পশ্চিমবঙ্গের শিল্পকলা ভারতের শিল্পকুশলতার এক বড় দৃষ্টান্ত। শৈল্পিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পকলার মধ্যে নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক অভিনবত্ব রয়েছে। সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, মুখোশ, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদির মেলবন্ধনে পশ্চিমবঙ্গের শৈল্পিক ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধশালী।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীতকলা শাস্ত্রীয়, লৌকিক, ধ্রুপদী, ধর্মীয়, ঐতিহ্যবাহী, জাতিগত ইত্যাদি বিভিন্ন রীতি ও ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে বাংলা লৌকিক সঙ্গীতধারা বাংলার তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীতধারাকে এক আলাদা মাধুর্যে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। এছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, শ্যামা সঙ্গীত, বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদী সঙ্গীত, পটুয়া সঙ্গীত, নজরুলগীতি ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীতধারার অনন্য উদাহরণ।
বাউল, হাপু গান, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, ভাওয়াইয়া, জাগের গান, টপ্পা গান, আখড়াই গান, হোলবোল, জাওয়া গান ইত্যাদি গানের ধারা পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।
গৌড়ীয় নৃত্য অথবা গৌড় নাচ হল একধরনের বাঙালি ঐতিহ্যগত শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা।[১][২][৩] এই নৃত্যকলাটি প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী গৌড়ে উৎপন্ন।[৪] বাঙালি নৃত্যশিল্পী মহুয়া মুখোপাধ্যায় এই গৌড়ীয় নৃত্যের পুনঃনির্মাণ করেছেন।[৩][৫]
রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালে তাল মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে শাস্ত্রীয় নৃত্যধারার জন্ম হয় সেটি হল রবীন্দ্র নাট্যনৃত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালে এই নৃত্য পরিবেশিত হয়।
নৃত্যের সঙ্গে গান একাত্মভাবে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সাংস্কৃতিক এবং সৃজনশীল মন তাদের ঐতিহ্যময় সাংস্কৃতিক লোকনৃত্যগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। লৌকিকনৃত্যের যে প্রাচীন আভিজাত্য তা এখনও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের নৃত্যকলায় ফুটে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের লোকনৃত্য খুবই বৈচিত্র্যময়। পশ্চিমবঙ্গের লোকনৃত্যকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের রণনৃত্যগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পৌরাণিক যুদ্ধের দৃশ্যপটকে তুলে ধরে। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহিষাসুর বধ ইত্যাদি ঘটনাকে তুলে ধরে।
ঋতুভিত্তিক নৃত্য সাধারণত কৃষিভিত্তিক হয়ে থাকে। শস্য বপন বা শস্য তোলার সময় পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন লোকউৎসব হয়ে থাকে, যা নৃত্যগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। মালদা জেলার গম্ভীরা নাচ পুরাণভিত্তিক। টুসু নাচ, নবান্ন নাচ ইত্যাদি কৃষিভিত্তিক নাচ। কিছু কিছু আদিবাসী নৃত্য যেমন সাঁওতাল নৃত্য, মুন্ডারী নৃত্য, রাভা নৃত্য ইত্যাদি প্রকৃতি সম্পর্কিত।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ধরনের লোকাচারমূলক নৃত্য পরিবেশিত হয়। এদের মধ্যে বেশ কিছু নৃত্য মুখোশ পরিধান করে প্রদর্শিত হয়।
মুখা খেল পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার একটি বিশেষ প্রসিদ্ধ লোকনৃত্য। এখানকার রাজবংশী সম্প্রদায়ের পুরুষরা অবসর সময়ে মুখোশ বা 'মুখা' পরে সংলাপমূলক গান ও নৃত্যের মাধ্যমে অভিনয় প্রদর্শন করেন।[৬]
মেছেনি খেল বা মেছেনি নাচ হল উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মহিলাদের গ্রামীণ লোকাচারকেন্দ্রিক নৃত্যগীত। মূলত পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় তিস্তাবুড়ির ব্রতপূজা উপলক্ষে এই নাচগান অনুষ্ঠিত হয়।[৬]
গম্ভীরা নৃত্য পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় গম্ভীরা উৎসবে মুখোশ পরে বা মুখোশবিহীনভাবে পরিবেশিত একক বা দলবদ্ধ নৃত্য। এতদাঞ্চলের নিম্নবর্গীয় হিন্দু, কোচ-রাজবংশী, পোলিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নাচের প্রচলন রয়েছে।[৭]
ভাঁজো নাচ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ জেলায় বাঙালি হিন্দু মহিলাদের একটি ব্রতাচারমূলক সারিনৃত্য। ভাদ্র মাসের শুক্লাদ্বাদশীর থেকে পরপর আটদিন ইন্দ্রপূজা ও ভাঁজো পাতাকে কেন্দ্র করে গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।[৮]
কালী নাচ বা কালীর নৃত্য বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী কালীর মুখোশ পরে বা রঙ-কালিতে কালী সেজে প্রদর্শিত নিম্নবর্গীয় হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে প্রচলিত নাচ। পূর্ববঙ্গের কয়েকটি স্থান ব্যতীত পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ইত্যাদি অঞ্চলে এই নাচ প্রচলিত ছিল। বর্তমানে এই সকল অঞ্চলের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় এই নাচের প্রচলন আছে।[৯]
পশ্চিমবঙ্গের লোকনৃত্যের ক্ষেত্রে মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। পুরুলিয়া ছৌ নাচে মুখোশের ব্যবহার হয়। মালদা জেলায় গম্ভীরা উৎসবের গম্ভীরা নৃত্যের সময় গম্ভীরা মুখোশ ব্যবহৃত হয়। পৌরাণিক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে ও লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে মুখোশের ব্যবহার হয়।
পুরুলিয়া ছৌ নাচে মুখোশের ব্যবহার পুরুলিয়া ছৌ কে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্পের অংশ হিসেবে ছৌ মুখোশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরুলিয়ার ছৌ মুখোশ পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় গম্ভীরা উৎসবে মুখোশ পরে একক বা দলবদ্ধ নৃত্য পরিবেশিত হয়। এইসব অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় হিন্দু, কোচ-রাজবংশী, পোলিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নাচের প্রচলন রয়েছে।
গম্ভীরা নৃত্যের মুখোশ বিভিন্ন ধরনের মুখোশ ব্যবহৃত হয়। হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের বাণ, কালী, নরসিংহী, বাশুলী, গৃধিনীবিশাল, চামুণ্ডা, উগ্রচণ্ডা, ঝাঁটাকালী, মহিষমর্দিনী, লক্ষ্মী-সরস্বতী, হিরণ্যকশিপুবধ, তাড়কাবধ, শুম্ভনিশুম্ভ বধ ইত্যাদির মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এই মুখোশের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় নরসিংহী মুখোশ।[১০]
পশ্চিমবঙ্গের পোড়ামাটির মন্দিরের যে দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সেটি বাংলার মন্দির স্থাপত্যের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মন্দিরগুলি চালি ও ছাউনির বিভিন্নতার ও পোড়ামাটির শিল্পকলায় বিশ্বের কাছে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।[১১] বিষ্ণুপুরের জোড় বাংলা, দুই চালা, চার চালা, আট চালা, এক রত্ন, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন মন্দিরগুলোয় বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যান পাওয়া যায়। পোড়ামাটির শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলো এক আলাদা মর্যাদা পেয়ে থাকে। এইসকল মন্দিরের বেশিরভাগ দেওয়ালই পোড়ামাটির শিল্পকলায় সুসজ্জিত।
মন্দির স্থাপত্যে বিভিন্ন চালির ব্যবহারের মাধ্যমে চালিসহ মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়। বিষ্ণুপুরের মন্দির, কালনার মন্দির, পুরুলিয়ার মন্দির ইত্যাদি স্থানের মন্দিরে পোড়ামাটির কারুকার্য বাংলার পোড়ামাটির মন্দির স্থাপত্যে এক বড়ো দৃষ্টান্ত।
পোড়ামাটির পুতুল পশ্চিমবঙ্গের হস্তশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। পোড়ামাটির পুতুল পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। [১২]
বাঁকুড়ার ঘোড়া এক ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া গ্রামে এই বিশেষ শিল্পদ্রব্যটি তৈরি হয়। এগুলি "সুরুচিপূর্ণ ভঙ্গি ও মৌলিক মূল্যবোধের অদ্বিতীয় বিমূর্তনের" জন্য নন্দিত। এগুলি মূলত গ্রাম্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য নির্মিত হলেও, আজকাল সমগ্র বিশ্বেই ভারতীয় লোকশিল্পের প্রতীভক হিসেবে গৃহস্থালীতে শোভা পেয়ে থাকে। অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস সংস্থার লোগোতেও বাঁকুড়ার ঘোড়ার ছবি ব্যবহৃত হয়।[১৩]
বোঙা হাতি বাঁকুড়ার অন্যতম মাটির পুতুলের একটি লৌকিক নিদর্শন। বাঁকুড়া জেলা মূলত সাঁওতাল অধ্যুষিত। সাঁওতাল দেবতা সিং বোঙার উদ্যেশ্যে এই হাতি উৎসর্গ করা হয়।[১৪][১৫]
পটচিত্র পশ্চিমবঙ্গের তথা বাংলার প্রাচীনতম চিত্রকলা। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিলনা তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের বাহক ছিল। পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্র বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। চালচিত্র, কালীঘাট পটচিত্র, পটুয়া সঙ্গীত, দুর্গাপট, লক্ষ্মী সরা প্রভৃতি সবই পটচিত্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যামিনী রায় পটচিত্র ধারার কালীঘাট পটচিত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পটচিত্র পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
হস্তশিল্প পশ্চিমবঙ্গের শিল্পকলার বড়ো আকর্ষণ। বঙ্গ অঞ্চলে হস্তশিল্পের যে লৌকিক এবং সংস্কৃতিক আভিজাত্য লক্ষ্য করা যায় তা পশ্চিমবঙ্গে বিশেষভাবে চোখে পরে।
পশ্চিমবঙ্গের মৃৎশিল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম কৃষ্ণগরের মাটির পুতুল। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান কুটির শিল্প। কৃষ্ণনগরের পুতুল প্রধানত তৈরি হয় কৃষ্ণনগরের পার্শবর্তী অঞ্চল ঘূর্নীতে।[১৬]
কলকাতার কুমারটুলির মৃৎশিল্প তথা প্রতিমা শিল্প বিশ্বমানের খ্যাতি অর্জন করেছে। কলকাতার উত্তরভাগে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ‘পটুয়াপাড়া’ বা মৃৎশিল্পীদের বসতি অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত। কুমারটুলি অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। কলকাতার এই অঞ্চল থেকে দেবদেবীর প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ও ঘরোয়া পূজার জন্যই সরবরাহ করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। ২০০৬ সালে কুমারটুলি থেকে ১২,৩০০টি দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯৩টি রাষ্ট্রে কলকাতার এই পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। এই সংখ্যা বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।[১৭]
|তারিখ=
(সাহায্য)