পুন্ডলিক | |
---|---|
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | অজ্ঞাত |
মৃত্যু | অজ্ঞাত |
দর্শন | বারকরী |
সম্মান | বিঠোবার কিংবদন্তিগুলির কেন্দ্রীয় চরিত্র |
পুণ্ডলিক (মারাঠি: पुंडलिक) বা পুণ্ডরীক হলেন হিন্দু দেবতা বিঠোবার কিংবদন্তিগুলির এক কেন্দ্রীয় চরিত্র। বিঠোবাকে একজন বৈষ্ণব দেবতা এবং বিষ্ণু বা কৃষ্ণের একটি রূপ মনে করা হয়। মনে করা হয়, পুণ্ডলিকই বিঠোবাকে পণ্ঢরপুরে নিয়ে আসেন। এখানেই বর্তমানে বিঠোবার প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। পুণ্ডলিককে বিঠোবা উপাসনা-কেন্দ্রিক বারকরী সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠাতাও মনে করা হয়।
পুণ্ডলিক ছিলেন প্রাচীনতম কুণ্ডলিনী যোগ অনুশীলনকারী। তিনি কুণ্ডলিনী যোগের একজন গুরুও ছিলেন। এই জন্য তাঁকে ‘কুণ্ডলিক’ নামেও অভিহিত করা হত। বহু বছর পরে কুণ্ডলিক পুন্ডলিক হন। তিনি কুণ্ডলিনী শক্তিকে বিঠোবা বা বিট্ঠলের মূর্তিতে প্রতীকায়িত করেন এবং বিট্ঠল তাঁর নামানুসারে পাণ্ডুরঙ্গ নামে পরিচিত হন। প্রকৃতপক্ষে পণ্ঢরপুরের বিট্ঠল বিষ্ণু বা কৃষ্ণের অবতার নন। তিনি কুণ্ডলিনী শক্তিরই প্রতীক। তবে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই শক্তি সকলের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে।
যে ইঁটটির উপর বিঠোবা দাঁড়িয়ে থাকেন, সেটি হল কুণ্ডলিনীর শক্তির মূল চক্র বা মূলাধার চক্র। ধনুকের মতো বাঁকা দুটি হাত ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ি এবং কেন্দ্রীয় শরীরটি সুষুম্না বা ব্রহ্ম নাড়ির প্রতীক। দেবতার শরীরটি শক্তির প্রতীক এবং মূর্তির উপরস্থ লিঙ্গটি পুরুষ অর্থাৎ শিবের প্রতীক। ধ্যানের মাধ্যমে কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ হলে তা সহস্রার চক্র নামে পরিচিত মস্তকোপরি স্থিত চক্রে পৌঁছায়।
একাধিক রাজা ও অভিজাত পুরুষ ছিলেন পুণ্ডলিকের ভক্ত। তাঁরা পণ্ঢরপুরের বিখ্যাত বিট্ঠল মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। বহু বছর ধরে কুণ্ডলিনী যোগ অনুশীলনের কেন্দ্র এই মন্দিরটি বর্তমানে একটি পবিত্র তীর্থস্থানের মর্যাদা পায়। বহু ভক্ত ভক্তির সহজ পন্থা অবলম্বনে কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করতে এখানে আসেন।
সাধারণভাবে পুণ্ডলিককে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এবং বিঠোবা উপাসনা-কেন্দ্রিক বারকরী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়।[১] রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর পুণ্ডলিইককে বারকরী কাল্টের প্রতিষ্ঠাতা ও মারাঠা দেশে সেই কাল্টের প্রচারক মনে করেন।[২] স্টিভেনসন (১৯৪৩) আরও বলেছেন যে, তিনি সম্ভবত জৈন বা বৌদ্ধ ছিলেন। কারণ, বারকরী সম্প্রদায়ে জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিক আদর্শের একটি মিশ্রণ লক্ষিত হয় এবং বিঠোবাকে বিষ্ণুর বুদ্ধাবতার মনে করা হয়।[৩] ফ্রেজার, এডওয়ার্ডস ও পি. আর. ভাণ্ডারকর (১৯২২) বলেছেন যে পুন্ডলিক শিব ও বিষ্ণুর একীকরণের চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর কাল্টের জন্ম হয়েছিল অধুনা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে।[৪] রাণাডে (১৯৩৩) মনে করেন যে, পুন্ডলিক ছিলেন একজন কন্নড় সন্ত এবং তিনি শুধু বারকরী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, বরং পণ্ঢরপুর মন্দিরের প্রথম প্রধান ভক্ত বা প্রথম প্রধান পুরোহিতও ছিলেন।[৫] উপাধ্যায়ও মনে করেন যে, তিনি উক্ত মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত ছিলেন। তিনি পুন্ডলিকের কন্নড় দেশে জন্মগ্রহণের তত্ত্বটি অস্বীকার করেছেন।[৪] তুলপুলে স্বীকার করেছেন যে, পুন্ডলিক ছিলেন বারকরী সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠাতা। তবে তিনি “সঠিক প্রমাণের অভাবে” পুন্ডলিকের কাল নির্ণয়ে অস্বীকার করেছেন।[৪] এম. এস. মাতের মতে, পুণ্ডলিকই হোয়সল রাজা বিষ্ণুবর্ধনকে প্রভাবিত করে পণ্ঢরপুরের বিষ্ণু মন্দিরটি নির্মাণ করান। সেই কারণে, তাঁকে খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর প্রথম ভাগের ব্যক্তি হিসেবে ধরা যেতে পারে।[৬] ডেলেরি (১৯৬০) মনে করেন, পুণ্ডলিক ছিলেন একজন ধর্মগুরু। তিনি কর্ণাটকের হরিদাস সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, হরিদাস সম্প্রদায় বিঠোবা উপাসনায় প্রভূত পরিবর্তন এনেছিল। পুন্ডলিক শুধুমাত্র বারকরী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাই করেননি, বরং প্রথম বিঠোবাকে বিষ্ণুর সঙ্গে যুক করেছিলেন। পুন্ডলিকের খ্যাতি এততাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, পণ্ঢরপুরের নাম হয়েছিল ‘পুণ্ডরীকক্ষেত্র’।[৬]
রিসিড (১৯৬৫), ধনবলবর (১৯৭২) ও ভডেভিল (১৯৭৪) প্রমুখ গবেষকেরা পুন্ডলিকের ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং তাঁকে পৌরাণিক চরিত্র হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। শ্রীধরের পাণ্ডুরঙ্গ মাহাত্ম্য গ্রন্থটি আলোচনা করতে গিয়ে (এই নিবন্ধের ‘কিংবদন্তি’ অংশ দ্রষ্টব্য), রিসিড বলেছেন যে, পুণ্ডলিকের কিংবদন্তিটি পৌরাণিক কিংবদন্তির সূত্রেই প্রচলিত হয়।[৭] ধনপলবর এই সম্ভাবনার বিষয়ে দৃঢ় সম্মতি জানান।[৮] ভডেভিল পণ্ঢরপুরের পুণ্ডলিকের কিংবদন্তিটির সঙ্গে হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের বিষ্ণুভক্ত পুণ্ডরীকের কিংবদন্তির নিকট সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।[৯] ধর্মীয় ইতিহাসবিদ তথা শ্রীবিট্ঠল: এক মহাসমন্বয় গ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী আর. সি. ধেরে বলেছেন, বিঠোবে বিষ্ণু হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে শৈব পুণ্ডরীক মন্দিরটি ভক্ত পুন্ডলিকের বৈষ্ণব মন্দিরে পরিণত হয়। এই তত্ত্বের প্রধান যুক্তিটি হল পুন্ডলিকের স্মারক মন্দিরটি বৈষ্ণব মন্দির নয়, বরং একটি শৈব মন্দির। কারণ, সেখানে শিবের প্রতীক একটি শিবলিঙ্গ আছে।[১০]
যে ধর্মগ্রন্থগুলিতে পুন্ডলিক ও বিঠোবার কিংবদন্তিটি পাওয়া যায়, সেটিকে বারকরী প্রথা, ব্রাহ্মণ প্রথা এবং রিসিডের ভাষায় একটি ‘তৃতীয় প্রথা’র অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তৃতীয় প্রথায় বারকরী ও ব্রাহ্মণ উভয় প্রথারই উপাদান বিদ্যমান। বারকরী ধর্মগ্রন্থগুলি মারাঠি ভাষায় রচিত, ব্রাহ্মণ ধর্মগ্রন্থগুলি সংস্কৃতে এবং ‘তৃতীয় ধারা’র ধর্মগ্রন্থগুলি ব্রাহ্মণেরা মারাঠি ভাষায় রচনা করেছিলেন।
বারকরী রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহীপতিরভক্তলীলামৃত ও ভক্তবিজয়, বহিনাবাইয়েরপুণ্ডলিক-মাহাত্ম্য এবং নামদেব রচিত একটি দীর্ঘ ‘অভঙ্গ’। এই সকল রচনায় পুণ্ডলিকের কিংবদন্তিটি বর্ণিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্কন্দপুরাণ থেকে গৃহীত পাণ্ডুরঙ্গ-মাহাত্ম্য (৯০০টি শ্লোকে), পদ্মপুরাণ থেকে গৃহীত পাণ্ডুরঙ্গ-মাহাত্ম্য (১,২০০টি শ্লোকে), পদ্মপুরাণ থেকে গৃহীত ভীমা-মাহাত্ম্য এবং বিষ্ণুপুরাণ থেকে গৃহীত পাণ্ডুরঙ্গ-মাহাত্ম্য।[১১][১২][১৩] ‘তৃতীয় ধারা’য় দুটি রচনা পাওয়া যায়। এদুটি হল ব্রাহ্মণ শ্রীধর রচিত পাণ্ডুরঙ্গ-মাহাত্ম্য (৭৫০টি শ্লোকে) এবং প্রহ্লাদ মহারাজ রচিত পাণ্ডুরঙ্গ-মাহাত্ম্য (১৮১টি শ্লোকে)।[১৪][১৫]
পুণ্ডলিক কিংবদন্তির তিনটি পাঠ পাওয়া যায়। দুটি কিংবদন্তি স্কন্দপুরাণের পুথিগত পাঠান্তরের সঙ্গে যুক্ত (১। ৩৪-৬৭)। প্রথম কিংবদন্তি অনুসারে, সন্ন্যাসী পুণ্ডরীক (পুন্ডলিক) হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর ভক্ত এবং তিনি নিজের পিতামাতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিষ্ণুর এক রূপ গোপাল-কৃষ্ণ রাখাল বালকের বেশে তাঁর পোষ্য গোরুর পালের সঙ্গে গোবর্ধন পর্বত থেকে পুণ্ডরীকের সঙ্গে দেখা করতে নেমে আসেন। কৃষ্ণ ছিলেন দিগম্বর বা নগ্ন। তাঁকে কানে ছিল ‘মকরকুণ্ডল’ এবং বুকে ছিল ‘শ্রীবৎস’ চিহ্ন (উপরে আলোচিত)[১৬] তাঁর মাথায় ছিল ময়ূরপুচ্ছের উষ্ণীষ। তিনি কোমরে হাত দিয়ে তাঁর গোরু চরানোর দণ্ডটি দুটি উরুর ফাঁকে রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুণ্ডরীক কৃষ্ণকে সেই রূপেই ভীমা নদীর তীরে অবস্থান করতে বলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কৃষ্ণের উপস্থিত সেই স্থানটিকে একটি ‘তীর্থ’ ও ‘’ক্ষেত্রে’ পরিণত করবে।[১৭] এই স্থানটিকে অধুনা পণ্ঢরপুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পণ্ঢরপুর ভীমা নদীর তীরে অবস্থিত। কৃষ্ণের বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলি পণ্ঢরপুরের বিঠোবার অনুরূপ।[১৮]
দ্বিতীয় কিংবদন্তি অনুসারে, কৃষ্ণ পুন্ডলিকের সামনে পঞ্চবর্ষীয় গোপালের বেশে উপস্থিত হন। এই কিংবদন্তিটি উভয় পুরাণের পাণ্ডুলিপিতে, প্রহ্লাদ মহারা, ও সন্তকবিদের (বিশেষত তুকারামের) রচনায় পাওয়া যায়।[১৯] পুন্ডলিকের তৃতীয় কিংবদন্তিটি শ্রীধরের রচনায় এবং পদ্মপুরাণের একটি পাঠান্তরে পাওয়া যায়। পুন্ডলিক ছিলেন এক ব্রাহ্মণ। তিনি তাঁর স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালবাসা এতটাই বেশি ছিল যে, তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতামাতাকে উপেক্ষা করতেন। পরবর্তীকালে কুক্কুট ঋষির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। পুন্ডলিকের জীবনে পরিবর্তন আসে। তিনি নিজের পিতামাতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। এদিকে কৃষ্ণের গোপী প্রেমিকা রাধা কৃষ্ণের রাজ্য দ্বারকায় আসেন এবং কৃষ্ণের কোলে বসেন। রাধা কৃষ্ণের প্রধানা মহিষী রুক্মিণীকে সম্মান প্রদর্শন করেন না। কৃষ্ণও রাধার আচরণে দোষাবহ কিছু দেখেন না। বিরক্ত হয়ে রুক্মিণী কৃষ্ণকে পরিত্যাগ করে পণ্ঢরপুরের কাছে দণ্ডীবনে চলে আসেন। রুক্মিণীর বিরহে দুঃখিত কৃষ্ণ তাঁর মহিষীকে খুঁজতে খুঁজতে শেষে তাঁকে দণ্ডীবনে পুন্ডলিকের বাড়ির কাছে খুঁজে পান। কিছু মিষ্ট বাক্যালাপের পর রুক্মিণী শান্ত হন। এরপর কৃষ্ণ পুন্ডলিকের কাছে আসেন। তিনি দেখেন পুন্ডলিক নিজের পিতামাতার সেবা করছেন। কৃষ্ণ বিশ্রাম করবেন বলে পুন্ডলিক একটি ইঁট বাইরে ছুঁড়ে দেন। কৃষ্ণ ইঁটটির উপর দাঁড়িয়ে পুন্ডলিকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। পিতামাতার সেবা শেষ করে পুন্ডলিক কৃষ্ণকে অনুরোধ করেন বিঠোবার মূর্তিতে সেই ইঁটের উপরেই অবস্থান করতে এবং রুক্মিণীকে অনুরোধ করেন রাখুমাইয়ের মূর্তিতে তাঁর পাশে অবস্থান করতে এবং চিরকাল ভক্তদের আশীর্বাদ করতে।[২][১৫][১৭][২০]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; MW1100
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Pande 2008 p. 508
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি