উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
---|---|
সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া | |
ভাষা | |
আরবী, সিন্ধি, বেলুচি, পশতু, পাঞ্জাবী, উর্দু | |
ধর্ম | |
ইসলাম (সুন্নি, শিয়া) |
পাকিস্তানে আরব জাতি (উর্দু: پاکستان میں عرب) আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষত মিশর, ওমান, ইরাক, কুয়েত, সিরিয়া, লিবিয়া, সৌদি আরব, ফিলিস্তিন, জর্ডান এবং ইয়েমেন থেকে আগতদের নিয়ে গঠিত এবং এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আরব জাতি এবং আধুনিক পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যোগাযোগের সূচনাটি মূলত ৭১১ সালে সিন্ধুতে হয়েছিল। সেসময় কিছু মুসলমান ও তাদের পরিবার একটি বাণিজ্য জাহাজে শ্রীলঙ্কা থেকে ইরাকের বসরায় তাদের বাড়িতে ফেরার সময় রাজা দাহিরের সৈন্যরা তাদের গ্রেপ্তার করে এবং মুক্তি না দেওয়ায় আরব সেনাবাহিনীর জেনারেল মুহাম্মদ বিন কাসিম মুসলমান এবং তাদের পরিবারকে মুক্ত করা জ্ন্য সিন্ধুতে উপনিত হন।[১]
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত একটি বন্দর দিয়ে যাওয়ার সময় জাহাজটিকে লুণ্ঠনকারীরা অপহরণ করে এবং লোকজনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। সে সময় বর্তমান ইরাকের গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। খবরটি শুনার পর তিনি রাজা দাহিরকে চিঠি প্রেরণ করেন এবং বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার দাবি করেন। তৎকালীন সিন্ধুর রাজা ছিলেন রাজা দাহির, দাহির বন্দিদের মুক্ত করতে অস্বীকার করে, ফলে হাজ্জাজ বন্দীদের মুক্ত করার জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ৬,০০০ সৈন্যের একটি সেনাদল নিয়ে সিন্ধুতে যাওয়ার আদেশ দেন। মুহম্মদ বিন কাসিম তখন সতেরো বছরের কম বয়সের এক তরুণ ছিলেন, তবে তিনি ছিলেন কঠিনহৃদয় ও যোগ্য সামরিক সেনাপতি, এবং এই যোগ্যতার কারণেই হাজ্জাজ তাকে নিয়োগ করেছিলেন।
সিন্ধুতে অবতরণের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরের বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং বন্দীদের মুক্ত করেন। তিনি সিন্ধু জয় করেন এবং মুলতান পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলকে মুসলিম ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সময় থেকে পাকিস্তান আরবদের সাথে প্রথম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ তৈরি হয় এবং এই অঞ্চলে আরব সংস্কৃতি, খাদ্য, বিজ্ঞান, কলা এবং ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য প্রবেশ ঘটে। এই সময়কালে এখনকার পাকিস্তানের মধ্যে ইসলামের প্রবর্তন হয় যা সমৃদ্ধ এবং যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে। আজ ইসলাম পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ধর্ম।
কাসিমের মৃত্যুর পরে সিন্ধু অঞ্চল দুই শতাব্দী ধরে অব্যাহত আরব শাসনের অধীনে ছিল।
অনেক পরিসংখ্যান অনুসারে, পাকিস্তানে বৈধ এবং অবৈধ উভয় ধরনের মোট হাজারখানেক আরব বাসিন্দা রয়েছে এবং তারা এদেশে বাস করে।[২]
নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানে ১,৫০০ মিশরীয় বসবাস করতো। মিশরীয় উগ্রপন্থীদের দ্বারা ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানে অবস্থিত মিশরীয় দূতাবাসে হামলার পরে, মিশরীয় সরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুর্নবীকরণ করে এবং এ ধরনের কাজে যুক্ত সন্দেহভাজনদের পাকিস্তান থেকে অপসারণ করতে পাকিস্তান সরকারের সাথে সহযোগিতা করে; ফলস্বরূপ, পাকিস্তানে বসবাসরত অনেক মিশরীয়কে বহিষ্কার করা হয় বা বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখিন হয়। দুইদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে করে পাকিস্তানে গ্রেপ্তারকৃত যে কোন মিশরীয়কে দ্রুততার সাথে কায়রোতে ফিরিয়ে নেওয়া যায়।[৩]
আমিরাতি নাগরিক এবং রাজকীয় পরিবারের সদস্যরা বাজপাখি বিশেষত ম্যাককুেইন’স বুস্টার্ড (বা এশিয়ান হুবার) শিকারের জন্য পাকিস্তান যান। শেখ জায়েদ যখনই পাকিস্তানে শিকার ও বিনোদনের জন্য ভ্রমণ করেন তখন তিনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রহিম ইয়ার খানে তাঁর নিজস্ব গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ এবং একটি বিমানবন্দর তৈরি করেছেন। বাজপাখির সংখ্যা হ্রাস পাওয়া নিয়ে বাস্তুবিদদের প্রতিবাদের মধ্যেও এই ঐতিহ্যটি আবারও অনেক রাজকীয় ব্যক্তির দ্বারা পুনরুত্থিত হয়েছে।[৪] পাকিস্তানে বসবাসকারী একজন উল্লেখযোগ্য আমিরাতি হলেন সুহাইল আল জারুনি, তিনি একজন অর্ধ-পাকিস্তানি।
পাকিস্তানের জর্দানীয়রা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। [৫]
ওমান পাকিস্তানের কাছাকাছি অবস্থানে অবস্থিত। দুই দেশের মধ্যে অভিবাসন সাধারণ বিষয়। বেলুচিস্তান থেকে আসা পাকিস্তানি অভিবাসীরা কয়েক দশক ধরে ওমানে বসতি স্থাপন করেছে এবং ওমানির নাগরিকত্ব অর্জন করেছে। ওমানি সমাজে অন্তর্ভুক্ত এই ওমানি বেলুচিদের অনেকেই বেলুচিস্তানের সাথে অভিবাসন এবং যোগাযোগ বজায় রেখেছে।
১৯৭০ এর দশকে একসময় পাকিস্তানে ফিলিস্তিনি মোট জনসংখ্যা ছিল ৮,০০০ এরও বেশি।[৬] তবে বর্তমানে এই সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে ফিলিস্তিনি বাস করে এবং কিছু সংখ্যক পরিবার এখনও এদেশে রয়ে গেছে। পাকিস্তানে বসবাস করা বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিই সাধারণত চিকিৎসা শাস্ত্র এবং প্রকৌশল শিক্ষার্থী। তারা করাচী, লাহোর, হায়দ্রাবাদ, কোয়েটা এবং মুলতানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানে শিক্ষারত আছে। অন্যদিকে বসবাসকারি পরিবারগুলি মূলত ইসলামাবাদ ও করাচিতে বাস করে।
স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে জর্দানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। পাকিস্তান সরকার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৫০ টি আসন সংরক্ষণ করেছে: ১৩ টি চিকিৎসা বিজ্ঞানে, ৪টি দন্ত্যচিকিৎসায়, ২৩ প্রকৌশল শিক্ষা, এবং ১০ টি ফার্মাসি বিভাগের জন্য। তাছাড়া আটটি বৃত্তিও দেওয়া হয়।
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন সমর্থিত গেরিলাদের পাশাপাশি লড়াই করতে গিয়ে এমন অনেক ফিলিস্তিনি পাকিস্তানে সাহায্য ও আশ্রয় নিয়েছিল। আবদুল্লাহ ইউসুফ আযম পাকিস্তানে থাকা ফিলিস্তিনিদের একজন ছিলেন।
২০০৯ সালের হিসাব মতে পাকিস্তানে ২৫০ থেকে ৩০০ সৌদি নাগরিক ছিল।[৭]
পাকিস্তানে প্রায় ২০০ সিরীয় রয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিরিয়ার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে।[৮] ২০১১ সালের মে মাসে সিরীয় গৃহযুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানে সিরীয় প্রবাসীদের ইসলামাবাদের সিরিয় দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করতে এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ সরকারের নিন্দা করতে দেখা গেছে।[৯]
পাকিস্তানের অনেক মুহাজির সম্প্রদায় যেমন চৌস, নাওয়াথ এবং গুজরাটের আরব জাতি আধুনিক যুগের ইয়েমেনের হাদারামি বংশোদ্ভূত। পাকিস্তানের আরবদের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ ইয়েমেন থেকে আগত। [১০]
পাকিস্তানে পাঞ্জাবে অসংখ্য সাইয়িদ এবং নয়ার রয়েছে। পাকিস্তানে অসংখ্য সাইয়িদ/সৈয়দ/শাহ/শরীফ (আরব) রয়েছে। এর মধ্যে কিছু (আরব) সাইয়িদ প্রথমে গার্দেজ, বুখারা, এবং তিরমিজ এবং তারও পরে দক্ষিণ এশিয়ায় পাড়ি জমায়। অনেকে প্রথম দিকে খাইবার পাখতুনখোয়া, সিন্ধু ও পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করে। ইসলামের শিয়া ও সুন্নি উভয় সম্প্রদাইয়েই অনেক সাইয়িদ রয়েছে। এই অঞ্চলে আগত বিখ্যাত সায়্যিদের মধ্যে আছেন মুলতানের শাহ ইউসুফ গার্দেজ, যিনি প্রায় ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পাঞ্জাবের মুলতানে এসেছিলেন। তাঁর দাদা ছিলেন সৈয়দ আলী কাসওয়ার যিনি ইমাম হোসাইনের নাতি ইমাম জাফর সাদিকের বংশধর ছিলেন, তিনি বাগদাদ থেকে পাড়ি জমান এবং আফগানিস্তানের গার্দেজে বসতি স্থাপন করেন। পাকিস্তানের গার্দেজগণ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের আজাদ তাঁর বংশধর। অন্যান্য সুফিগণের মধ্যে আছেন বুনের-এর সৈয়দ আলী শাহ তিরমিযী (পীর বাবা), নওশেরার সৈয়দ কাস্তির গুল (কাকা সাহেব), জালালউদ্দিন সুর্খ-পশ বুখারী, কাশ্মীরের খানকা আন্দ্রবির শায়খ সৈয়দ মীর মিরাক আন্দ্রবি, দিরের হাজী সৈয়দ আহমেদ শাহ (হাজী বাবা) এবং সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আল-মাক্কী। পাকিস্তানের সাইয়িদ জনগণ এ দেশের সর্বাধিক বিশিষ্ট এবং সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসাবে চিহ্নিত, তাদের বেশিরভাগই জনপ্রিয় ও সুপরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ি হয়ে উঠেছে। তাছাড়া পাকিস্তানে বর্তমানে সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাইয়িদ জনসংখ্যার বসবাস। মাশওয়ানীরাও পাকিস্তানে বসবাস করে।
পাকিস্তানে অসংখ্য সৈয়দ ( মুহাম্মদ সাঃ এর বংশধর) রয়েছেন, যারা আরবি ঐতিহ্য নিয়ে পাকিস্তানিদের আরেকটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। এর মধ্যে কিছু সৈয়দ প্রথমে বুখারা এবং পরে দক্ষিণ এশিয়ায় পাড়ি জমান। অন্যরা আরবীয় উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের জীবন রক্ষার জন্য সিন্ধুতে বসতি স্থাপন করেছিল বলে জানা গেছে। পাকিস্তানের সৈয়দ জনগণ এ দেশের সর্বাধিক বিশিষ্ট এবং সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসাবে চিহ্নিত, তাদের বেশিরভাগই জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ি হয়ে উঠেছে।[১১]
সৈয়দ, শরীফ, আব্বাসি, মাশওয়ানি, আরিন আল রায়ী, আওয়ান, আলভী, আনসারী, ওসমানী, সিদ্দিকী, পোসওয়াল এবং ফারুকী সকলেই আরব বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে।[১২]