পুরাপ্রস্তর যুগের ধর্ম বলতে বিশ্বাস করা হয় পুরাপ্রস্তর সময়কালে আবির্ভূত হওয়া আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের সমাহারকে। অনুমান করা হয়, আজ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগে ধর্মীয় আচরণের উদ্ভব হয়েছে।[১] তবে সমাধি দেওয়ার প্রথা আজ থেকে ৩ লক্ষ বছর আগে মধ্য পুরাপ্রস্তর যুগে শুরু হয়েছিল। অনেকে একে ধর্মীয় আচরণ বলে আখ্যায়িত করে। এ আচরণের সুত্রপাত হয়েছিল হোমো নিয়ান্ডারথাল এবং সম্ভবত হোমো নালেদিদের আগমনের মাধ্যমে। এটা অনুমান করা হয় যে, প্রথা, আধ্যাত্মবাদ, পৌরাণিক গল্প এবং জাদুচিন্তা অথবা সর্বপ্রাণবাদের (এই ভাবনায় ভাবা হয়, প্রতিটা বস্তুতে আত্মা অবস্থান করছে) সমন্বয়ে ধর্ম গঠিত। ব্যবহারিক আধুনিকতার দিক থেকে মধ্যযুগীয় পুরাপ্রস্তরের ধর্মের সাথে উচ্চ পুরাপ্রস্তরীয় ধর্মের পার্থক্য আছে।
এটাও প্রস্তাবনা করা হয়েছে নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগে (সুনির্দিষ্টভাবে প্রাক হোমো স্যাপিয়েন্সের ৩ লক্ষ বছর পূর্বে) ধর্মীয় অথবা আধ্যাত্মিকতার ঘটনা সেসময়কার বনমানুষ বিশ্বাস করত। তবে এই প্রস্তাব বিতর্কিত এবং একাডেমিক মহলে কম সমর্থিত।[২]
মধ্য পুরাপ্রস্তর যুগের সময়সীমা আজ থেকে ৩ লক্ষ বছর থেকে ৫০ হাজার বছর পর্যন্ত। কিছু প্রমাণ থেকে এটা অনুমেয় হয় যে, ৩ লক্ষ বছর পূর্ব থেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে কবরের সাথে দ্রব্যাদি দিয়ে কবর দেওয়ার প্রথা পালন করা হত। একে ধর্মীয় প্রথা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ফিলিপ লিবারম্যান প্রস্তাবনায় বলেন, "তারা জীবিত অবস্থায়ও মৃতের প্রতি উদ্বিগ্ন হত।"[৩]
যদিও এই বিষয়টি বিতর্কিত তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নিয়ান্ডারথালরাই প্রথম মানব যারা ইচ্ছাকৃতভাবে মৃতদেহকে কবর দিতেন। পাথর এর যন্ত্রাংশ এবং প্রাণীর হাড় সেই কবরে দেওয়া হত।[৪] এরকম উল্লেখযোগ্য কিছু স্থান হলো ইরাকের শানিদার, ইসরায়েলের কেবারা গুহা এবং ক্রোয়েশিয়ার ক্রাপিনা। অবশ্য কিছু পণ্ডিত যুক্ত দেন যে, এই দেহগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ কারণে সমাধিস্থ করা হয়েছে।[৫] ফ্রান্সের কমবে-গ্রিনাল ও আব্রি মৌলাতে নিয়ান্ডারথালদের হাড়ের চিহ্ন দেখে এটা মনে হয়, নিয়ান্ডারথালরাই এক্সকারণ্যাশনের (হাড় এবং মাংস আলাদা করে, হাড় কবর দেওয়ার প্রথা) চর্চা করত।
অনেক পুরাতত্ত্ববিদ মনে করেন, নিয়ান্ডারথালদের মতই মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগের সমাজে, কবর দেওয়ার পাশাপাশি টোটেমবাদ অথবা প্রাণীর পূজা করা হত। এমিল বাচেলর মধ্য-পুরাপ্রস্তরযুগের একটি গুহার সাক্ষ্যর বহন করা চিহ্ন দেখে প্রস্তাব করেন, নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে ভল্লুক পূজার সংস্কৃতি চালু ছিল।[৬] উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগে, ভল্লুকের মত প্রাণীর পূজা করার যে রীতি প্রচলিত ছিল; অনুমান করা হয় এই রীতির আগমন ঘটেছে মধ্যপুরাপ্রস্তরযুগ থেকেই।[৭] উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগে যে প্রাণীর পূজা করা হত, এর সাথে শিকারের সংযোগ আছে।[৭] বিভিন্ন শিল্প ও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এটা অনুমেয় হয় যে, ভল্লুকের পূজা করার জন্য একটি ভালুককে তীর দ্বারা শিকার করা হত, এরপর তার ফুসফুসে আবার তীর মেরে তাকে হত্যা করে বলি দেওয়া হত এবং প্রথাগত ভাবে ভালুকের মুর্তি (যা কাদা দ্বারা আবৃত থাকত) বা শিলালিপির কাছাকাছি পশম দ্বারা আবৃত করে তার কঙ্কালকে কবর দেওয়া হত এবং ভালুকের মাংসকে আলাদাভাবে অন্যস্থানে কবর দেওয়া হত।[৭]
মানুষকে কবর দেওয়ার যে নিশ্চিত চিহ্ন পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন চিহ্ন টা হলো ১ লক্ষ বছর আগের। Human skeletal remains stained with red ochre were discovered in the Skhul cave and Qafzeh, Israel. সেই কবরগুলোতে বিভিন্ন দ্রব্যাদিও পাওয়া গিয়েছে, একটি কবরে পাওয়া গিয়েছে কঙ্কালের বাহুতে বন্য শুকরের চোয়াল।[৮] সেসময়তেই ব্যবহারিক আধুনিক মানুষের আবাস ছিল পূর্বের কাছাকাছি এলাকায়; তারা এই কবর দেওয়ার প্রথার চর্চা করত।[৮] Middle stone age sites in Africa dating to around the same time-frame also show an increased use of red ochre, a pigment thought to have symbolic value.[৯][১০][১১]
ধর্মীয় আচরণ হলো ব্যবহারিক আধুনিকতার একটি নিদর্শন। অনুমান করা হয় ধর্মীয় আচরণের উত্থান ঘটেছিল পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। যখন সমাজ মধ্য প্রস্তর যুগীয় সমাজ থেকে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের সমাজে পদার্পণ করেছে। খুব সম্ভবত প্রথম দিকের উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগের সাধারণ মানুষরা সমান ভাবে এবং সম্পুর্ণভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। কিন্তু পরবর্তীকালে ধর্মীয় সম্প্রদায় যেমনঃ শামান, পুরোহিতরা এককভাবে ধর্মের দায়িত্ব কাধে তুলে নেন।[১২]
কবরের সাথে দ্রব্যাদি এবং গুহাচিত্রে নরাত্বরোপ (মানুষের সাথে অন্য প্রানীর সংযোজন) ছবি দেখে এটা প্রতীয়মান হয় যে, উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষ অপ্রাকৃতিক বিষয়ে বিশ্বাস করা শুরু করেছিল।[১৩] চাউভেট গুহাচিত্র ৩২ হাজার বছর আগের এবং লাস্কাস গুহাচিত্র সতেরো হাজার বছর আগের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। লাস্কাসের নরাত্বরোপ গুহাচিত্রে অদ্ভুৎ ধরনের জন্তু দেখা যায়। সেগুলোর মধ্যে আছে অর্ধেক মানুষ ও বাকি অর্ধেক পাখি এবং অর্ধ মানব ও বাকি অর্ধ সিংহের সমন্বয়ে গঠিত জীবের চিত্রায়ন। কেউ কেউ এ ধরনের চিত্রায়ন দেখে এমটা প্রস্তাবনা করেছে যে, এই সমস্ত চিত্রায়ন সামানিজম বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। এ ধরনের বিশ্বাস হল এমন এক ধরনের বিশ্বাস যেখানে মনে করা হয় যারা এই বিশ্বাসের চর্চা করে তারা প্রাকৃতিক শক্তি এবং প্রাকৃতিক বিষয়ের (যেমনঃ আত্মা) মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে পারে।[১৪]
ভিঞ্চেন্ট ডব্লিও এফ ফ্যালিও তার লেখনীতে বলেছেন, মৃত পূর্বপুরুষকে পূজা করার সংস্কৃতির প্রথম উদ্ভব হয়েছে জটিল উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের সমাজে। ফ্যালিও যুক্তি দেখান, জটিল উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের অভিজাত সম্প্রদায়; বিশেষ প্রথা এবং পূর্বপুরুষকে পূজা করার রীতি পালনের জুজু দেখিয়ে সে সমাজকে তাদের অধীনস্থ করে রাখত।[১৫] গুপ্ত সমাজ সম্ভবত একই ধরনের কাজ করত, তারা সমাজের সাধারণ মানুষ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে থিওক্রেটিক সমাজ গঠন করে। এসমাজে এই বিশ্বাস স্থাপন করা হত যে, ঈশ্বরই বিশেষ ব্যক্তিকে পরিচালনা করছেন।[১৫]
ধর্ম অনেকসময় সমবেদনামুলক জাদু হিসেবে এপোট্রোপাইজম (এপোট্রোপাইজম হলো, এমন এক অলীকতার ন্যায় চর্চা যা দ্বারা শয়তানের অশুভ শক্তি থেকে বাচার চেষ্টা করা হয়) এর ন্যায় কাজ করত।[১৬] উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগের সময়ের সংরক্ষিত ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, সে সময় ভেনাস প্রতিমূর্তি প্রচুর পরিমাণে ছিলো। এটি উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের সমবেদনা মূলক জাদুর উদাহরণ। মানুষ এই ধর্ম চর্চা শিকার করার সময় সফলতার জন্য ব্যবহার করত। নারীর জন্য এবং মাঠের উর্বরতার জন্য তারা এই ধর্ম চর্চা করত।[১৭] গবেষকরা উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের ভেনাস প্রতিমূর্তি কে পৃথিবীর দেবী হিসেবে বিবেচনা করত এই দেবী অনেকটা পৌরাণিক গয়া দেবীর মত ছিল তারা এই দেবীকে পশুর মাতা অথবা তার শাসনকর্তা হিসেবে বিবেচনা করত।[৭][১৮] জেমস হ্যারোট একে নারী ও পুরুষের শ্যামনাসীয় আধ্যাত্মিক পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[১৯]