দেশ অনুযায়ী ইসলাম |
---|
![]() |
![]() |
নেপালে ইসলাম হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের পর তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। দেশটিতে প্রায় ১১ লাখ মুসলমান বাস করে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪.৪%।[১] ধারণা করা হয় যে, দেশটিতে বাংলাদেশি মুসলমান, পাকিস্তানি মুসলমান এবং ভারতীয় মুসলমানদের হাত ধরে ইসলাম যাত্রা শুরু করেছিল, যারা বিভিন্ন সময়ে নেপালে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।[২][৩] গোটা দেশে মোট ৪৩০টি মসজিদ রয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুর রত্নাপার্ক সংলগ্ন এলাকায় দেশটির ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মসজিদটি অবস্থিত।
মোট জনসংখ্যা | |
---|---|
১১,০০০০ (২০১১) | |
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
রৌতহট জেলা | ১৯.৭% |
বাঁকে জেলা | ১৯% |
কপিলবস্তু জেলা | ১৮%২ |
পর্সা জেলা | ১৪.৫% |
মহোত্তরী জেলা | ১৩.৩% |
বারা জেলা | ১৩% |
সুনসরী জেলা | ১১.৫% |
ধর্ম | |
কাশ্মিরি মুসলমান, বাঙালি,পশতুন,নেওয়ার মুসলমান,গোর্খা মুসলমান | |
ভাষা | |
আওয়াধি, ভোজপুরি ভাষা,নেপালি ভাষা,উর্দু,বাংলা ভাষা,হিন্দি ভাষা |
মুসলমানরা দীর্ঘ সময় ধরে নেপালে বসবাস করছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে সাধারণ ঐতিহ্যে অবদান রেখে নেপাল রাষ্ট্রের সাথে একটি শক্তিশালী পরিচয় গড়ে তুলেছে। ঐতিহাসিক প্রমাণ মতে, ১৩৫০ সালে অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের নেপাল অভিযানের সময় সেখানে মুসলিম বসতির সূচনা হয়। তবে যেহেতু সুলতান সেখানে বেশি দিন স্থায়ী হননি তাই মুসলিম বসতিও স্থায়ী হয়নি। কিছু ঐতিহাসিকের মনে করেন যে, বাংলা বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আমলে নেপালে ইসলামের আগমন ঘটে। তাদের বলেন, ইখতিয়ার তিব্বত অভিযানে ব্যর্থ হলে তার সৈন্যদের একটি দলছুট অংশ নেপাল গমন করেন এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলেন।[৪]
কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, ১৫ শতকের শেষের দিকে রাজা রত্ন মল্লের শাসনামলে প্রথম মুসলমানরা নেপালের কাঠমান্ডুতে বসতি স্থাপন করে।[৫] এই মুসলিমরা ছিল কাশ্মীরি বণিক, যাদের রত্না মাল্লা কাঠমান্ডুতে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। পশ্চিম নেপালের চৌবিসে রাজারাও আফগান ও ভারতীয় মুসলমানদের নেপালি সৈন্যদের আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে নিযুক্ত করেছিলেন। লাসায় রত্না মাল্লার দূত কাশ্মীরি মুসলমানদের কাশ্মীর, লাদাখ এবং লাসার মধ্যে যে উন্নত পাটি, কার্পেট, শাল এবং পশমী জিনিসপত্রের ব্যবসা করতেন তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য কাঠমান্ডুতে আমন্ত্রণ জানান। শামীমা সিদ্দিকা তার নেপালের মুসলিম বইয়ে লিখেন, মুসলমানদের প্রথম দলটি একজন কাশ্মীরি দরবেশের সাথে এসেছিল, যিনি ১৫২৪ সালে নেপালে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটি এখন কাশ্মীরি তাকিয়া মসজিদ নামে পরিচিত।[৫][৬][৭]
দিল্লিতে মুঘল দরবারের ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মল্লরাও ভারতীয় মুসলমানদের দরবারী এবং পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এটি মল্ল দরবারের নেওয়ার অভিজাতদের সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে। ফলে মুসলিম দরবারীরা বেশিদিন টিকতে না পেরে ভারতে ফিরে গেলেও অন্যান্য মুসলমানরা সেখানেই থেকে যায়। মল্লরাও মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ভারতীয় মুসলমানদের তাদের দরবারে সঙ্গীতজ্ঞ, পারফিউম ও অলঙ্কার বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগদান করেছিল। ঐতিহাসিক বাবুরাম আচার্য বিশ্বাস করেন যে, তারা রাজা রত্ন মল্লকে বিদ্রোহী আত্মীয়স্বজন এবং উচ্চ আদালতের কর্মকর্তাদের থেকে রক্ষা করার জন্যও সেখানে নিযুক্ত ছিলেন।[৫][৬]
নেপালের একীভূতকরণের পর রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ মুসলিম ব্যবসায়ীদের স্বপরিবারে বসতি স্থাপন করতে উৎসাহিত করেছিলেন। বাণিজ্য ছাড়াও আফগানিস্তান ও ভারতের মুসলমানরা বন্দুক, কার্তুজ এবং কামান তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ছিল এবং অন্যরা ফার্সি ও আরবি ভাষার জ্ঞানের কারণে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কার্যকর ছিল। পৃথ্বী নারায়ণ শাহ উপত্যকায় যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিলেন সে সময় অনেক মুসলমান বিশেষ করে কাশ্মীরি ব্যবসায়ীরা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।"তাদের ধর্ম এবং মল্লদের সাথে তাদের সম্পর্কের কারণে একজন হিন্দু রাজার নিপীড়নের ভয়ে তাদের কোন ক্ষতি হবে না" এমন আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা চলে যায়। ১৭৭৪ সাল নাগাদ শুধুমাত্র গুটিকয়েক কাশ্মীরি বণিক অবশিষ্ট ছিল। তা সত্ত্বেও কাশ্মীরি ব্যবসায়ীরা একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সময় একটি দুর্দান্ত সহায়ক হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, পৃথ্বী নারায়ণ শাহ তাদের মল্ল শাসকদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারণে তাদের গুপ্তচর ও তথ্যদাতা হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। তার বিজয়ের পর তিনি মুসলিমদের একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেন, যা বর্তমানে নেপালি জামে মসজিদ নামে পরিচিত।[৬]
১৮৫৭ সালে জং বাহাদুর রানার শাসনামলে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে পালিয়ে ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান তরাইয়ে চলে আসেন। তারা তরাই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে চামড়ার পণ্য বিক্রি শুরু করেন। তবে কেউ কৃষি শ্রমিক হিসাবেও কাজ করেন। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের একজন সিনিয়র দরবারীও কাঠমান্ডুতে পালিয়ে যান। পরে তিনি জামে মসজিদ সংস্কার করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় লখনৌর নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের স্ত্রী বেগম হযরত মহলও নেপালগঞ্জ হয়ে কাঠমান্ডুতে পালিয়ে যান এবং তাকে জং বাহাদুর কর্তৃক নেপালে আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি থাপাথালি দরবারে বসতি স্থাপন করেন এবং পরে কাঠমান্ডুতে মারা যান। তাকে নেপালি মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।[৫][৬]
নেপালের মুসলিম সম্প্রদায়ের ইতিহাস মূলত তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর ইতিহাস। তিব্বতি, কাশ্মীরি এবং মাধেসি।[৮]
ঐতিহাসিকগণের মতে, কাশ্মীরি মুসলমানরা রাজা রাম মল্লের শাসনকালে (১৪৮৪-১৫২০ খ্রি) কাঠমান্ডু আসেন। তারা তখন একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন এবং বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কয়েকজনকে মল্ল দরবারে দরবারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং অনেকে তিব্বতের সাথে ব্যবসা করতেন। এদের বংশধর বর্তমান কাঠমান্ডুতে বাস করে; সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। তারা সুশিক্ষিত হওয়ার প্রবণতা রাখে এবং কাশ্মীরি ভাষায় কথা না বলে নেপালি ও উর্দু ভাষার মিশ্রণে কথা বলে। তাদের অনেকে ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করলেও কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন বা রাজনীতিতে এসেছেন।[৯]
তিব্বতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম অভিবাসীদের মধ্যে লাদাখ এবং তিব্বত থেকে আসা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। তিব্বতীদের বেশিরভাগই চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পরে এসেছিলেন। তিব্বতী মুসলমানরা ভাষা ও পোশাকে তিব্বতি বৌদ্ধ থেকে আলাদা নয়। বর্তমান তাদের অনেকে চীনা পণ্যের ব্যবসায় এবং কিউরিও বিক্রিতে নিযুক্ত রয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই গোষ্ঠীর মুসলিমরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশি ধনী হয়ে থাকে।
তিব্বতীয় মুসলমানদের গল্প একটি অনন্য সম্প্রদায়ের গল্প, যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের ঐতিহ্য অনুসারে, ইসলাম প্রায় এক হাজার বছর আগে তিব্বতে এসেছিল। তিব্বত এমন একটি অঞ্চল, যা সর্বদাই একচেটিয়া বৌদ্ধ সংস্কৃতির সমার্থক। ১২ শতকের কোনো এক সময়ে কাশ্মীর ও লাদাখ থেকে একদল মুসলিম ব্যবসায়ী হিসেবে তিব্বতে এসেছিলেন। তখন তাদের অনেকেই তিব্বতে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তিব্বতি নারীদের বিয়ে করেছিলেন। লেখক টমাস আর্নল্ড তার বই ইসলাম প্রচারে বলেন, ধীরে ধীরে বিবাহ এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় তিব্বতের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেতে থাকে এবং একপর্যায়ে রাজধানী লাসার আশেপাশে একটি বিশাল মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হলে নির্যাতনের ভয়ে অনেক মুসলমান নেপাল পালিয়ে আসেন।[৯][১০]
মাধেসি মুসলমানরা ইসলাম অনুগামীদের বৃহত্তম সম্প্রদায়। ৭৪ শতাংশেরও বেশি মুসলিম মাধেস অঞ্চলে পাওয়া যায়। মাধেসি মুসলমানরা সাধারণত হিমালয়ের নিম্ন পাহাড় এবং ভারত সীমান্তের কাছেই অবস্থিত তরাই সমভূমিতে বসবাস করে। তারা তরাইয়ের বাঁকে, কপিলবস্তু, রূপানদেহি, পারসা, বারা এবং রাউতহাটে কেন্দ্রীভূত। নেপাল একীভূতকরণের সময় কিছু মাধেসি মুসলমান এখানে ছিলেন এবং অন্যরা ভারত, পাকিস্তান থেকে এসেছেন। অনেকে ১৯ শতকে আফগানিস্তান, তুরস্ক, আরব, তিব্বত, মিশর থেকে মজুরি শ্রমিক হিসাবে আসেন। তাদের বেশিরভাগই কৃষক এবং একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এখনো ভাড়াটে এবং কৃষি শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। বাড়িতে তারা উর্দুতে কথা বলে। তবে কেউ কেউ আওয়াধী ভোজপুরি, মৈথিলি ও নেপালি ভাষাতেও কথা বলে।[১১]
২০১১ সালের সরকারি আদমশুমারি অনুসারে নেপালে এগারো লক্ষাধিক মুসলমান বাস করে। মুসলিমদের অধিকাংশই তিরাই অঞ্চলে বাস করে।[১২] শতকরা হিসেবে দেশটির সাতটি মুসলমান অধ্যুষিত জেলাগুলো হল:
রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রায় ২১ হাজারের অধিক মুসলমান বাস করে, যা শহরটির মোট জনসংখ্যার ১.২৫%।
একটি জরিপে দেখা গেছে যে, নেপালি মুসলমানরা ধর্মকর্মে অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলির তুলনায় বেশ এগিয়ে এবং নেপালি সমাজে দিন দিন ইসলামের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। নেপালের ইসলামি সোসাইটির প্রধান খুরশিদ আলম বলেন, গত ১৫ বছরে প্রায় ১ লাখ নেপালি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।[১৩] এর আগে নেপালি ভাষায় ইসলাম ধর্মের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বই ছিল না। নেপালি ভাষায় কোরআনের অনুবাদও ছিল না। সম্প্রতি মুসলমানদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন ভারত থেকে নেপালী ভাষায় কোরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেছে।[১৪] নেপালে অনেক দেওবন্দি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
|তারিখ=
(সাহায্য)
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)