্যের শহর ক্রিন্দে স্বাগত জানায়।[২৬] ১৯১৫ সালের ১৪ই জুন, ক্রিন্দ ছেড়ে তাঁরা তুরস্কাধীন কারমানশাহে পৌঁছান। কিছু সদস্য ম্যালেরিয়া এবং ক্রান্তীয় রোগে আক্রান্ত হলে তাদেরকে ডাঃ বেকারের তত্বাবধানে রেখে হেন্টিগ যাত্রা শুরু করেন তেহরানের দিকে। উদ্দেশ্য- নিডারমায়ার আর যুবরাজ হাইনরিখ রুসের সাথে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা।[২৭]

পারস্যে ঐ সময় এক দিকে ব্রিটেনের প্রভাব ছিল আর অন্যদিকে ছিল রাশিয়ার। ‌এ দুইয়ের মধ্যবর্তী নিরপেক্ষ অঞ্চলে, ইস্পাহানের দূতাবাসের মাধ্যমে জার্মানি প্রতিপত্তি খাটাত। স্থানীয় জনগণ এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ রাশিয়া আর ব্রিটেনের প্রচ্ছন্ন ঔপনিবেশিক মনোভাবকে অপছন্দ করত বলে এই অভিযানটিতে তাদের সমর্থন ছিল। নিডারমায়ার আর হেন্টিগের দল জুনের শেষ পর্যন্ত থেকে ইস্পাহানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।[২৮] এদিকে ভারতের ভাইসরয় চার্লস হার্ডিঞ্জ জার্মানদের প্রতি পারসিক ও আফগান গোষ্ঠীসমূহের অনুরাগ সম্পর্কে অবগত হন। ব্রিটিশ গোয়ন্দারা অভিযানটির আদ্যপান্ত জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।[২৫][২৮] সিস্তানবাহিনীসহ আফগান সীমান্তে দায়িত্বরত সকল ব্রিটিশ ও রুশ বাহিনী অভিযাত্রী দলের সদস্যদের খোঁজা শুরু করে।[২৮] আফগানিস্তানে পৌঁছানোর জন্য অভিযাত্রী দলটিকে এই অতিশয় তৎপর বাহিনীর চোখে ধূলো দিয়ে, পারসিক মরুভূমির হাজার হাজার মাইল পথ, অসহনীয় তাপ এবং প্রাকৃতিক বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে আসতে হত।[২৮]

জুলাই এর শুরুর দিকে কারমানশাহের অসুস্থ সদস্যরা আরোগ্য লাভ করে পুনরায় অভিযানে যোগ দেন। আফগান সীমান্তের মাঝপথে, তেব্বেসে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে উট এবং পানির মশক ক্রয় করা হয়, এবং ৩ জুলাই তারিখে মরুভূমি অতিক্রমের জন্য দলটি পৃথক পৃথক ভাবে ইস্পাহান ত্যাগ করে।[২৮] হেন্টিগের দল ১২ টি ঘোড়া, ২৪টি খচ্চর এবং একটি ঊটের কাফেলা নিয়ে রওয়ানা হয়। পুরো যাত্রায় ব্রিটিশ ও রুশ প্রহরীদের চোখে ধুলা দেয়ার জন্যে দলটি প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দলের সদস্য সংখ্যা, গন্তব্যস্থল এবং উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা গুজব রটানো হয়।[২৮] দিনের অসহনীয় গরম এড়াতে দলটি শুধু রাত্রিভাগে যাত্রা করে। আগে পাঠানো পারসিক দূতগণের সাহায্যে খাবার সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও এই দূতের দল শত্রুভাবাপন্ন গ্রামবাসীদেরকে চিহ্নিত করত আর পানির উৎস খুঁজে বের করত। এরূপে, দলটি পারস্যের মরুভূমি ৪০ রাতে অতিক্রম করে। ততদিনে দলের অনেক সদস্য আমাশয় ও বিকারগ্রস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিছু পারসিক পথপ্রদর্শক পলায়নের চেষ্টা করে, তদুপরি ডাকাতদলের আচমকা আক্রমণের আশংকায় ঊটচালকদের সদাসতর্ক থাকতে হয়। ২৩শে জুলাইয়ে দলটি তেব্বেস শহরে পৌঁছে। সুইডিশ পরিভ্রাজক স্‌ভেন হেডিনের পর এটিই প্রথম ইউরোপীয় দল, যেটি এ শহরে আগমন করে। অতঃপর অবিলম্বেই নিডারমায়ারের দলটিও তাঁদের সাথে মিলিত হয়, যার অন্তর্গত ছিল গবেষক উইলহেম পাসচেন এবং তুর্কীস্তানের রুশ যুদ্ধ শিবির থেকে পালিয়ে আসা ৬ জন অস্ট্রীয় এবং হাঙ্গেরীয় যোদ্ধা সহ।[২৮] তাঁরা আসামাত্র শহরটির মেয়র তাদেরকে বিশাল এক অভ্যর্থনা দেয়,[২৮] যার অর্থ এটিই, যে তাঁদের আগমনের কথা ছড়িয়ে পড়েছে।

পূর্ব পারসিক বেষ্টনী

[সম্পাদনা]
কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ার কর্তৃক অলংকৃত আফগানিস্তানের সিস্তান সীমান্তের মানচিত্র। কর্নেল ডায়ার সিস্তান বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন, যে বাহিনী সমগ্র ১৯১৬ সাল জুড়ে অনুপ্রবেশকারী জার্মান গোয়েন্দাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

অভিযাত্রী দলটি তখনও আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে ২০০ মাইল দূরে থাকায় তাঁরা সময় সংকটে আপতিত হন। তাঁদের সম্মুখে তখন রুশ চৌকি এবং ব্রিটিশ পূর্ব পারসিক বেষ্টনী (যা পরবর্তীতে সিস্তান বাহিনী নামে পরিচিত হয়)। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ওয়াসমাসের ফেলে যাওয়া সংকেত বইখানার পাঠোদ্ধার করা হয়ে গেলে অভিযানের সার্বিক অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে পড়ে। এই সময়ে দলনেতা নিডারমায়ার অসাধারণ রণকৌশলের পরিচয় দেন।[২৯] তিনি তিনটি প্রহরী দলকে সম্মুখে প্রেরণ করেন। যার প্রথমটি উত্তর-পূর্ব দিকে রুশ সেনাদলকে ভুলপথে নিয়ে যায়, দ্বিতীয়টি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ব্রিটিশদের ভুলপথে যেতে প্রলু্ব্ধ করে; এবং ত্রিশজন পারসিক সৈন্যবিশিষ্ট তৃতীয় দলটি জার্মান লেফটেনেন্ট ওয়েগনারের নেতৃত্বে সামনের যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণের জন্যে প্রেরিত হয়।[২৯][৩০]। প্রথম দলটির দায়িত্ব ছিল, রুশদের পথভ্রষ্ট করিয়ে পারস্যতে অবস্থান করা এবং প্রধান অভিযাত্রী দলের জন্য মরুভূমিতে গোপন একটি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় দলটির দায়িত্ব ছিল, ব্রিটিশদের পথভ্রষ্ট করিয়ে কারমানশাহে গমন করা এবং লেফটেন্যান্ট জুগমায়ের এবং গ্রিসিঙ্গারের নেতৃত্বাধীন অপর একটি জার্মান বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা।[৩১] সবগুলি প্রহরীদলের ওপর আদেশ ছিল কোন স্থানীয় গ্রামবাসী বা যাযাবরের সাথে দেখা হলে বিভান্তিমূলক খবর প্রচার করা।[৩১] ইতোমধ্যে প্রধান অভিযাত্রী দলটি আফগান সীমান্তের কাছাকাছি বিরজান্দ প্রদেশের উদ্দেশ্যে চেহার দেহ হয়ে অগ্রসর হতে থাকে।[২৯][৩২] দলটি পরবর্তী গ্রামটিতে পৌঁছাতে প্রায় ৪০ মাইল পথ অতিক্রম করে। এস্থানে, ওয়েগনারের প্রহরী দলের কাছ থেকে বার্তাপ্রাপ্তির জন্যে নিডারমায়ার বিরতি গ্রহণ করেন। গ্রামবাসীদেরও সাময়িক ভাবে এলাকাবন্দী করা হয়। তবে ওয়েগনার একটি দুঃসংবাদ নিয়ে আসেন: তাঁর দল একটি রুশ চৌকির সম্মুখীন হয়েছে এবং মরুভূমির আশ্রয়টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।[৩৩] ব্রিটিশ এবং রুশ চৌকি থেকে একদিন এগিয়ে থাকতে দলটি তড়িঘড়ি করে বিরজান্দ অভিমুখে রওয়ানা দেয়। তাছাড়াও নিডারমায়ার অপরাপর সমস্যার সম্মুখীন হন, যেমন পারসিক উটচালকদের আফিম আসক্তি। পারসিকরা আফিমের আগুন ধরাতে গেলে তিনি ধরা পড়ার আশংকায় বেশ কয়েকবার তাদের বাধা দেন। যাত্রাপথে কেউ পিছু পড়ে গেলে তাদেরকে সেখানেই ফেলে আসা হয়। কিছু পারসিক চালক পলায়নের চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে এক চালক দলটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার উদ্দেশ্যে পলায়নের সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।[২৯][৩৪]

রেজিনাল্ড ডায়ার কর্তৃক অঙ্কিত অপর একটি মানটিত্র। আফগানিস্তানের নিকটস্থ লুত মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত পারস্যের বিরজান্দ নগরী।

বিরজান্দ একটি ক্ষুদ্র শহর হলেও এতে একটি রুশ দূতাবাস অবস্থিত ছিল। নিডারমায়ারের ধারণা অনুযায়ী, এস্থানে ব্রিটিশ সেনারা অবস্থান করছিল। তাই তাঁর দু'টি যাত্রাপথের উত্তরেরটিতে ছিল রুশ চৌকি, এবং দক্ষিণেরটিতে ছিল ব্রিটিশ প্রহরীদল।[৩৪] সম্মুখে কোন পর্যবেক্ষণ দল প্রেরণের সুযোগ তাঁর ছিল না। তাঁর পারসিক পথপ্রদর্শকের পরামর্শমতে বিরজান্দের উত্তরের মরুভূমিটি ছিল অত্যন্ত দুর্গম, ফলে নিডারমায়ার অনুমান করেন, ব্রিটিশ প্রহরীদের এ আশা করার সম্ভাবনা কম যে অভিযাত্রী দল এ পথে অগ্রসর হবে। তিনি একটি ছোট দলকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রেরণ করেন এবং তারা গুজব ছড়ায় যে, মূল দলটিও এ পথে গমন করবে। অতঃপর নিডারমায়ার তাঁর দলবল নিয়ে উত্তরে রওনা দেন।[৩৪] তাঁর এই ছলনাটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাঁর শত্রুপক্ষের সন্ধানী দলগুলো যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে, তাদের ধারণা হতে থাকে যে অভিযাত্রীরা একটি সুবিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আবার কখনো তারা কেরমানশাহ থেকে আগত একটি জার্মান বাহিনীর সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বাস্তবে যে বাহিনীর কোন অস্তিত্ব ছিল না।[৩৫] এসময়ে অভিযাত্রী দলটি দিনে ও রাতে যাত্রা করতে থাকে। যাযাবরদের কাছ থেকে নিডারমায়ার ব্রিটিশ প্রহরীদের অবস্থান সম্বন্ধে জ্ঞাত হন। ক্লান্তি-অবসাদ, পলায়ন ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তিনি বহু সদস্যকে হারান। কয়েকটি ক্ষেত্রে, বিশ্বাসঘাতকেরা বন্দুক দেখিয়ে দলের কাছ থেকে বাড়তি পানি ও ঘোড়া কেড়ে নেয়।[৩৬] এতদসত্ত্বেও, দলটি আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ বিরজান্দ-মেশেদ সড়কে পৌঁছায়, যেটি আফগানিস্তান থেকে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত। এস্থানে আমিরকে পাঠানো কাইজারের উপহারসামগ্রীসমূহ মরুভূমিতে পুঁতে ফেলা হয়, যাতে পরে সেসব উদ্ধার করা যেতে পারে।[৩৬] যেহেতু আফগানিস্তানগামী সকল কাফেলাই এ সড়ক দিয়ে যাত্রা করতে হত, নিডারমায়ার ধারণা করেন যে, সড়কটিতে ব্রিটিশরা নজরদারী করছে। তাঁর প্রেরিত একটি পর্যবেক্ষণ দল ব্রিটিশ সৈন্যদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। এসব পর্যবেক্ষকদের প্রহরায় রাতের আঁধারে দলটি অগ্রসর হতে থাকে।[৩৬] ইঙ্গ-রুশ বেষ্টনী অতিক্রম করার জন্যে তাঁর আরো একটি বাধা অতিক্রম করতে হত, তা হল তথাকথিত "পার্বত্য পথ", যা ছিল ত্রিশ মাইল পূর্বে অবস্থিত কঠিন প্রহরাবিশিষ্ট একটি পথ। এ পথজুড়ে ইঙ্গ-রুশ বাহিনীর টেলিগ্রাফ তার ছিল, যার মাধ্যমে তারা দূরবর্তী চৌকিসমূহের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করতে পারত।[৩৭] তথাপি, নিডারমায়ার এ পথটিও অতিক্রম করতে সক্ষম হন। তাঁর দলটি সাত দিনের মধ্যে দাশ্‌ত-এ-কাভিরের দুর্গম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ২৫৫ মাইল পথ অতিক্রম করে।[৩৮] অবশেষে ১৯শে আগস্ট তারিখে অভিযাত্রী দল আফগান সীমান্তে পৌঁছে। মহেন্দ্র প্রতাপের স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, এ পর্যায়ে দলটিতে প্রায় ৫০জন সদস্য অবশিষ্ট ছিল, যা ৭ সপ্তাহ পূর্বে ইস্পাহান থেকে যাত্রাকারী সদস্যের অর্ধেকেরও কম। ডা. বেকারের উট-কাফেলাটি পথ হারিয়ে রুশদের হাতে আটক হয়। ১৭০টি ঘোড়া ও ভারবাহী পশুর মধ্যে মাত্র ৭০টি অবশিষ্ট ছিল।[২৯][৩৯]

আফগানিস্তান

[সম্পাদনা]

আফগানিস্তানে প্রবেশ করে দলটি একটি পরিত্যক্ত গ্রামের সেচ পথে মিঠাপানির সন্ধান পায়। জোঁকপূর্ণ হলেও, এ পানি পান করে তৃষ্ণার্ত দলটি মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায়। আরো দু'দিন যাত্রার পর দলটি হেরাতের কাছাকাছি পৌঁছে স্থানীয় আফগান কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে।[৩৯] হেন্টিগ এ বিষয়ে অনিশ্চিত ছিলেন যে তাদের আসাটা কর্তৃপক্ষ কীভাবে গ্রহণ করবে। তাই তিনি প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত বরকতুল্লাহকে প্রেরণ করেন আমিরের জন্য কাইজারের বার্তা ও উপহারের কথা উল্লেখ করে তাদের আগমনের সংবাদ পেশ করার জন্যে।[২৯] এ সংবাদ পেয়ে, স্থানীয় প্রশাসক কাপরচোপড়, উপহার সামগ্রী, বেশ কিছু সংখ্যক ভৃত্য ও শখানেক অস্ত্রসজ্জিত প্রহরী দানের মাধ্যমে তাদেরকে সাদরে বরণ করেন। অভিযাত্রীদেরকে আফগান সরকারের অতিথি হিসেবে শহরে নিমন্ত্রণ করা হয়। ২৪শে আগস্ট জার্মান "ক্যুরাসিয়ার" উর্দি পরিহিত হেন্টিগের নেতৃত্বে দলটি হেরাতে প্রবেশ করে। সেখানে তুর্কী সেনাদল তাদের অভ্যর্থনা জানায়।[২৯][৪০] আমিরের প্রাদেশিক প্রাসাদে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। এর কিছুদিন পর দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নরের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, এসময় হেন্টিগ হেরাতের প্রধানকে তুর্কী সুলতানের জিহাদের ঘোষণা, কাইজার কর্তৃক আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ ও এ বাবদে জার্মান সহায়তার প্রতিজ্ঞা বিবৃত করেন।[৪১] কাইজার আফগানিস্তানকে রাশিয়ার তুর্কেমেনিস্তানের সমরকন্দ পর্যন্ত এবং ভারতের মুম্বাই পর্যন্ত এলাকা প্রদানের প্রতিজ্ঞা করেন।[৪১]

ভারতের ভাইসরয় ইতোমধ্যেই আমিরকে "জার্মান গোয়েন্দা" এবং "ভাড়াটে খুনী"দের আগমনের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন এবং আমির তাকে কথা দেন এমন কেউ আসলেই তিনি তাদের আটক করবেন। তথাপি, কড়া নজরদারির মধ্যে অভিযাত্রী দলের সদস্যদের হেরাতে চলাফেলার স্বাধীনতা দেয়া হয়। হেরাতের প্রধান সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই দলটিকে কাবুলের ৪০০ মাইল পূর্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। আমিরের সাথে সাক্ষাতের উপযোগী হওয়ার জন্যে অভিযাত্রীদের কেতাদুরস্ত পোশাক থেকে শুরু করে ঘোড়ার জিন- সবই নতুন করে তৈরি করা হয়।[৪১] ভারত সীমান্তের কাছাকাছি পাঠান অধিকৃত এলাকায় গোলমালের ভয়ে দক্ষিণের রাস্তা ও কান্দাহার শহরকে এড়িয়ে যাওয়া হয়।[৪১] হাজারাযাতের মধ্য দিয়ে মধ্য আফগানিস্তানের অনুর্বর গিরিপথ হয়ে উত্তরের পথ ধরে যাত্রা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে দলটি আফগান দূতসমেত হেরাত থেকে কাবুল অভিমুখে ২৪ দিনের এক যাত্রার উদ্দেশ্যে রওনা হয়[৪১]। যাত্রপথে অভিযাত্রী দলটি স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সুকৌশলে অর্থ ও স্বর্ণমুদ্রা বিলি করে।[৪১] অবশেষে, ১৯১৫ সালের ২রা অক্টোবর অভিযাত্রী দলটি কাবুল পৌঁছায়। কাবুলে দলটি স্থানীয় তুর্কী সম্প্রদায় থেকে সালাম এবং তুর্কী উর্দিশোভিত আফগান সেনাদল থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অভ্যর্থনা পান।[৪২] হেন্টিগ পরবর্তীতে কাবুলীদের কাছ থেকে উল্লসিত সমাদর পাওয়ার স্মৃতিচারণ করেছিলেন।[৪১]

আফগান পরিকল্পনা

[সম্পাদনা]

কাবুলে অভিযাত্রী দলটি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমিরের প্রাসাদ বাগ-ই-বাবুরে স্থান পায়।[৪১] এই জমকালো অভ্যর্থনা এবং বিলাসব্যসনের মধ্যেও তাঁরা যে প্রকৃতপক্ষে বন্দী তা উপলব্ধি হতে তাঁদের সময় লাগেনি। প্রাসাদের বাইরে প্রহরারত সশস্ত্র রক্ষীদল ছিল, যারা দৃশ্যতঃ "ব্রিটিশ গোয়েন্দা থেকে দলটিকে রক্ষার জন্য" নিয়োজিত ছিল, এবং যাত্রাকালে অস্ত্রধারী সেনারা তাঁদের সঙ্গ দিচ্ছিল।[৪৩] প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পাগমানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে অবস্থানরত আমির হাবিবুল্লাহ দলটির সাথে দেখা করার অনুরোধের প্রত্যুত্তর ভদ্রভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর বিচক্ষন রাজনৈতিক বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি ঐ সময় অতিথিদের স্বাগত জানানো মুলতবি রেখে তাদের ব্যাপারে যথাসম্ভব জানার চেষ্টা করছিলেন, এবং দিল্লীর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে আতাত করছিলেন।[৪৩] নিডারমায়ার আর হেন্টিগ অনশন ধর্মঘটে যাওয়ার হুমকি দিলে, শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাত শুরু হয়।[৪৩] এই সময়ের মধ্যে হেন্টিগ খামখেয়ালী এই সুলতান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। আমির হাবিবুল্লাহ যথার্থ অর্থেই আফগানিস্তানের হর্তা-কর্তা ছিলেন। তিনি আফগান ভূমিকে এবং একে শাসনের ক্ষমতাকে তাঁর অধিকার মনে করতেন।[৪৩] দেশের একমাত্র সংবাদপত্র, একমাত্র ঔষধের দোকান এবং দেশের সকল যানবাহনের (যার সবই ছিল রোলস রয়েস) একচ্ছত্র মালিকানা ছিল তাঁরই।[৪৩]

আমিরের ভাই, প্রধানমন্ত্রী নাসরুল্লাহ খান ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি সাবলীলভাবে স্থানীয় ভাষা পশতুতে কথা বলতে পারতেন, আফগানিস্তানের বনেদি পোশাক আলখাল্লা পরতেন এবং সীমান্তের উপজাতিগুলির সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন, যেসকল কাজ আমির করতেন না। আমির ব্রিটিশ ভারতের অনুরাগী হলেও, নাসরুল্লাহ খানের সমর্থন ছিল জার্মানীর প্রতি।[৪৩] নাসরুল্লাহ খানের চিন্তা ভাবনা ছিল আমিরের সবচেয়ে প্রতিভাধর সন্তান আমানুল্লাহ খানের অনুরূপ।[৪৩] আমানুল্লাহ খানের জ্যেষ্ঠ ভাই ইনায়াতুল্লাহ খান ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর দায়িত্বে।[৪৩] অভিযাত্রী দলটি সঙ্গত কারণেই নাসরুল্লাহ এবং আমানুল্লাহর কাছ থেকে আমিরের তুলনায় বেশি গুরুত্ব ও সহযোগিতা পাবার আশা করে।[৪৩]

আমির হাবিবুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত

[সম্পাদনা]
হাবিবুল্লাহ খান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আফগানিস্তানের আমির। হাবিবুল্লাহ খান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের পরম মিত্র।

১৯১৫ এর ২৬শে অক্টোবর আমির অবশেষে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর থেকে সুরক্ষিত পাগমান প্রাসাদে দলটির সাথে সাক্ষাতে রাজি হন।[৪৩] আমির হাবিবুল্লাহর অস্বস্তিকর এক ভাষ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই বৈঠক সারা দিনব্যপী অব্যাহত থাকে। আমির দীর্ঘ এক বক্তব্যের মাধ্যমে অভিযানটি নিয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন:

আপনাদেরকে আমি বণিক হিসেবে গণ্য করি, যারা আমার সামনে তাদের পণ্যসমূহ তুলে ধরবে। এই পণ্যসমূহের মধ্য থেকে আমি আমার খেয়ালখুশী মত বাছাই করব, আমার যা পছন্দ তা গ্রহণ করব এবং যা আমার প্রয়োজন নেই তা প্রত্যাখ্যান করব।[৪৪]

তিনি প্রথমেই বিস্ময় প্রকাশ করেন এই বলে যে, এত জরুরি একটি অভিযানের দায়িত্ব এত কম বয়সী প্রতিনিধিদলের কাছে কেন অর্পিত হল। হেন্টিগ আমিরকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে অভিযাত্রীরা ব্যবসায়ী নন বরং তারা কাইজার, অটোমান সুলতান এবং ভারতের কাছ থেকে আফগানিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেয়ার বার্তা বহন করছে।[৪৪][৪৫] অটোমানদের হস্তাক্ষরে লেখা শুভেচ্ছাপূর্ণ চিঠির তুলনায় এবং কাইজারের মুদ্রাক্ষরে লেখা চিঠির তুলনা করে আমির এর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কাইজার তাঁর হাতে সেই মুহূর্তে যা ছিল তাই দিয়ে চিঠি লিখে দিয়েছেন যাতে দলটি তৎক্ষণাৎ যাত্রা শুরু করতে পারে- হেন্টিগের এই ব্যাখা আমিরের মনোঃপুত হয়নি।[৪৪] যুদ্ধের অবস্থা জার্মানীর পক্ষে এবং কাইজারের ইচ্ছা কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে আফগানিস্তান যুদ্ধে যোগ দেবে- এ কথা হেন্টিগ আমিরকে জানান। তিনি আমিরকে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার আহবান দেন।[৪৪] এরপর একে একে কাসিম বে এবং বরকতুল্লাহ নিজেদের বক্তব্য পেশ করেন। কাশিম বে উসমানীয় সুলতানের জিহাদের ঘোষণার কথা আমিরকে জানান এবং তিনি আরো বলেন, আফগান ও তুর্কি- এ মুসলিম জনগোষ্ঠীদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধ হবে ভ্রাতৃহত্যার শামিল। তিনিও আফগানিস্তানের নিকট কাইজারের বার্তার অনুরূপ একটি বার্তা পেশ করেন। বরকতুল্লাহ আমিরকে ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে যোগদানের এবং ভারতীয় মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তুর্কী-জার্মান যেন ফৌজ নির্বিঘ্নে আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছাতে পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি আমিরকে অনুরোধ জানান[৪৬]। বরকতুল্লাহ আর মহেন্দ্র প্রতাপ দুজনই প্রাঞ্জল ভাষায় আমিরকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে যোগদান করলে আমির ভূখণ্ড প্রাপ্তির দিক থেকে লাভবান হবেন।[৪৭]

আমিরের উত্তর ছিল সোজাসাপ্টা কিন্তু বিচক্ষণ। তিনি ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মাঝে আফগানিস্তানের নাজুক কৌশলগত অবস্থান এবং পূর্ব পারসিক বেষ্টনীর উপস্থিতিতে তুর্কী-জার্মান দলের পক্ষে আফগানিস্তানকে সহয়তা প্রদান কতটা কঠিন সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এছাড়া আর্থিক ভাবে তার দেশের দুর্বলতার কারণে তিনি নানা ধরনের ব্রিটিশ ভর্তুকী এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল।[৪৬] ব্রিটেনের বিপক্ষে গেলে তাঁর সৈন্য এবং দেশের কল্যাণে যে বাধা আসবে, তা কীভাবে পূরণ হবে- এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে অভিযাত্রীগণ ব্যর্থ হন। তাদের কাজ ছিল আমিরকে পবিত্রযুদ্ধে সম্পৃক্ত হতে রাজি করানো, নিজেদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কোন প্রতিজ্ঞা করার মত কর্তৃত্ব তাদের কারোরই ছিলনা।[৪৬] তবু তারা পারস্যের সাথে নিকট ভবিষ্যতে জোট বাঁধার আশ্বাস দেন, (যে কাজে যুবরাজ হেনরি অভ রইস এবং উইলহেম ওয়াসমাস নিযুক্ত ছিলেন) যা আমিরের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করবে।[৪৮] যদিও কোন স্থির সিদ্ধান্তে কেউই পৌঁছাতে পারেনি কিন্তু ইতিহাসবেত্তারা বলেন এই বৈঠক ছিল আন্তরিক এবং প্রতিনিধি দলটির মাঝে কিছুটা হলেও আশাব্যাঞ্জক।[৪৮]

এই বৈঠকের পরে ১৯১৫ সালের অক্টোবরে পাগমানে একটি আট-ঘণ্টাব্যপী বৈঠক এবং কাবুলে কয়েকটি সাক্ষাত অনুষ্ঠিত হয়।[৪৪] এসকল সাক্ষাতের বার্তাও ছিল প্রথমটির অনুরূপ। বৈঠকের শুরুতে হাবিবুল্লাহ তাঁর গতানুগতিক বক্তব্য পেশ করতেন, অতঃপর ফন হেন্টিগ রাজনীতি ও ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য রাখতেন। এরপর আলোচনা হত কেন্দ্রীয় শক্তিকে আফগানিস্তান মধ্য দিয়ে যাত্রার অনুমতি প্রদান, ব্রিটেন থেকে বিচ্ছেদ ও আফগানিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে।[৪৭] অভিযাত্রীগণ আশা করছিলেন পারস্য কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে হাত মেলাবে এবং এ ঘটনা আফগানিস্তানের আমিরকেও তাদের পক্ষে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করবে। নিডারমায়ার যুক্তি দিয়ে দেখান যে জার্মানদের বিজয় আসন্ন; ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করলে আফগানিস্তান যে বিচ্ছিন্ন ও বেগতিক অবস্থানে পতিত হবে সে বিষয়ও তিনি আমিরকে অবগত করেন।[৪৭] কোন কোন সময় আমির ভারতীয় ও জার্মান প্রতিনিধিদের সাথে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাত করতেন,[৪৭] তিনি তাঁদের যুক্তিসমূহ বিবেচনা করার আশ্বাস দিলেও কখনো কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন না। তিনি নিশ্চিত হতে চাইতেন যে তুর্কি-জার্মান পক্ষ যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য কিনা।[৪৭] তেহরানে অবস্থানরত যুবরাজ হেনরিকে একটি বার্তা প্রেরণ করা হয়, যাতে ফন হেন্টিগ তুর্কি সৈন্যদের পাঠানোর অনুরোধ করেন (বার্তাটি পথিমধ্যে আটক হয় এবং রুশদের নিকটে প্রেরিত হয়)। ওয়াল্টার রোর পরবর্তীতে যুবরাজকে চিঠি মারফত জানান যে, কয়েকটি মেশিন গান সমেত এক হাজার তুর্কি সৈন্য প্রেরণ করলে এবং তাদের নেতৃত্বে যুবরাজ নিজেই নিয়োজিত থাকলে আফগানরা কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।[৪৯] অপরদিকে, নিডারমায়ার আমির হাবিবুল্লাহকে পরামর্শ দেন কী করে তাঁর সেনাবাহিনীতে গতিশীল সৈন্যদল ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিবৃদ্ধি করা যেতে পারে।[৫০]

নসরুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত

[সম্পাদনা]
নসরুল্লাহ খান, আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী। তিনি অভিযাত্রীগণের সমর্থক ছিলেন।

আমির সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও তাঁর ভ্রাতা প্রধান মন্ত্রী নসরুল্লাহ খান এবং তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আমানুল্লাহ খান অভিযাত্রীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও তাঁদের দর্শনলাভে আগ্রহী ছিলেন।[৪৭] পাগমানে প্রথম বৈঠকটিতে নসরুল্লাহ খান উপস্থিত ছিলেন। "আমানুল্লাহ দল"এর সাথে গোপন বৈঠকে তিনি অভিযাত্রীদের উত্সাহিত করেন। এসকল বৈঠকের কথা আমিরের কানে পৌঁছানোর গুজব রটলেও, আমানুল্লাহ খান দলটিকে আশ্বস্ত করেন।[৪৭] তদুপরি যুবরাজ হেনরির নিকটে প্রেরিত ফন হেন্টিগের বার্তাটি ব্রিটিশ ও রুশ গোয়েন্দারা আটক করলে, তা কালক্রমে আমিরের নিকটেও পাঠানো হয়। এসকল ঘটনায় ফন হেন্টিগ তাই আফগানিস্তানকে যুদ্ধে টেনে আনবার জন্যে প্রয়োজনে অন্তর্কলহ সৃষ্টি করতে মনস্থির করেন।[৪৭][৫১] এসকল ঘটনার বিবৃতি আমিরের কর্ণ গোচর হলে তিনি চিন্তিত হন এবং অভিযাত্রীদেরকে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পুত্রদের সাথে সাক্ষাত করতে বারণ করেন। তাঁর পূর্বে তাঁর পিতা ব্যতীত আফগানিস্তানের অন্যান্য সকল রাষ্ট্রপ্রধান অপমৃত্যুর শিকার হন। আমির নিজে ব্রিটিশ-পন্থী কিন্তু তাঁর নিকটাত্মীয়রা জার্মান-পন্থী হওয়ায় তিনি তাঁর ক্ষমতা ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হন।[৪৭] ফন হেন্টিগের বর্ণনা মতে, আমিরের সঙ্গে তাঁর এক সাক্ষাতে তিনি একটি পকেট অ্যালার্ম ঘড়ির সময় নির্ধারণ করে রেখেছিলেন যাতে বৈঠক চলাকালীন তা বেজে ওঠে, এর উদ্দেশ্য ছিল আমিরকে অভিভূত করা। কিন্তু ফল হয় তার বিপরীত, ঘড়িটিকে বিস্ফোরকের সংকেত ভেবে আমির ঘাবড়ে যান। ফন হেন্টিগ বিষয়টি ব্যখ্যা করলেও আমির শীঘ্রই বৈঠকটির ইতি টেনে দেন।[৪৯]

অভিযাত্রীদলটি যতদিন কাবুলে অবস্থান করছিল, হাবিবুল্লাহ কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষ অবলম্বনের সমস্ত প্রস্তাব "কৌশলগত নিষ্ক্রিয়তার" মাধ্যমে নাকচ করে দিতে থাকেন।[৪৯] যুদ্ধের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, সেটি স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। অভিযাত্রী সদস্যদের সম্মুখে তিনি কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছিলেন। এবং যখন তুর্কি-জার্মান সৈন্যরা তাঁকে সহায়তা প্রদান করতে পারবে, কেবলমাত্র তখনই তিনি তাদের বাহিনীকে আফগানিস্তানে প্রবেশের অনুমতি দিবেন বলে জানান। আমিরের পক্ষ থেকে কোন ফলপ্রসূ সাড়া না পেয়ে অভিযাত্রী দলটি কাবুল ত্যাগ করার ইঙ্গিত দিলে আমির তাদেরকে তোয়াজ ও তোষামোদ করে আরো কিছু দিন রয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানান। এবং কাবুলে থাকাকালীন দলটির সদস্যগণকে কাবুলে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করার অনুমতিও প্রদান করা হয়, তাঁরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে স্থানীয় জনগণের মন জয়ে সচেষ্ট হন। স্থানীয়দের পণ্যদ্রব্য তাঁরা ক্রয় করেন এবং বিনিময়ে নগদ অর্থ প্রদান করেন। রুশ বন্দীশালা থেকে পালিয়ে আসা চব্বিশ জন অস্ট্রিয়ান বন্দীদেরকে নিডারমায়ার আদেশ দেন একটি হাসপাতাল নির্মান করার জন্যে।[৪৯] ইতোমধ্যে, কাসিম বে স্থানীয় তুর্কি জনগণের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেন। তিনি এনভার পাশার বার্তা তাঁদের মধ্যে প্রচার করেন এবং ঐক্য ও সমগ্র-তুরানীয় জনগণের জিহাদের প্রতি আহ্বান জানান।[৫০] স্থানীয় সংবাদপত্র "সিরাজ আল আকবার"-এ ব্রিটিশ বিরোধী এবং কেন্দ্রীয়-পন্থী সংবাদ প্রচারিত হলেও আমির তা সহ্য করেন। সংবাদপত্রটির সম্পাদক ছিলেন আমিরের শ্বশুর মাহমুদ তার্জি, যিনি ১৯১৬ সালে বরকতুল্লাহকে তাঁর সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করেন। তার্জি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ কর্তৃক লিখিত কতিপয় জ্বালাময়ী প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন। ১৯১৬ সালে এ পত্রিকাটির ব্রিটিশ-বিরোধী প্রবন্ধসমূহ গুরুতর আকার ধারণ করলে ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ সরকার এ সংবাদপত্রটির কয়েকটি কপি ভারতে প্রবেশের সময় আটক করে।[৪৯][৫২]

উসমানীয় তুরস্কের সাথে জার্মানির সংযোগের মারফতে বার্লিন কমিটি হেজাজে অবস্থানরত মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আবার, কাবুলেই উবাইদুল্লাহ সিন্ধির দলের সাথে অভিযাত্রীদের সাক্ষাত হয়।[৫২][৫৩]

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি

[সম্পাদনা]

১৯১৫ সালের ডিসেম্বরের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও পরামর্শ বৈঠকসমূহে যেসকল রাজনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছিল, তা উদযাপন করতে আমির বড়দিনে অভিযাত্রীদের মদ ও ব্রান্ডি (কোনিয়াক) দ্বারা আপ্যায়ন করেন, যা চল্লিশ বছর পূর্বে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত মর্টিমার ডুরান্ড ফেলে গেছিলেন। এসকল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে, ঐ মাসেই কাবুলে ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। আমিরের অনড় অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়, এবং তুর্কি-জার্মান পক্ষের মৈত্রীচুক্তির আলোচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।[৫০][৫৪]

নভেম্বর মাসে ভারতীয় সদস্যগণ আমিরকে জিহাদ ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সচেষ্ট হন। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে আমিরের উপদেষ্টাদের দ্বারা আমিরকে প্রভাবিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।[৫০][৫৪] ১৯১৫ সালের ১লা ডিসেম্বরে, আমির হাবিবুল্লাহ খানের প্রাসাদ বাগ-এ-বাবুরে ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, যাতে উপস্থিত থাকেন ভারতীয়, জার্মান ও তুর্কী অভিযাত্রী সদস্যবৃন্দ। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে উত্খাত করার পর, এই বিপ্লবী নির্বাসিত সরকার ভারতে শাসনভার গ্রহণ করার দায়িত্ব নেবে, এমনটাই আশা করা হয়।[৫০] মহেন্দ্র প্রতাপকে প্রেসিডেন্ট, বরকতুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী, দেওবন্দী নেতা মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মৌলভী বশিরকে যুদ্ধমন্ত্রী এবং চম্পকরান পিল্লাইকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ঘোষণা করা হয়।[৫৫] ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার জন্যে গালিব পাশার পক্ষ থেকে সমর্থন প্রদান করা হয়, এবং রাশিয়া, চীন প্রজাতন্ত্র ও জাপানের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি প্রাপ্তির প্রচেষ্টা করা হয়।[৫৬] ১৯১৭ সালে রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর মহেন্দ্র প্রতাপের নেতৃত্বাধীন সরকার রাশিয়ার নবগঠিত বলশেভিক সরকারের পক্ষ থেকে সমর্থন লাভের আশায় তাদের সাথে যোগসাজশ স্থাপন করেন। ১৯১৮ সালে মহেন্দ্র প্রতাপ রাশিয়ার পেট্রোগ্রাড নগরীতে ট্রটস্কির সাথে সাক্ষাত করেন এবং এরপরে জার্মানির কাইজারের সঙ্গেও সাক্ষাতে যান, তাঁদের উভয়কেই তিনি ব্রিটিশ ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধে গমনের অনুরোধ করেন।[৫৪][৫৭]

আফগান-জার্মান মৈত্রীর চুক্তির খসড়া

[সম্পাদনা]

১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে অভিযানের তুর্কি-জার্মান জোটের লক্ষ্য পূরণে ব্যাপক অগ্রগতি হয়। ফন হেন্টিগকে আমির জানান যে, আফগান-জার্মান মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে তিনি প্রস্তুত, তবে তিনি এটিও বলেন যে এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হবে এবং এতে বিস্তর ঐতিহাসিক গবেষণার প্রয়োজন পড়বে। ফন হেন্টিগ মৈত্রী চুক্তির একটি খসড়া প্রস্তাব দিলে আলোচনার সূত্রপাত হয়। ১৯১৬ সালের ২৪শে জানুয়ারি ১০ দফাসহ চূড়ান্ত খসড়া পেশ করা হয়, যার অন্তর্গত ছিল আফগান স্বাধীনতার স্বীকৃতি, জার্মানির সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। জার্মান সাম্রাজ্যের দূতাবাসের সচিব হিসেবে মনোনীত হন ফন হেন্টিগ নিজেই। তদুপরি, যদি আফগানিস্তান কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে ব্রিটিশ ও রুশ আক্রমণ থেকে জার্মানি তাদের সুরক্ষা দেবে, জার্মানির পক্ষ থেকে এরূপ আশ্বাস দেয়া হয়।[৫৪] আমিরের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে জার্মানি তাদেরকে ১,০০,০০০ আধুনিক রাইফেল, ৩০০টি কামানসহ অন্যান্য আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করবে। এছাড়াও জার্মানি উপদেষ্টা ও প্রকৌশলী নিয়োগের দায়িত্বও গ্রহণ করবে, এবং এসকল রসদ ও গোলাবারুদ সরবরাহের জন্যে পারস্যের মধ্য দিয়ে স্থলপথ স্থাপনের দায়িত্বও জার্মানির থাকবে। তার ওপর আমিরকে উপঢৌকন হিসেবে ১০,০০,০০০ পাউন্ড পরিমাণ অর্থ দান করা হবে।[৫৪] ফন হেন্টিগ ও নিডারমায়ার উভয়েই এই চুক্তিতে সাক্ষর করেন। ফন হেন্টিগ তাঁর পররাষ্ট্র দপ্তরকে টেলিগ্রাফ মারফত অবহিত করেন যে, এই চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারত আক্রমণের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিডারমায়ার ব্যখ্যা করেন যে, আফগান-রুশ সীমান্ত প্রতিরক্ষার জন্যে ২০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করা হলেই আমির এই অভিযান শুরু করতে উদ্যত হবেন।[৫৮] এছাড়াও নিডারমায়ার অতি শীঘ্রই বেতার যন্ত্র, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্তত ১০ লক্ষ পাউন্ড অর্থ সরবরাহের অনুরোধ জানান। তাঁর বিচারে তখনই ছিল ভারত আক্রমণের উপযুক্ত সময়, এবং এপ্রিলের প্রথম ভাগে আক্রমণ আরম্ভ হবে বলে তিনি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।[৫৮]

অভিযানের পরিসমাপ্তি

[সম্পাদনা]

পরিশেষে আমির হাবিবুল্লাহ পুনরায় তাঁর পূর্বের দোদুল্যমান মানসিকতা ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ফিরে যান। অভিযাত্রীগণ যে তাঁর সভাসদদের মদদ প্রাপ্ত হচ্ছিলেন এবং তাঁর প্রজাদেরকে উসকে দিচ্ছিলেন, সে সম্পর্কে আমির অবগত ছিলেন। খসড়া চুক্তি সাক্ষর হবার চার দিনের মাথায় আমির তাঁর দরবারের একটি অধিবেশনের ঘোষণা দেন, যা ছিল একটি শিখর সম্মেলন এবং যা জিহাদ ঘোষণার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে সমীচীন স্থান হিসেবে গণ্য হত। কিন্তু দরবারের অধিবেশনে আমির তাঁর নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন, কেননা যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তিনি তখনো সন্দিহান ছিলেন এবং তাঁর জাতির ঐক্যবদ্ধতা তাঁর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[৫৮]

পাদটীকা

[সম্পাদনা]
  1. Hughes 2002, পৃ. 450
  2. Hughes 2002, পৃ. 452
  3. Hoover 1985, পৃ. 251
  4. Strachan 2001, পৃ. 798
  5. Hoover 1985, পৃ. 252
  6. Brown 1948, পৃ. 300
  7. Yadav 1992, পৃ. 29
  8. Hughes 2002, পৃ. 449
  9. Hughes 2002, পৃ. 451
  10. Hughes 2002, পৃ. 453
  11. Jalal 2007, পৃ. 105
  12. Reetz 2007, পৃ. 142
  13. Ansari 1986, পৃ. 515
  14. Qureshi 1999, পৃ. 78
  15. Qureshi 1999, পৃ. 77–82
  16. Hopkirk 2001, পৃ. 85
  17. Hughes 2002, পৃ. 455
  18. Hopkirk 2001, পৃ. 98
  19. Hughes 2002, পৃ. 456
  20. Popplewell 1995, পৃ. 234
  21. Hughes 2002, পৃ. 457
  22. Hopkirk 2001, পৃ. 99
  23. Hopkirk 2001, পৃ. 121
  24. Hughes 2002, পৃ. 458
  25. Hughes 2002, পৃ. 459
  26. Hughes 2002, পৃ. 460
  27. Hughes 2002, পৃ. 461
  28. Hughes 2002, পৃ. 462
  29. Hughes 2002, পৃ. 463
  30. Hopkirk 2001, পৃ. 136
  31. Hopkirk 2001, পৃ. 137
  32. Hopkirk 2001, পৃ. 138
  33. Hopkirk 2001, পৃ. 139
  34. Hopkirk 2001, পৃ. 141
  35. Hopkirk 2001, পৃ. 142
  36. Hopkirk 2001, পৃ. 143
  37. Hopkirk 2001, পৃ. 144
  38. Hopkirk 2001, পৃ. 125
  39. Hopkirk 2001, পৃ. 150
  40. Hopkirk 2001, পৃ. 151
  41. Hughes 2002, পৃ. 464
  42. Hopkirk 2001, পৃ. 154
  43. Hughes 2002, পৃ. 465
  44. Hughes 2002, পৃ. 466
  45. Hopkirk 2001, পৃ. 160
  46. Hopkirk 2001, পৃ. 161
  47. Hughes 2002, পৃ. 467
  48. Hopkirk 2001, পৃ. 162
  49. Hughes 2002, পৃ. 468
  50. Hughes 2002, পৃ. 469
  51. Hopkirk 2001, পৃ. 165
  52. Sims-Williams 1980, পৃ. 120
  53. Seidt 2001, পৃ. 1,3
  54. Hughes 2002, পৃ. 470
  55. Ansari 1986, পৃ. 516
  56. Andreyev 2003, পৃ. 95
  57. Hughes 2002, পৃ. 474
  58. Hughes 2002, পৃ. 471

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  • Andreyev, Alexandre (২০০৩), Soviet Russia and Tibet: The Debacle of Secret Diplomacy, 1918–1930s, Boston: Brill, আইএসবিএন 90-04-12952-9 .
  • Ansari, K. H. (১৯৮৬), "Pan-Islam and the Making of the Early Indian Muslim Socialist", Modern Asian Studies, Cambridge University Press, 20 (3): 509–537, ডিওআই:10.1017/S0026749X00007848 .
  • Bailey, F.M.; Hopkirk, Peter (২০০২), Mission to Tashkent, Oxford: Oxford University Press, আইএসবিএন 0-19-280387-5 .
  • Brown, Emily (মে ১৯৭৩), "Book Reviews; South Asia", Journal of Asian Studies, Pacific Affairs, University of British Columbia, 32 (3): 522–523, আইএসএসএন 0030-851X .
  • Brown, Giles T. (আগস্ট ১৯৪৮), "The Hindu Conspiracy, 1914–1917", Pacific Historical Review, University of California Press, 17 (3): 299–310, আইএসএসএন 0030-8684, জেস্টোর 3634258, ডিওআই:10.2307/3634258 .
  • Cell, John W. (২০০২), Hailey: A Study in British Imperialism, 1872–1969, Cambridge; New York: Cambridge University Press, আইএসবিএন 0-521-52117-3 .
  • Collett, Nigel (২০০৬), The Butcher of Amritsar: General Reginald Dyer, London; New York: Continuum International Publishing Group, আইএসবিএন 1-85285-575-4 .
  • Desai, A.R. (২০০৫), Social Background of Indian Nationalism, Bombay: Popular Prakashan, আইএসবিএন 81-7154-667-6 .
  • Fisher, Margaret W.; Kumar, R. (১৯৭২), "Essays on Gandhian Politics. the Rowlatt Satyagraha of 1919 (in Book Reviews)", Pacific Affairs, Pacific Affairs, University of British Columbia, 45 (1): 128–129, আইএসএসএন 0030-851X, জেস্টোর 2755297, ডিওআই:10.2307/2755297 .
  • Hoover, Karl (মে ১৯৮৫), "The Hindu Conspiracy in California, 1913–1918", German Studies Review, German Studies Association, 8 (2): 245–261, আইএসএসএন 0149-7952, জেস্টোর 1428642, ডিওআই:10.2307/1428642 .
  • Hopkirk, Peter (২০০১), On Secret Service East of Constantinople, Oxford; New York: Oxford Paperbacks, আইএসবিএন 0-19-280230-5 .
  • Hughes, Thomas L. (অক্টোবর ২০০২), "The German Mission to Afghanistan, 1915–1916", German Studies Review, German Studies Association, 25 (3): 447–476, আইএসএসএন 0149-7952, জেস্টোর 1432596, ডিওআই:10.2307/1432596 .
  • Jalal, Ayesha (২০০৭), "Striking a just balance: Maulana Azad as a theorist of trans-national jihad", Modern Intellectual History, Cambridge University Press, 4 (1): 95–107, আইএসএসএন 1479-2443, ডিওআই:10.1017/S1479244306001065 .
  • Jain, Naresh Kumar (১৯৭৯), Muslims in India: A Biographical Dictionary, New Delhi: Manohar, ওসিএলসি 6858745 .
  • James, Frank (১৯৩৪), Faraway Campaign, London: Grayson & Grayson, ওসিএলসি 565328342 .
  • Lovett, Sir Verney (১৯২০), A History of the Indian Nationalist Movement, New York: Frederick A. Stokes, আইএসবিএন 81-7536-249-9 
  • McKale, Donald M (১৯৯৮), War by Revolution: Germany and Great Britain in the Middle East in the Era of World War I, Kent, Ohio: Kent State University Press, আইএসবিএন 0-87338-602-7 .
  • Popplewell, Richard J. (১৯৯৫), Intelligence and Imperial Defence: British Intelligence and the Defence of the Indian Empire 1904–1924, Routledge, আইএসবিএন 0-7146-4580-X .
  • Qureshi, M. Naeem (১৯৯৯), Pan-Islam in British Indian Politics: A Study of the Khilafat Movement, 1918–1924, Leiden; Boston: Brill, আইএসবিএন 90-04-11371-1 .
  • Reetz, Dietrich (২০০৭), "The Deoband Universe: What Makes a Transcultural and Transnational Educational Movement of Islam?", Comparative Studies of South Asia, Africa and the Middle East, Duke University Press, 27 (1): 139–159, আইএসএসএন 1089-201X, ডিওআই:10.1215/1089201x-2006-049 .
  • Sarkar, Benoy Kumar; Lovett, Verney (মার্চ ১৯২১), "A History of the Indian Nationalist Movement", Political Science Quarterly, The Academy of Political Science, 36 (1): 136–138, hdl:2027/mdp.39015009367007, আইএসএসএন 0032-3195, জেস্টোর 2142669, ডিওআই:10.2307/2142669 .
  • Sarkar, Sumit (১৯৮৩), Modern India, 1885–1947, Delhi: Macmillan, আইএসবিএন 978-0-333-90425-1 .
  • Seidt, Hans-Ulrich (ফেব্রুয়ারি ২০০১), "From Palestine to the Caucasus-Oskar Niedermayer and Germany's Middle Eastern Strategy in 1918", German Studies Review, German Studies Association, 24 (1): 1–18, আইএসএসএন 0149-7952, জেস্টোর 1433153, ডিওআই:10.2307/1433153 .
  • Schimmel, Annemarie (১৯৮০), Islam in the Indian Subcontinent, Leiden: Brill, আইএসবিএন 978-90-04-06117-0 .
  • Sims-Williams, Ursula (১৯৮০), "The Afghan Newspaper Siraj al-Akhbar. Bulletin", British Society for Middle Eastern Studies, London: Taylor & Francis, 7 (2): 118–122, আইএসএসএন 0305-6139, ডিওআই:10.1080/13530198008705294 .
  • Strachan, Hew (২০০১), The First World War. Volume I: To Arms, Oxford; New York: Oxford University Press, আইএসবিএন 0-19-926191-1 .
  • Stürmer, Michael (২০০০), The German Empire, 1870–1918, New York: Random House, আইএসবিএন 0-679-64090-8 .
  • Swami, Praveen (১ নভেম্বর ১৯৯৭), "Jallianwala Bagh revisited", The Hindu, The Hindu Group, ২৮ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ১০ জানুয়ারি ২০১৩ .
  • Tinker, Hugh (অক্টোবর ১৯৬৮), "India in the First World War and after", Journal of Contemporary History, Sage Publications, 3 (4): 89–107, আইএসএসএন 0022-0094, ডিওআই:10.1177/002200946800300407 .
  • Tuteja, K. L. (১৯৯৭), "Jallianwala Bagh: A Critical Juncture in the Indian National Movement", Social Scientist, 25 (1/2): 25–61, জেস্টোর 3517759, ডিওআই:10.2307/3517759 .
  • Uloth, Gerald (১৯৯৩), Riding to War, Stockbridge, Hants: Monks, আইএসবিএন 0-9522900-0-6 .
  • Yadav, B.D. (১৯৯২), M.P.T. Acharya: Reminiscences of an Indian Revolutionary, New Delhi: Anmol, আইএসবিএন 81-7041-470-9 .

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]