পশ্চিম রণাঙ্গন | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয় রণাঙ্গন | |||||||||
উপরে বাঁ থেকে (ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তিত): বিমান হামলার পর রটারডেম নগরী, ব্রিটেনের যুদ্ধে জার্মান হাইনকেল হে-১১১ বিমানসমূহ, "অপারেশন মার্কেট গার্ডেন"-এর সময় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের প্যারাস্যুটের সাহায্যে অবতরণ, জার্মানির ওয়ের্নবার্গে মার্কিন সেনাগণ, ব্যাস্টোন শহর অবরোধ, "অপারেশন ওভারলর্ড"-এর সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর ওমাহা সমুদ্রসৈকতে অবতরণ। | |||||||||
| |||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
মিত্রবাহিনী
পোল্যান্ড বেলজিয়াম নেদারল্যান্ডস নরওয়ে চেকোস্লোভাকিয়া লুক্সেমবুর্গ গ্রীস সোভিয়েত ইউনিয়ন[nb ১] ডেনমার্ক |
অক্ষশক্তি ভিচি ফ্রান্স[nb ২] | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
১৯৩৯-১৯৪০ মরিস গ্যামলিন ম্যাক্সিম ওয়েগ্যান্ড জন ভেরেকার, লর্ড গর্ট উইলিয়াম বয়েল, লর্ড কর্ক ভ্লাদিস্লাভ সিকোরস্কি হেনরি উইংকেলম্যান সম্রাট ৩য় লিওপোল্ড অটো রুগে উইলিয়াম ওয়েইন প্রাইওর ১৯৪৪-১৯৪৫ ফ্র্যাংকলিন ডি. রুজভেল্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার উইনস্টন চার্চিল বার্নার্ড মন্ট্গমারি আর্থার টেডার ওমার ব্র্যাডলি জ্যাকব এল. ডেভার্স জর্জ প্যাটন কোর্টনি হজেস উইলিয়াম সিম্পসন আলেক্সান্ডার প্যাচ মাইল্স ডেম্পসি ট্র্যাফোর্ড লে-ম্যালোরি বার্ট্রাম রামসি কেনেথ স্টুয়ার্ট হ্যারি ক্রেরার চার্লস ডি গল জন ডি ট্যাসিনি ক্যাসিমিয়ের্জ সোসেনকোস্কি |
১৯৩৯-১৯৪০ ওয়াল্টার ফন ব্রকিচ গার্ড ফন রুনস্টেট এরিখ ফন ম্যানস্টাইন হাইন্জ গুডেরিয়ান ফিডোর ফন বক উইলহেম ফন লীব নিকোলাস ফন ফকেনহোর্স্ট উমবের্টো ডি সাভোইয়া ১৯৪৪-১৯৪৫ অ্যাডলফ হিটলার হেনরিক হিমলার হার্মান গোরিং গার্ড ফন রুনস্টেট রবার্ট ফন গ্রাইম গুন্টার ফন ক্ল্যুগ ওয়াল্টার মডেল অ্যালবার্ট কেসেলরিং এরউইন রমেল জোহান্স ব্লাস্কোউইত্জ হার্মান বাল্ক পল হসার | ||||||||
শক্তি | |||||||||
১৯৩৯-১৯৪০
১৯৪৪-১৯৪৫
|
১৯৩৯-১৯৪০
১৯৪৪-১৯৪৫ | ||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
১৯৪০ ১৯৪৪-১৯৪৫ ১০,৫৬১টি ট্যাংক ধ্বংসপ্রাপ্ত[১১][১২][১৩]
|
১৯৪০ ১৯৪৪-১৯৪৫ সর্বমোট:
| ||||||||
১৬,৫০,০০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত[nb ৯] |
পশ্চিম রণাঙ্গন বলতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয় রণাঙ্গনের পশ্চিম অঞ্চলসমূহকে বোঝায়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ডেনমার্ক, নরওয়ে, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড্স, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি এবং জার্মানি।[৩২] ২য় বিশ্বযুদ্ধের যেসমস্ত সংঘাত দক্ষিণ ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল তা অন্য শিরোনামের অধীনে আলোচিত হয়। প্রধানত দু'টি পর্যায়ে সংঘটিত হওয়া বৃহৎ পরিসরের সামরিক অভিযান দ্বারা পশ্চিম রণাঙ্গনকে চিহ্নিত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে, ১৯৪০ সালের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে উত্তর-পশ্চিমের নিম্নভূমিসমূহে ও দক্ষিণ ফ্রান্সে জার্মানির হাতে নেদারল্যান্ড্স, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্স পরাজিত হয় এবং নতি স্বীকার করে, এবং জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে বিমান যুদ্ধ চলতে থাকে যার পরিসমাপ্তি ঘটে ব্রিটেনের যুদ্ধে। দ্বিতীয় পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল- ১৯৪৪ সালে নরম্যান্ডি সৈকতে মিত্র বাহিনীর আক্রমণ এবং মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির মধ্যকার তুমুল স্থলযুদ্ধ, একই সাথে অন্তরীক্ষেও চলতে থাকে বিমানযুদ্ধ, যা ১৯৪৫ সালের মে মাসে জার্মানির চূড়ান্ত পরাজয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
ফোনির যুদ্ধ ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মহাদেশীয় ইউরোপে সংঘটিত হওয়া কতিপয় সামরিক অভিযান, যেগুলো অনুষ্ঠিত হয় জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড দখলের পরে এবং ফ্রান্সের যুদ্ধের পূর্বে। যদিও ইউরোপের ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কিন্তু তখন পর্যন্ত কোন পক্ষই উল্লেখযোগ্য কোন আক্রমণ পরিচালনা করেনি, এবং স্থলভাগে তূলনামূলক স্বল্প পরিসরেই যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছিল। এসময় পোল্যান্ডের সাথে চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
যখন জার্মান সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশ পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তখন একটি ক্ষুদ্রতর জার্মান বাহিনী "সিগফ্রেড রেখায়" (Siegfried Line) নিযুক্ত থাকে, যা ছিল ফ্রান্স ও জার্মানির সীমান্তে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত দুর্গসমূহ। সীমান্তের অপর পার্শ্বে ফরাসী বাহিনী জার্মানদের বিপরীতে অবস্থান নেয়। একই সময়ে ব্রিটিশ অভিযাত্রী বাহিনী ও ফরাসী সেনাবাহিনী বেলজিয়াম-জার্মানি সীমান্তে প্রতিরক্ষামূলক ব্যূহ গড়ে তোলে। এসময় কেবল আঞ্চলিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে সংঘাত ঘটে থাকে। ব্রিটিশ বিমান বাহিনী জার্মানিতে রটনামূলক প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেয় এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে কানাডিয়ান সেনারা ব্রিটেনের সমুদ্রতটে এসে পৌঁছে, অতঃপর ৭ মাস যাবৎ পশ্চিম ইউরোপে একটি থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে।
যুদ্ধ সরঞ্জাম পুনঃসজ্জিত করার জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স তড়িঘড়ি করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করতে থাকে, যা তাদের নিজস্ব উৎপাদনের ঘাটতিকে সামাল দেয়। তখন পর্যন্ত যুদ্ধে অংশ না নেয়া যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা মিত্রবাহিনীকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রের মূল্যহ্রাস করে দেয়। মিত্রবাহিনীর আন্তঃ-আটলান্টিক বাণিজ্যে জার্মানরা বাধা দিতে চাইলে আটলান্টিক যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
যদিও ১৯৪০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পশ্চিম রণাঙ্গন অনেকাংশেই ছিল শান্ত, মিত্রবাহিনীর সঙ্গে জার্মানদের সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় নরওয়েজিয়ান অভিযানের হাত ধরে, যখন জার্মানরা ডেনমার্ক ও নরওয়ে আক্রমণ করে ("অপারেশন ওয়েসেরুবুং")। এতে করে জার্মানরা মিত্রবাহিনীর আগেই এসমস্ত এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়; এদিকে মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল স্ক্যান্ডিনিভিয়ায় তাদের বাহিনী স্থাপন করে জার্মানিকে চতুর্পাশ থেকে ঘেরাও করবে এবং সুইডেন থেকে তাদের কাঁচামাল সরবরাহকে বন্ধ করবে, জার্মানদের এই অভিযানের ফলে মিত্রশক্তির এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তথাপি, মিত্ররা নরওয়ের সমুদ্রতটে তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে জলে ও স্থলে পাল্টা আক্রমণ চালালে জার্মানরা তাদের রুখে দেয়, নরওয়েজিয়ান সেনাবাহিনী জার্মান বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয় এবং নিজদেশ থেকে বিতাড়িত হয়। তবে, নরওয়ের দখল নিয়ে দুই মাসব্যপী এ যুদ্ধে, জার্মান নৌবাহিনী "ক্রিগ্স ম্যারিন" ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
১৯৪০ সালের মে মাসে জার্মানরা ফ্রান্স আক্রমণ করে। পশ্চিমা মিত্রবাহিনীসমূহ, বিশেষ করে ফরাসি, বেলজিয়ান ও ব্রিটিশ স্থল বাহিনীসমূহ জার্মানদের উপর্যুপরি "ব্লিট্জক্রিগ" বা ঝটিকা আক্রমণে পরাস্ত হয়। সমগ্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও ফরাসি সেনাবাহিনীর কিছু অংশ ডানকার্ক বন্দর হয়ে ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধ শেষে জার্মানরা পরিকল্পনা করতে থাকে ব্রিটেনের সাথে তাদের আচরণ কীরূপ হবে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ব্রিটিশরা যদি শান্তি চুক্তিতে রাজি না হয় তবে ব্রিটেন আক্রমণ করাই হবে তাদের একমাত্র পন্থা ("অপারেশন সী-লায়ন")। তবে, জার্মান নৌবাহিনী "ক্রীগ্স ম্যারিন" নরওয়ের যুদ্ধে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়াতে তাদের একমাত্র উপায় ছিল, জার্মান বিমান বাহিনী "লুফ্টওয়াফ" কর্তৃক আকাশ পথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া।
জার্মান বিমান বাহিনী লুফ্টওয়াফ আকাশ-যুদ্ধে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনী (RAF)-কে পরাভূত করতে ব্যর্থ হয়, এতে জার্মানদের ব্রিটেন আক্রমণ করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তদুপরি জার্মানদের স্থল বাহিনীর অধিকাংশই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নেয় ইংলিশ প্রণালীর পাড়ে সমগ্র ফরাসি উপকূল জুড়ে সারিবদ্ধ প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা নির্মাণ করার, (যাকে বলা হয় "আটলান্টিক দেয়াল")। মিত্রবাহিনী ফরাসি উপকূলে হানা দিতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে এসমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ইংলিশ প্রণালী পাড়ি দিয়ে আক্রমণ চালানো অত্যন্ত দুঃসাধ্য একটি অভিযান হবে, এই ভেবে মিত্রবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন যে ফরাসি উপকূলে প্রস্তুতিমূলক একটি হামলা চালিয়ে দেখা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪২ সালের ১৯এ আগস্ট ফ্রান্সের ডিয়েপ (Dieppe) উপকূলে আক্রমণ চালানো হয়। আক্রমণকারী বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য ছিল কানাডীয় সেনাবাহিনীর, সাথে কিছু ব্রিটিশ, ফরাসি ও মার্কিন সেনা ছিল এবং ব্রিটিশ ও পোলিশ নৌবাহিনী তাদের সমর্থন প্রদান করছিল। এই আক্রমণটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত হয়, আক্রমণকারী সৈন্যদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই হতাহত হয়। যদিও এ আক্রমণ থেকে মিত্ররা প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভ করে এবং এই অভিজ্ঞতা তারা পরবর্তী আক্রমণসমূহে কাজে লাগায়।
এরপর প্রায় দুই বছর যাবৎ পশ্চিম রণাঙ্গনের স্থলভাগে বড় কোন যুদ্ধ হয়নি। এসময় যুদ্ধ কেবলমাত্র বিশেষ কমান্ডো বাহিনীর গুপ্ত হামলা, গেরিলা যুদ্ধ এবং ফরাসি বেসামরিক নাগরিকদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে ব্রিটিশ "বিশেষ অভিযান কর্মসূচি" (Special Operations Executive, বা SOE) এবং মার্কিন "কৌশলগত সহায়তা দফতর" (Office of Strategic Services বা OSS) সহায়তা প্রদান করে। তদুপরি এসময়ে মিত্রবাহিনী জার্মান ভূমিতে যুদ্ধের সূচনা করে, দিনের আলোয় মার্কিন ৮ম বিমান বাহিনী (Eighth Air Force) জার্মান ভূখণ্ডের অঞ্চলসমূহে একের পর এক কৌশলগত বোমা হামলা চালাতে থাকে এবং রাতের আঁধারে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনী (Royal Air Force) বোমা হামলা চালায়। মিত্রবাহিনীর একটি বড় অংশ ভূমধ্যসাগরীয় রণাঙ্গনে যুদ্ধে নিযুক্ত হয় যাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহের কর্তৃত্ব তাদের হাতে চলে আসে এবং ইতালির ফোগিয়া বিমানবন্দরে জলপথে আক্রমণের পথ খুলে যায়।
এ পর্যায়ের প্রথমভাগে পরিচালিত দু'টি হামলা অভিযানের জন্য ব্রিটিশ সরকার সম্মাননা পদক প্রদান করে থাকে- অভিযান দু'টি হল ফ্রান্সের বোলোনে পরিচালিত "অপারেশন কলার" (২৪ জুন, ১৯৪০) এবং গের্নসিতে সংঘটিত "অপারেশন অ্যামবাসেডর" (১৪-১৫ জুলাই, ১৯৪০)। এছাড়া, বুর্নেভালে সংঘটিত "অপারেশন বাইটিং" (২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২), সেন্ট নাজায়ের আক্রমণ (২৭-২৮ মার্চ, ১৯৪২), বায়োনে সংঘটিত "অপারেশন মিরমিডন" (৫ এপ্রিল, ১৯৪২), হার্ডেলটে সংঘটিত "অপারেশন অ্যাবেরক্রম্বি" (২১-২২ এপ্রিল, ১৯৪২), ডিয়েপ আক্রমণ (১৯ আগস্ট, ১৯৪২) এবং গিরন্ডে সংঘটিত "অপারেশন ফ্র্যাংকটন" (৭-১২ ডিসেম্বর, ১৯৪২) অভিযানসমূহের অংশগ্রহণের জন্য ব্রিটিশ সরকার "১৯৪২ সালের উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ অভিযান" সম্মাননা পদক দান করে।[৩৩][৩৪]
এছাড়াও ইংলিশ প্রণালীর সার্ক দ্বীপে ১৯৪২ সালের ৩-৪ অক্টোবর অভিযানটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কেননা এর কিছুদিন পরে জার্মানরা প্রচারণার মাধ্যমে রটিয়ে দেয় যে একজন বন্দী পালিয়ে গেছে এবং অপর দু'জনকে পলায়নের সময় হাতবাঁধা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই হাত বাঁধা অবস্থায় গুলি করার কারণ, হিটলারের এই আদেশ যে কোন কমান্ডো বা তদ্রূপ যোদ্ধাকে আটক করা গেলে তাদেরকে আইনমাফিক হত্যা করা হবে।
১৯৪৪ সালের গ্রীস্মে, যখন মিত্রবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের কথা জার্মান সেনাপ্রধানগণ অনুধাবন করতে পারলেন, তখন তা প্রতিরোধের জন্যে নিয়োজিত সেন্যবাহিনীর কর্তৃত্ব নেয় জার্মান পশ্চিম রণাঙ্গন কর্তৃপক্ষ (O.B. West), যার সদর দপ্তর ছিল প্যারিসে। এর অধীন সেনাবাহিনীকে ৩ ভাগে বিভক্ত করা হয়: প্রথম ভাগ "ওয়েরমাক্ট নেদারল্যান্ড্স কমান্ড" (Wehrmachtbefehlshaber Niederlande, WBN) এর দায়িত্ব ছিল ডাচ ও বেলজিয়ামের উপকূল প্রতিরক্ষা করা। দ্বিতীয় ভাগ ছিল "যুগ্ম বাহিনী-বি" (Army Group B), যার অন্তর্ভুক্ত "ওয়েরমাক্ট ১৫শ বাহিনী" ছিল ফ্রান্সের উত্তর উপকূল এবং সীন নদীর উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে, "ওয়েরমাক্ট ৭ম বাহিনী" ছিল সীন নদী ও লোয়ার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ইংলিশ চ্যানেল ও আটলান্টিকের উপকূল প্রতিরক্ষার দায়িত্বে। এবং তৃতীয় ভাগটি হল "যুগ্ম বাহিনী-জি" (Army Group G) যার দায়িত্বে ছিল বিস্কে উপসাগরের তীর এবং ভিচি ফ্রান্সের দায়িত্ব, এর অন্তর্ভুক্ত "ওয়েরমাক্ট ১ম বাহিনী" ছিল লোয়ার নদী ও স্পেনীয় সীমান্তের মধ্যবর্তী আটলান্টিকের উপকূল রক্ষার দায়িত্বে, এবং "ওয়েরমাক্ট ১৯শ বাহিনী" ছিল ভূমধ্যসাগরীয় ফরাসি উপকূলের দায়িত্বে।
মিত্রবাহিনী কোন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করবে তা অনুমান করা অসম্ভব ছিল। সমগ্র সমুদ্র উপকূলজুড়েই সেনাবাহিনী অবতরণ (amphibious landing) করা সম্ভব ছিল বলে জার্মান সেনাবাহিনীকে বিস্তর অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে হয় এবং দ্রুতগতির যানবাহনসমূহকে নিয়োজিত করতে হয়, এরমধ্যে ছিল জার্মান ট্যাংকবাহিনী "প্যানজার"-এর অধিকাংশ। সেনাবাহিনীর প্রতিটি দলের সাথে যানবাহন বহর নিযুক্ত করা হয়। উত্তর ফ্রান্সে "যুগ্ম বাহিনী-বি"-এর সাথে নিযু্ক্ত হয় "২য় প্যানজার বিভাগ", প্যারিসে নিযুক্ত হয় "১১৬ তম প্যানজার বাহিনী", এবং নরম্যান্ডিতে "২১ তম প্যানজার বাহিনী"। আটলান্টিক উপকূলে মিত্রবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় "যুগ্ম বাহিনী-জি" এর যুদ্ধযানবহরকে বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়, জিরোন্ড অঞ্চলে নিয়োজিত হয় "১১শ প্যানজার বিভাগ", "২য় এস.এস. প্যানজার বিভাগ- ডাস রাইখ" নিযুক্ত হয় ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে মন্ট্যুবান নগরীর নিকটে এবং "৯ম প্যানজার বিভাগ" নিযুক্ত হয় রোন ব-দ্বীপ এলাকায়।
"জার্মান তিনবাহিনী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ" (OKW, "Oberkommando der Wehrmacht")-এর সংরক্ষণে যুদ্ধবহরের বড় একটি অংশ মজুদ থাকে, তবে এই বহরটি বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে থাকে। "১ম এস.এস. প্যানজার বিভাগ" তখনো নেদারল্যান্ড্সে নিয়োজিত ছিল, "১২শ এস.এস. প্যানজার বিভাগ- হিটলারইউগেন্ড" এবং "প্যানজার-লার বিভাগ" নিযুক্ত ছিল প্যারিস-অর্লিয়েঁ এলাকায়, কেননা নরম্যান্ডির উপকূল অঞ্চলে হামলা হবার সম্ভাবনাই ছিল সবচেয়ে বেশি। "১৭শ এস.এস. প্যানজার-গ্রেনেডিয়ার বিভাগ" ("গোত্জ ফন বের্লিকিঙ্গেন" বিভাগ) অবস্থান নিয়েছিল লোয়ার নদীর দক্ষিণে ট্যুর নগরীর নিকটে।
১৯৪৪ সালের ৬ই জুন মিত্রবাহিনী পরিচালনা করে "অপারেশন ওভারলর্ড" যা "নরমান্ডি অবতরণ", ("Normandy landings") বা "ডি-ডে" ("D-Day") নামেও পরিচিত। যা ফ্রান্সের বহু প্রতিক্ষিত স্বাধীনতার লড়াই। জার্মান বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য পরিচালিত "অপারেশন ফোর্টিটিউড" এবং "অপারেশন বডিগার্ড"-এর ফলে জার্মানদের এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, আক্রমণ হবে ক্যালে বন্দরে (Pas-de-Calais), কিন্তু বাস্তবে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল নরম্যান্ডিতে। ফ্রান্সের ছায়াঘেরা গ্রামাঞ্চলে টানা দুই মাস যুদ্ধ করার পর অবশেষে "অপারেশন কোবরা" সংঘটনের মাধ্যমে মার্কিন সেনারা জার্মানদের পশ্চিমাংশের রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়। এর পরপরই মিত্রবাহিনী ফ্রান্সের ভেতরের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। "ফালেজ পকেট"-এর যুদ্ধে তারা ২ লক্ষ জার্মান সেনাকে ঘেরাও করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে পূর্ব রণাঙ্গনেও জার্মানরা একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকলেও হিটলার কৌশলগত সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানান, যখন তিনি সেনা প্রত্যাহারে রাজি হন ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায়। প্রায় ১,৫০,০০০ জার্মান সেনা "ফালেজ পকেট" থেকে পালিয়ে আসতে পারলেও তারা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সরঞ্জাম পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়, এবং ৫০,০০০ জার্মান সেনা নিহত অথবা যুদ্ধবন্দী হয়।
ডি-ডে তথা নরম্যান্ডি আক্রমণের আগে থেকেই মিত্ররা আলোচনা করে আসছিল তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী হবে তা নিয়ে। বিতর্ক চলছিল- তারা কি সমগ্র উপকূল বরাবর বিস্তৃতভাবে জার্মানদের ধাওয়া করে ফ্রান্সের ভেতরে অগ্রসর হবে ("ব্রড ফ্রন্ট পরিকল্পনা"), নাকি একস্থানে তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে জার্মান কেন্দ্র বার্লিনে সরাসরি হামলা চালাবে ("ন্যারো ফ্রন্ট পরিকল্পনা")।[৩৫] যদি "অপারেশন গুডউড"-এর সময় ব্রিটিশ বাহিনী নরম্যান্ডি সমুদ্রতটের কায়েন এলাকাতে জার্মানদের রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে পারত, তবে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি বিবেচনা করে "ন্যারো ফ্রন্ট পরিকল্পনা"টি বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন, উপকূলের পশ্চিম অংশে "অপারেশন কোবরা" চলাকালীন ব্রিটিশ এবং কানাডিয়ান সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত "২১ তম যুগ্ম বাহিনী" (21st Army Group) আক্রমণ চালাতে চালাতে ক্রমশঃ বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও উত্তর জার্মানির দিকে ধাবিত হয়; অপরদিকে "মার্কিন ১২শ যুগ্ম বাহিনী" (U.S. Twelfth Army Group) পূর্ব ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ এবং রুর অঞ্চল হয়ে ক্রমশঃ দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে সম্পূর্ণ মিত্রবাহিনী বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে, যা "ব্রড-ফ্রন্ট পরিকল্পনার" অংশ ছিল। মার্কিন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার এই পরিকল্পনার পক্ষপাতি ছিলেন, এবং মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণও এই পদ্ধতিকে সমর্থন দেন, তাই মিত্রবাহিনী কর্তৃক তা গৃহীত হয়।
১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনী "অপারেশন ড্রাগুন" পরিচালনা করে- যা ছিল ট্যুলো এবং কান নগরীর মধ্যবর্তী ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল। "মার্কিন ৭ম সেনাবাহিনী" এবং "ফরাসি ১ম সেনাবাহিনী"র সমন্বয়ে গঠিত "মার্কিন ৬ষ্ঠ যুগ্ম বাহিনী" (US 6th Army Group) দ্রুত সমু্দ্রতট দখল করে নেয় এবং ২ সপ্তাহের মধ্যে দক্ষিণ ফ্রান্স স্বাধীন করে; এরপর তারা উত্তরে রোন উপত্যকার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অগ্রসরের মুখে ভৌজ পর্বতমালার নিকটে পুনর্গঠিত হওয়া জার্মান সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হলে এ অগ্রসর বাধাপ্রাপ্ত হয়।
ফ্রান্সে এসময় জার্মান বাহিনী মিত্রশক্তির তিন তিনটি শক্তিশালী বাহিনীর মুখামুখি হয়: উত্তরে ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টগমারির নেতৃত্বে ব্রিটিশ ২১ তম যুগ্ম বাহিনী, কেন্দ্রে জেনারেল ওমার ব্র্যাডলির নেতৃত্বে মার্কিন ১২শ যুগ্ম বাহিনী এবং দক্ষিণে লেফটেনেন্ট জেনারেল জ্যাকব এল. ডেভার্সের নেতৃত্বে মার্কিন ৬ষ্ঠ যুগ্ম বাহিনী। সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে ৬ষ্ঠ যুগ্ম বাহিনী দক্ষিণে অগ্রসর হতে হতে ব্র্যাডলির বাহিনীর সাক্ষাৎ লাভ করে যারা পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিল, ফলে এই দুই দল একত্র হয়ে যায় এবং ডেভার্সের বাহিনীর কর্তৃত্ব ভূমধ্যসাগরীয় মিত্রবাহিনী সদর দপ্তর থেকে স্থানান্তরিত হয়। ফলে তিনটি যুগ্ম বাহিনীর আইজেনহাওয়ারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা "শিখর সদর দপ্তর, মিত্রবাহিনী অভিযাত্রী বাহিনী" (Supreme Headquarters, Allied Expeditionary Forces, SHAEF)-এর নিকট চলে আসে।
ফ্রান্সের উত্তর ও দক্ষিণে একত্রে প্রবল হামলার মুখে জার্মান সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৯ আগস্ট ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনী (FFI) একটি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করে এবং ২৫শে আগস্ট প্যারিস স্বাধীনতা লাভ করে, যখন জার্মান জেনারেল ডিট্রিখ ফন কোলটিট্জ ফরাসিদের চরমপত্র মেনে নিয়ে "২য় ফরাসি ট্যাংক বিভাগ"-এর জেনারেল ফিলিপ লোক্লে ডি হটিক্লকের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, যদিও হিটলারের আদেশ ছিল প্যারিস যেন সবশেষে আত্মসমর্পণ করা হয় এবং তার আদে নগরীটি ধ্বংস করে দেয়া হয়, জেনারেল কোলটিট্জ সে আদেশ পালন করেননি।
এদিকে উত্তর ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড্স এবং লুক্সেমবার্গ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় লন্ডন ও দক্ষিণ ইংল্যান্ডের বাসিন্দারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, কারণ এতে জার্মানদের ভি-১ ও ভি-২ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উৎক্ষেপণ স্থলসমূহ তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, এই ক্ষেপণাস্ত্রসমূহ (Vergeltungswaffen) জার্মানরা ইংল্যান্ডের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার জন্য প্রস্তুত করছিল।
মিত্রবাহিনী ফ্রান্সের যত অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের রসদ সরবরাহ তত কঠিন হতে থাকে। এক পর্যায়ে মিত্রশক্তির ট্রাক বহর "রেড বল এক্সপ্রেস" পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহে ব্যর্থ হয়, কেননা নরম্যান্ডিতে অবস্থিত বন্দরসমূহ থেকে বহুদূরে অবস্থিত সম্মুখ সারিতে প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিত্রদের সম্মুখ রণাঙ্গন জার্মান সীমান্তে গিয়ে পৌঁছে।
নরম্যান্ডির যুদ্ধে অংশ নেয়নি এমন জার্মান সৈন্যদলসমূহ ধীরে ধীরে পিছু হটে আসে, হয় পূর্বদিকে অ্যালসেসের দিকে (কখনো তারা মার্কিন ৬ষ্ঠ যুগ্ম বাহিনীর অগ্রসর পথের নিকটে এসে পড়ে) অথবা বন্দরসমূহের দিকে যাতে বন্দরগুলোর সুবিধা থেকে তারা মিত্রবাহিনীকে বঞ্চিত করতে পারে। এই সৈন্যদলগুলোকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি এবং তাদেরকে পালিয়ে যেতে দেয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র ১৯৪৫ সালের মে মাসে স্বাধীন হওয়া বোর্ডো নগরীতে জেনারেল এডগার্ড ডি লার্মিনাটের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় ("অপারেশন ভেনারেব্ল")।[৩৬]
পশ্চিম রণাঙ্গনের লড়াই এসময়ে অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে পড়ে, এবং ফ্রান্স-জার্মানি "সিগফ্রেড লাইন" (পশ্চিম দেয়াল) এবং রাইনের দক্ষিণ প্রান্তের সম্মুখে এসে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে মার্কিন সৈন্যেরা হুর্টগেনের জঙ্গলে শত্রু রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে অত্যন্ত ধীর ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আরম্ভ করে।
৪ সেপ্টেম্বরে "১১শ ব্রিটিশ ট্যাংক বিভাগ" অ্যান্টোয়ার্প বন্দর স্বাধীন করে। তবে এই বন্দরটি শেল্ট নদীর মোহনার পাশে অবস্থিত ছিল যার অতি নিকটে জার্মান সেনাদের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান ছিল, তাই এই জার্মান ঘাঁটিগুলো ধ্বংস না করে বন্দরটি মিত্রদের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। ফলে মোহনা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণকারী উপদ্বীপটি দখল করার জন্যে আরেকটি দীর্ঘায়িত অভিযান পরিচালনা করতে হয়। অবশেষে নভেম্বরে ওয়ালকেরেন দ্বীপে উভচর হামলা চালানো হয়। শেল্ট নদীর মোহনা দখল করার অভিযান এবং এর পরবর্তী "অপারেশন ফিজ্ন্ট"-এ মিত্ররা চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়। এতে করে অ্যান্টোয়ার্প বন্দরে সরাসরি রসদ সরবরাহের পথ খুলে যায়, যা নরম্যান্ডির তুলনায় যুদ্ধের সম্মূখভাগ থেকে অনেকটাই কাছে ছিল।
অক্টোবর মাসে মার্কিনরা এই সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আকেন শহর দখলের জন্যে সময় ও লোকবল খরচ করার পর তা পুনরায় জার্মানদের দখলে চলে যেতে দিতে পারে না, কারণ এতে "৯ম মার্কিন সেনাবাহিনী"-এর পাশ থেকে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু আকেন ছিল মিত্রদের আক্রমণ করা প্রথম জার্মান নগরী, হিটলার এ নগরীকে রক্ষা করতে তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। তুমুল যুদ্ধের পর অবশেষে আকেন নগরীর পতন ঘটে, এতে উভয় পক্ষেরই প্রায় ৫,০০০ সৈন্য হতাহত হয়, তদুপরি মিত্রবাহিনী আরো ৫,০০০ জার্মান সৈন্যকে আটক করে।
ফ্রান্সের আর্ডেন অঞ্চলের দক্ষিণে মার্কিন সেনারা সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুদ্ধরত থাকে এবং জার্মান বাহিনীকে লরেইন অঞ্চল থেকে সিগফ্রেড লাইনের অপর পাশে বিতাড়িত করে। কিন্তু জার্মানদের শক্তিবৃদ্ধি, রসদ সরবরাহে জটিলতা এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে মার্কিনদের পক্ষে মোসেল নদী পাড়ি দেয়া এবং মেট্জ দুর্গ দখল করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে "৭ম মার্কিন সেনাবাহিনী" ও "১ম ফরাসি সেনাবাহিনী"-এর সমন্বয়ে গঠিত "৬ষ্ঠ মার্কিন যুগ্ম বাহিনী" ভৌজ পর্বতশ্রণীতে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য একটি অভিযান চালায়, যেখানে তারা পদে পদে জার্মানদের তুমুল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং অতি ধীরগতিতে তাদেরকে অগ্রসর হতে হয়। অবশেষে নভেম্বর মাসে আক্রমণের মুখে জার্মানদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে ফলে হঠাৎ করেই মিত্রবাহিনী দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে এবং বেলফোর্ট, মুলহাউজ এবং স্ট্রাসবুর্গ নগরীসমূহ স্বাধীন করতে সক্ষম হয় এবং রাইন নদীর তীরে মিত্রদের বাহিনীসমূহ অবস্থান নেয়। রাইন নদীর পশ্চিম তীরে কোলমার নগরীকে কেন্দ্র করে "কোলমার পকেট" এলাকার সেতুটিতে জার্মানরা একটি কঠিন প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ১৬ নভেম্বরে মিত্রবাহিনী বৃহৎ পরিসরে তাদের শরত্কালীন হামলা অভিযান পরিচালনা করে, যার নামকরণ করা হয়- "অপারেশন কুইন"। এই আক্রমণের মূল কেন্দ্র ছিল হুর্টগেন অরণ্য, এ অভিযানে মিত্ররা রুর নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হলেও তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু অর্জনে ব্যর্থ হয়, তথা রুর নদীর বেড়িবাঁধ দখল করে রাইন নদীর দিকে অগ্রসর হবার রাস্তা উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর জার্মান বাহিনী মিত্রদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়, এর নাম দেয়া হয় "আর্ডেন সংগ্রাম"।
"১১শ ব্রিটিশ ট্যাংক বিভাগ" ৪ই সেপ্টেম্বরে অ্যান্টোয়ার্প বন্দর স্বাধীন করে। ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টগমারি ইঙ্গ-কানাডিয়ান সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত "২১ তম যুগ্ম বাহিনী"র নেতৃত্ব দান করেন, তিনি মিত্রবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (Supreme Headquarters Allied Expeditionary Force)-কে একটি সম্মুখ আক্রমণ পরিচালনা করার জন্যে রাজি করান, যে আক্রমণে মিত্রবাহিনী রাইন নদী অতিক্রম করার সুযোগ পেতে পারে এবং জার্মান বাহিনীর কেন্দ্র বার্লিনে সরাসরি আঘাত করতে পারে, যা ছিল মন্টগমারি কর্তৃক সমর্থিত "ন্যারো-ফ্রন্ট" বা সংকীর্ণ-রণাঙ্গন পরিকল্পনা। উড়োজাহাজে করে সৈন্যদেরকে যুক্তরাজ্য থেকে উড়িয়ে আনা হবে এবং প্যারাস্যুটের সাহায্যে তারা অবতরণ করবে, অতঃপর তারা জার্মান-অধিকৃত নেদারল্যান্ড্সের প্রধান তিনটি নগরী অভিমুখে যাত্রাপথে প্রধান নদীসমূহের সেতুগুলো দখল করে নেবে, নগরী তিনটি হল: এইন্ডহোভেন, নিজমেগেন এবং আর্নহেম। "৩০শ ব্রিটিশ সৈন্যদল" মাস-শেল্ড প্রণালীতে অবস্থানরত জার্মান সারিতে আক্রমণ চালাবে এবং এইন্ডহোভেন নগরীতে "১০১ তম মার্কিন উড্ডীয়মান সৈন্যদল", নিজমেগেন নগরীতে "৮২তম মার্কিন উড্ডীয়মান সৈন্যবিভাগ" এবং আর্নহেম নগরীতে "১ম ব্রিটিশ উড্ডীয়মান সৈন্যবিভাগ" -এর সাথে সংযুক্ত হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সবকিছু সম্পাদিত হলে ৩০ তম সৈন্যদল কোন উল্লেখযোগ্য বাধা ছাড়াই জার্মানির অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে পারবে। ৩০ তম সৈন্যদল উড্ডীয়মান সৈন্যদের দখল করা সাতটি সেতুর ছয়টি অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও আর্নহেম নগরীতে রাইন নদীর উপরোস্থ সেতুতে অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে মিলিত হতে ব্যর্থ হয়। এর ফলশ্রুতিতে আর্নহেমের যুদ্ধে "১ম ব্রিটিশ উড্ডীয়মান সৈন্যদল" প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এ যুদ্ধে প্রায় ৮,০০০ ব্রিটিশ সেনা হতাহত হয়। এই অভিযানের সমাপ্তিতে জার্মানরা আর্নহেম নগরীর কর্তৃত্ব বজায় রাখে এবং মিত্রবাহিনী বেলজিয়াম সীমান্ত থেকে নিজমেজেন ও আর্নহেম নগরী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড দখল করতে সক্ষম হয়।
নরম্যান্ডিতে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের পর থেকেই জার্মানগণ একটি বৃহদাকার পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। এ পরিকল্পনার নাম দেয়া হয় "রাইনের প্রহরা" ("Wacht am Rhein", ইংরেজি:"Watch on the Rhine"), এর উদ্দেশ্য ছিল আর্ডেন নগরী হয়ে অ্যান্টোয়ার্প বন্দর আক্রমণ করা এবং এর দ্বারা ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনাদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা। ১৬ই ডিসেম্বর তারা তাদের এই আক্রমণ পরিচালনা করে যার "বাল্জ এর যুদ্ধের" সূচনা করে। আর্ডেন নগরীর প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ১ম মার্কিন সেনাবাহিনী। প্রতিকূল আবহাওয়ার সুযোগে জার্মান সেনারা মিত্রদের বিমান বাহিনী থেকে সুরক্ষা পায় এবং তারা হামলা চালিয়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মিউস নদীর ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়। প্রাথমিকভাবে হতচকিত মিত্রবাহিনী তাদের সৈন্যদের পুনর্গঠিত করে এবং তাদের স্থল ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে জার্মানদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়, এ আক্রমণের মুখে জার্মান বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ১৯৪৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে তাদের পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায়।
১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি জার্মান বাহিনী অ্যালসেস নগরীতে আরেকটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরের হামলা চালায় ("অপারেশন নর্ডউইন্ড)। স্ট্রাট্সবুর্গ নগরী পুনর্দখলের জন্যে জার্মানরা "৬ষ্ঠ যুগ্ম বাহিনী"কে কয়েকেটি স্থানে আক্রমণ করে। আর্ডেনের সংগ্রামের পর মিত্রবাহিনীর সারিসমূহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ায় জার্মানদের এই হামলা সামাল দেয়া মিত্রদের জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে এবং এই আক্রমণ চার সপ্তাহ ব্যপী চলতে থাকে। অবশেষে মিত্রবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ জার্মান সীমান্তে তাদের অবস্থানকে পুনর্গঠিত করে এবং "কোলমার পকেটে" অবস্থানরত জার্মানদের পরাস্ত করে।
১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে "অপারেশন ব্ল্যাক্কক"-এর সময় হাইন্সবার্গ ও রুরমন্ড নগরীদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে রুর নদীর উপরস্থ সেতুকে ঘিরে সৃষ্ট জার্মান রক্ষাব্যূহ ভেঙে পড়ে। অতঃপর মিত্রশক্তির দু'টি বাহিনী জার্মানদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়- "১ম কানাডিয়ান সেনাবাহিনী" পরিচালিত "অপারেশন ভেরিটেব্ল", যাতে বাহিনীটি নেদারল্যান্ড্সের নিজমেগেন অঞ্চল দিয়ে অগ্রসর হয়, এবং "৯ম মার্কিন সেনাবাহিনী" যারা "অপারেশন গ্রেনেড" পরিচালনা করে রুর নদী পাড়ি দেয়। এই অপারেশন দু'টি একত্রে ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে পরিচালনা করার কথা থাকলেও "অপারেশন গ্রেনেড" জার্মানদের কর্মকান্ডে বিলম্বিত হয়, জার্মান বাহিনী রুর নদীর উজানে অবস্থিত বাঁধ ভেঙে দিয়ে এর চারপাশের উপত্যকা অঞ্চল প্লাবিত করে দেয়। জার্মান ফিল্ড মার্শাল গার্ড ফন রুনস্টেট রাইন নদীর পেছনে সেনা প্রত্যাহার করার জন্যে হিটলারের নিকট অনুমতি চান, তিনি যুক্তি দেন যে এ অবস্থায় শত্রুদের প্রতিরোধ করা অনিবার্য পরাজয়কে বিলম্বিত করা মাত্র, কিন্তু হিটলার তাঁকে তাঁর সৈন্যদের অবস্থান ধরে রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
এক পর্যায়ে এই বন্যার পানি নেমে যায় এবং ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ ৯ম মার্কিন সেনাবাহিনী রুর নদী অতিক্রম করে, মিত্রবাহিনীর অন্যান্য অংশও রাইন নদীর পশ্চিম তীরের কাছাকাছি অবস্থান করছিল। "রাইনল্যান্ডের যুদ্ধে" ফিল্ড মার্শাল ফন রুনস্টেডের নেতৃত্বাধীন জার্মান বাহিনীর যে অংশ রাইনের পশ্চিম তীরে অবস্থান করছিল তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও পরাস্ত হয়। ২,৮০,০০০ জার্মান সেনা মিত্রবাহিনীর হাতে আটক হয়। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে রাইন নদীর পাড়ে মিত্রবাহিনীর অভিযানসমূহে বিশাল সংখ্যায় জার্মান সৈন্য যুদ্ধবন্দী হওয়াতে জার্মানদের প্রতিরোধ ব্যূহ অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়ে। এসমস্ত যুদ্ধে জার্মানদের মোট ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪,০০,০০০ সেনা।[৩৭] মার্চের শেষে মিত্রবাহিনী যখন রাইন নদী পার হচ্ছে তখন তাদের হাতে পশ্চিম ইউরোপে আটক হওয়া প্রায় ১৩,০০,০০০ জার্মান যুদ্ধবন্দী সেনা ছিল।[৩৮]
মিত্রবাহিনীর রাইন নদী পারাপারের পর ব্রিটিশরা উত্তর-পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এল্বে নদী পার করে হামবার্গ নগরীর দিকে এবং তার পরবর্তীতে ডেনমার্ক ও বাল্টিক সাগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ২৬ এপ্রিল এক সপ্তাহ ব্যপী যুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনী ব্রেমেন নগরী দখল করে নেয়।[৪২] ২রা মে ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান প্যারাসুটবাহিত সৈন্যেরা সোভিয়েত বাহিনীর আগেই বাল্টিক উপকূলবর্তী নগরী উইস্মারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। "৯ম মার্কিন সেনাবাহিনি", বাল্জের যুদ্ধের পর যাদের নেতৃত্ব ছিল ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের নিকটে, তারা সাঁড়াশি আক্রমণ সম্পন্ন করতে দক্ষিণে রুর বেষ্টনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তাদের একাংশ পূর্বদিকেও ধাবিত হয়। ৯ম বাহিনীর অন্তর্গত ১৯তম সৈন্যদল ১৮ এপ্রিলে ম্যাজবার্গ শহর দখল করে নেয় এবং উত্তরে ১৩শ সৈন্যদল স্টেন্ডাল শহর দখল করতে সক্ষম হয়।[৪৩]
"১২শ মার্কিন যুগ্ম সৈন্যবাহিনী"ও বিস্তৃত হয়ে পড়ে, ১ম সেনাবাহিনী উত্তর বরাবর অগ্রসর হয়ে রুর রক্ষাব্যূহের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণের দক্ষিণ ভাগ গঠন করে। ৪ এপ্রিল রুর ঘাঁটিকে তারা সম্পূর্ণ ঘেরাও করে ফেলে এবং ৯ম সেনাবাহিনী জেনারেল ব্র্যাডলির "১২শ যুগ্ম বাহিনী"র কর্তৃত্বে ফিরে আসে। ফিল্ড মার্শাল ওয়াল্টার মডেলের নেতৃত্বে রুর ঘাঁটিতে অবস্থানরত জার্মান "যুগ্ম বাহিনী-বি" (Army Group B) ফাঁদে পড়ে যায় এবং তাদের ৩,০০,০০০ সৈন্য মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। মধ্য এপ্রিলে ৯ম এবং ১ম মার্কিন সেনাবাহিনীদ্বয় পূর্বে এল্বে নদী বরাবর অগ্রসর হতে থাকে। পূর্বে অগ্রসর হবার পথে মিত্রসৈন্যেরা ফ্র্যাংকফুর্ট, ক্যাসেল, মাজবার্গ, হ্যাল এবং লিপজিগ শহরে জার্মানদের তুমুল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, ততক্ষনাৎ সৃষ্ট এ জার্মান বাহিনীতে ছিল নিয়মিত সৈন্য, বিমান-বিধ্বংসী যান (Flak), জার্মান জাতীয় বেসরকারি বাহিনী (Volkssturm) এবং অস্ত্রধারী নাৎসি পার্টির সদস্যরা। জেনারেল আইজেনহাওয়ার ও জেনারেল ব্র্যাডলি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এল্বে নদী পার হয়ে পূর্ব জার্মানিতে হামলা চালানোর কোন মানে হয় না, কারণ সোভিয়েত "লাল ফৌজ"-এর হাতে পূর্ব জার্মানির পতন এমনিতেই অবশ্যম্ভাবী। তাই ৯ম ও ১ম সেনাবাহিনী এল্বে ও মুল্ড নদীর তীরে এসে থেমে যায়, পরে এপ্রিলের শেষভাগে সোভিয়েত বাহিনীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। "৩য় মার্কিন সেনাবাহিনী" পূর্বদিকে পশ্চিম-চেকোস্লোভাকিয়াতে, এবং দক্ষিণ-পূর্বদিকে পূর্ব-ব্যাভারিয়া ও উত্তর অস্ট্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ বিজয় দিবসে (Victory in Europe Day, বা V-E Day) ১২শ মার্কিন যুগ্ম বাহিনীটি চারটি বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ছিল (১ম, ৩য়, ৯ম এবং ১৫শ মার্কিন সেনাবাহিনী) যাতে মোট সৈন্য ছিল ১ কোটি ৩০ লক্ষ।[৪৪]
"৬ষ্ঠ মার্কিন যুগ্ম বাহিনী" দক্ষিণ-পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাভারিয়া হয়ে তারা সুইটজারল্যান্ডের পূর্ব সীমান্তে এসে পড়ে এবং অস্ট্রিয়া ও উত্তর ইতালিতে প্রবেশ করে। ব্ল্যাক ফরেস্ট ও ব্যাডেন অঞ্চল ফরাসি ১ম সেনাবাহিনীর দখলে চলে আসে। হেইলব্রনের যুদ্ধ, নুরেমবার্গের যুদ্ধ এবং মিউনিখে জার্মান বাহিনী উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের এই প্রতিরোধ পরাস্ত হয়। মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে "মার্কিন ৩য় পদাতিক ডিভিশন" বার্কটেসগ্যাডেন নগরীতে পদার্পণ করে এবং এর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। এবং "ফরাসি ২য় ট্যাংক ডিভিশন" ১৯৪৫ সালের ৪ই এপ্রিল হিটলারের পার্বত্য বাসস্থান বের্গফ নগরী দখল করে নেয়। ৫ই মে তারিখে জার্মান যুগ্ম বাহিনী-জি (Army Group-G) ব্যাভারিয়ার হার (Haar) নগরীতে মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৪৫ সালের ৪ই মে তারিখে ল্যুনবার্গ হীথে (হ্যামবুর্গ, হ্যানোভার ও ব্রেমেন নগরীত্রয়ের মধ্যবর্তী একটি স্থান) নেদারল্যান্ড্স, উত্তর-পশ্চিম জার্মানি ও ডেনমার্কে অবস্থানরত সকল জার্মান সেনা ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল মন্ট্গমারির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এসব বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গ্র্যান্ড অ্যাডমিরাল কার্ল ডনিট্জ, যিনি ছিলেন জার্মানির নতুন প্রেসিডেন্ট (Reichspräsident), ৩য় রাইখের রাষ্ট্রপ্রধান, এতে করে ইউরোপে আনুষ্ঠানিকভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
৭ই মে ফ্রান্সের রীম্স নগরীতে মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তরে, জেনারেল আইজেনহাওয়ার পশ্চিমা মিত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সকল জার্মান বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন[৪৫] জার্মানদের হয়ে আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করেন জার্মান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আলফ্রেড জোড্ল, তিনি প্রথম সাধারণ আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করেন রাত ২টা বেজে ৪১ মিনিটে। জেনারেল ফ্রাঞ্জ বৌম নরওয়েতে অবস্থানরত জার্মান সেনাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেন। ৮ মে (ইউরোপ বিজয় দিবসে) কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সময়ে রাত ১১টা ১ মিনিটে যুদ্ধের সকল কর্মকান্ডের সমাপ্তি ঘটে। একই দিনে জার্মান ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কাইটেল, জার্মান সামরিক বাহিনী (OKW)-এর প্রধান এবং জোড্লের ঊর্ধ্বতন হিসেবে জার্মানির কার্লসহোর্স্ট নগরীতে সোভিয়েতদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন, আত্মসমর্পণ দলিলে তাঁর সাক্ষর নেন সোভিয়েত মার্শাল গ্রেগরি জুকভ। এই দ্বিতীয় দলিলটি রীম্সে সাক্ষরিত আত্মসমর্পণ দলিলটির অবিকল ছিল, শুধুমাত্র সোভিয়েতদের দুটি অতিরিক্ত শর্ত এতে যুক্ত হয়েছিল।[৪৬]
Quoting Alfred Jodl's "Strategic situation in spring 1944" presentation. The total given for German forces in the west in May 1944, prior to a slight upgrade of forces in the west in preparation for Operation Overlord, was 1,873,000 personnel.