পুষ্কর হ্রদ | |
---|---|
অবস্থান | পুষ্কর, রাজস্থান |
স্থানাঙ্ক | ২৬°২৯′১৪″ উত্তর ৭৪°৩৩′১৫″ পূর্ব / ২৬.৪৮৭২২° উত্তর ৭৪.৫৫৪১৭° পূর্ব |
হ্রদের ধরন | কৃত্রিম হ্রদ |
প্রাথমিক অন্তর্প্রবাহ | লুনি নদী |
প্রাথমিক বহিঃপ্রবাহ | লুনি নদী |
অববাহিকা | ২২ কিমি২ (৮.৫ মা২) |
অববাহিকার দেশসমূহ | ভারত |
পৃষ্ঠতল অঞ্চল | ২২ কিমি২ (৮.৫ মা২) |
গড় গভীরতা | ৮ মি (২৬ ফু) |
সর্বাধিক গভীরতা | ১০ মি (৩৩ ফু) |
পানির আয়তন | ৭,৯০,০০০ ঘনমিটার (২,৮০,০০,০০০ ঘনফুট) |
পৃষ্ঠতলীয় উচ্চতা | ৫৩০ মি (১,৭৪০ ফু) |
জনবসতি | পুষ্কর |
পুষ্কর হ্রদ বা পুষ্কর সরোবর পশ্চিম ভারতের রাজস্থান রাজ্যের অজমের জেলার পুষ্কর শহরে অবস্থিত। এটি হিন্দুদের কাছে পবিত্র একটি হ্রদ। হিন্দুশাস্ত্রে এটিকে ‘তীর্থগুরু’ বা সকল তীর্থের মূর্তিরূপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, এই তীর্থটি সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার ক্ষেত্র। ব্রহ্মার প্রধান মন্দিরটি পুষ্করেই অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মুদ্রাতেও পুষ্কর হ্রদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
সমগ্র পুষ্কর হ্রদটিকে ঘিরে বাহান্নটি স্নানের ঘাট রয়েছে। এখানে তীর্থযাত্রীরা দলে দলে পুণ্যস্নান করতে আসেন। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পুষ্করের মেলা উপলক্ষ্যে বিশেষ জনসমাগম ঘটে। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, এই হ্রদে স্নান করলে পাপ নাশ হয় ও চর্মরোগ দূর হয়। হ্রদ-সন্নিহিত অঞ্চলে পাঁচশোটিরও বেশি হিন্দু মন্দির অবস্থিত।
বর্তমানকালে হ্রদের চারিদিকে পর্যটন কেন্দ্রের বিকাশ ও অরণ্যনিধনের ফলে হ্রদের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এর ফলে হ্রদের জল দূষিত হচ্ছে, জলস্তর নেমে যাচ্ছে এবং মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হ্রদটি সংরক্ষণ করতে বর্তমানে সরকার পলি পরিষ্কার, কচুরিপানা পরিষ্কার, জল সংশোধন, বনসৃজন এবং সেই সঙ্গে গণসচেতনতা বৃদ্ধিরও প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
ভারতের রাজস্থান রাজ্যের অজমের জেলায় অরাবলী পর্বতমালার মাঝে পুষ্কর হ্রদ অবস্থিত। এই হ্রদটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পুষ্কর শহরটি। নাগপর্বত নামে একটি পর্বতমালা হ্রদের থেকে অজমের শহরটিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। যে উপত্যকায় এই হ্রদটি অবস্থিত সেটি গঠিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমে ও উত্তর-পূর্বে প্রসারিত অরাবলীর দু’টি সমান্তরাল পর্বতমালার (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৬৫০–৮৫৬ মিটার (২,১৩৩–২,৮০৮ ফু)) মধ্যবর্তী স্থানে। অজমেরের ১৪ কিলোমিটার (৮.৭ মা) উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পুষ্কর হ্রদটি হল বাঁধ-নির্মাণের ফলে সৃষ্ট একটি কৃত্রিম হ্রদ, যেটিকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে মরুভূমি ও পাহাড়।[১][২] "ভারতে হ্রদগুলোর শ্রেণিবিন্যাসের" তালিকায় পুষ্কর হ্রদ "পবিত্র হ্রদ" হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে।[২][৩]
হ্রদের আহরণ ক্ষেত্রের মাটি ও ভূপ্রকৃতি প্রধানত বালুকাময়। এই মাটির জল ধারণ ক্ষমতা খুবই কম।[২] পুষ্কর উপত্যকায় হ্রদ-সংলগ্ন জমির ব্যবহারের ধরন নিম্নরূপ: ৩০ শতাংশ এলাকা রয়েছে স্থানবদলকারী বালিয়াড়ির তলায়, ৩০ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে পাহাড় (পতিত ও অনাবাদি জমি) ও নদী এবং ৪০ শতাংশ এলাকা কৃষিজমি।[৪]
এই অঞ্চলের জলবায়ু প্রায় শুষ্ক প্রকৃতির। এখানে গ্রীষ্মকাল অতিমাত্রায় উষ্ণ এবং শীতকাল বেশ ঠাণ্ডা। গ্রীষ্মের মাসগুলোর মধ্যে মে থেকে জুন মাসের মধ্যে উষ্ণতা সর্বাধিক থাকে, এই সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৪৫ °সে (১১৩ °ফা)। আবার শীতকালে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ২৫–১০ °সে (৭৭–৫০ °ফা)।[২] প্রধানত জুলাই ও আগস্ট মাসে স্বল্প বৃষ্টিপাত হয়। নথিবদ্ধ গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০০–৬০০ মিলিমিটার (১৬–২৪ ইঞ্চি)। কখনও কখনও শীতকালে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেও অল্প বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।[২]
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে বয়ে যাওয়া জোরালো বায়ুপ্রবাহের ফলে বালিয়াড়িগুলো গঠিত হয়।[২]
পুষ্কর হ্রদের আহরণ এলাকার মধ্যে অরাবলী পর্বতের ২২ বর্গকিলোমিটার (৮.৫ মা২) এলাকা পড়ে। হ্রদের জলতলের আয়তন ২২ হেক্টর (৫৪ একর)। এটি একটি বারোমেসে হ্রদ, যার জলের উৎস আহরণ এলাকা থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জল। ঋতুভেদে হ্রদে জলের গভীরতার পার্থক্য থেকে ৮–১০ মিটার (২৬–৩৩ ফু) পর্যন্ত। হ্রদের জল ধারণ ক্ষমতা ০.৭৯ মিলিয়ন কিউবিক মিটার (১.০৩ মিলিয়ন কিউবিক ইয়ার্ড)। যেহেতু হ্রদটির চারপাশ বিভিন্ন আকারের বাহান্নটি ঘাট দিয়ে ঘেরা রয়েছে, সেই কারণে আহরণ এলাকা থেকে হ্রদে জল প্রবাহিত হয় পথচারীদের জন্য নির্মিত ১১০ মিটার (৩৬০ ফু) দীর্ঘ একটি সেতুর নিচে খিলানের একটি সারির মধ্যে দিয়ে। এটি হ্রদের দক্ষিণ সীমায় অবস্থিত। সেতুটির জন্য তীর্থযাত্রীদের ২ হেক্টর (৪.৯ একর) এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বাহান্নটি ঘাটে তীর্থ পরিক্রমায় বিশেষ সুবিধা হয়।[৫]
পূর্ণ অবস্থায় পুষ্কর হ্রদ মাছ ও অন্যান্য জলচর জীবে ভরা থাকে। হ্রদের গভীরতা অনেকটাই কমে গিয়েছে: সর্বাধিক ৯ মিটার (৩০ ফু) থেকে ১.৫ মিটার (৪.৯ ফু)-এরও কম। এর ফলে ৫–২০ কিলোগ্রাম (১১–৪৪ পা) ওজনের বড়ো মাছ প্রচুর মারা পড়ে। তাতে জল বিষাক্ত হয়ে যায় ও অন্যান্য মাছের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনে টান পড়ে। যে অঞ্চলে এই হ্রদ ও উপত্যকাটি অবস্থিত সেটি শুষ্ক হওয়ায়, এখানকার গাছপালা এবং পশু-পাখির মধ্যে ক্যাকটাস ও কাঁটাঝোপের মতো মরু উদ্ভিদ এবং উট ও গবাদিপশুর মতো মরুজীবই বেশি দেখা যায়।[৬][৭] অতীতে নরখাদক কুমির পুষ্কর হ্রদের একটি বড়ো সমস্যা ছিল। এর ফলে প্রচুর জীবনহানি ঘটত। তীর্থযাত্রীরা সেই ব্যাপারে সচেতন হলেও সেকালে কুমিরের খাদ্যে পরিণত হওয়াকে পুণ্যদায়ী মনে করা হতো।[৮] ব্রিটিশ আমলে কুমিরগুলোকে ধরে নিকটবর্তী জলাধারে স্থানান্তরিত করা হয়।[৯]
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর গ্রিক ও কুষাণ মুদ্রায় পুষ্কর হ্রদের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সাঁচিতে উৎকীর্ণ একটি অভিলেখেও পুষ্কর হ্রদের উল্লেখ আছে। এর থেকে অনুমান করা হয়, বাণিজ্যপথের ধারে অবস্থিত না হলেও সেই যুগেও পুষ্কর একটি তীর্থস্থানের মর্যাদা পেত।[১০]
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে ফা হিয়েন পুষ্কর হ্রদে আগত বহুসংখ্যক দর্শনার্থীর কথা উল্লেখ করেছেন।[১১]
খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে মান্দোরের রাজপুত রাজা নহর রাও পরিহারের একটি উপাখ্যানে পুষ্কর হ্রদের জলের আরোগ্যদায়ী গুণের কথা উল্লিখিত হয়েছে। একবার রাজা এই হ্রদের ধারে বন্য শূকর শিকার করতে এসে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। সেই কারণে হ্রদের জলে হাত দিতেই তিনি অবাক হয়ে দেখেন যে তার হাতের ধবলকুষ্ঠ রোগের চিহ্নগুলো লুপ্ত হয়েছে। হ্রদের এই পবিত্র আরোগ্যদায়ী শক্তি দেখে খুশি হয়ে রাজা হ্রদটিকে পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই থেকে সাধারণ পূণ্যার্থীরাও এই হ্রদের তীরে আসতে শুরু করেন নিজেদের চর্মরোগ সারানোর জন্য।[১২][১৩]
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে লুনি নদীর উৎসধারাটিতে বাঁধ নির্মিত হলে পুষ্কর হ্রদ হয়ে ওঠে একটি কৃত্রিম হ্রদ। কথিত আছে, দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিং (১৬৬৬-১৭০৮) এই হ্রদের তীরে বসে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থসাহিব আবৃত্তি করতেন।[১৪]
মুঘল শাসনকালে তীর্থকর আরোপিত এবং ধর্মীয় শোভাযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি হলে হ্রদটির গুরুত্ব সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। ১৬১৫-১৬ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির (১৫৬৯-১৬২৭) স্থানীয় রাজপুত রানাকে পরাজিত করে বিজয়োৎসবের অঙ্গ হিসেবে পুষ্কর হ্রদের তীরে একটি মৃগয়াকুটির নির্মাণ করেন (বর্তমানে এটির ধ্বংসাবশেষই দেখা যায়)। পুষ্কর থেকে ২৩ কিলোমিটার (১৪ মা) দূরে অবস্থিত অজমেরে অবস্থানকালে তিনি ষোলোবার শিকার উপলক্ষ্যে এই মৃগয়াকুটিরে এসেছিলেন। পবিত্র হ্রদের তীরে পশুহত্যা ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধ হলেও জাহাঙ্গির এখানে শিকার চালিয়ে যান এবং বিষ্ণুর বরাহ অবতারের একটি মূর্তি ধ্বংস করেন। জাহাঙ্গিরের পৌত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬১৮-১৭০৭) পুষ্করের অনেক মন্দির ধ্বংস ও অপবিত্র করেন। এই মন্দিরগুলো পরবর্তীকালে পুনর্নির্মিত হয়েছিল।[১১][১৫] যদিও জাহাঙ্গিরের পিতা সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) শাসনকালে শুধুমাত্র যে হ্রদকে কেন্দ্র করে তীর্থস্থানের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল, তা-ই নয়, বরং অজমেরে সুফি সন্ত মইনুদ্দিন চিস্তির দরগাটিও নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, আকবর স্বয়ং মইনুদ্দিন চিস্তির অনুরাগী ভক্ত ছিলেন।[১০]
অম্বর, বুন্দি, বিকানির এবং জয়সলমিরের রাজপুত শাসকেরা হ্রদ ও হ্রদ-সন্নিহিত মন্দিরগুলোর গুরুত্ব পুনঃস্থাপনে বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়েছিলেন। মুঘল-পরবর্তী যুগে পুষ্করের তীরে ঘাট নির্মাণ ও মন্দিরগুলোর সংস্কার বা নির্মাণের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত রাজন্যবর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
অম্বরের প্রথম মান সিংহ রাজঘাট ও মান মন্দির নির্মাণ করেন; মহারানা প্রতাপ বরাহ মন্দির নির্মাণ করেন; দৌলত রাও সিন্ধিয়া নির্মাণ করে তীর্থঘাট; মারাঠা শাসক অনাজি সিন্ধিয়া কোটেশ্বর মহাদেব মন্দির এবং অজমেরের মারাঠা প্রাদেশিক শাসনকর্তা গোবিন্দ রাও শিবঘাট নির্মাণ করেন। ব্রিটিশ যুগে হ্রদ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উন্নতিসাধনের কর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এই তীর্থস্থানে গবাদিপশুর একটি মেলা চালু হয়। ১৯৫৬ সালে জয়পুরের মহারাজা জয়পুর ঘাট ও ঘাটের প্রধান প্রাসাদটি নির্মাণ করে দেন।[১৬]
হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং পৌরাণিক শাস্ত্রে উল্লিখিত অনেক কিংবদন্তীতে পুষ্কর হ্রদ ও সেটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা পুষ্কর শহরটির কথা পাওয়া যায়।
পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে, দৈত্য বজ্রনাভ (মতান্তরে বজ্রনাশ) ব্রহ্মার সন্তানদের হত্যা ও মানুষকে হেনস্থা করতে শুরু করলে ব্রহ্মা পদ্মফুল ছুঁড়ে তাকে বধ করেন। সেই সময় সেই পদ্মের পাপড়িগুলো তিনটি স্থানে পতিত হয় এবং সেই স্থানগুলোতে তিনটি হ্রদের উৎপত্তি ঘটে: পুষ্কর হ্রদ বা জ্যেষ্ঠ পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর ও কনিষ্ঠ পুষ্কর। ব্রহ্মার ‘কর’ অর্থাৎ হাত থেকে খসে পড়া ‘পুষ্প’ অর্থাৎ ফুল থেকে উৎপন্ন হওয়ার দরুন ব্রহ্মা এই স্থানটির নামকরণ করেন ‘পুষ্কর’।[১০][১৭] কথিত আছে, পবিত্র সরস্বতী নদী পুষ্কর হ্রদেই পাঁচটি ধারায় উৎপন্ন হয়েছিল।[১][১২] উক্ত তিনটি হ্রদের অধিষ্ঠাতা দেবতারা হলেন যথাক্রমে হিন্দুধর্মে ‘ত্রিদেব’ নামে পরিচিত তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। জ্যেষ্ঠ পুষ্করে ব্রহ্মা একটি যজ্ঞ সম্পাদনার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ব্রহ্মার পত্নী সাবিত্রী (মতান্তরে সরস্বতী) যজ্ঞের নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে পারেননি। ব্রহ্মা তাই স্থানীয় শাসকস্থানীয় কৃষিজীবী সমাজ গুজ্জরদের গায়ত্রী নামে একটি কন্যাকে বিবাহ করেন। তারপর ব্রহ্মা নববধূকে পাশে বসিয়ে যজ্ঞ সমাপ্ত করেন। ইতিমধ্যে সাবিত্রী সেই স্থানে উপস্থিত হন এবং গায়ত্রীকে ব্রহ্মার পত্নীর আসনে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পান। ক্রুদ্ধ হয়ে সাবিত্রী ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে, একমাত্র পুষ্কর ভিন্ন অন্য কোথাও ব্রহ্মার পূজা হবে না। এরপর পুষ্করে সকল দেবতার উপস্থিতিতে যজ্ঞ সম্পাদিত হয়। কথিত আছে, এই হ্রদে স্নান করলে সকল পাপ দূরীভূত হয়। বর্তমানে এটি হিন্দুদের প্রধান পাঁচটি তীর্থস্থানের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়।[১০][১৮][১৯][২০][২১]
রামায়ণ ও মহাভারতে পুষ্কর হ্রদকে ‘আদিতীর্থ’ বা প্রথম তীর্থ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কৃত কবি ও নাট্যকার কালিদাস অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটকে পুষ্কর হ্রদের কথা উল্লেখ করেছেন।[১৯] রামায়ণে বলা হয়েছে যে, বিশ্বামিত্র পুষ্কর হ্রদের তীরে এক হাজার বছর তপস্যা করেছিলেন। ব্রহ্মা স্বয়ং এসে বিশ্বামিত্রকে রাজর্ষির থেকে উচ্চ মর্যাদা দান করে গেলেও তিনি তপস্যা ছাড়েননি। কিন্তু একদিন অপ্সরা মেনকাকে পুষ্করে স্নানরতা অবস্থায় দেখে বিশ্বামিত্রের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। তিনি দশ বছর মেনকার সঙ্গে সহবাস করেন। তারপর যখন বিশ্বামিত্র মেনকাকে নিজের তপস্যার পথের বাধা হিসেব উপলব্ধি করেন তখন তিনি উত্তরদিকে যাত্রা করেন পুনরায় ধ্যানে বসার জন্য।[২২] কথিত আছে, ব্রহ্মার যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে বিশ্বামিত্রই সেই যজ্ঞস্থলে এখানকার প্রসিদ্ধ ব্রহ্মামন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।[২৩]
হিন্দু ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, ‘পঞ্চসরোবর’ বা পাঁচটি হ্রদ হিন্দুদের কাছে পবিত্র হ্রদ বলে পরিচিত। এগুলো হলো: মানস সরোবর, বিন্দু সরোবর, নারায়ণ সরোবর, পম্প সরোবর ও পুষ্কর সরোবর। এই কারণেই পুষ্কর হ্রদ ভারতের পবিত্রতম তীর্থগুলোর অন্যতম। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে এই হ্রদে স্নান করলে বহু শতাব্দীকাল ধরে যজ্ঞ সম্পাদনের সমতুল্য পূণ্য অর্জন করা সম্ভব।[২৪] কোনও কোনও গ্রন্থে পুষ্করকে ‘তীর্থরাজ’ অর্থাৎ জলাশয়ের তীরে অবস্থিত তীর্থগুলোর মধ্যে প্রধান বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[১][২] হিন্দুশাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে যে, জ্যেষ্ঠ পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর (যেখানে হনুমান মন্দির ও একটি প্রাচীন বটগাছ অবস্থিত) ও কনিষ্ঠ পুষ্কর (যেখানে কৃষ্ণের একটি মন্দির আছে) – কার্তিক পূর্ণিমায় এই তিন পুষ্করকে ঘিরে ১৬ কিলোমিটার (৯.৯ মা) পথ পরিক্রমা করলে বিশেষ পূণ্যলাভ হয়।[১৭] ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস পুষ্করকে পৃথিবীর দশটি শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থানের এবং ভারতে হিন্দুদের পাঁচটি পবিত্রতম তীর্থস্থানের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করে।[২০]
পুষ্কর হ্রদ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন অনেকগুলো স্মারক দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে - পুষ্কর শহর, ব্রহ্মা মন্দির ও হ্রদের চারিপাশের ঘাটগুলো। এই শহরের সকল স্মারক স্থল ও এখানে আয়োজিত মেলাটির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হল পবিত্র বলে খ্যাত এই হ্রদটিই।
পুষ্কর শহরটি হল ভারতের প্রাচীনতম শহরগুলোর অন্যতম। ২০০১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী, এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৪,৭৯১।[২৫] শহরটি পুষ্কর হ্রদের তীরেই অবস্থিত। ঠিক কবে শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে কিংবদন্তী অনুযায়ী, এই হ্রদ ও শহরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। কথিত আছে, এখানেই ব্রহ্মা বিষ্ণুর দর্শনলাভের আশায় তপস্যা করেছিলেন। এই কারণেই এই শহরের স্বাতন্ত্র্যের একটি ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান। বার্ষিক পুষ্কর মেলায় বিপুল জনসমাগম ছাড়াও এই শহরে প্রতি মাসে প্রায় এক লক্ষ তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়।[২৬] ২০০৫ সালে এই শহরে আগত নথিবদ্ধ পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬.১২ মিলিয়ন (যা রাজস্থানের সকল পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে কথিত), এবং এর মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাই ছিল প্রায় ৬৩,০০০।[২৭]
পবিত্র হ্রদটি ছাড়াও পুষ্করে পাঁচশোরও বেশি মন্দির আছে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে ৮০টি বড়ো মন্দির এবং বাকিগুলি ছোটো ছোটো। পুষ্করের অনেক মন্দিরই আওরঙ্গজেবের শাসনকালে (১৬৫৮-১৭০৭) মুসলমানেরা ধ্বংস ও অপবিত্র করেছিল। পরবর্তীকালে এই মন্দিরগুলো পুনর্নির্মিত হয়। পুষ্করের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরটি হল এখানকার ব্রহ্মা মন্দির। মন্দিরের বর্তমান ভবনটি খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত হলেও লোকবিশ্বাস অনুযায়ী আদি মন্দিরটি ছিল ২০০০ বছরের পুরনো।[২৮] শাস্ত্রে সাবিত্রীর অভিশাপের কারণে পুষ্করের মন্দিরটিকেই পৃথিবীর একমাত্র ব্রহ্মামন্দির হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে পুষ্করকে ‘তীর্থরাজ’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[১৭][২৯] বর্তমানে যদিও পুষ্করের মন্দিরটি ব্রহ্মার একমাত্র মন্দির নয়, তবুও ভারতে যে অল্প কয়েকটি ব্রহ্মামন্দির রয়েছে তার মধ্যেই এইটিই সর্বপ্রধান।[১১][২৩] হিন্দু পূণ্যার্থী ও সাধু-সন্তেরা পুষ্কর হ্রদে স্নান করে এই মন্দির দর্শন করেন।[১৩] হ্রদ-তীরবর্তী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলোর মধ্যে রয়েছে বরাহ মন্দির (বিষ্ণুর বরাহ অবতারের প্রতি উৎসর্গিত) এবং ব্রহ্মার দুই পত্নী সাবিত্রী ও গায়ত্রীর মন্দির।
ঘাটগুলো পুষ্কর হ্রদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলো শুধুমাত্র স্নানের জন্যই নয়, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি ধর্মকৃত্যের জন্যও ব্যবহৃত হয়। হ্রদের চারিধারে পূণ্যার্থীদের স্নানের জন্য ব্যবহৃত বাহান্নটি ঘাটের মধ্যে দশটি ঘাট প্রধান। এই ঘাটগুলোর লাগোয়া আরও কিছু ঘাট রয়েছে। তবে এই দশটি ঘাটকেই জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন স্মারক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘাটগুলো হল: বরাহঘাট, দধিচীঘাট, সপ্তর্ষিঘাট, গোয়ালিয়র ঘাট, কোটাঘাট, গৌঘাট, যাগঘাট, জয়পুর ঘাট, কার্নি ঘাট ও গঙ্গৌর ঘাট। পুষ্কর হ্রদ (এটিকেও জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থান বলে ঘোষণা করা হয়েছে)সহ ঘাটগুলোকে কয়েক শতাব্দী ধরে রাজস্থানের রাজপরিবারগুলো ও মারাঠা রাজারা রক্ষণাবেক্ষণ করে এসেছিলেন। বর্তমানে রাজস্থান সরকার ও ভারত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অর্থসাহায্যে ঐতিহ্য উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে এগুলো সংস্কারের আরও কাজ চলছে। ঘাটগুলোতে স্নান করার ক্ষেত্রেও অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন, ঘাট ও মন্দিরগুলো পবিত্র হ্রদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ঘাট থেকে দূরে জুতো খুলতে হয় এবং অ-হিন্দুরা হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করতে পারে না। কথিত আছে, এই হ্রদের জলে স্নান করলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সেরে যায়। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, প্রতিটি ঘাটে জলের একটি বিশেষ আরোগ্যদায়ী ক্ষমতা রয়েছে।[৩০] অনেকগুলো ঘাটের নামকরণ করা হয়েছে সেই সব ঘাট নির্মাণকারী রাজাদের নামানুসারে। আবার কয়েকটি ঘাটের বিশেষ কিছু গুরুত্বও রয়েছে। যেমন, কথিত আছে যে বরাহঘাটে বিষ্ণু বরাহ অবতারের রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং ব্রহ্মাঘাটে ব্রহ্মা স্নান করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম গৌঘাটে বিসর্জিত করার পর এই ঘাটের নামকরণ করা হয় গান্ধীঘাট।[২১][৩১] বরাহঘাটের কাছে নর্ত সিং ঘাটে একটি স্টাফড কুমির প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে রাখা থাকে।[৯]
পুষ্কর হ্রদ ও ঘাটে আগত দর্শনার্থীদের হাতে একটি লাল সুতো দক্ষিণার বিনিময়ে বেঁধে দেন পুরোহিতরা। এই সুতোটির অর্থ সেই পূণ্যার্থী পুষ্কর হ্রদ দর্শন করেছেন এবং অন্য পুরোহিতেরা এই সুতো দেখলে আর তার থেকে দক্ষিণা চাইতে পারবেন না।[৩২]
বার্ষিক পুষ্কর মেলা উপলক্ষ্যে পুষ্কর হ্রদ-সন্নিহিত অঞ্চলে প্রচুর জনসমাগম ঘটে। এই মেলাটির ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি একটি অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। মেলা উপলক্ষ্যে বহুসংখ্যক পূণ্যার্থী হ্রদে স্নান করেন এবং পাশাপাশি উটের একটি মেলা আয়োজিত হয়। পুষ্কর মেলা শুরু হয় প্রবোধিনী একাদশী (কার্তিক শুক্লা একাদশী) তিথিতে এবং সমাপ্ত হয় কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসের পূর্ণিমা তিথিতে। কার্তিক পূর্ণিমা তিথিটিই মেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার সম্মানে এই মেলা আয়োজিত হয়। মনে করা হয় যে, কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে পুষ্কর হ্রদে স্নান করলে মোক্ষলাভ হয়। এছাড়া হিন্দুরা এই তিথিতে তিন পুষ্কর পরিক্রমাকেও বিশেষ পূণ্যদায়ী মনে করেন। সাধু-সন্তেরা এই অঞ্চলে জড়ো হয়ে একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাহাড়ের গুহায় বাস করেন। পুষ্কর মেলাটি এশিয়ার বৃহত্তম উটের মেলাও বটে।[২৮][৩৩] সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বর্ণময় ও আনন্দোচ্ছল উটের মেলায় ২ লক্ষ লোকের সমাগম হয় এবং ৫০,০০০ উট কেনাবেচা হয়।[৩৪] মেলাটি আয়োজিত হয় হ্রদের তীরেই। এই মেলা উপলক্ষ্যে উটগুলোকে রঙিন সাজে সজ্জিত করে হ্রদের দক্ষিণে বালিয়াড়ির উপরে কুচকাওয়াজ করানো হয়। আশেপাশের গ্রামের অধিবাসীরা তাদের প্রথাগত রঙিন পোষাক পরে মেলায় যোগদান করে। কথিত আছে, কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতেই ব্রহ্মা এই হ্রদ প্রতিষ্ঠার যজ্ঞ সম্পূর্ণ করেছিলেন। সেই কারণেই এই মেলা এই তিথিতে আয়োজিত হয়। বর্তমানে এই মেলার আয়োজক রাজস্থান পর্যটন উন্নয়ন নিগম (আরটিডিসি), পুষ্কর পৌর পর্ষদ ও রাজস্থানের প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ।[৩৫] মেলা উপলক্ষ্যে লোকনৃত্য, সংগীত, উটের দৌড় ও গবাদিপশুর মেলাও আয়োজিত হয়।[১৩][৩৬] দড়ি-টানাটানি খেলা এই মেলার একটি জনপ্রিয় বিনোদন। রাজস্থানী ও বিদেশিদের মধ্যে এই খেলা হয় এবং স্থানীয়রাই অনিবার্যভাবে এতে জয়লাভ করে।[১১]
বিগত কয়েক দশকে পুষ্কর হ্রদ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বহুলাংশে দূষিত হয়েছে। এই সমস্যার প্রধান কারণ পর্যটকদের সাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এলাকার নগরায়ন ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বনভূমির ধ্বংসসাধন।[৩৭][৩৮]
হ্রদ সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হল:[৩৯]
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুষ্কর হ্রদের জলস্তর বিপজ্জনকভাবে নেমে গেছে। বহু বছর যাবৎ দেখা যাচ্ছে, উৎসবের মরসুমে হ্রদে সামান্য জলই অবশিষ্ট থাকে। ২০০৯ সালে পুষ্কর মেলার সময় পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। কারণ, সেই সময় হ্রদটি সম্পূর্ণতই শুকিয়ে গিয়েছিল। উচ্চতর একটি ঘাটের কাছে কংক্রিটের ট্যাংক থেকে এবং টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভৌমজল তুলে এনে পূণ্যার্থীদের স্নানের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়। কর্তৃপক্ষ হ্রদ থেকে পলি-অপসারণের যথেষ্ট পরিকল্পনা না থাকাটিকেই এর জন্য দায়ী করেছিল। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলে খরা হওয়ায় অপ্রতুল বৃষ্টিপাতের ফলে হ্রদটি জলপূর্ণ হতে পারেনি।[৪০][৪১]
বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ডের (বিওডি) উচ্চ ঘনীভবনের ফলে পুষ্কর হ্রদের জল জাতীয় জল গুণমান সূচক স্পর্শ করতে পারেনি।[৪২] ইউট্রোফিকেশন, অ্যানথ্রোপোজেনিক চাপ এবং ধর্মকৃত্য ও পর্যটন ব্যবসার চাপে হ্রদের জলের গুণমানের উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তার কথা বিবেচনা করে ছয় মাস ধরে মাসিক ভিত্তিতে চারটি স্থানে জলের গুণমান পরীক্ষার একটি কর্মসূচি গৃহীত হয়। তীর্থযাত্রীদের চাপ ও দূষণের অন্যান্য উৎসগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করে নমুনা পরীক্ষাস্থলগুলো নির্বাচন করা হয়েছিল। জলের নমুনা বিশ্লেষণ করা হয় তাপমাত্রা, পি.এইচ, লবণাক্ততা, পরিবাহিতা, মোট দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ, ক্ষারত্ব, কঠিনতা, ঘোলাটে ভাব, দ্রবীভূত অক্সিজেন, ক্লোরাইড, নাইট্রাইট, ফসফেট, সালফেট, সোডিয়াম, অ্যামোনিয়াম, পটাশিয়াম, মোট ক্লোরোফিল, বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড ও কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ডের পরিমাণ জানার জন্য। সেই সময় জল বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, চারটি স্থানেই জলের ক্ষারত্ব, ক্লোরাইডের পরিমাণ এবং পরিবাহিতার ঘনীভবন অতি উচ্চ, যেখানে দূষণের পরিমাণ সর্বাধিক সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের আধিক্যের কারণে কাঠিন্যও বেশি। বার্ষিক পুষ্কর মেলার সময় বিশ্লেষিত বিভিন্ন স্থিতিমাপ ও হ্রদের জলদূষণের মাত্রার মধ্যে একটি দূরবর্তী সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে জনসাধারণের অংশগ্রহণে সকল সরকারি সংস্থা হ্রদ ব্যবস্থাপনায় আপদকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।[৪৩]
হ্রদে জলের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য ১৯৯৩ সালেই সরকার বারোটি গভীর নলকূপ তৈরি করেছিল। যদিও পরে অধিকাংশ নলকূপই অকেজো হয়ে পড়ে এবং সমস্যা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রক পুষ্কর হ্রদকে জাতীয় হ্রদ সংরক্ষণ প্রকল্পের (এনএলসিপি) অধীনে থাকা পাঁচটি হ্রদের তালিকাভুক্ত করে। ২০০৮ সাল থেকে এই মন্ত্রকই পুষ্কর হ্রদের সংরক্ষণের জন্য অর্থ সাহায্য করে আসছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।[৪১]
হ্রদ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে উন্নয়নের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনাগুলোর উদ্দেশ্যে জলের গুণমান বৃদ্ধি, জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, হ্রদের চারপাশের জমি জবরদখল রোধ, হ্রদের চারিধারের পরিবেশের উন্নতি এবং সেই সঙ্গে বিনোদন ও কর সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।[৩৯]
পুষ্কর শহরের নর্দমাগুলোর সংযোগকারী পথের মাঝখানে বাধা সৃষ্টি করে এবং অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সেগুলোর হ্রদে মেশা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রধান সংযোগকারী লাইন স্থাপন এবং জলসংশোধন যন্ত্র স্থাপন করে নিরন্তর হ্রদের জল সংশোধন ও জলের মুক্তভাবে চলাচল সুনিশ্চিত করার কথাও ভাবা হয়।[৩৯] এছাড়া সংস্কারের উপায় হিসেবে হ্রদের পলি পরিষ্কার করা, সংযোগকারী ধারাগুলো যেখানে হ্রদে মিশনে সেখানে জল সংশোধনের যন্ত্র স্থাপন, নিবারক বাঁধ নির্মাণ, ঘাট সংরক্ষণ, হ্রদের তীরে বৃক্ষশূন্য পাহাড়গুলোতে বনসৃজন, মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ, উপযুক্ত গাছপালা বসিয়ে বালিয়াড়িগুলোকে সুস্থিতকরণ এবং সংযোগকারী ধারাগুলোর তীরে কৃষিকার্য বন্ধ করার কথা প্রস্তাব করা হয়।[৩৯] সেই সঙ্গে হ্রদের পরিবেশ উন্নতকরণের জন্য গণ সচেতনা বৃদ্ধির কর্মসূচিও গৃহীত হয়। জনসাধারণের সহযোগিতায় হ্রদে মাছের মৃত্যু রুখতে হ্রদে যখন জল কম থাকে তখন মাছের দ্রুত বংশবিস্তার রোধেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।[৩৯]