পলিরাইবোসোম বা পলিসোম বা আর্গাসোম (ইংরেজি: polyribosome বা polysome বা ergasome) হচ্ছে এক ধরনের রাইবোসোম যা বার্তাবাহী আরএনএ () এর সাথে কোন "সুতা"-য় বোনা "পুঁতি"-র মতন আবদ্ধ থাকে।[১] এটি অণুর একটি জটিল যৌগ এবং দুই বা ততোধিক রাইবোসোম দ্বারা গঠিত; রাইবোসোম কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা পলিপেপটাইড-এ রূপান্তরে কাজ করে। ১৯৬৩ সালে প্রথমে এর নাম দেওয়া হয়েছিল "আর্গাসোম", পরে জোনাথন ওয়ার্নার, পল এম. নফ[২], এবং আলেকজান্ডার রিচ কর্তৃক এদের আরও বৈশিষ্ট্য নির্ণীত হয়।
পলিসোম গঠিত হয় দীর্ঘায়ন দশায়, যখন রাইবোসোম ও দীর্ঘায়ন নিয়ামকসমূহ মিলে সাংকেতিক নির্দেশনাযুক্ত পলিপেপটাইড (encoded polypeptide) সংশ্লেষণ করে। কতিপয় রাইবোসোম এর সংকেত অঞ্চল বরাবর অগ্রসর হয়, এবং এভাবে একটি পলিসোম গঠিত হয়। কতগুলো রাইবোসোম মিলে একটি অণুর ওপর ক্রিয়াশীল হওয়ার ক্ষমতা থেকে, কোন কোষের মধ্যে এর সীমাবদ্ধ প্রাচুর্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।[৩] প্রাক-কেন্দ্রিক পলিসোম, সুকেন্দ্রিক পলিসোম, এবং ঝিল্লি-আবদ্ধ পলিসোমের মধ্যে গাঠনিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।[১] পলিসোমের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করে জিন অভিব্যক্তি'র মাত্রা পরিমাপ করা যায়; যে পদ্ধতিটি পলিসোমীয় পরিলেখন (পলিসোমাল প্রোফাইলিং) নামে পরিচিত।[৪]
ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ প্রযুক্তিসমূহ, যেমন- দাগাঙ্কন (staining[৫]), ধাতব প্রতিচ্ছায়া (metal shadowing[৬]), অতি-সূক্ষ্ম কোষ খণ্ড-ই ছিল পলিসোমের গঠন নির্ণয়ের আদি পদ্ধতি। ক্রায়ো-ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ পদ্ধতির বিকাশের ফলস্বরূপ বর্ধিত রেজোলিউশনে বিম্ব পাওয়া সম্ভব হয়েছে, যার জন্য আরও নির্ভুল পদ্ধতিতে গঠন নির্ণয় সম্ভবপর হয়েছে।
- এর রূপান্তর (translation) এর বৈচিত্র্যের প্রতিফলনস্বরূপ পলিরাইবোসোম এর ভিন্ন ভিন্ন গাঠনিক বিন্যাস দেখা যেতে পারে। পলিরাইবোসোমের আকারের অনুপাত নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে যে, কয়েক দফা রূপান্তর সম্পন্ন হওয়ার পর, উচ্চ সংখ্যক বৃত্তাকার এবং আঁকাবাঁকা (zigzag) আকৃতির পলিসোম পাওয়া যায়। দীর্ঘ সময়কাল ধরে ঘটিত রূপান্তরের কারণে ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট ত্রিমাত্রিকভাবে প্যাঁচানো পলিসোম গঠিত হয়।[১] ভিন্ন ভিন্ন কোষে ভিন্ন ভিন্ন গঠনের পলিসোম উৎপন্ন হয়।
ব্যাকটেরিয়া'র পলিসোমে যুগল-সারিবিশিষ্ট গঠন দেখা যায়। এ ধরনের গঠনে, রাইবোসোমসমূহ একে অপরের সাথে ক্ষুদ্রতর উপ-এককের মাধ্যমে সংযোগ রক্ষা করে। এসব যুগল-সারি কাঠামো সাধারণত "সাইনুসয়েড" (আঁকাবাঁকা) অথবা ত্রিমাত্রিক সর্পিলাকার গঠন অনুসরণ করে। "সাইনুসয়েড" পথে, ক্ষুদ্রতর উপ-এককগুলোর মধ্যে দুই ধরনের সংযোগ বিদ্যমান থাকে: "ঊর্ধ্ব-থেকে-ঊর্ধ্ব" অথবা "ঊর্ধ্ব-থেকে-নিম্ন"। ত্রিমাত্রিক সর্পিলাকার পথে, শুধুমাত্র "ঊর্ধ্ব-থেকে-ঊর্ধ্ব" সংযোগ পরিলক্ষিত হয়।[১]
আর্কিয়া-তে (archaea; প্রাক-কেন্দ্রিক অণুজীবের একটি ডোমেইন) পলিসোমের উপস্থিতি বিদ্যমান, তবে এর গঠন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু জানা যায়নি।[৭]
কোষ নিয়ে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, ইউক্যারিওটিক বা সুকেন্দ্রিক পলিসোমসমূহ রৈখিক রূপবিন্যাস প্রদর্শন করে। সেখানে ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট ত্রিমাত্রিক প্যাঁচবিশিষ্ট এবং প্রাক-কেন্দ্রিক পলিসোমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের সন্নিবেশ (যেমন- "ঊর্ধ্ব-থেকে-ঊর্ধ্ব" সংযোগ) সহ সমতলীয় যুগল-সারিবিশিষ্ট পলিসোম-ও পাওয়া গেছে। সুকেন্দ্রিক ত্রিমাত্রিক পলিরাইবোসোমের সাথে প্রাক-কেন্দ্রিক ত্রিমাত্রিক পলিরাইবোসোমের মিল এখানে যে, এরা উভয়ই "ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট বাঁ-হাতি প্যাঁচবিশিষ্ট, যেখানে প্রতিটি প্যাঁচে চারটি করে রাইবোসোম থাকে"। এই ঘন সন্নিবেশ দ্বারা, রূপান্তর প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাদের ক্রিয়াকলাপ নির্ধারিত হতে পারে। প্রতিপ্রভা অণুবীক্ষণ ব্যবহার করে, সারকোমা (মারাত্মক ধরনের টিউমার বা ক্যান্সার কোষ) কোষে ত্রিমাত্রিক পলিসোমের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।[১]
কাচপাত্রে বা ইন ভিট্রো গবেষণায় ব্যবহৃত পারমাণবিক বল অণুবীক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, ৫' মাথার (cap) সাথে আবদ্ধ সূচনাকারী নিয়ামক এবং ৩'-পলি(এ) লেজের সাথে আবদ্ধ (Poly(A) Binding Protein; পলি(এ) বাঁধাইকারী আমিষ) এর উপস্থিতিতে, মুক্ত পলিঅ্যাডেনাইল সংযোজিত দ্বারা বৃত্তাকার সুকেন্দ্রিক পলিসোম গঠিত হতে পারে। তবে, পলিসোমীয় কে চক্রাকার করার উদ্দেশ্যে, কোন প্রোটিন কমপ্লেক্স এর মধ্যস্থতায় মাথা এবং পলি(এ)-লেজের মধ্যকার এই মিথষ্ক্রিয়া কোন অনন্য উপায় নয়। রূপান্তরমূলক (translational) ব্যবস্থায়, মাথাবিহীন ও পলি(এ) লেজবিহীন দ্বারা এবং মাথাযুক্ত কিন্তু ৩'-পলি(এ) লেজবিহীন দ্বারাও, টপোগাণিতিকভাবে বৃত্তাকার পলিসোম সফলভাবে গঠিত হতে পারে।[১]
ঝিল্লিতে আবদ্ধ পলিরাইবোসোমগুলো ঝিল্লি-পৃষ্ঠের দ্বিমাত্রিক স্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। আন্তঃ রাইবোসোমীয় সংযোগের এই সীমাবদ্ধতার কারণে গোলাকার বিন্যাস সৃষ্টি হয়, যা রাইবোসোমসমূহকে বরাবর সজ্জিত করে, যাতে করে প্রবেশ ও নির্গমনের স্থানগুলো একটি মসৃণ পথ তৈরি করতে পারে। প্রতিটি রাইবোসোম তার আগেরটির সাপেক্ষে আবর্তিত অবস্থায় থাকে, যা দেখতে একটি সমতলীয় প্যাঁচ (planar spiral) এর মত মনে হয়।[১]
পলিসোমীয় পরিলেখন (Polysomal Profiling) হচ্ছে এমন একটি কৌশল যা সাইক্লোহেক্সিমাইড (cycloheximide) ব্যবহার করে রূপান্তর (ট্রান্সলেশন) কে বাধাদান করে, এবং সুক্রোজ অবক্রম ব্যবহার করে কেন্দ্রবিমুখীকরণ[টীকা ১] (ইংরেজি: centrifugation, প্রতিবর্ণীকৃত: সেন্ট্রিফিউগেশন) প্রক্রিয়া হতে প্রাপ্ত কোষ নির্যাসগুলোকে পরস্পর থেকে পৃথক করে।[৩] মুক্ত বার্তাবাহী আরএনএ () এর তুলনায় রাইবোসোম-সংযোজিত দ্রুততরভাবে স্থানান্তরিত হয়; আবার রাইবোসোম-সংযোজিত এর চেয়ে পলিসোম-সংযোজিত দ্রুততরভাবে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। সমগ্র অবক্রমজুড়ে মোট আমিষ পরিমাপ করলে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি শীর্ষ উন্মোচিত হয়। ক্রমবর্ধমান হারে রাইবোসোম হিসেবে পলিসোমের উপস্থিতির পেছনে ঐ সংশ্লিষ্ট জড়িত থাকে। অবক্রমজুড়ে এর উপস্থিতি এর রূপান্তর (ট্রান্সলেশন) এর বিষয়টি উন্মোচন করে। সনাক্তকৃত কোন এর রূপান্তরজনিত অবস্থা অনুসরণ এবং সেই সাথে রাইবোসোম ঘনত্ব পরিমাপ করার উদ্দেশ্যে, কালচার করা কোষ ও কলায় কার্যকরভাবে পলিসোমীয় পরিলেখন প্রয়োগ করা হয়।[৪] এই কৌশল প্রয়োগ করে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কোষের এর রূপান্তরজনিত অবস্থার তুলনা করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্তন্যপায়ীদের কোষে ভেসিকুলার স্টোমাটাইটিস ভাইরাস (ভিএসভি) এর প্রভাব নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় পলিসোমীয় পরিলেখন ব্যবহার করা হয়েছিল।[৯] প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে দেখা গিয়েছিল যে, পলিসোম নিয়ে প্রতিযোগিতায় আশ্রয়দাতা কোষের -সমূহ ভাইরাল এর কাছে পরাস্ত হয়; যার ফলস্বরূপ আশ্রয়দাতা কোষের রূপান্তর ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে আর অন্যদিকে, ভাইরাসের এর রূপান্তর ক্রমশ বাড়তে থাকে।[৯]
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)