নির্বিকল্প একটি সংস্কৃত বিশেষণ, যার সাধারণ অর্থ "বিকল্প নেই এমন"[১] নিঃ (निह्, না বা নয় ) ও বিকল্প (विकल्प, পরিবর্ত) – এই দুটি প্রতি অবস্থানকারী উপসর্গকে পরস্পর যুক্ত করে শব্দটি গঠিত হয়েছে।[২]
হিন্দুধর্মে রাজযোগে একটি আঙ্গিক শব্দরূপে ব্যবহৃত নির্বিকল্প সমাধি শব্দবন্ধটি সমাধি অবস্থার একটি বিশেষ রূপকে নির্দেশিত করে। হেইনরিক জিমার অন্যান্য অবস্থার সঙ্গে এই অবস্থার পার্থক্য প্রতিপাদন করতে গিয়ে বলেছেন:
অন্যদিকে নির্বিকল্প সমাধি বা অহংবোধ ব্যতিরেকে আত্মমগ্নতা হল একটি নিমজ্জিত মানসিক অবস্থা। এই অবস্থায় আত্ম-চিত্তবৃত্তি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয় যে জ্ঞাতৃজ্ঞেয়ত্রভেদ রহিত হয়; ঠিক যেমন ঢেউ জলে বিলীন হয়, ফেনা সমুদ্রে মিশে যায়।[৩] অন্যান্য সমাধি অবস্থার থেকে এর পার্থক্য এই যে এই সমাধিতে নিম্নস্থ কোনো চেতনায় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নেই। তাই এই সমাধিই একমাত্র সত্য সর্বশেষ জ্ঞান।
পরমহংস যোগানন্দ এই সমাধি অবস্থাকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন:[৪]
[সমাধির] সর্বোচ্চ স্তর নির্বিকল্প সমাধি। এই অবস্থায় আত্মা আত্ম ও পরমাত্মাকে জ্ঞাত হয়। দেখা যায় অহংবোধ, আত্মবোধ, পরমাত্ম-সমুদ্র সকলই একত্রে অবস্থান করছে। এটি এমন অবস্থা যখন পরমাত্ম-সমুদ্র ও সৃষ্টিতরঙ্গ সবই একসঙ্গে দৃষ্ট হয়। স্বতন্ত্র ব্যক্তি নিজেকে আর কোনো নির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকের "জন স্মিথ"-রূপে দেখতে পান না। তিনি উপলব্ধি করেন পরমাত্ম-সমুদ্র শুধু জন স্মিথরূপে তরঙ্গেই পরিণত হচ্ছে না, বরং পরিণত হচ্ছে অন্য সকল জীবের রূপেও। নির্বিকল্প অবস্থায় আত্মা অন্তস্থ পরমাত্মা ও বহিস্থ সৃষ্টি উভয় সম্পর্কেই যুগপৎ সচেতন হয়ে ওঠে। দিব্যপুরুষ নির্বিকল্প অবস্থায় আন্তরিক ঈশ্বরোপলব্ধির কোনো হানি না করেই জাগতিক জীবন অতিবাহিত করতে পারেন।
ধ্যান কীভাবে নির্বিকল্প সমাধি স্তরে উন্নীত হতে পারে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাগবত-গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৯ নং শ্লোকের অনুবাদে মহর্ষি মহেশ যোগী বলেছেন: [৫]
ধ্যান মনকে অতিন্দ্রিয় আত্ম-চৈতন্যে উন্নীত করে। এবং একটি স্বাভাবিক ও কার্যকারণবোধযুক্ত ক্রিয়া মনের এই অতিন্দ্রিয় দিব্য প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়। মন যখন ক্রিয়াক্ষেত্রে নিযুক্ত তখনও সেই ভাব বিলুপ্ত হয় না। এইভাবেই আত্মচৈতন্যবোধ বিশ্বচৈতন্যবোধে উন্নীত হয় – আত্মানন্দ থেকে ব্রহ্মানন্দে, সবিকল্প থেকে নির্বিকল্পে – সবশেষে যোগাবস্থায় বিশ্বচৈতন্যবোধ ঈশ্বরচৈতন্যবোধে পরিপূর্ণতা লাভ করে। জ্ঞানের প্রথম আলো তাঁর পূর্ণ গৌরবে উপনীত হয়।
নির্বিকল্প যোগ কাশ্মীর শৈবধর্মের দর্শনচিন্তার একটি আঙ্গিক শব্দ। শব্দটির অর্থ "আমি" ও শিবের সম্পূর্ণ সম্মিলন; নাম ও রূপ সকলই অন্তর্ধিত হয় এবং শিবই একমাত্র সত্য সত্ত্বারূপে প্রতিভাত হয়। এই ধারণা অনুযায়ী, সকল চিন্তা-চেতনার অবসানে এই অবস্থা হয়ে থাকে।[৬]
বৌদ্ধ দর্শনে আঙ্গিক শব্দ নির্বিকল্প জ্ঞান এডওয়ার্ড কনজ-এর অনুবাদে হয়েছে "সার্বিক বোধি" ("undifferentiated cognition")।[৭] কনজ বলেছেন, নির্বিকল্প জ্ঞান-এর উপলব্ধিই শাস্ত্রবচনের একমাত্র প্রমাণ। বৌদ্ধ দর্শনতত্ত্ব অনুযায়ী তিনি এই অবস্থাটিকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন:
"সার্বিক বোধি" প্রথমেই সকল বস্তুর অনিত্যতা উপলব্ধি করে। তারপর উপলব্ধি করে যে তাদের ছাড়া সকল জ্ঞানই ভূপতিত হয়। এবং সবশেষে চরম সত্যে উপনীত হয়। সত্যের এই স্ববিরোধী চরিত্রকে ধরে রাখার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করা হয়। যদিও ধারণা, বিচার ও পার্থক্য প্রতিপাদন ছাড়া এটি চিন্তাবিহীনতা ছাড়া কিছুই নয়। এটি বোধিও নয়, নির্বোধিও নয়। এর মূল চিন্তা নয়, চিন্তাবিহীনতাও নয়... বিষয় বা বস্তুর কোনো দ্বৈতভাব এখানে নেই। বোধি প্রাপ্ত বোধের থেকে পৃথক নয়; কিন্তু তার সঙ্গে একাত্ম।[৮]
বৌদ্ধ প্রয়োগ-প্রকরণের একটি ভিন্ন রূপ লক্ষিত হয় সংস্কৃত নির্বিকল্পযাতি (পালি: নিব্বিকপ্প ) শব্দে, যার অর্থ "সংশয় থেকে মুক্তি।[৯]