কবি নির্মলেন্দু গুণ | |
---|---|
জন্ম | নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী জুন ২১, ১৯৪৫ |
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশী |
পেশা | সাংবাদিকতা, কবি |
কর্মজীবন | – |
সন্তান | মৃত্তিকা গুণ |
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার | বাংলা একাডেমী, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার |
নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী[১] (জন্ম ২১ জুন ১৯৪৫, ৭ আষাঢ় ১৩৫২ বঙ্গাব্দ), যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত, একজন বাংলাদেশি কবি। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন ও ছবি এঁকেছেন। তার কবিতায় মূলত নারীপ্রেম,শ্রেণী-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধিতা, এ-বিষয়সমূহ প্রকাশ পেয়েছে।
১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের অন্তর্ভূত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তার স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য।
তাকে ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি তার ২য় মায়ের কাছে শিক্ষা অর্জন করেন।
গুণ ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণার বারহাট্টার কাশবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম রতন। তার ছেলেবেলা কাটে নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার কাশবনে। তার পিতার নাম সুখেন্দু প্রকাশ গুণ এবং মাতা বীণাপাণি। সুখেন্দু ও বীণাপাণির তিন মেয়ে এবং দুই ছেলের মধ্যে নির্মলেন্দু ছোট। চার বছর বয়সে মাতার মৃত্যুর পর তার পিতা চারুবালাকে বিয়ে করেন।[১]
আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলাম তখন দুপুর
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় দাঁড়িয়েছে।
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে
একজনের কাছ থেকে আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম
মহকুমা স্টেশনে উঠেই একজন আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
দূর থেকে বারবার চেয়ে দেখলেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না
বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনল না।
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম মা
বহুদিন যে দরজায় কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না
মরচে পড়া সেই দরজা মুহূর্তেই ক্যাচক্যাচ
শব্দ করে খুলে গেল।
বহুদিন চেষ্টা করেও গোয়েন্দা বিভাগ
আমাকে ধরতে পারেনি।
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভেতরে
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন
তিন মাইল বৃষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য।
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে
আমতলা থেকে আসবে আব্বাস।
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর
আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
আইয়ুব খান কোথায়?
শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?
আমার নামে কতদিন আর এ রকম হুলিয়া ঝুলবে?
— ১৯৭০ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ বিরচিত “হুলিয়া” কবিতার অংশ বিশেষ
চারুবালার কাছেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় তার। প্রথমে বারহাট্টার করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউটে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি।[১] ১৯৬২ সালে করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউট অর্থাৎ বারহাট্টা সি. কে. পি. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান৷ মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’৷
মেট্রিকের পর আই.এস.সি পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে৷ মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপসহ পড়তে থাকেন এখানে৷ ১৯৬৪ সালের আই.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনি ছিলেন একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের৷
পরবর্তীকালে বাবা চাইতেন ডাক্তারী পড়া৷ কিন্তু না, তিনি চান্স পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে৷ ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ৷ হঠাত্ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়৷ দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে৷ ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তার নাম ভর্তি লিষ্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া৷ এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে ফিরে আসেন গ্রামে৷
আই.এস.সি-তে ভালো রেজাল্ট করায় তিনি ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেয়েছিলেন৷ মাসে ৪৫ টাকা, বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা৷ তখনকার দিনে অনেক টাকা৷ ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন তিনি (যদিও বি.এ. সার্টিফিকেটটি তিনি তোলেননি)। ১৯৬৫ সালে আবার বুয়েটে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
১৯৮০ সালে তিনি নীরা গুণের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে এ দাম্পত্য জীবন সফল হয় নি। তাদের একটি মাত্র সন্তানের নাম মৃত্তিকা গুণ।
স্বাধীনতার পূর্বে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সাংবাদিকতায়ও জড়িত ছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ আধুনিকতার পথিকৃৎ জীবনানন্দ দাশের উত্তরসূরী নন। তার কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহ্যের আবহে লালিত। বেশিরভাগ কবিতায় অত্যাধুনিক দৃষ্টান্তবাদিতা পরিলক্ষিত।[২] তার নারীপ্রেমার্দ্র কবিতাগুলো ভারতীয় আবেগ-অনু্ভূতি সংলগ্ন। তার কবিতায় পাওয়া যায় কমনীয় ধ্বনি ও ছন্দ। নিজের অনুভূতিকে তিনি চিত্রিত করেন চিত্রময়তায়। অনেক ক্ষেত্রে ছন্দময়তার পরিবর্তে অবলম্বন করেছেন গদ্যকবিতার সহজ কাঠামো।
স্বদেশপ্রীতি তার কাব্যরচনার অন্যতম অনুপ্রেরণা। ১৯৬৬’ এর ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। এর বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে যখনই বিপর্যয় এসেছে ততবারই তিনি কলম তুলে প্রকাশ করেছেন তার ক্ষোভ ও দ্রোহ। শ্রেণীসংগ্রাম এবং স্বৈরাচার-বিরোধী কবিতা। নিহত হবার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে যে-ক’জন কবি ও লেখক সোচ্চার হয়েছেন, তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য।
১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কবিতার পাশাপাশি ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছেন। নিজের লেখা কবিতা এবং গদ্য সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য হলো -
অনেক সময় কবিতা লেখার চেয়ে আমি গদ্যরচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে আমার আত্মজৈবনিক রচনা বা ভ্রমণকথা লেখার সময় আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমি যে গদ্যটি রচনা করতে চলেছি, তা আমার কাব্য-রচনার চেয়ে কোনো অর্থেই ঊনকর্ম নয়। কাব্যকে যদি আমি আমার কন্যা বলে ভাবি, তবে গদ্যকে পুত্রবৎ। ওরা দুজন তো আমারই সন্তান। কাব্যলক্ষ্মী কন্যা যদি, গদ্যপ্রবর পুত্রবৎ।
বহুল আবৃত্ত কবিতাসমূহের মধ্যে - হুলিয়া, অসমাপ্ত কবিতা, মানুষ (১৯৭০ প্রেমাংশুর রক্ত চাই), আফ্রিকার প্রেমের কবিতা (১৯৮৬ নিরঞ্জনের পৃথিবী) - ইত্যাদি অন্যতম।