পিথিয়াস বা মাসালিয়ার পিথিয়াস (প্রাচীন গ্রিক - Πυθέας; পিথেয়াস; লাতিন - Pytheas Massiliensis; পিথেয়াস মাসালিয়েনসিস; জন্ম - আনুমানিক ৩৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, মৃত্যু - আনুমানিক ৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর একজন গ্রিক ব্যবসায়ী, ভৌগোলিক, সমুদ্র অভিযাত্রী ও প্রাচীন যুগের একজন বড় ভৌগোলিক আবিষ্কারক। সেযুগের এক গ্রিক উপনিবেশ মাসালিয়ায় (আজকের ফ্রান্সের মার্সেই শহর) তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর সমকালীন যুগেই একদিকে আলেকজান্ডার যখন পূর্বদিকে ইউরোপের জানা জগতের পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছিলেন, পিথিয়াস সেই সময় (৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অভিযান চালিয়েছিলেন উত্তরপশ্চিম ইউরোপ অভিমুখে। তাঁর সেই যাত্রার বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করেন একটি গ্রন্থে। গ্রন্থটির নাম ছিল যতদূর সম্ভব মহাসমুদ্র বিষয়ক (Περὶ τοῦ ᾿Ωκεανοῦ Perì toũ Okeanoũ বা পেরি তোউ ওকেয়ানোউ)। প্রাচীন যুগে গ্রন্থটি যথেষ্ট পরিচিত হলেও মূল গ্রন্থটি আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। তবে পরবর্তী বিভিন্ন লেখকের লেখায় (স্ট্রাবো, প্লিনি, এরাতোস্থেনেস, প্রভৃতি]] তার বিভিন্ন অংশের যে উল্লেখ আমরা পাই, তার থেকে আমরা এখনও তার কিছু অংশ সম্পর্কে জানতে পারি।
পিথিয়াসের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আমাদের জানার পরিমাণ খুবই কম। শুধু এটুকু জানা যায় যে, তিনি ফোকাইয়ার (প্রাচীন গ্রিক - Φώκαια) গ্রিকদের উপনিবেশ মাসালিয়ায় (বর্তমান ফ্রান্সের মার্সেই) জন্মগ্রহণ করেন ও ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। এমনকি তিনি উত্তরে একবার না একাধিকবার অভিযান চালিয়েছিলেন - সে সম্বন্ধেও আমাদের কিছু জানা নেই। অভিযান পরবর্তী তাঁর জীবন সম্বন্ধেও আমরা অন্ধকারে। তবে এটুকু পরিষ্কার যে তিনি তাঁর উত্তরের অভিযান ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই সম্পন্ন করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সেইসব প্রথম গ্রিক অভিযাত্রীদের একজন, যাঁরা জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করেন। সেইসময় এই প্রণালী কার্থেজীয়দের প্রভাবযুক্ত অঞ্চল ছিল। কার্থেজীয়রা উত্তর আফ্রিকার উপকূল অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ রক্ষার্থে কাউকে উত্তর থেকে এই প্রণালী অতিক্রম করতে দিত না। এরফলে এই অঞ্চলে টিন'এর খনি থেকে ইউরোপে টিন (ব্রোঞ্জ তৈরির প্রধান উপাদান) রপ্তানীর বাণিজ্যের উপর তাদের পুরো কর্তৃত্ব বজায় ছিল। যতদূর সম্ভব ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোনও এক রাত্রিতে তিনি গোপনে এই প্রণালী অতিক্রম করেন।[১] এছাড়া তাঁর লেখাতেই প্রথম ইবেরীয় উপদ্বীপ হিস্পানিয়া (Hispania) হিসেবে উল্লিখিত হয়। এটি যে আদতে একটি উপদ্বীপ, তাও তিনি উল্লেখ করেন বলে জানা যায়।
পিথিয়াস তাঁর অভিযানে যেসব জায়গায় পা রাখেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গাদেস (কাদিথ, স্পেন) গল (ফ্রান্স), মঁ সাঁ-মিশেল দ্বীপ (টিন ব্যবসার সেযুগের এক অন্যতম কেন্দ্র), বেলেরিয়াম (কর্নওয়াল), ব্রিটানিয়া (গ্রেট ব্রিটেন), ওরকনি দ্বীপপুঞ্জ, শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ এবং বহুদূরের একটি দেশ (উত্তর ব্রিটেন থেকে ৬ দিনের নৌ-দূরত্ব) যাকে তিনি বর্ণনা করেছে থুলে নামে। যতদূর সম্ভব এই দেশটি আজকের আইসল্যান্ড বা নরওয়ে।[২] তবে আইসল্যান্ড হবার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ তিনি এখানে একটি আলো উদ্গীরনকারী ঝর্ণার উল্লেখ করেছেন, যেটি সম্ভবত কোনও আগ্নেয়গিরি। এরপরেও তিনি আরও উত্তর অভিমুখে তাঁর যাত্রা বজায় রাখেন ও শেষপর্যন্ত উত্তর মেরুবৃত্তে উপনীত হন।[২] এরপরে বড় বড় হিমশৈলের কারণে তাঁর পক্ষে আরও উত্তরে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই তাঁর যাত্রা শুরু হলেও সাঁ-মিশেলের পর তিনি যে আরও অগ্রসর হয়েছিলেন, সেখানে কোনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল না। শুধুমাত্র অভিযানের নেশাতেই তিনি এই যাত্রা করেছিলেন। অর্থাৎ, তিনি তাঁর যাত্রাপথে মোট ৭০০০ - ৭৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন; সেই হিসেবে তাঁর অভিযান ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সঙ্গে তুলনীয় ছিল বলা যেতে পারে।
ফেরবার পথে তিনি আজকের ডেনমার্কের উপকূল ধরে অগ্রসর হন, দ্বিতীয়বারের জন্য ব্রিটেনে পদার্পণ করেন ও শেষে সুস্থ শরীরে মাসালিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর এই বাণিজ্যযাত্রায় যে লাভ হয়, তার থেকে ফিরে এসে তিনি যথেষ্ট সচ্ছল জীবনযাপন করতে সক্ষম হন ও তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করায় মনোনিবেশ করেন। এরই ফলশ্রুতি তাঁর বহু উল্লিখিত সেই বই "মহাসমুদ্র বিষয়ক" (Περί τοῦ Ὠκεανοῦ)। গ্রন্থটি প্রাচীন যুগে বহুদিন পর্যন্ত নৌযাত্রার ক্ষেত্রে একধরনের পেরিপ্লাস বা নৌ যাত্রা সংক্রান্ত লগবুক-এর মর্যাদা অর্জন করেছিল। সেই হিসেবে একে আজকের নটিকাল রুটার বা নৌপথের প্রাথমিক ভৌগোলিক তথ্যসংকলন-এর পূর্বসূরী হিসেবে বর্ণনা করা যেতেই পারে।[৩]
পিথিয়াস ছিলেন প্রাচীন যুগের সাপেক্ষে এক যথেষ্ট বিজ্ঞানমনষ্ক নাবিক। তিনি হিসেব কষে উত্তর মেরুর অবস্থান নির্দিষ্ট করেছিলেন (ধ্রুবতারার অবস্থানের সাথে যে তা পুরোপুরি মেলে না তাও উল্লেখ করেছিলেন), তাঁর নিজের শহর মাসালিয়ার অক্ষাংশ প্রায় নির্ভুলভাবে কষে বার করেছিলেন (তাঁর হিসেবে ৪৩°১৭' উত্তরের জায়গায় এসেছিল ৪৩°৩' উত্তর); তাঁর অভিযানে তিনি সূর্যের অবস্থান নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন, তা থেকে পরবর্তী ভূগোলবিদদের পক্ষে সমান্তরাল অক্ষরেখার ধারণা গড়ে তোলার কাজে সুবিধা হয়; মধ্যরাতের সূর্যের প্রথম লিপিবদ্ধ পর্যবেক্ষণও তাঁরই কৃতিত্ব[৪]; মেরুজ্যোতি এবং চাঁদের কলার সাথে যে জোয়ার ভাঁটার যোগ আছে, তাও তাঁর পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।[৫]