পর্ণমোচী (ইংরেজি: deciduous) মানে “পরিপক্ব অবস্থায় ঝরে যাওয়া”[১] অথবা “ঝরে যাওয়ার ঝোঁক”[২] বোঝায়। যেসব বৃক্ষ অথবা গুল্ম ঋতুভেদে পাতা ঝরিয়ে দেয় সেসব ক্ষেত্রে, এবং উদ্ভিদের অন্যান্য অংশসমূহ (যেমন- ফুল ফোটার পর পাপড়ি বা পরিপক্ব হয়ে গেলে ফল) ঝরানোর ক্ষেত্রে আদর্শরূপে এটিকে ব্যবহার করা হয়। আরোও সাধারণ অর্থে বলা যায়, পর্ণমোচী মানে হল যে অঙ্গ আর প্রয়োজন নেই, অথবা যে অঙ্গের উদ্দেশ্য ফুরিয়ে গেছে, তার ঝরে যাওয়া। উদ্ভিদে এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গের ক্ষেত্রেও একই অর্থ নির্দেশ করা হয়, যেমন- হরিণের পর্ণমোচী শিং,[৩] অথবা মানুষসহ কিছু স্তন্যপায়ীর পর্ণমোচী দুধদাঁত।
উদ্ভিদবিদ্যা এবং উদ্যানবিদ্যায় বৃক্ষ, গুল্ম ও বিরুৎ বহুবর্ষজীবীসহ পর্ণমোচী উদ্ভিদ হল সেগুলো যারা বছরের একটি সময়ে তাদের সকল পাতা ঝরিয়ে দেয়।[৪] এই প্রক্রিয়াকে অ্যাবসিশন বলে।[৫] কিছু কিছু ক্ষেত্রে পত্রঝরার বিষয়টি শীতকালের সাথে কাকতালীয়ভাবে মিলে যায়- যেমন, শীতপ্রধান অথবা মেরু জলবায়ু।[৬] বিশ্বের অন্যান্য অংশে, যেমন ক্রান্তীয়, প্রায়-ক্রান্তীয়, এবং শুষ্ক অঞ্চলে, বৃষ্টিপাতের বৈচিত্রের উপর ভিত্তি করে শুষ্ক মৌসুমে অথবা অন্যান্য মৌসুমে উদ্ভিদ তাদের পাতা ঝরিয়ে দেয়।
পর্ণমোচীর বিপরীত হল চিরহরিৎ, যার ক্ষেত্রে সারা বছর ধরে সবুজ পত্ররাজি বিরাজ করে।[৭] যেসব উদ্ভিদ এসবের মাঝামাঝি, তাদেরকে প্রায়-পর্ণমোচী বলা হয়; নতুন বৃদ্ধি শুরুর সাথে সাথে এরা পাতা ঝরিয়ে দেয়।[৮] অন্যসব উদ্ভিদ হল প্রায়-চিরহরিৎ যারা শীতঋতুতে অথবা শুষ্ক মৌসুমে কিছু পাতা ধরে রেখে পরবর্তী বৃদ্ধি মৌসুম আসার আগেই পাতা ঝরিয়ে দেয়।[৯] ওকের কিছু প্রজাতিসহ, কিছু বৃক্ষের শুষ্ক পাতা রয়েছে যা শীতকাল জুড়ে বৃক্ষে রয়ে যায়। এসব অটল শুষ্ক পাতাকে মার্সেসেন্ট পাতা বলে এবং নতুন বৃদ্ধি শুরুর সাথে সাথে বসন্তে এরা ঝরে পড়ে।
বহুসংখ্যক পর্ণমোচী উদ্ভিদ পাতাবিহীন অবস্থায় ফুল ফোটায় যেহেতু তাতে পরাগায়নের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। পাতার অনুপস্থিতি বায়ু-পরাগি উদ্ভিদে বায়ুর প্রবাহ উন্নত করে এবং কীট-পরাগি উদ্ভিদে কীটের নিকট ফুলের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি করে। এই কৌশলের ঝুঁকিও আছে, যেমন হিম দ্বারা ফুলের ক্ষতি হতে পারে অথবা, শুষ্ক মৌসুমের অঞ্চলে উদ্ভিদের পানির পীড়ণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তথাপি, পাতাবিহীন অবস্থায় স্বচ্ছ বরফ ঝড় দ্বারা বৃক্ষশাখা ও কান্ডের অনেক কম ভাঙন হয়। এছাড়াও ঠান্ডা শীতের দিনে তরল পানির প্রাপ্যতা কমে যাবার কারণে উদ্ভিদ পানির অপচয় হ্রাস করতে পারে।[১০]
পত্রঝরা বা অ্যাবসিশনের সাথে জটিল শারীরবৃত্তীয় সংকেত এবং উদ্ভিদের মধ্যকার পরিবর্তন জড়িত রয়েছে। সালোকসংশ্লেষণের প্রক্রিয়া পাতায় ক্লোরোফিলের যোগান ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। উদ্ভিদ সাধারণত গ্রীষ্মে পুনরায় এসব ক্লোরোফিল পূর্ণ করে নেয়। শরৎকালে যখন দিন ছোটো হয়ে আসে অথবা উদ্ভিদ যখন খরা-পীড়িত,[১১] পর্ণমোচী উদ্ভিদ ক্লোরোফিল কণা উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এর ফলে অন্যান্য রঞ্জক কণা স্পষ্ট হয় এবং অসবুজ রঙের পত্ররাজী পরিলক্ষিত হয়। দিন যখন ছোটো হয়ে আসে এবং রাত্রি ঠান্ডা হলেও হিমাঙ্কের উপরে বিরাজ করে, পাতার রঙ তখন সবচাইতে উজ্জ্বল হয়।[১২] অন্যান্য রঞ্জক পদার্থের মধ্যে রয়েছে ক্যারটিনয়েড যা হলুদ, বাদামি, আর কমলা রঙের। এ্যানথোসায়ানিন রঞ্জক পদার্থ লাল এবং রক্তবর্ণের সৃষ্টি করে, যদিও তারা সবসময় পাতাতে উপস্থিত থাকে না। বরং এ্যাবসিশন প্রক্রিয়া শুরুর পর যখন শর্করা পাতার মধ্যে আটকে থাকে, গ্রীষ্মের শেষের দিকে এমন সময়ে এরা পত্ররাজীতে উৎপাদিত হয়।
পত্রবৃন্ত ও শাখার মধ্যবর্তী স্থানে যখন একটি অ্যাবসিশন স্তরের সৃষ্টি হয় তখনই পাতা ঝরা আরম্ভ হয়। পাতার নতুন বৃদ্ধির সময়ে বসন্তকালে এই স্তরের সৃষ্টি হয়। একের সাথে অন্যের পার্থক্য করতে পারে এমন কোষের স্তরের দ্বারা এটি গঠিত। পাতা এবং উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ থেকে উৎপাদিত অক্সিন নামক উদ্ভিদ হরমোনের প্রতি এসব কোষ সংবেদনশীল হয়। পাতা থেকে অক্সিনের উৎপাদনের হার যখন উদ্ভিদের দেহের উৎপাদনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, এ্যাবসিশন স্তরের কোষগুলো তখন পরষ্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে। শরতে, অথবা পীড়ণের সময়, পাতায় অক্সিনের উৎপাদন কমে যায় অথবা বন্ধ হয়ে যায় যা এ্যাবসিশন স্তরের কোষগুলোকে সম্প্রসারিত করে দেয়। কোষের এই সম্প্রসারণ কোষের বিভিন্ন স্তরের মধ্যকার সংযোগ ভেঙে দেয় যার ফলে উদ্ভিদ থেকে পাতা আলাদা হয়ে পড়ে। এসময় ভাঙনের অংশে একটি স্তরের সৃষ্টি হয় যা উদ্ভিদকে রসহানি থেকে রক্ষা করে।
বেশ কিছু সংখ্যক উদ্ভিদ পাতা ঝরানোর পূর্বে তা থেকে নাইট্রোজেন এবং কার্বন অপসারণ করে এবং প্রোটিন আকারে মূল ও অভ্যন্তরীন বাকলের প্যারেনকাইমা কোষের ভ্যাকুয়লে জমা রাখে। বসন্তকালে নতুন পাতা বা ফুল বৃদ্ধির সময় এসব প্রোটিন নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[১৩]
চিরহরিতের সাপেক্ষে পর্ণমোচী উদ্ভিদের সুবিধা-অসুবিধা উভয়ই রয়েছে। জল সংরক্ষণের জন্য অথবা শীতের আবহাওয়ায় বেচে থাকার জন্য পর্ণমোচী উদ্ভিদকে পাতা ঝরিয়ে ফেলতে হয়, পরবর্তী বৃদ্ধি মৌসুমে অবশ্যই তাদেরকে নতুন পাতা ছাড়তে হয়। এজন্য তাদেরকে যেসব সম্পদ ব্যবহার করতে হয়, চিরহরিতের ক্ষেত্রে তার দরকার পড়ে না। অন্যদিকে শীতকালে পাতা ঝরানোর ফলে উদ্ভিদ কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা পায়। পত্র মেরামত এবং একে কার্যক্ষম রাখার চাইতে কেবলমাত্র একে হারানো এবং পুনরায় গজানো অধিকতর শ্রেয়।[১৪] পাতা ঝরানোর ফলে ক্যাভিটেশন কমে যায় যা উদ্ভিদের জাইলেম ভেসেলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এই ঘটনা পর্ণমোচী উদ্ভিদে বৃহৎ ব্যাসার্ধের জাইলেম ভেসেলের সৃষ্টি করে যা গ্রীষ্মের বৃদ্ধি ঋতুতে প্রস্বেদনের হার বাড়িয়ে দেয়।
যেসব বনের অধিকাংশ বৃক্ষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৃদ্ধি মৌসুমের শেষে পাতা ঝরিয়ে দেয় সেসব বনকে পর্ণমোচী বন বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এসব বন দেখতে পাওয়া যায় যাদের রয়েছে নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র, বনতলের বৃদ্ধি, এবং মৃত্তিকার গতিময়তা।[১৫]
পৃথিবীতে দুই ধরনের স্বতন্ত্র পর্ণমোচী বন পাওয়া যায়ঃ শীতপ্রধান পর্ণমোচী বন এবং ক্রান্তীয় ও প্রায়-ক্রান্তীয় পর্ণমোচী বন।
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)