পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্য | |||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
৯৭৩–১১৮৯[১] | |||||||||||||
১১২১ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম চালুক্য রাজবংশের বিস্তার[২] | |||||||||||||
অবস্থা | সাম্র্যাজ্য (৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের অধীনস্থ) | ||||||||||||
রাজধানী | মান্যখেত, বাসবকল্যাণ | ||||||||||||
প্রচলিত ভাষা | কন্নড়, সংস্কৃত | ||||||||||||
ধর্ম | হিন্দুধর্ম বৌদ্ধধর্ম[৩] জৈনধর্ম | ||||||||||||
সরকার | রাজতন্ত্র | ||||||||||||
রাজা | |||||||||||||
• ৯৫৭ – ৯৯৭ | দ্বিতীয় তৈলপ | ||||||||||||
• ১১৮৪ – ১১৮৯ | চতুর্থ সোমেশ্বর | ||||||||||||
ইতিহাস | |||||||||||||
• প্রাচীনতম নথি | ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ | ||||||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ৯৭৩ | ||||||||||||
• বিলুপ্ত | ১১৮৯[১] | ||||||||||||
|
পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্য ছিল ভারতের একটি আদি মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম দাক্ষিণাত্য মালভূমির অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে এই সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এই কন্নড়িগ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কল্যাণী (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের বিদার জেলার অন্তর্গত বাসবকল্যাণ)। রাজধানীর নামানুসারে এটিকে কখনও কখনও কল্যাণী চালুক্য সাম্রাজ্য, আবার খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর বাদামীর চালুক্য রাজবংশের সঙ্গে একটি তাত্ত্বিক সম্পর্কে নিরিখে ক্ষেত্রবিশেষে এটিকে পরবর্তী চালুক্য সাম্রাজ্য নামেও অভিহিত করা হয়। বেঙ্গি অঞ্চলের (অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের পূর্ব গোদাবরী, পশ্চিম গোদাবরী ও কৃষ্ণা জেলা[৪]) সমসাময়িক পূর্ব চালুক্য রাজবংশের সঙ্গে পার্থক্য প্রতিপাদনের জন্য এই রাজবংশটিকে "পশ্চিম চালুক্য" নামে অভিহিত করা হয়। পশ্চিম চালুক্যদের উত্থানের পূর্বে মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট সম্রাটেরা দুই শতাব্দী কাল দাক্ষিণাত্য মালভূমি ও মধ্য ভারত শাসন করেছিলেন। ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সুযোগে মালবের পরমার রাজবংশের দ্বিতীয় তৈলপ সফলভাবে রাষ্ট্রকূট রাজধানী মান্যখেত আক্রমণ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন বিজয়পুরের এক রাষ্ট্রকূট সামন্ত শাসক। নিজ অধিরাজবর্গকে পরাজিত করে তিনি মান্যখেতকে নিজের রাজধানী ঘোষণা করেন। এরপরে পশ্চিম চালুক্যেরা দ্রুত রাজ্যবিস্তার করতে থাকে এবং রাজা প্রথম সোমেশ্বরের শাসনকালেই এই রাজ্য একটি সাম্রাজ্যের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম সোমেশ্বরই কল্যাণীতে চালুক্য রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন।
দক্ষিণ ভারতের দুই সাম্রাজ্য কল্যাণীর চালুক্য ও তঞ্জাবুরের চোলেরা উর্বর বেঙ্গি অঞ্চলে আধিপত্য রক্ষার জন্য শতাধিক বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। বেঙ্গির পূর্ব চালুক্যেরা পারিবারিক সূত্রে পশ্চিম চালুক্যদের দূর সম্পর্কে জ্ঞাতিভ্রাতা হলেও চোলেদের সঙ্গে তাদের একটি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সেই কারণে পূর্বোক্ত যুদ্ধগুলিতে তারা চোলেদের পক্ষাবলম্বন করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ও দ্বাদশ শতাব্দীর গোড়ায় ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের শাসনকালে পশ্চিম চালুক্যেরা চোলদের প্রতিরোধ করতে বহুলাংশে সক্ষম হয় এবং উত্তরে উত্তরে নর্মদা নদী থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত প্রসারিত দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে।[৫][৬][৭][৮] পিতা প্রথম সোমেশ্বরের রাজত্বকালে যুবরাজ অবস্থায় ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের বিজয়াভিযান শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পূর্ব ভারতের অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলেও তিনি সফলভাবে সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন।[৯][১০][১১] এই পর্যায়ে দাক্ষিণাত্যের হৈসল, দেবগিরির সেউণ যাদব, কাকতীয় ও দক্ষিণের কল্যাণীর কলচুরি প্রভৃতি শাসক রাজপরিবার ছিল পশ্চিম চালুক্যদের অধীনস্থ সামন্ত শাসক। দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পশ্চিম চালুক্যদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার পর এই রাজপরিবারগুলি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।
পশ্চিম চালুক্যেরা এমন একটি স্থাপত্যশৈলীর বিকাশ ঘটিয়েছিল যা বর্তমানে একটি পরিবর্তনমূলক শৈলী হিসেবে পরিচিত। এই শৈলীটি আদি চালুক্য রাজবংশের শৈলীর সঙ্গে পরবর্তীকালের হৈসল সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে একটি যোগসূত্রের কাজ করে। মধ্য কর্ণাটকের তুঙ্গভদ্রা নদী-তীরবর্তী জেলাগুলিতেই পশ্চিম চালুক্যদের অধিকাংশ স্থাপত্য নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। লক্কুণ্ডীর কাশীবিশ্বেশ্বর মন্দির, কুরুবত্তির মল্লিকার্জুন মন্দির, বাগলির কল্লেশ্বর মন্দির ও ইতগীর মহাদেব মন্দির এই স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদাহরণ। দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পকলার বিকাশেও পশ্চিম চালুক্যদের রাজত্বকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। পশ্চিম চালুক্য সম্রাটেরা মাতৃভাষা কন্নড় ও সংস্কৃত উভয় ভাষাতেই সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিতেন বলে এই যুগে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল।
পশ্চিম চাল্যক্য সম্রাটেরা অসংখ্য কন্নড় অভিলেখ রেখে গিয়েছেন (গবেষক শেলডন পোলক ও জ্যঁ হবেনের দাবি অনুযায়ী, চালুক্য রাজ-অভিলেখগুলির মধ্যে ৯০ শতাংশই কন্নড় ভাষায় লিখিত[১২][১৩])। এই সকল অভিলেখ এবং রন্নের কন্নড় গ্রন্থ গদাযুদ্ধ (৯৮২ খ্রিস্টাব্দ) এবং বিলহণের সংস্কৃত রচনা বিক্রমাঙ্কদেবচরিতম্ (১১২০ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক সাহিত্যকীর্তি[১৪][১৫] থেকে পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। প্রাচীনতম নথিটি ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের অর্থাৎ দ্বিতীয় তৈলপের রাজত্বকালের সমসাময়িক। তখনও পশ্চিম চালুক্যেরা ছিলেন রাষ্ট্রকূটদের সামন্ত শাসক; দ্বিতীয় তৈলপ অধুনা কর্ণাটকের বিজয়পুর জেলার তারাবাদি থেকে রাজ্য শাসন করতেন।[১৬][১৭] চালুক্য রাজাদের বংশলতিকা বিতর্কিত। সমকালীন সাহিত্য ও অভিলেখের প্রমাণ এবং পশ্চিম চালুক্য রাজাদের দ্বারা আদি চালুক্য রাজাদের উপাধি ও নামের ব্যবহারের ভিত্তিতে একটি অভিমত এই যে, পশ্চিম চালুক্য রাজারা ষষ্ঠ শতাব্দীর বাদামী চালুক্য রাজবংশেরই পারিবারিক ধারার একটি শাখা।[১৮][১৯] আবার অন্যান্য পশ্চিম চালুক্য অভিলেখগুলি ইঙ্গিত করে যে পশ্চিম চালুক্য রাজবংশের সঙ্গে আদি চালুক্যদের কোনও সম্পর্কই ছিল না।[২০]
নথিপত্র থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আনুমানিক ৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে বনবাসী-১২০০০ প্রদেশের স্থানীয় চালুক্য রাজা চত্তিগদেব সম্ভবত স্থানীয় কদম্ব দলপতিদের সহায়তায় বিদ্রোহ করেছিলেন। বিদ্রোহটি নিষ্ফল হলেও তা চত্তিগদেবের উত্তরসূরি দ্বিতীয় তৈলপের উত্থানের পথ সুগম করে দিয়েছিল।[২১] এরপর ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ভারতের পরমারেরা রাষ্ট্রকূট রাজধানী মান্যখেত আক্রমণ করলে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তার সুযোগে দ্বিতীয় তৈলপ বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কর্ককে পরাজিত করেন এবং চালুক্য শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।[২২][২৩] রাষ্ট্রকূটদের ক্ষমতাচ্যূত করার পর দ্বিতীয় তৈলপ নিজের রাজধানী মান্যখেতে সরিয়ে আনেন। পরমার ও অন্যান্য আগ্রাসী প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করে তিনি পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে চালুক্য সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করেন এবং নর্মদা নদী থেকে তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।[২৪] যদিও কয়েকটি শিলালিপি থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মহীশূর অঞ্চলের বেলাগাম্বে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ প্রথম সোমেশ্বরের রাজত্বকাল পর্যন্ত একটি ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল।[২৫]
একাদশ শতাব্দীতে কৃষ্ণা-গোদাবরীর দোয়াব অঞ্চলে অবস্থিত বেঙ্গির (অধুনা উপকূলীয় অন্ধ্র) উর্বর নদী উপত্যকাটিকে নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কেন্দ্র করে পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের চালুক্যদের সঙ্গে তামিল দেশের রাজ্যগুলির সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। বেঙ্গির সম্পদের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করার লক্ষ্যে পশ্চিম চালুক্যদের সঙ্গে তামিল দেশের চোলেরা বহুবার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। বিখ্যাত রাজা প্রথম রাজরাজ চোল ও যুবরাজ প্রথম রাজেন্দ্র চোলের আমলে চোলেরা বেঙ্গির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে সক্ষমও হয়েছিল।[২৬] বেঙ্গির শাসক পূর্ব চালুক্যেরা পশ্চিম চালুক্যদের জ্ঞাতিভ্রাতা হলেও তামিল রাজ্যের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের সূত্রে চোলেদের প্রভাবই তাদের উপর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা পশ্চিম চালুক্য স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় তারাও সময় নষ্ট না করে বেঙ্গির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দ্বিতীয় তৈলপের উত্তরসূরি রাজা সত্যাশ্রয় চোলেদের হাত থেকে রাজ্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কোঙ্কণ ও গুজরাতের অঞ্চলগুলিও ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু বেঙ্গির উপর সত্যাশ্রয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্বল।[২৭][২৮] সত্যাশ্রয়ের উত্তরসূরি দ্বিতীয় জয়সিংহ আনুমানিক ১০২০-২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বেঙ্গির রাজা নির্বাচনকে নিয়ে চোলদের সঙ্গে অনেকগুলি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।[২৮][২৯] এরপর আনুমানিক ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দ্বিতীয় জয়সিংহ মধ্য ভারতের পরমার এবং বিদ্রোহী যাদব রাজা ভীল্লমকে দমন করেন।[২৮]
চালুক্য রাজবংশ |
---|
জয়সিংহের পুত্র প্রথম সোমেশ্বরের নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক ১০৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি চালুক্য রাজধানী কল্যাণীতে স্থানান্তরিত করেছিলেন। ইতিহাসবিদ সেন প্রথম সোমেশ্বরের শাসনকালকে পশ্চিম চালুক্য শাসনের এক অসাধারণ পর্ব বলে উল্লেখ করেন।[৩০][৩১] চোল ও চালুক্যদের দীর্ঘ বিবাদে দুই পক্ষই কোনও যুদ্ধে জয়লাভ করে আবার কোনও যুদ্ধে পরাজিত হয়; কিন্তু কেউই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হারায়নি।[৩২][৩৩] যুদ্ধ চলাকালীন বেঙ্গির সিংহাসনে এক ক্রীড়ানক রাজাকে স্থাপন করা হয়।[৩১][৩৪][৩৫] প্রথম সোমেশ্বর এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই ১০৬৮ খ্রিস্টাব্দে "পরমযোগ" নামে এক ধর্মকৃত্যের অঙ্গ হিসেবে তুঙ্গভদ্রা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।[৩৬][৩৭][৩৮] চোলেদের বিরুদ্ধে অনেকগুলি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও প্রথম সোমেশ্বর নিজ শাসনকালে উত্তর দিকের কোঙ্কণ, গুজরাত, মালব ও কলিঙ্গ অঞ্চল ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রথম সোমেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় সোমেশ্বর সিংহাসনে আরোহণ করার পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে এক পারিবারিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী যোদ্ধা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় সোমেশ্বরের রাজত্বকালে প্রথমে দক্ষিণ দাক্ষিণাত্যের গঙ্গবাদীর প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১০৬৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে যুবরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বাংলা আক্রমণ করে পাল সাম্রাজ্যের শাসনভিত্তি দুর্বল করে দেন। এই সব আকস্মিক আক্রমণ পূর্ব ভারতে স্থায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য করা না হলেও তা বাংলায় সেন ও বর্মণ রাজবংশ এবং বিহারে নয়নদেব রাজবংশের ন্যায় "কর্ণাট" রাজবংশগুলি স্থাপনের পথ সুগম করে দেয়।[৯][১০][১১] এক চোল রাজকন্যাকে (বীর রাজেন্দ্র চোলের কন্যা) বিবাহ করে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য চোল রাজবংশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে চোল রাজার মৃত্যুর পর ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য তামিল রাজ্যটি আক্রমণ করেন এবং নিজ শ্যালক অধিরাজেন্দ্র চোলকে সিংহাসনে স্থাপন করেন। এর ফলে বেঙ্গির শক্তিশালী শাসক প্রথম কুলোত্তুঙ্গ চোলের সঙ্গে বিবাদেও জড়িয়ে পড়েন। কারণ, প্রথম কুলোত্তুঙ্গ চোল নিজে চোল সিংহাসনে আরোহণের চেষ্টায় ছিলেন।[৩৯] একই সময়ে চালুক্য সামন্ত শাসক হৈসল, সেউণ ও হঙ্গলের কদম্বদের আনুগত্য অর্জন করে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় সোমেশ্বরের কর্তৃত্বকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন। গৃহযুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে দ্বিতীয় সোমেশ্বর ভাইয়ের শত্রু প্রথম কুলোত্তুঙ্গ চোল ও গোয়ার কদম্বদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এরপর ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য জয়লাভ করে নিজেকে চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজা ঘোষণা করেন।[৪০][৪১]
পরবর্তী চালুক্য শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের পঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালটি কর্ণাটকের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইতিহাসবিদেরা এই পর্যায়টিকে "চালুক্য বিক্রম যুগ" নামে অভিহিত করেন।[৪২][৪৩][৪৪] তিনি যে শুধু উত্তরের (গোয়ার কদম্ব দ্বিতীয় জয়কেশী, সিলহর ভোজ ও যাদব রাজা) এবং দক্ষিণের (হৈসল বিষ্ণুবর্ধন) শক্তিশালী সামন্ত শাসকদের নিয়ন্ত্রণেই সক্ষম হয়েছিলেন তাই নয়, ১০৯৩ খ্রিস্টাব্দের বেঙ্গির যুদ্ধে এবং পরে ১১১৮ খ্রিস্টাব্দের একটি যুদ্ধে শক্তিশালী চোল সম্রাটকে পরাজিত করেও রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন। চোলদের সঙ্গে বহু বিরোধ সত্ত্বেও নিজস্ব অঞ্চল তিনি বহু বছর ধরে রাখতে পেরেছিলেন।[৫][৬][৭][৮] বেঙ্গি জয়ের ফলে পূর্ব দাক্ষিণাত্যে চোল প্রভাব হ্রাস পায় এবং দক্ষিণে কাবেরী নদী থেকে উত্তরে নর্মদা নদী পর্যন্ত প্রসারিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সম্রাট হয়ে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য "পেরমাদিদেব" ও "ত্রিভুবনমল্ল" (তিন ভুবনের অধিপতি) উপাধি অর্জন করেন। সমসাময়িক পণ্ডিতেরা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সামরিক নেতৃত্বের কুশলতা, চারুকলার প্রতি আগ্রহ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।[৪৫][৪৬] এই যুগে সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে এবং কন্নড় ও সংস্কৃত পণ্ডিতেরা রাজসভা অলংকৃত করতে থাকেন। সুদূর কাশ্মীর থেকে রাজ্যে উপনীত হয়ে কবি বিলহণ সুবিখ্যাত বিক্রমাঙ্কদেবচরিতম্ গ্রন্থে রাজার প্রশস্তি কীর্তন করেন।[৪৭][৪৮] ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য শুধুমাত্র একজন সক্ষম যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ রাজাও। সমসাময়িক অসংখ্য রাজকীয় অভিলেখ থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তিনি পণ্ডিত ও ধর্মীয় কেন্দ্রগুলিকে প্রচুর অনুদান দিয়েছিলেন।[৪৯][৫০]
চালুক্য ও চোলেদের মধ্যে ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহের ফলে দুই সাম্রাজ্যেরই উল্লেখযোগ্য শক্তিক্ষয় ঘটে, যার ফলে দুই সম্রাটেরই অধীনস্থ সামন্তেরা বিদ্রোহের সুযোগ পেয়ে যান।[৫০][৫৩] ১১২৬ খ্রিস্টাব্দে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যে চালুক্যদের শক্তিশালী সামন্ত রাজারা স্বায়ত্তশাসন ও আঞ্চলিক অধিকারের পরিধি বৃদ্ধি করতে থাকলে সাম্রাজ্যের আকারও নিয়মিতভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে।[৫০][৫৪] ১১৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চালুক্য ও তাদের সামন্ত শাসকদের মধ্যে অনেকগুলি প্রবল যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এই সামন্ত শাসকেরা আবার অনেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয় জগদেকমল্লের রাজত্বকালে চালুক্যেরা বেঙ্গির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জগদেকমল্লের উত্তরসূরি তৃতীয় তৈলপ ১১৪৯ খ্রিস্টাব্দে কাকতীয় রাজা প্রোলের হাতে পরাজিত হন।[৫৪] প্রথমে বন্দী করা হলেও পরে তৃতীয় তৈলপকে মুক্তি দিলে পশ্চিম চালুক্যদের বিশেষ সম্মানহানি ঘটে। চালুক্য শাসনে অবনতি ও অনিশ্চয়তা ঘনিয়ে আসতে দেখে হৈসল ও সেউণরা সাম্রাজ্য দখলে অগ্রসর হতে থাকে। হৈসল রাজা প্রথম নরসিংহ তৃতীয় তৈলপকে পরাজিত ও নিহত করেন। কিন্তু কলচুরিরা যখন একই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলে তাদের কাছে তিনি পরাস্ত হন। ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিজ্জলের অধীনস্থ কল্যাণীর কলচুরিরা কল্যাণী অধিকার করে এবং পরবর্তী কুড়ি বছর তা নিজেদের দখলে রাখে। ফলে চালুক্যদের নিজেদের রাজধানী অধুনা ধারওয়াড় জেলার অন্নিগেরীতে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়।[৫৪][৫৫]
কলচুরিরা প্রকৃতপক্ষে মধ্য ভারত থেকে দক্ষিণ দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে এসে বসতিস্থাপন করেছিল। তাই তারা নিজেদের বলত "কলঞ্জরপুরবরধিসবর"।[৫৬] দ্বিতীয় বিজ্জলের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন করহাড-৪০০০ ও তারাবাদি-১০০০ প্রদেশের (অধুনা কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত) "মহামণ্ডলেশ্বর" বা চালুক্য সেনাধ্যক্ষ। এদের রাজধানী ছিল মঙ্গলবাদ[৫৭] বা অন্নিগেরী।[৫৮] দ্বিতীয় বিজ্জল নিজেও ছিলেন মহামণ্ডলেশ্বর। ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে চিক্কালাগি নথিতে দ্বিতীয় বিজ্জল নিজেকে "মহাভুজবল চক্রবর্তী" ("শক্তিশালী স্কন্ধ ও বাহুবিশিষ্ট সম্রাট") বলে উল্লেখ করেন, যা ইঙ্গিত করে যে সেই সময় তিনি আর চালুক্যদের অধীনস্থ সামন্ত শাসক ছিলেন না।[৫৭] যদিও দ্বিতীয় বিজ্জলের উত্তরসূরিরা কল্যাণী ধরে রাখতে পারেননি। ১১৮৩ সালে শেষ চালুক্য বংশধর চতুর্থ সোমেশ্বর কল্যাণী পুনর্দখল করে সাম্রাজ্য পুনরাধিকারে একবার শেষ চেষ্টা করলে কলচুরিদের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।[৫৫][৫৮] এই যুদ্ধে চালুক্য সেনাধ্যক্ষ নরসিংহের হাতে কলচুরি রাজা সঙ্কম নিহত হন।[৫৯][৬০] এই সময় হৈসল রাজা দ্বিতীয় বীর বল্লাল ক্রমশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন এবং একাধিক ক্ষেত্রে চালুক্য ও সাম্রাজ্যের অন্যান্য দাবিদারদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি চালুক্য রাজা চতুর্থ সোমেশ্বর ও সেউণ রাজা পঞ্চম ভিল্লমকে পরাজিত করে কৃষ্ণা নদী উপত্যকার বৃহৎ অংশকে হৈসল নিয়ন্ত্রণে আনলেও কলচুরিদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে পারেননি।[৬১] পঞ্চম ভীল্লমের অধীনস্থ সেউণরা চাল্যক্যদের কল্যাণী পুনরুদ্ধারের সময় সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয়েছিল। ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে চালুক্য সেনাধ্যক্ষ বর্মার বিরুদ্ধে পরাজয়ের পরে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাময়িকভাবে অবদমিত হয়েছিল, কিন্তু ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে তারা প্রতিশোধও গ্রহণ করেছিল।[৬২]
চালুক্য সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের জন্য চতুর্থ সোমেশ্বরের সামগ্রিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে সেউণ শাসকেরা চতুর্থ সোমেশ্বরকে বনবাসীতে নির্বাসনে বিতাড়িত করলে চালুক্য রাজবংশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। চালুক্যদের পতনের পরেও কৃষ্ণা নদী উপত্যকার অধিকার নিয়ে সেউণ ও হৈসলদের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত থাকে। দুই পক্ষকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জয়ী ও পরাজিত হয়।[৬৩] এই যুগপর্যায়ে দু’টি বিরাট সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল: পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে চালুক্য সাম্রাজ্য এবং তামিলকমে চোল সাম্রাজ্য। এই দুই সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর তাদের সামন্তদের রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সামন্ত শাসকদের পারস্পরিক বিরোধিতার কাহিনী পরবর্তী শতাধিক বছর দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসের বর্ষপঞ্জিগুলি পরিপূর্ণ করে ছিল। পাণ্ড্যরা পূর্বতন চোল সাম্রাজ্যে কিছু অঞ্চলের উপর নিজেদের অধিকার বজায় রাখতে পেরেছিল।[৬৪]
পশ্চিম চালুক্য রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। অপুত্রক অবস্থায় রাজার মৃত্যু ঘটলে রাজভ্রাতা সিংহাসনে আরোহণ করতেন। প্রশাসন ছিল অতিমাত্রায় বিকেন্দ্রীকৃত। অলুপ, হৈসল, কাকতীয়, সেউণ, দক্ষিণ কলচুরি ও অন্যান্য সামন্ত রাজবংশগুলি সম্রাটকে বার্ষিক রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে নিজেদের স্বশাসিত প্রদেশ পরিচালনার অনুমতি পেত।[৬৫] প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে প্রাপ্ত অভিলেখগুলি থেকে ‘মহাপ্রধান’ (প্রধান মন্ত্রী), ‘সন্ধিবিগ্রহিক’ ও ‘ধর্মাধিকারী’ (প্রধান বিচারক) প্রভৃতি উপাধির কথা জানা যায়। ‘তদেয়দণ্ডনায়ক’ (রক্ষিত সামরিক বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ) ইত্যাদি কয়েকটি পদ কিছু বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছিল; আবার ‘দণ্ডনায়ক’ (সেনাধ্যক্ষ) সহ কয়েকটি পদ মন্ত্রী সমমর্যাদাসম্পন্ন হওয়ায় মনে করা হয় যে মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রশাসনিক কাজকর্ম শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক বাহিনীর অধ্যক্ষ হিসেবেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হত।[৬৬]
পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল। যেমন, বনবাসী-১২০০০, নোলাম্বাবাদী-৩২০০০, গঙ্গবাদী-৯৬০০০ (নামের শেষে যুক্ত সংখ্যাটি হল সংশ্লিষ্ট প্রদেশের এক্তিয়ারভুক্ত গ্রামের সংখ্যা)। বড়ো বড়ো প্রদেশগুলি আবার অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক গ্রাম নিয়ে গঠিত ক্ষুদ্রতর উপ-প্রদেশে বিভক্ত ছিল। যেমন, বেলাবোলা-৩০০। বড়ো প্রদেশগুলিকে বলা হত ‘মণ্ডল’ এবং তার অন্তর্গত ক্ষুদ্রতর উপ-প্রদেশগুলিকে বলা হত ‘নাড়ু’। নাড়ুগুলি আবার বিভক্ত ছিল বিভিন্ন ‘বাদ’ বা গ্রাম নিয়ে গঠিত ‘কম্পন’-এ (গ্রামসমষ্টি)। মণ্ডলগুলি শাসন করতেন রাজপরিবারের কোনও সদস্য, কোনও বিশ্বস্ত সামন্ত শাসক অথবা কোনও প্রবীণ আধিকারিক। রাষ্ট্রকূট শাসনকালে দ্বিতীয় তৈলপ নিজে ছিলেন তারাবাদী প্রদেশের প্রশাসক। রাজনৈতিক উত্থানপতনের সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডলগুলির প্রশাসকেরাও বদলি হতেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজা তৃতীয় সোমেশ্বরের শাসনকালে বনবাসী-১২০০০ প্রদেশের প্রশাসক বাম্মানয়্য পরে হলসিগে-১২০০০ প্রদেশে বদলি হয়ে যান। রাজপরিবারের মহিলারাও নাড়ু ও কম্পন শাসন করতেন। মণ্ডলের প্রশাসক সেনাধ্যক্ষদের উপাধি ছিল ‘মহামণ্ডলেশ্বর’ এবং নাড়ুর অধিপতিকে বলা হত ‘নাড়ুগৌভ্ন্দ’।[৬৭]
পশ্চিম চালুক্যেরা টাঁকশালে পাঞ্চ যন্ত্রে মুদ্রিত ‘পগোডা’ নামে এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করত। এগুলিতে কন্নড় ও নাগরী হরফ খোদিত হত।[৬৮] আকারে বড়ো ও পাতলা এই মুদ্রাগুলিতে বিভিন্ন ধরনের পাঞ্চ চিহ্ন এবং নকশার আকারে অঙ্কিত সিংহমূর্তি, কন্নড় ভাষায় "শ্রী" কথাটি,[৬৯] বল্লমের আগা, রাজার উপাধি, পদ্মফুল বা অন্যান্য জিনিস অঙ্কিত হত। দ্বিতীয় জয়সিংহের মুদ্রায় "শ্রী জয়", প্রথম সোমেশ্বরের মুদ্রায় "শ্রী ত্রে লো ক মল্ল", দ্বিতীয় সোমেশ্বরের মুদ্রায় "ভুবনেক মল্ল", লক্ষ্মীদেবের মুদ্রায় "শ্রী লশ", দ্বিতীয় জগদেকমল্লের মুদ্রায় "শ্রী জগদে" কথাগুলি পাওয়া গিয়েছে। সামন্ত রাজবংশ অলুপদের মুদ্রাতে কন্নড় ও নাগরী হরফে "শ্রী পাণ্ড্য ধনমজয়" কথাটি পাওয়া যায়।[৭০] গদাগ জেলার লক্কুণ্ডী ও ধারওয়াড় জেলার সুদী ছিল প্রধান টাঁকশাল (‘টঙ্খশালে’)। এদের সবচেয়ে ভারী স্বর্ণমুদ্রাটি ছিল গদ্যনক, যার ওজন ছিল ৯৬ গ্রেইন। অন্যান্য স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে ছিল দ্রম্ম (৬৫ গ্রেইন), কলঞ্জু (৪৮ গ্রেইন), কাসু (১৫ গ্রেইন), মনজদি (২.৫ গ্রেইন), অক্কম (১.২৫ গ্রেইন) ও পণ (৯.৬ গ্রেইন)।[৭১]
কৃষিকার্য ছিল পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস। ভূসম্পত্তি ও উৎপাদিত পণ্যের উপর কর আরোপ করা হত। অধিকাংশ মানুষই গ্রামে বসবাস করত। শুষ্ক অঞ্চলের প্রধান ফলস ছিল ধান, শিম, তুলা। যে অঞ্চলগুলিতে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হত সেখানে আখ চাষ করা হত। সুপারি ও পান ছিল প্রধান অর্থকারী ফসল। কৃষিশ্রমিকদের জীবনযাত্রার অবস্থা সম্ভবত সহনশীল ছিল। কারণ, ধনী ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে জমিহীনদের কোনও বিদ্রোহের কথা নথিবদ্ধ হয়নি। কৃষকরা অসন্তুষ্ট হলে সাধারণত বৃহৎ সংখ্যায় অন্যায়কারী শাসকের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা ত্যাগ করে সেই শাসককে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করত।[৭২]
খনিজ ও বনজ সম্পদের উপর কর আরোপ করা হত। অতিরিক্ত আয় আসত পরিবহন সুবিধাগুলির উপর আরোপিত শুল্ক থেকে। এছাড়াও রাজা আমদানি-রফতানি শুল্ক, পেশাদার অনুমতিপত্র ও বিচারালয়-কৃত জরিমানা থেকেও রাজত্ব আদায় করতেন।[৭৩] নথিপত্র থেকে জানা যায় যে ঘোড়া ও নুনের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যসামগ্রীর (সোনা, বস্ত্র, সুগন্ধী) ও কৃষিজ পণ্যের (গুঁড়ো গোলমরিচ, ধান, মশলা, পান পাতা, খেজুর পাতা, নারকেল ও চিনি) উপরও কর আরোপ করা হত। জমির উপর করের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য প্রায়শই জরিপ করে জমির গুণগত মান ও উৎপাদিত পণ্যের ধরনের মূল্যায়ন করা হত। চালুক্য নথিপথে কালো মাটি ও লাল মাটির জমির বিশেষ উল্লেখের পাশাপাশি জলাজমি, শুষ্ক জমি ও পতিত জমির উল্লেখ থাকত রাজস্বের হার ধার্য করার সুবিধার জন্য।[৭৪]
কর্ণাটকের ইতিহাস |
---|
}} অভিলেখগুলি থেকে গ্রামীণ এলাকার যে দুই প্রধান শ্রেণির কথা জানা যায় তারা হল ‘গবুন্দ’ (আধিকারিক) বা গৌড়া। গবুন্দরা দু’টি অর্থনৈতিক স্তরের ছিলেন: ‘প্রজা গবুন্দ’ (জনসাধারণের গবুন্দ) ও ‘প্রভু গবুন্দ’ (গবুন্দদের অধিপতি)। এদের ভূমিকা ছিল দ্বৈত: শাসকবর্গের সামনে জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করা এবং সেই সঙ্গে সম্রাটের জন্য রাজস্ব আদায় ও অসামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন। জমি আদানপ্রদান, সেচ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ, গ্রামীণ রাজত্ব আদায় ও গ্রামীণ পরিষদের কর্তব্য সংক্রান্ত অভিলেখগুলিতে এদের উল্লেখ পাওয়া যায়।[৭৫]
একাদশ শতাব্দীতে যৌথ শিল্পোদ্যোগের সংগঠনগুলি গড়ে উঠেছিল।[৭৬] প্রায় সকল শিল্পদ্রব্যই গিল্ডের মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল এবং সকল কাজ হত যৌথ উদ্যোগে; নথিপথে আলাদা করে শিল্পী, ভাস্কর ও কারিগরের নাম পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র হৈসল শাসিত অঞ্চলগুলিতেই ভাস্কররা তাদের শিল্পকর্মের নিচে নিজেদের নাম খোদাই করে দিতেন।[৭৭]
বণিকেরা নিজেদের শক্তিশালী গিল্ডে সংগঠিত করেছিল। এই গিল্ডগুলি রাজনৈতিক বিভাগের সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বহুলাংশে যুদ্ধ ও বিদ্রোহের দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই কাজ করত। তাদের একমাত্র ভয় ছিল দূর দেশে যাত্রার সময় তাদের জাহাজ ও যানবাহনে রাহাজানি। শক্তিশালী দক্ষিণ ভারতীয় বণিক গিল্ডগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মনিগ্রামম, নাগরত্তর ও অঞ্জুবন্নম। স্থানীয় গিল্ডগুলিকে বলা হত ‘নগরম’ এবং ‘ননদেসিস’, এগুলি ছিল প্রতিবেশী রাজ্যের বণিকদের গিল্ড। দক্ষিণ ভারতের সকল বণিক গিল্ডের মধ্যে সবচেয়ে ধনী, প্রভাবশালী ও বিশিষ্ট গিল্ডটি ছিল ‘ঐন্নুররুবর’, যা অয়্যবোলেপুরার ৫০০ ‘স্বামী’ নামেও পরিচিত ছিল (অধুনা ঐহোলের ব্রাহ্মণ ও ‘মহাজন’)।[৭৮][৭৯] এরা ব্যাপক হারে সড়ক ও সমুদ্র বাণিজ্য পরিচালনা করত এবং সেই কারণে সাম্রাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যে এদের অবদানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই সংস্থাটি তীব্রভাবে বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতাগুলি (‘বীর বনঞ্জুধর্ম’ বা অভিজাত বণিকদের আইন) রক্ষা করত এবং এর সদস্যেরা প্রায়শই নিজেদের কীর্তিকলাপ অভিলেখে (‘প্রশস্তি’) নথিবদ্ধ করে রাখত। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এই ধরনের পাঁচশো প্রশস্তি পাওয়া গিয়েছে। এগুলিতে তাদের নিজস্ব পতাকা, প্রতীক, বৃষ ও ব্যবসায়িক কীর্তির কথা উল্লিখিত হয়েছে।
ধনী বণিকেরা আমদানি ও রফতানি শুল্ক প্রদানের মাধ্যে রাজকোষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত। ঐহোল ‘স্বামী’দের অভিলেখে চের, পাণ্ড্য, মালেয় (মালয়েশিয়া), মগধ, কৌশল, সৌরাষ্ট্র, কুরুম্ব, কম্ভোজ (কম্বোডিয়া), লাট (গুজরাত), পারস (পারস্য) ও নেপালের মতো বিদেশি রাজ্যগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সড়ক ও সমুদ্রপথে যাত্রার মাধ্যমে এই বণিকেরা প্রধানত মূল্যবান পাথর, মশলা ও সুগন্ধী এবং কর্পূরের মতো বিশেষ দ্রব্যগুলির ব্যবসা করত। হিরে, লাপিস লাজুলি, অনিক্স, পোখরাজ, সর্পমণি ও পান্নার মতো মূল্যবান পাথরের ব্যবসা সমৃদ্ধি লাভ করে। সাধারণভাবে যে সব মশলার ব্যবসা চলত সেগুলি ছিল এলাচ, জাফরান ও লবঙ্গ। সুগন্ধী দ্রব্যের মধ্যে ছিল চন্দনকাঠ, ডেলিয়াম, কস্তুরি, সিভিট ও গোলাপ। এগুলি হয় বিপুল পরিমাণে বিক্রি হত অথবা শহরে শহরে স্থানীয় বণিকেরা রাস্তায় ফেরি করত।[৮০] দশম শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম চালুক্যেরা দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূলের অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে এনেছিল এবং চীনের তাং রাজবংশ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাম্রাজ্যসকল ও বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যের বন্ধনের আবদ্ধ হয়েছিল এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই ভারতীয় বন্দরগুলিতে চীনা বাণিজ্যতরীর প্রায়শই আনাগোনা করতে শুরু করেছিল। সোং রাজবংশীয় চীনে রফতানি করা হত বস্ত্র, মশলা, ঔষধি গুল্ম, অলংকার, হাতির দাঁত, গণ্ডারের সিং, আবলুস কাঠ ও কর্পূর। একই দ্রব্য রফতানি করা হয় পশ্চিমে জোফার ও অ্যাডেনের মতো বন্দরগুলিতে। পশ্চিমে এই বাণিজ্যের শেষ গন্তব্য ছিল পারস্য, আরব ও মিশর।[৮১] পারস্য উপসাগরের পূর্ব উপকূলে সিরাফ বন্দর ছিল একটি বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য কেন্দ্র। চালুক্য সাম্রাজ্যের বণিকেরা এখানে এলে স্থানীয় ধনী বণিকেরা সেই উপলক্ষ্যে ভোজসভার আয়োজন করতেন। তাদের যে পাত্রে খাদ্যদ্রব্য পরিবেশনা করা হত তার বিবরণ-সম্বলিত একটি নথি থেকে সিরাফে ভারতীয় বণিকদের গুরুত্বের কথা আন্দাজ করা যায়।[৮২] সেই সঙ্গে সিরাফে এলো কাঠ, সুগন্ধী, চন্দনকাঠ ও মশলা ইত্যাদি রফতানি করা হত। দক্ষিণ ভারতে সর্বাধিক পরিমাণে আমদানি করা হত আরবি ঘোড়া। আরব ও স্থানীয় ব্রাহ্মণ বণিকদের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল এটি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পর্যটক মার্কো পোলো লিখেছেন যে, ভারতের আবহাওয়ার পরিবর্তন, মাটি ও তৃণভূমির অবস্থার কারণে এখানে অশ্ব প্রজনন সফল হয়নি।[৮১]
দশম শতাব্দীতে পশ্চিম চালুক্যদের হাতে রাষ্ট্রকূটদের পতন এবং একই সঙ্গে গঙ্গবাদীতে চোলেদের হাতে পশ্চিম গঙ্গদের পরাজয়ের ফলে জৈনধর্মের প্রসার উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়েছিল। কারণ, চালুক্য-শাসিত অঞ্চলে বীরশৈব মতবাদ এবং হৈসল-শাসিত অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালভাবে জৈনধর্মের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। যদিও পরবর্তীকালের রাজ্যগুলিতে হিন্দু ও জৈনরা শান্তিপূর্ণভাবেই সহাবস্থান করতেন। হৈসল-শাসিত অঞ্চলের দুই জৈন তীর্থ শ্রবণবেলগোলা ও কম্বদহল্লি রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা থেকে কখনই বঞ্চিত হয়নি।[৮৩]
অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন সূচিত হয়।[৮৪] পশ্চিম চালুক্য শাসনকালে শুধুমাত্র ডম্বল ও বল্লিগাবিতে বৌদ্ধ উপাসনা কেন্দ্র ছিল।[৮৫] সমসাময়িককালের সাহিত্য বা অভিলেখে ধর্মীয় সংঘাতের উল্লেখ না থাকা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ইঙ্গিতবাহী।
বীরশৈব মতবাদের উৎপত্তি নিয়ে মতানৈক্য আছে। তবে এই বিষয়ে সকলেই একমত যে দ্বাদশ শতাব্দীতে বসবের সময় থেকে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।[৮৬][৮৭] বাসব ও অন্যান্য বীরশৈব সন্তেরা জাতিভেদ প্রথা-বিরোধী এক ধর্মমত প্রচার করতেন। স্বরচিত ‘বচন’ কবিতাগুলিতে বসব সরল কন্নড় ভাষায় জনসাধারণের কাছে নিজ অভিমত ব্যক্ত করতেন। তিনি বলতেন, "কর্মই পূজা"। এই বীরশৈবেরা লিঙ্গায়েত (শিবের বিশ্বজনীন প্রতীক লিঙ্গের উপাসক) নামেও পরিচিত। এরা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকাণ্ড ও পুনর্জন্মবাদের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং বিধবার পুনর্বিবাহ ও অবিবাহিত বয়স্ক মহিলাদের বিবাহের পক্ষে মত প্রকাশ করে।[৮৮] এই মতবাদ নারীকে অনেক বেশি সামাজিক স্বাধীনতা দিলেও তাদের পৌরোহিত্যের কাজে গ্রহণ করেনি। শ্রীরঙ্গমের (অধুনা তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত) বৈষ্ণব মঠের প্রধান রামানুজ হৈসল অঞ্চলে ভ্রমণ করে ভক্তিমার্গের কথা প্রচার করেন। পরে তিনি আদি শঙ্করের অদ্বৈত দর্শনকে সমালোচনা করে বাদরায়নের ব্রহ্মসূত্র গ্রন্থের শ্রীভাষ্য রচনা করেন।[৮৯] মেলুকোটে থাকাকালীন হৈসল রাজা বিষ্ণুবর্ধন বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। পরবর্তী হৈসল রাজারাও এই মতকেই অনুসরণ করতেন।
দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও স্থাপত্যে এই ধর্মান্দোলনগুলির উত্থানের প্রভাব ছিল অপরিসীম। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে এই সব দার্শনিকদের শিক্ষার ভিত্তিতে কাব্যসাহিত্য ও অধিবিদ্যামূলক গ্রন্থাবলি রচিত হয়। অক্ক মহাদেবী, অল্লম প্রভু এবং চেন্নবসব, প্রভুদেব, সিদ্ধরাম ও কোন্ডাগুলি কেশীরাজ প্রমুখ বসবের অনুগামীগণ শিবের মাহাত্ম্য কীর্তন করে শতাধিক ‘বচন’ শ্রেণির কবিতা রচনা করেছিলেন।[৯০] হৈসল রাজসভার দুই বিশিষ্ট পণ্ডিত হরিহর ও রাঘবাঙ্ক ছিলেন বীরশৈব।[৯১] এই প্রথা বিজয়নগর সাম্রাজ্যেও বজায় ছিল। সেই যুগে সিঙ্গিরাজ, মল্লনর্য, লক্কন দন্দেস ও অন্যান্যেরা ছিলেন বীরশৈব সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক।[৯২][৯৩] বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সলুব, তুলুব ও অরবিদু রাজবংশ ছিল বৈষ্ণবধর্মের অনুগামী। বিজয়নগরের বিট্ঠলপুরা এলাকায় একটি বৈষ্ণব মন্দিরে আজও রামানুজের মূর্তি দেখা যায়।[৯৪] পরবর্তীকালে মহীশূর রাজ্যের পণ্ডিতেরাও রামানুজের শিক্ষার ভিত্তিতে গ্রন্থ রচনা করেন।[৯৫] রাজা বিষ্ণুবর্ধন জৈনধর্ম থেকে বৈষ্ণবধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর রাজ্যে অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।[৯৬]
বীরশৈব মতবাদের বৈপ্লবিক উত্থান তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ও রাজ-সমর্থিত বর্ণব্যবস্থায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দেয়। তুলনামূলকভাবে উদারনৈতিক এই যুগে সমাজে নারীর ভূমিকা বহুলাংশে নির্ভর করত তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিক্ষার স্তরের উপর। রাজপরিবার ও শহরের সম্পন্ন পরিবারগুলিতেও নারী স্বাধীনতা অধিকতর ছিল। বিভিন্ন নথিপত্রে শিল্পকলায় নারীর অংশগ্রহণের বিবরণ রয়েছে। যেমন চালুক্য রানি চণ্ডলদেবী ও কল্যাণীর কলচুরি রানি সোবলদেবী নৃত্য ও সংগীতে পারদর্শিনী ছিলেন বলে জানা যায়। ‘বচন’ কবিদের রচনার মধ্যে ৩০ জন ছিলেন মহিলা কবির রচনা পাওয়া যায়, যার মধ্যে অন্যতম দ্বাদশ শতাব্দীর বীরশৈব অতিন্দ্রীয়বাদী অক্ক মহাদেবীর রচনা।[৯৭] সমসাময়িক নথিপত্র থেকে এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে রাজপরিবারের কয়েকজন মহিলা সদস্য প্রশাসনিক ও সামরিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যেমন রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহের ভগিনী রাজকুমারী অক্কদেবী বিদ্রোহী সামন্ত রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের পরাজিত করেন।[৯৮][৯৯] অভিলেখগুলি থেকে জানা যায়, মেয়েরা স্বাভাবিক বৈধব্য জীবন যাপন করত, যার থেকে মনে করা হয় যে সতীদাহ প্রথা ছিল কোনও কোনও ব্যক্তিবিশেষের স্বেচ্ছা-নির্বাচিত প্রথা মাত্র।[১০০]
সমকালীন যুগে প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় ব্রাহ্মণেরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। তাদের পেশা ছিল ধর্মানুশীলন ও শিক্ষাদান-কেন্দ্রিক। এছাড়া স্থানীয় বিচারালয়ের বিচারকের দায়িত্বও ব্রাহ্মণেরাই পালন করত। অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ব্রাহ্মণেরা সামরিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজা, অভিজাত ও উচ্চবংশীয় ধনীরা ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং ভূমি ও বসতবাটী দান করে তাদের নির্দিষ্ট শহরে বা গ্রামে বাস করাত। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের স্থানান্তরনের ঘটনা ঘটত সম্ভবত রাজ্যের স্বার্থে। কারণ ক্ষমতা ও অর্থসম্পদের থেকে দূরে থাকা এই পণ্ডিতদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাধারণ শিক্ষাদান এবং নীতিজ্ঞান প্রদান ও শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার কাজে লাগানো হত। এছাড়াও ব্রাহ্মণেরা নিরপেক্ষ নিয়ন্তা ব্যক্তি ("পঞ্চায়েত") হিসেবে স্থানীয় সমস্যা সমাধানের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত।[১০১]
খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ, জৈন, বৌদ্ধ ও শৈবেরা কঠোরভাবে নিরামিশাষী হলেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মাংস খাওয়ার চল ছিল। বাজারের বিক্রেতারা ছাগল, ভেড়া, শূকর, মুরগির মতো গৃহপালিত প্রাণীর মাংস ছাড়াও তিতির, খরগোশ, বনমোরগ ও বুনো শূকরের মতো দুর্মূল্য প্রাণীর মাংসও বিক্রি করত।[১০২] ঘরোয়া বিনোদনের জন্য লোকে পছন্দ করত কুস্তি লড়া বা মোরগ লড়াই বা ভেড়ার লড়াই দেখা অথবা জুয়া খেলা। ঘোড়দৌড় ছিল একটি জনপ্রিয় বহির্দ্বার ক্রীড়া।[১০৩] এই ধরনের বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজ্যে প্রায়শই উৎসব ও মেলা আয়োজিত হত এবং কসরতবাজ, নৃত্যশিল্পী, নাট্যশিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের দলও প্রায়ই ঘুরে ঘুরে লোকের চিত্তবিনোদন করত।[১০৪]
নথিপত্রে বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয়ের উল্লেখ রয়েছে। এগুলি নির্মিত হত মন্দিরের কাছে। বাজারগুলি ছিল এক ধরনের মুক্তাঙ্গন, যেখানে মানুষ জড়ো হয়ে স্থানীয় বিষয়গুলি আলোচনা ও বিবেচনা করত। বৃন্দগায়ক দলগুলির প্রধান কাজ ছিল ভক্তিমূলক স্তোত্র গাওয়া। মন্দিরের খরচে এই দলগুলির ভরণপোষণ করা হত। ধর্মীয় মঠগুলির (হিন্দু ‘মঠ’, জৈন ‘পল্লী’ ও বৌদ্ধ ‘বিহার’) সঙ্গে যুক্ত বিদ্যালয়গুলিতে অল্পবয়সী যুবকদের বৃন্দগায়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।[১০৫] এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ম ও নীতিবিদ্যা বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল এবং প্রতিষ্ঠানগুলিতেও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ("সরস্বতী ভাণ্ডার") গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় ভাষায় ও সংস্কৃতে শিক্ষাদান করা হত। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বলা হত "ব্রহ্মপুরী" (বা "ঘটিক" বা "অগ্রহার")। সংস্কৃত শিক্ষাদান ছিল ব্রাহ্মণদের প্রায় একচেটিয়া এবং এর জন্য তারা রাজার থেকে নিয়মিত অনুদান পেত। অভিলেখগুলি থেকে জানা যায় এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চার থেকে আটটি পর্যন্ত বিষয় শিক্ষা দেওয়া হত।[১০৬]
পশ্চিম চালুক্য যুগে সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় কন্নড় ভাষাতেও সাহিত্যের বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়।[১০৭] সেই কারণে এই যুগটিকে কন্নড় সাহিত্যের এক সুবর্ণ যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়।[১০৮] এই যুগের জৈন পণ্ডিতেরা তীর্থংকরদের জীবনী রচনা করেন এবং বীরশৈব কবিরা ‘বচন’ নামে এক শ্রেণির ভক্তিমূলক কবিতা রচনা শুরু করেন। সেই যুগের প্রায় তিনশো ‘বচনকার’-এর (‘বচন’ কবি) নাম নথিবদ্ধ রয়েছে, যার মধ্যে ত্রিশ জন ছিলেন মহিলা কবি।[১০৯][১১০] ব্রাহ্মণ লেখকদের প্রথম দিকের রচনাগুলি ছিল বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ সংক্রান্ত। ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ের মধ্যে প্রণয়কাহিনি, কামশাস্ত্র, ঔষধশাস্ত্র, শব্দকোষ, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, বিশ্বকোষ ইত্যাদি বিষয়ে গ্রন্থ এই যুগেই প্রথম রচিত হয়।[১১১][১১২]
কন্নড় পণ্ডিতদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা ছিলেন রন্ন, বৈয়াকরণ দ্বিতীয় নাগবর্মা, মন্ত্রী দুর্গসিংহ এবং বীরশৈব সন্ত ও সমাজ সংস্কারক বসব। রাজা দ্বিতীয় তৈলপ এবং সত্যাশ্রয় ছিলেন রন্নের পৃষ্ঠপোষক। রন্নকে "কন্নড় সাহিত্যের ত্রিরত্ন"-এর অন্যতম মনে করা হয়।[১১৩] রাজা দ্বিতীয় তৈলপ রন্নকে "কবি চক্রবর্তী" ("কবিগণের সম্রাট") উপাধি দিয়েছিলেন। রন্নের প্রধান রচনা পাঁচটি। এগুলির মধ্যে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘চম্পু’ শৈলীতে রচিত সাহসভীমবিজয়ম্ বা গদাযুদ্ধ ছিল পৃষ্ঠপোষক রাজা সত্যাশ্রয়ের প্রশস্তিগাথা। এই গ্রন্থে কবি রাজাকে শৌর্যে ও বীর্যে ভীমের সঙ্গে তুলনা করে মহাভারতে কথিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অষ্টাদশ দিবসে সংঘটিত ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধের কাহিনিটি বর্ণনা করেছেন।[১১৪] ৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় তীর্থংকর অজিতনাথের জীবনকথা বর্ণনা করে অজিতপুরাণ গ্রন্থটি রচনা করেন।[১১৫][১১৬]
রাজা দ্বিতীয় জগদেকমল্লের রাজকবি ("কটকাচার্য") দ্বিতীয় নাগবর্মা বিভিন্ন বিষয়ে কন্নড় সাহিত্যে অবদান রাখেন।[১১৭][১১৮] কাব্য, ছন্দশাস্ত্র, ব্যাকরণ ও শব্দকোষ বিষয়ে দ্বিতীয় নাগবর্মার রচনাবলি প্রামাণ্য উৎসগ্রন্থ এবং কন্নড় ভাষা নিয়ে গবেষণার কাজে এগুলির গুরুত্ব সুবিদিত। কাব্যতত্ত্ব বিষয়ে কাব্যালোকন, ব্যাকরণ বিষয়ে কর্ণাটক-ভাষাভূষণ ও শব্দকোষ বিষয়ে বাস্তুকোষ (সংস্কৃত শব্দের কন্নড় প্রতিশব্দ সহ) হল দ্বিতীয় নাগবর্মা রচিত কয়েকটি সমন্বিত অবদান।[১১৯] এই যুগে ঔষধশাস্ত্র বিষয়েও একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়। এগুলির মধ্যে জগদ্দল সোমনাথ রচিত কর্ণাটক-কল্যাণকারক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১২০]
কন্নড় কাব্য সাহিত্যে ‘বচন’ নামে পরিচিত একটি স্বতন্ত্র রূপ এই যুগে বিকাশ লাভ করেছিল। অতিন্দ্রীয়বাদী সন্ত-কবিরা এই সরল কবিতাগুলির মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিবেদন করতেন এবং তা জনসাধারণের কাছেও বিশেষ আদৃতও হয়েছিল। এই সন্ত-কবিদের মধ্যে বসব, অক্ক মহাদেবী, অল্লম প্রভু, চন্নবসব ও সিদ্ধরামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১২১]
কাশ্মীরী কবি বিলহণ সংস্কৃত ভাষায় ১৮টি সর্গে বিক্রমাঙ্কদেবচরিতম্ নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। এই সুপরিচিত কাব্যটিতে তিনি পৃষ্ঠপোষক রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের জীবন ও কীর্তি মহাকাব্যের আকারে বর্ণনা করেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় সোমেশ্বরকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করার পর কেমন করে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য চালুক্য সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা এই কাব্যে পাওয়া যায়।[১২২] বিশিষ্ট ভারতীয় গণিতজ্ঞ দ্বিতীয় ভাস্কর (জন্ম আনু. ১১১৪ খ্রিস্টাব্দ) এই যুগেরই ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে লীলাবতী, বীজগণিত, গোলাধ্যায় (খ-গোলক বিষয়ক গ্রন্থ) ও গ্রহগণিত (গ্রহ-সংক্রান্ত গ্রন্থ) অবলম্বনে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ সিদ্ধান্ত শিরোমণি। এই গ্রন্থ থেকেই জানা যায় যে, তিনি ছিলেন বিজ্জদ বিদের (অধুনা বিজয়পুর জেলা, কর্ণাটক) অধিবাসী।[১২৩]
১১২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর মানসোল্লাস বা অভিলাষিতার্থ চিন্তামণি নামে একটি সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেন সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের ব্যবহারোপযোগী করে। এটি সংস্কৃত ভাষায় একটি প্রাচীন বিশ্বকোষের নমুনা যেখানে ঔষধ, জাদুবিদ্যা, পশুচিকিৎসা বিজ্ঞান, মূল্যবান পাথর ও মুক্তোর দাম নির্ধারণ, দুর্গনির্মাণ, চিত্রকলা, সংগীত, ক্রীড়া, বিনোদন ইত্যাদি বিষয় বিধৃত হয়েছিল।[১২৪] বইটিতে গুরুত্বের ক্রমানুসারে বিষয়গুলি সজ্জিত না হলেও, তৎকালীন যুগে এই সকল বিষয়ের উপর জ্ঞানের পরিধির কথা জানতে বইটি বিশেষভাবে সাহায্য করে।[১২৫] তৃতীয় সোমেশ্বর পিতা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের একটি জীবনীও রচনা করেন। বইটির নাম বিক্রমাঙ্কাভ্যুদয়। এই গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক গদ্যোপাখ্যান, যেখানে কর্ণাটকের ভূগোল ও অধিবাসীদের একটি জীবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়।[১২৬]
ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় বিজ্ঞানেশ্বর নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত মিতাক্ষরা গ্রন্থটি রচনা করে আইন সাহিত্যে খ্যাতি অর্জন করেন। এই জাতীয় সাহিত্যে সম্ভবত মিতাক্ষরা-ই সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য গ্রন্থ। এটি যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি-এ একটি টীকা, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলির ভিত্তিতে রচিত আধুনিক ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে স্বীকৃত। কোলব্রুক নামে এক ইংরেজ এই গ্রন্থের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অংশটি অনুবাদ করেন, যা ব্রিটিশ ভারতীয় আদালত ব্যবস্থায় গৃহীত হয়।[১২৭] এই যুগে সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র-সংক্রান্ত কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল সংগীত চূড়ামণি, সংগীত সময়সয়ার ও সংগীত রত্নাকর।[১২৮]
পশ্চিম চালুক্য রাজবংশের শাসনকাল ছিল দ্রাবিড় স্থাপত্যের বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই যুগের স্থাপত্যশৈলীটি ছিল অষ্টম শতাব্দীর বাদামী চালুক্য স্থাপত্যশৈলী এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হৈসল স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে একটি তাত্ত্বিক যোগসূত্র।[১২৯][১৩০] পশ্চিম চালুক্য শিল্পকলাকে ক্ষেত্রবিশেষে অধুনা কর্ণাটকের গদাগ জেলার তুঙ্গভদ্রা-কৃষ্ণা দোয়াব অঞ্চলের মন্দিরনগরী গদাগের নামানুসারে ‘গদাগ শৈলী’ নামেও অভিহিত করা হয়।[১৩১] দ্বাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম চালুক্যদের মন্দির নির্মাণ কর্মসূচি পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। ততদিনে সমগ্র দাক্ষিণাত্য জুড়ে পশ্চিম চালুক্য রাজারা শতাধিক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নির্মিত হয়েছিল অধুনা মধ্য কর্ণাটক অঞ্চলে।[১৩২][১৩৩] মন্দির ছাড়াও এই যুগে পুণ্যার্থীদের স্নানের জন্য ‘পুষ্করণি’ (অলংকৃত ধাপযুক্ত কুয়ো) প্রচুর নির্মিত হয়েছিল। লক্কুণ্ডীতে এই রকম কয়েকটি কূপ সুসংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীকালে হৈসল ও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্থাপত্যেও এই ধাপযুক্ত কূপের নকশাগুলি একত্রীভূত হয়েছিল।[১৩৪][১৩৫]
লক্কুণ্ডীর (গাদাগ জেলা) কাশীবিশ্বেশ্বর মন্দির,[১৩৬][১৩৭] ডম্বলের (গাদাগ জেলা) ডোড্ডাবসপ্প মন্দির,[১৩৮][১৩৯] কুরুবত্তি (বেল্লারী জেলা) মল্লিকার্জুন মন্দির,[১৩৭][১৪০] বাগালির (দাবণগেরে জেলা) কল্লেশ্বর মন্দির,[১৪০][১৪১] হাবেরীর (হাবেরী জেলা) সিদ্ধেশ্বর মন্দির,[১৪২][১৪৩] অন্নিগেরীর (ধারওয়াড় জেলা) অমৃতেশ্বর মন্দির,[১৪৪] ইতগীর (কোপ্পাল জেলা) মহাদেব মন্দির,[১৪৫][১৪৬] কুবাতুরের কৈটভেশ্বর মন্দির,[১৪৭] এবং বল্লিগাবির কেদারেশ্বর মন্দির হল পরবর্তী চালুক্য স্থাপত্যশৈলীর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন।[১৪৮] দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মহাদেব মন্দিরটি পশ্চিম চালুক্য স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এই মন্দিরের সুদৃশ্য ভাস্কর্য এবং দেওয়ালে, স্তম্ভে ও মিনারগুলিতে জটিল ও সূক্ষ খোদাইচিত্রগুলি চালুক্য রুচি ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মন্দিরের বাইরে প্রাপ্ত একটি অভিলেখে মন্দিরটিকে ‘দেবালয় চক্রবর্তী’ (‘মন্দিরসমূহের সম্রাট’) বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই অভিলেখ থেকে জানা গিয়েছে যে রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাধ্যক্ষ মহাদেব এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।[১৪৯][১৫০] বল্লিগাবির কেদারেশ্বর মন্দিরটি (১০৬০ খ্রিস্টাব্দ) হল চালুক্য থেকে হৈসল স্থাপত্যশৈলীতে উত্তরণের মধ্যবর্তী স্তরের একটি উদাহরণ।[১৫১][১৫২] পশ্চিম চালুক্যরা মন্দির নির্মাণ কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ে বাদামী ও ঐহোলেও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দিরগুলির মধ্যে মল্লিকার্জুন মন্দির, ইয়েল্লাম্মা মন্দির ও ভূতনাথ মন্দির চত্বর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১৫৩][১৫৪]
পশ্চিম চালুক্য মন্দিরগুলির ‘বিমান’ অংশে (গর্ভগৃহের উপরস্থ চূড়া) পূর্বতন চালুক্যদের সাদামাটা ধাপযুক্ত শৈলীর সঙ্গে হৈসলদের অলংকরণবহুল শৈলীর একটি মিশ্রণ চোখে পড়ে।[১৩০] পশ্চিম চালুক্য স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হল লেদ নির্মিত স্তম্ভ এবং ভবন ও ভাস্কর্য নির্মাণের মৌলিক উপাদান হিসেবে সোপস্টোনের (ক্লোরিটিক সিস্ট) ব্যবহার, যা পরবর্তীকালে হৈসল মন্দির নির্মাণের সময়ও জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিল। পশ্চিম চালুক্যেরা নিজেদের ভাস্কর্যের মধ্যে অলংকারবহুল ‘কীর্তিমুখ’ (দানব মুখ) জনপ্রিয় করে তুলেছিল। হৈসল রাজ্যের বিখ্যাত ভাস্করদের মধ্যে বল্লিগাবী প্রভৃতি স্থানের স্থানীয় চালুক্য ভাস্কররাও ছিলেন।[১৫৫] পশ্চিম চালুক্যদের শৈল্পিক দেওয়াল অলংকরণ ও সাধারণ ভাস্কর্যশৈলীটি ছিল দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলীরই অন্তর্গত।[১৩৫] ভারতীয় স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলির অন্যতম এই শৈলীটিকে কখনও কখনও ‘কর্ণাট দ্রাবিড়’ শৈলী নামেও অভিহিত করা হয়।[১৫৬]
পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের অভিলেখগুলিতে প্রধানত স্থানীয় ভাষা কন্নড়ই ব্যবহৃত হত। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, পশ্চিম চালুক্যদের অভিলেখগুলির ৯০ শতাংশই কন্নড়ে এবং অবশিষ্টাংশ সংস্কৃতে রচিত।[১৩][১৫৭] খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী অন্যান্য রাজাদের তুলনায় ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কন্নড় অভিলেখই অধিক সংখ্যায় পাওয়া যায়।[১৫৮] ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ইতিহাসবিদেরা এই অভিলেখগুলির মধ্যে অনেকগুলিরই পাঠোদ্ধার ও অনুবাদ করেছেন।[১৫] অভিলেখগুলি সাধারণত পাথর (‘শিলাশাসন’) বা তামার পাতের (‘তাম্রশাসন’) উপর উৎকীর্ণ হত। এই যুগে সাহিত্য ও কাব্যের ভাষা হিসেবে কন্নড় ভাষার বিকাশ ঘটেছিল, যে ঘটনার চালিকাশক্তি ছিল বীরশৈব বা লিঙ্গায়েত নামে পরিচিত এক ভক্তিবাদী আন্দোলন। বীরশৈবেরা '’বচন’ নামে পরিচিত এক শ্রেণির সরল গীতিকবিতার মাধ্যমে ইষ্টদেবতার প্রতি ভক্তি নিবেদন করত।[১৫৯] প্রশাসনিক স্তরে অবস্থান ও ভূমিদান-সংক্রান্ত অধিকারগুলি নথিবদ্ধ করার কাজে স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করা হত। দ্বিভাষিক অভিলেখগুলির ক্ষেত্রে শিরোনাম, বংশলতিকা, রাজবংশের উৎপত্তি-সংক্রান্ত অতিকথা ও আশীর্বচনগুলি সাধারণত সংস্কৃতে লেখা হত। কন্নড় ভাষা ব্যবহৃত হত অনুদানের শর্ত উল্লেখের ক্ষেত্রে, যার মধ্যে জমি, জমির সীমানা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অংশীদারিত্ব, গ্রহীতার অধিকার ও বাধ্যবাধকতা, রাজত্ব ও দেয় অর্থ ও সাক্ষী বিষয়ক তথ্যগুলিও থাকত এবং এই স্থানীয় ভাষা এমনভাবে ব্যবহার করা হত যাতে স্থানীয় লোকেরা কোনও রকম দ্ব্যর্থতা ব্যতিরেকেই বিষয়বস্তু সহজে বুঝতে পারে।[১৬০]
অভিলেখ ছাড়াও রাজবংশগুলির ঐতিহাসিক বর্ণনা দেওয়ার জন্য বংশাবলি নামে পরিচিত এক শ্রেণির কালপঞ্জিও রচিত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় কাব্য, ব্যাকরণ, শব্দকোষ, সারগ্রন্থ, অলংকার শাস্ত্র, প্রাচীন গ্রন্থাবলির উপর টীকা, গদ্য কথাসাহিত্য ও নাটক রচিত হত। ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়বস্তুর উপর কন্নড় ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই যুগের কয়েকটি সুপরিচিত গ্রন্থ হল প্রথম নাগবর্মা রচিত ছন্দোম্বুধি (ছন্দশাস্ত্র) ও কর্ণাটক কাদম্বরী (প্রেমকাহিনি), রন্ন রচিত রন্নকাণ্ড (শব্দকোষ, ৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ), জগদ্দল সোমনাথ রচিত কর্ণাটক-কল্যাণকারক (ঔষধ-বিষয়ক গ্রন্থ), শ্রীধরাচার্য রচিত জাতকতিলক (প্রাচীনতম কন্নড় জ্যোতিষ গ্রন্থ, ১০৪৯ খ্রিস্টাব্দ), চন্দ্ররাজ রচিত মদনকতিলক (কামশাস্ত্র) এবং দ্বিতীয় চবুন্দরায় রচিত লোকপকার (বিশ্বকোষ, ১০২৫ খ্রিস্টাব্দ)।[১১২][১৬১]
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
কালরেখা ও সাংস্কৃতিক যুগ |
উত্তর-পশ্চিম ভারত | সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি | মধ্যভারত | দক্ষিণ ভারত | ||
পশ্চিম গাঙ্গেয় সমভূমি | উত্তর ভারত (মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমি) |
উত্তরপূর্ব ভারত | ||||
লৌহযুগ | ||||||
সংস্কৃতি | পরবর্তী বৈদিক যুগ | পরবর্তী বৈদিক যুগ (ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শ)[ক] |
পরবর্তী বৈদিক যুগ (ক্ষত্রিয়/শ্রামণিক সংস্কৃতি)[খ] |
প্রাগৈতিহাসিক | ||
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী | গান্ধার | কুরু-পাঞ্চাল | মগধ | আদিবাসী | ||
সংস্কৃতি | পারস্য-গ্রিক প্রভাব | "দ্বিতীয় নগরায়ণ" | প্রাগৈতিহাসিক | |||
খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী | (পারস্য শাসনকাল) | শিশুনাগ রাজবংশ | আদিবাসী | |||
খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী | (গ্রিক বিজয়) | |||||
ঐতিহাসিক যুগ | ||||||
সংস্কৃতি | বৌদ্ধধর্মের প্রসার | প্রাগৈতিহাসিক | সঙ্গম যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ – ২০০ খ্রিস্টাব্দ) | |||
খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী | মৌর্য সাম্রাজ্য | আদি চোল প্রাচীন তামিঝাগামের অন্যান্য ৪৬টি ছোটো রাজ্য | ||||
সংস্কৃতি | প্রাকধ্রুপদি হিন্দুধর্ম[গ] - "হিন্দু সমন্বয়"[ঘ] (খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ – ৩০০ খ্রিস্টাব্দ)[ঙ][চ] মহাকাব্য - পুরাণ - রামায়ণ - মহাভারত - ভগবদ্গীতা - ব্রহ্মসূত্র - স্মার্ত সম্প্রদায় মহাযান বৌদ্ধধর্ম |
সঙ্গম যুগ (প্রসারিত) | ||||
খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী | ইন্দো-গ্রিক রাজ্য | শুঙ্গ সাম্রাজ্য | আদিবাসী | আদি চোল প্রাচীন তামিঝাগামের অন্যান্য ৪৬টি ছোটো রাজ্য | ||
খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দী | যোন | মহা-মেঘবাহন রাজবংশ | ||||
খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী | কুনিন্দ রাজ্য | |||||
২য় শতাব্দী | পহ্লব | বর্মণ রাজবংশ | ||||
৩য় শতাব্দী | কুষাণ সাম্রাজ্য | পশ্চিম সত্রপ | কামরূপ রাজ্য | কলভ্র রাজবংশ | ||
সংস্কৃতি | "হিন্দুধর্মের সুবর্ণযুগ"(৩২০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)[ছ] পুরাণ হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সহাবস্থান | |||||
৪র্থ শতাব্দী | গুপ্ত সাম্রাজ্য | কলভ্র রাজবংশ | ||||
৫ম শতাব্দী | মৈত্রক | আদিবাসী | কলভ্র রাজবংশ | |||
৬ষ্ঠ শতাব্দী | কলভ্র রাজবংশ | |||||
সংস্কৃতি | উত্তরকালীন ধ্রুপদি হিন্দুধর্ম (৬৫০-১১০০ খ্রিস্টাব্দ)[জ] অদ্বৈত বেদান্ত - তন্ত্র ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন | |||||
৭ম শতাব্দী | ইন্দো-সাসানিড | বাকাটক রাজবংশ হর্ষের সাম্রাজ্য |
মিয়েচ্ছ রাজবংশ | আদিবাসী | পাণ্ড্য রাজ্য (কলভ্রদের অধীনস্থ) | |
৮ম শতাব্দী | কিদারিত রাজ্য | পাণ্ড্য রাজ্য | ||||
৯ম শতাব্দী | ইন্দো-হেফঠালাইট (হুন) | গুর্জর-প্রতিহার | পাণ্ড্য রাজ্য | |||
১০ম শতাব্দী | পাল রাজবংশ | মধ্যযুগীয় চোল | ||||
ছকের জন্য তথ্যসূত্র এবং উত্স তথ্যসূত্র উত্স
|