ন্যায়পাল (সুইডীয়: Ombudsman উচ্চারিত [ˈɔ̂mːbʉːdsˌman] অম্বুদ্স্মান্) বা নাগরিক আইনজীবী এমন একজন কর্মকর্তা যিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বাধীনতাসহ সাধারণত সরকার বা সংসদ দ্বারা নিযুক্ত হন। কিছু দেশে একজন মহাপরিদর্শক, নাগরিক আইনজীবী বা অন্যান্য কর্মকর্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় ন্যায়পালের মতোই থাকতে পারে এবং তিনি আইনসভার দ্বারাও নিযুক্ত হতে পারে। জাতীয় স্তর ছাড়াও একটি রাষ্ট্র, স্থানীয় বা পৌর সরকার কর্তৃক একজন ন্যায়পাল নিয়োগ করা হতে পারে। উপযোগ সরবরাহকারী, সংবাদপত্র, বেসরকারি সংস্থা বা পেশাদার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতো একটি কর্পোরেশন দ্বারা অনানুষ্ঠানিক ন্যায়পাল নিয়োগ করা হতে পারে বা কাজ করতে পারে।
একজন ন্যায়পালের সাধারণ দায়িত্ব হলো অভিযোগ তদন্ত করা এবং সাধারণত সুপারিশ বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সেগুলি সমাধান করার চেষ্টা করা। ন্যায়পাল কখনো কখনো এমন পদ্ধতিগত সমস্যাকে চিহ্নিত করাকেও উদ্দেশ্য করে, যা দুর্বল পরিষেবা বা জনগণের অধিকার লঙ্ঘনের দিকে পরিচালিত করে। জাতীয় স্তরে অধিকাংশ ন্যায়পালের সম্পূর্ণ নাগরিক খাত এবং কখনো কখনো বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলিকে (উদাহরণস্বরূপ, চুক্তিবদ্ধ পরিষেবা প্রদানকারী) মোকাবেলা করার জন্য একটি বিস্তৃত কর্তৃত্ব রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আরও সীমাবদ্ধ কর্তৃত্ব ন্যায়পালের রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ সমাজের নির্দিষ্ট খাতের সাথে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশসমূহে ন্যায়পাল পদের সাম্প্রতিক উন্নয়নে বিশেষায়িত শিশু ন্যায়পাল গঠন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশ্বের কিছু বিচারব্যবস্থায় জাতীয় সরকার সম্পর্কে উদ্বেগ পরিচালনা করার জন্য অভিযুক্ত একজন ন্যায়পালকে আরও আনুষ্ঠানিকভাবে "সংসদীয় কমিশনার" হিসাবে উল্লেখ করা হয় (যেমন যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্টারি কমিশনার ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় রাজ্য ন্যায়পাল)। অনেক দেশে যেখানে ন্যায়পালের দায়িত্ব মানবাধিকার রক্ষার অন্তর্ভুক্ত, সেখানে ন্যায়পালকে জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০ শতকের শেষের দিকে ন্যায়পালের পদটি বেশিরভাগ দেশের সরকার এবং কিছু আন্তঃসরকারি সংস্থা যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
একজন ন্যায়পালের একটি আদিরূপ চীনে ছিন রাজবংশের (খ্রিস্টপূর্ব ২২১) সময় এবং পরে কোরিয়ায় জোসন রাজবংশের সময় বিকাশ লাভ করেছিল।[১] গোপন রাজকীয় পরিদর্শক বা আমহেং-ইওসা (암행어사, 暗行御史) পদটি জোসেন রাজবংশে অনন্য ছিল, যেখানে রাজা কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত একজন গোপন আধিকারিককে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর নজরদারি করতে এবং জনগণের দেখাশোনা করার জন্য ছদ্মবেশে প্রদেশগুলিতে পাঠানো হতো। রোমান ট্রিবিউনদেরও কিছু অনুরূপ ভূমিকা ছিল, যেখানে তাঁদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা ছিল যা প্লিবিয়ানদের সাথে তাঁদের অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি করতো। ন্যায়পালের আরেকটি প্রাক-নমুনা ছিল দিওয়ান আল-মাজালিম (دِيوَانُ الْمَظَالِمِ) ও কাদি আল-কুদাত (قَاضِي الْقُضَاةِ) এর ধারণা, যার উপস্থিতি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমরের (৬৩৪-৬৪৪) আমলে পাওয়া যায়।[২] ন্যায়পাল পদটি শ্যামদেশ, ভারত, লিয়াও রাজবংশ (খিতান সাম্রাজ্য), জাপান এবং চীনেও প্রত্যয়িত হয়েছিল।[৩]
Ombudsman শব্দটির আধুনিক ব্যবহার নরওয়েতে শুরু হয়েছিল, এবং সুইডেন ১৮০৯ সালের সরকারের ইনস্ট্রুমেন্ট দ্বারা নাগরিক অধিকার রক্ষার্থে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক একটি তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা ‘সুইডিশ সংসদীয় ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু হয়। সুইডিশ সংসদীয় ন্যায়পালের পূর্বসূরি ছিলেন সর্বোচ্চ ন্যায়পাল কার্যালয় (Högste Ombudsmannen), যা ১৭১৩ সালে সুইডিশ রাজা দ্বাদশ চার্লস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বাদশ চার্লস তুরস্কে নির্বাসিত হয়ে ছিলেন, এবং বিচারক ও বেসামরিক কর্মচারীরা আইন অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করছে কি-না নিশ্চিত করতে সুইডেনে একজন প্রতিনিধির প্রয়োজন ছিল। যদি তাঁরা তা না করতো, তাহলে অবহেলার দরুন তাঁদের বিচার করার অধিকার সর্বোচ্চ ন্যায়পালের ছিল। ১৭১৯ সালে সুইডেনের সর্বোচ্চ ন্যায়পাল পদটি চ্যান্সেলর অফ জাস্টিসে পরিবর্তন করা হয়।[৪] সংসদীয় ন্যায়পাল পদটি ১৮০৯ সালে সুইডিশ রিক্সদাগ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এখনো চালু থাকা চ্যান্সেলর অফ জাস্টিসের সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হয়, যা মতেঁস্কিউ দ্বারা বিকশিত ক্ষমতা পৃথকীকরণের ধারণাকে প্রতিফলিত করে চলেছে।[৪]
সাধারণভাবে ন্যায়পাল হলেন একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা যিনি নাগরিকদের স্বার্থে সরকারি কার্যকলাপের উপর একটি চেক প্রদান করবার জন্য এবং নাগরিকদের বিরুদ্ধে অনুপযুক্ত সরকারি কার্যকলাপের অভিযোগের তদন্তের তদারকি করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। যদি ন্যায়পাল একটি অভিযোগ প্রমাণিত হতে দেখেন, তাহলে তিনি সমস্যাটি সংশোধন করতে পারেন, অথবা পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেন। সমস্যার পরবর্তী প্রতিকার সংশ্লিষ্ট দেশের আইনের উপর নির্ভর করে, তবে এতে সাধারণত আর্থিক ক্ষতিপূরণ সাজা (জরিমানা) জড়িত থাকে। বেশিরভাগ দেশের ন্যায়পালের কাছে অভিযোগের ভিত্তিতে আইনি প্রক্রিয়া বা বিচার শুরু করার ক্ষমতা নেই। এই পদটিকে কখনো কখনো একটি "ট্রাইব্যুনিশিয়ান" পদ হিসাবে উল্লেখ করা হয় এবং ঐতিহ্যগতভাবে পদটি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পালন করতো - এই শব্দটি দ্বারা প্রাচীন রোমান "প্লিবিয়ানদের বিচারক"কে (ত্রিবুনি প্লেবিস) বোঝায়, যাঁর ভূমিকা ছিল সাধারণ নাগরিকদের কল্যাণে প্লিবিয়ানদের মাঝে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করা।
একজন ন্যায়পালের প্রধান সুবিধা হলো যে তিনি অপরাধমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরের অভিযোগগুলো নিরীক্ষণ করতে পরেন, যাতে করে তিনি স্ব-আরক্ষার অন্তর্নিহিত স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যান। যাইহোক, ন্যায়পাল ব্যবস্থা পদটির জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচনের উপর এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে থেকে অন্তত কিছু কার্যকর কর্মকর্তার সহযোগিতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। অবশ্য পদটিও সমালোচিত হয়েছে: "ন্যায়পাল হচ্ছে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের অবশেষ, একে ক্ষমতার কাঠামো অক্ষত রেখে প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার সবচেয়ে খারাপ অমিতাচারকে ইস্ত্রি করার জন্য নকশা করা হয়েছে।"[৫]
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল সম্পর্কে বলা হয়েছে। পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনার বা কর্মকর্তাকে ন্যায়পাল বলে। তিনি সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করেন। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ন্যায়পাল নিয়োগ করার বিধান রয়েছে। ন্যায়পাল অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত রিপোর্ট করেন কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেন না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে সংবিধানে ন্যায়পালের বিধান রয়েছে। ১৯৮০ সালে ন্যায়পাল নিয়োগ ও তাঁর দায়িত্ব নির্ধারণ করে 'Ombudsman Act' প্রণয়ন করা হয়। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত ন্যায়পাল পদটিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।