পরিষদীয় আন্দোলন (Conciliar Movement বা Conciliarism) হচ্ছে চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ক্যাথলিক চার্চের একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন, যার দাবী ছিল চার্চের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব হবে এক্যুমেনিকাল পরিষদের, পোপের নয়; এমনকি এক্যুমেনিকাল পরিষদ যদি পোপের বিরুদ্ধেও যায় তবুও চার্চের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব থাকবে এক্যুমেনিকাল পরিষদের উপরেই। এই আন্দোলনটি শুরু হয় রোম এবং এভিগোঁ এর পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী পোপের কারণে ঘটা পশ্চিমের বিভেদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। এই বিভেদের ফলে ১৪০৯ সালে পিসার পরিষদ বসে যা বিভেদের অবসানে ব্যর্থ হয়, এবং ১৪১৪ থেকে ১৪১৮ সাল ব্যাপী কনস্ট্যান্সের পরিষদ বসে যা সফল হয় এবং পোপের চেয়েও উচ্চ স্থান অর্জন করে দুজন পোপকে পদত্যাগ করতে বলে ও একজন পোপকে পদচ্যুত করে। এই পরিষদীয় আন্দোলন তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে ১৪৩১ থেকে ১৪৪৯ সালের বাসেলের পরিষদের সময়, যা চূড়ান্ত ভাবে বিফল হয়, শেষ পর্যন্ত ১৫১২ থেকে ১৫১৭ সালের পঞ্চম ল্যাটারান পরিষদের মাধ্যমে পরিষদীয় আন্দোলনের নিন্দা জানানো হয় এবং পাপাসি বা পোপতন্ত্র নামক প্রতিষ্ঠানটিরই বিজয় নিশ্চিত হয়।[১] তবে পেপল ইনফলিবিলিটি বা পোপ হিসেবে কার্যের সময় পোপের কখনও ভুল হতে পারে না এই ধারণাটি ১৮৭০ সালের প্রথম ভ্যাটিকান পরিষদের পূর্বে প্রচারিত হয় নি।
ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতক ছিল পোপতান্ত্রিক কর্তৃত্ব এবং ক্যাথলিক ইউরোপের জন্য একটি চ্যালেঞ্জের সময়কাল ছিল। পোপতন্ত্র এবং ইউরোপের ধর্মনিরপেক্ষ রাজাদের মধ্যে বিতর্কের সূচনা হলে আরও নতুন চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়। বিশেষ করে ফ্রান্সের চতুর্থ ফিলিপ এবং পোপ অষ্টম বনিফেসের মধ্যে ফ্রান্সের যাজকদের কর এর অধিকার নিয়ে বিতর্ক পরিস্থিতি অনেক উত্তপ্ত করে। ফিলিপকে চার্চচ্যুত করা হয়, আর বনিফেসকে দুর্নীতি, জাদু ও সডোমির (পায়ুকাম ও মৌখিক কাম বা মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর সাথে কাম যা খ্রিস্টধর্মে নিষিদ্ধ) অভিযুক্ত করা হয়। বনিফেস তার লেখা উনাম স্যাংকটাম (১৩০২) গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আধ্যাত্মিক ও পার্থিক উভয় জগতের উপরেই পোপের ক্ষমতা রয়েছে, ও একমাত্র ঈশ্বরই পোপকে বিচার করতে পারেন। ফিলিপ বনিফেসকে গ্রেফতার করার জন্য ইতালিতে নাইট পাঠানোর মাধ্যমে এর জবাব দেন। ফিলিপের নাইটেরা বনিফেসকে তার আনাগিঁর প্রাসাদে আক্রমণ করেন, তাকে বন্দী করেন। তবে তাকে মুক্তি দেয়া হয়, কিন্তু মুক্তির মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি উচ্চ মাত্রার জ্বর এবং বন্দীদশায় ভোগ করা মানসিক আঘাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
এই ঘটনার পর ১৩০৯ সালে রোমান পোপতন্ত্র ফ্রান্সের এভিগোঁতে চলে আসে, যেখানে এই পোপতন্ত্র ১৩৭৭ সাল অব্দি বর্তমান থাকে। দুর্নীতি, ফরাসীদের দিকে পক্ষপাতিত্ব এবং বৈধর্মের কারণে এভিগোঁ পোপতন্ত্রের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিণামে পোপ ষষ্ঠ ক্লিমেন্ট, যিনি নিজে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য সমালোচিত হতেন, তিনি বিবৃতি দিয়ে বসেন যে, আমার আগের পোপেরা জানতেন না যে কীভাবে পোপ হতে হয়"। এভিগোঁ পোপতন্ত্রের সময়ের সকল পোপ, বেশিরভাগ কার্ডিনাল এবং কিউরিয়াল অফিসারই ছিলেন ফরাসী। এভিগোঁ পোপতন্ত্রের মর্যাদার এই অবস্থার ফলে অনেকেই সার্বজনীন ক্যাথলিক চার্চকে পরিচালনার ক্ষেত্রে পোপের চূড়ান্ত ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
পশ্চিমের বিভেদ (১৩৭৮-১৪১৭) ছিল রোমের পোপ ষষ্ঠ আরবান এবং এভিগোঁ এর পোপ সপ্তম ক্লিমেন্ট এর বৈধ নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব। এই বিভেদে উচ্চমাত্রায় রাজনীতি ঢুকে যায়, কেননা ইউরোপের রাজারা যাকে পোপ নিযুক্ত করলে নিজেদের সর্বোত্তম স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে সেটা দেখে দুজন পোপের একজনকে সমর্থন দান করেন। উভয় পোপই পোপ হিসেবে তাদের উত্তরাধিকারীদেরকে ঠিক করে যান, আর তাই আরবান আর ক্লিমেন্টের মৃত্যুর পরও এই বিভেদ চলতেই থাকে। এই সমস্যার কারণে মঞ্চে আগমন ঘটে পরিষদীয় আন্দোলনের এবং এখান থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে কোন পোপের পদত্যাগের মাধ্যমে বসে যাওয়া উচিৎ। কার্ডিনালগণ ক্যাথলিক চার্চের একক পোপ হিসেবে কে বহাল থাকবেন তা ঠিক করার জন্য পিসার পরিষদের (১৪০৯) এর আয়োজন করেন। কিন্তু এই পরিষদটি বিফলে পর্যবসিত হয় যার ফলে এটি তৃতীয় একজন পোপকে নির্বাচিত করে। কনস্ট্যান্সের পরিষদ (১৪১৪-১৪১৮) সাফল্যের সাথে দুইজন পোপকেই (ত্রাবিংশ জন এবং ত্রয়োদশ বেনেডিক্ট) পদত্যাগ করিয়ে, এবং আরেকজনকে পদচ্যুত করিয়ে পোপ পঞ্চম মারটিনকে নির্বাচিত করা হয়। সেই সাথে এই পরিষদটি এই আইন জারি করে যে এরপর থেকে পরিষদই চার্চের প্রধান নিয়ন্ত্রক হবে, যদিও পোপ পঞ্চম মার্টিন এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন নি।
পোপের কিউরিয়াগণ সেই সময় সঙ্গে সঙ্গে চার্চের সংস্কার করেন নি, এর ফলে বাসেলের পরিষদে (১৪৩১-১৪৪৯) এই পরিষদীয় আন্দোলন মৌলবাদী হয়ে ওঠে, যা প্রথম দিকে ইউরোপে বিশাল সমর্থন লাভ করে, কিন্তু পরেই ভেঙ্গে পড়ে। এদের একটি অংশ ফ্লোরেন্সের পরষদে পোপের সাথে যোগ দেয়, যেখানে বাসেলের পরিষদীয় দল, যা আরেকজন এন্টিপোপকে নির্বাচিত করেছিল তা সমগ্র ইউরোপেই সমর্থন হারিয়ে ফেলে।
পঞ্চম ল্যাটারান পরিষদে (১৫১২-১৫১৭) পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস পুনরায় পরিষদের উপরে পোপতন্ত্রের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিষদীয় আন্দোলন বিরোধী কার্ডিনালই সেই পরিষদে বেশি ছিলেন, তারা পরিষদের কর্তৃত্বের নিন্দা করেন। প্রকৃতপক্ষে এই পরিষদ ছিল এর পূর্বের পরিষদগুলো যেমন চতুর্থ ল্যাটেরান (১২১৫), লিওঁ (১২৭৪), ভিয়েনা (১৩১১) এর সম্পূর্ণ অনুরূপ ছাড়া আর কিছুই না।
অকাম এর উইলিয়াম (মৃত্যু ১৩৪৯) পরিষদীয় আন্দোলন প্রথম দিককার রচনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলো লেখেন, যেখানে এই আন্দোলনের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে লেখা হয়। তার উদ্দেশ্য ছিল পোপ দ্বাদশ জনকে পোপের পদ থেকে সরানো, যিনি খ্রিস্ট এবং তার প্রচারকদের ব্যক্তিগত বা সামষ্টিকভাবে কোন কিছু না অধিকার করা সম্পর্কিত আধ্যাতিক ফ্রান্সিস্কান ধারণা সমর্থনকারী একটি আদেশকে বাতিল করেছিলেন। তার যুক্তিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলোর কয়েকটি হচ্ছে, বিশ্বাসীদের ও তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে পোপের পদাধিকার অর্জন পোপের কর্তৃত্বকে কমিয়ে দেয়। সার্বজনীন চার্চ হচ্ছে বিশ্বাসীদের একটি মিলনস্থল, ক্যাথলিক চার্চ এরকমটা নয় যার সম্পর্কে যিশুখ্রিস্ট তার বাণীপ্রচারকদেরকে বলে গিয়েছিলেন। সার্বজনীন চার্চগুলোর দ্বারা কখনই বৈধর্ম সংঘটিত হতে পারে না, কিন্তু এটা জানা যে অতীতে পোপের দ্বারা বৈধর্ম ঘটেছে।[২] যদি পোপ বৈধর্মে পতিত হন তাহলে, পোপের অনুমতি ছাড়াই তার বিচারের জন্য পরিষদের আয়োজন করা যাবে। উইলিয়াম এও বলেছিলেন যে, এটা সার্বজনীন চার্চ বলে পরিষদে নারী ও পুরুষ উভয়ই অংশগ্রহণ করতে পারবে।
পাদুয়ার মারসিলিয়াস তার ডিফেনসর পাসিস (১৩২৪) গ্রন্থে অকামের উইলিয়ামের সাথে সম্মত হন যে, সার্বজনীন চার্চ হচ্ছে বিশ্বাসীদের চার্চ, যাজকদের চার্চ নয়। মারসিলিয়াস এই ধারণায় মনোযোগ দিয়েছিলেন যে, যাজকগণের পৌরহিত্যের অসমতার কোন স্বর্গীয় ভিত্তি নেই, এবং পোপ নয়, যিশুখ্রিস্টই ক্যাথলিক চার্চের একমাত্র প্রধান।[৩] প্যাপাল ইনফলিবিলিটি বা পোপ কখনও পোপের কার্যে ভুল করতে পারেন না, এই ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে মারসিলিয়াস দাবী করেন, কেবল সার্বজনীন চার্চই ভুলের ঊর্ধ্বে, পোপ নন। মারসিলিয়াস উইলিয়ামের যাজকসম্প্রদায়ের বলপূর্বক ক্ষমতার প্রয়োগের নিষেধাজ্ঞার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। পরবর্তীতে পরিষদীয় তাত্ত্বিক যেমন জ্যাক আলমাইন এক্ষেত্রে মারসিলিয়াসের মতকে ত্যাগ করেন, এবং ঐতিহ্যগত যাজকভিত্তিক আমলাতন্ত্রের বদলে আরও বেশি সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিকভাবে চিন্তা করেন।
পরিষদীয় তত্ত্বের মূল একই সাথে ইতিহাস এবং ধর্মতত্ত্বে প্রোথিত, কারণ ক্যাথলিক চার্চ তার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই নিয়েছে ৩২৫ সালের নাইকিয়ার প্রথম পরিষদ থেকে শুরু করে অনেকগুলো পরিষদের মধ্য দিয়ে। পরিষদীয় আন্দোলন চার্চে অনেক করপোরেট তত্ত্বও প্রদান করেছিল, যেটা অনুসারে চার্চের প্রধানের কোন কাজে যদি সমগ্র জগতের স্বার্থ হুমকির মুখে পতিত হয় তাহলে চার্চের সদস্যগণ তার বিচার করতে পারবে।[২] যেসব ক্যাননিস্ট এবং ধর্মতাত্ত্বিকগণ পরিষদের প্রাধান্যের পক্ষে ছিলেন তারা মারসিলিয়াস এবং অখামের কথাগুলোই বলতেন, কিন্তু তারা এগুলো আরও বেশি রক্ষণশীল উপায়ে বলতেন। তারা যাজকদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানের সংযুক্তকরণ, রক্ষা এবং সংস্কার করতে চাইতেন, কিন্তু ফ্রান্সিসকান বা অন্য কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। এই অধিক যাজকভিত্তিক পরিষদীয় আন্দোলনের তাত্ত্বিকদের মধ্যে ছিল জ্যাঁ গারসন, পিয়েরে ডি'এলি এবং ফ্রান্সিসকো জাবারেলা। কুসা এর নিকোলাস পরিষদীয় আন্দোলনের ধারা সমন্বিত করার ধারণা দেন, যেখানে বিশ্বাসীদের সম্মতি এবং প্রতিনিধিত্বকে চার্চের যাজকতন্ত্রের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।[২]
জন কিলকুলেন স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফিতে লিখেছেন, "ফ্রান্সে পরিষদীয় আন্দোলন ছিল গ্যালিক্যান আন্দোলনের এর একটি অন্যতম উৎস্য।"[৪]
চার্চের অনেক সদস্য এই বিশ্বাসে অটল থাকেন যে, পোপগণ সেইন্ট পিটারের উত্তরাধিকারী এবং তারাই চার্চের সর্বময় কর্তৃত্বে বহাল থাকবেন। হুয়ান ডে টর্কমাডা তার ১৪৫৩ সালের সম্পন্ন গ্রন্থ Summa de ecclesia তে পোপের সর্বময় ক্ষমতাকে সমর্থন করেন। এর পরের প্রজন্মে থমাস ক্যাজেটান তার On the comparison of the authority of pope and council রচনায় খুব জোড়ের সাথে পোপের ক্ষমতাকে সমর্থন করেন। তিনি লেখেন, "পিটার একাই যিশু খ্রিস্টের ভিকারিয়েট বা প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছিলেন, আর কেবল তিনিই খ্রিস্টের পর সাধারণ উপায়ে এটি লাভ করেছিলেন, যাতে অন্যরাও (প্রচারকগণ) এই ক্ষমতা সাধারণ নিয়মের আওতায়ই লাভ করেন," এবং "এটাও দেখতে হবে যে, খ্রিস্ট যাজকীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণ চার্চ সম্প্রদায়কে প্রদান করেন নি, বরং প্রদান করেছিলেন চার্চের মাত্র একজন ব্যক্তিকে।"[৫] উভয় লেখকই অনেক কার্ডিনাল, ক্যানন আইনজীবী এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন, যেখানে এরা পরিষদীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পিটারের উত্তরাধিকারী বা পোপদের সর্বময় ক্ষমতাকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু পরিষদীয় আন্দোলন এই তর্কশাস্ত্রের মুখে পতিত হয়ে বিলুপ্ত হয়নি। এই আন্দোলন জীবিত ছিল যা ট্রেন্টের সভার কারণ হয়ে দাঁড়ায়ম, যে সভার ফলে ১৫৪০ এর দশকে ক্যাথলিক প্রতিসংস্কার শুরু হয়, এবং এই পরিষদীয় আন্দোলনই পরবর্তীতে গ্যালিক্যান আন্দোলন, জোসেফিন আন্দোলন এবং ফেব্রোনিয়ান আন্দোলনের জন্ম দেয়।
|প্রথমাংশ1=
এর |শেষাংশ1=
নেই (সাহায্য)