পুষ্যমিত্র শুঙ্গ | |
---|---|
'শুঙ্গ সম্রাট' | |
রাজত্ব | খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫- খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ |
রাজ্যাভিষেক | খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ |
পূর্বসূরি | মৌর্য্য রাজবংশের বৃহদ্রথ |
উত্তরসূরি | অগ্নিমিত্র |
দাম্পত্য সঙ্গী | দেবমালা |
বংশধর | অগ্নিমিত্র |
প্রাসাদ | শুঙ্গ রাজবংশ |
পুষ্যমিত্র শুঙ্গ (সংস্কৃত: पुष्यमित्र शुंग) (রাজত্বকাল: খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ -খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯) শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট ছিলেন। বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত গ্রন্থানুসারে, ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য রাজবংশের নবম সম্রাট বৃহদ্রথের প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য্য সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজে শক্তি প্রদর্শনের সময় তাকে হত্যা করে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান ও শুঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।[১]:২২-২৪
পতঞ্জলির মহাভাষ্য এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে পুষ্যমিত্র শুঙ্গকে ভারদ্বাজ গোত্রভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[২] আবার হরিবংশ পুরাণে তাকে কাশ্যপগোত্রীয় ব্রাহ্মণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক জে সি ঘোষ পুষ্যমিত্রকে দ্বৈয়মুষ্যায়ন (সংস্কৃত: द्वैयमुष्यायन) বা দুই গোত্র বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ বলে উল্লেখ করে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তার মতে পুষ্যমিত্রের পিতা ও মাতা ভারদ্বাজ ও কাশ্যপ দুই ভিন্ন গোত্রের ছিলেন বলে পুষ্যমিত্রের গোত্র দুইটি।[৩]:৩৫৯-৩৬০ অপস্তম্ভের প্রবর খণ্ডে শৌঙ্গশৈশিরি গোত্রের উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বামিত্রকে পূর্বপুরুষ হিসেবে গণনা করে শৈশিরি গোত্র উদ্ভূত হয়েছে।[৩]:৩৬০
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথের মতে নামের সঙ্গে মিত্র যুক্ত থাকায় পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পুর্বপুরুষ পারস্যের অধিবাসী ছিলেন। মিত্র নামক বৈদিক দেবতাকে পারস্যের অধিবসীদের উপাস্য ছিলেন।[৪] যদিও মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী স্মিথের এই মতবাদকে ভ্রান্ত বলে মনে করেছেন। ঋগ্বেদে মিত্র নাম যুক্ত পুরুমিত্র ও বিশ্বামিত্র ইত্যাদি বেশ কয়েকজন ব্যক্তির উদহারণ দিয়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে পুষ্যমিত্র একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন।[৫]
দিব্যাবদান নামক বৌদ্ধ গ্রন্থানুসারে, মৌর্য্যদের থেকেই শুঙ্গদের উৎপত্তি হয়েছে,[৬] কিন্তু সুরেশচন্দ্র রায়ের মতে এই বক্তব্য ভ্রান্ত।[৭] দিব্যাবদান গ্রন্থে পুষ্যমিত্রের পূর্বপুরুষ হিসেবে যে মৌর্য্য রাজপুরুষদের তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের ঐতিহাসিকতাও প্রতিষ্ঠিত নয়। ওন্যদিকে বেশির ভাগ পুরাণে একথা স্বীকার করা হয়েছে যে, সেনাপতি পুষ্যমিত্র সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে সিংহাসনলাভ করেন।[৮][৯][১০][১১]
যুগ পুরাণ অনুসারে, ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় শাসক প্রথম দেমেত্রিওসের নেতৃত্বে যবন সেনা মগধ আক্রমণ করে পাঞ্চাল অঞ্চল, সাকেত ও মথুরা নগরী ও অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অধিকার করে নেন।[১]:২২-২৪ হাথিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, কলিঙ্গ রাজ খারবেল তার রাজত্বের অষ্টম বছরে রাজগৃহ আক্রমণ করলে যবন রাজ দিমিত অবরুদ্ধ সেনা পরিত্যাগ করে মথুরায় পশ্চাৎ অপসারণ করেন। এই লিপি থেকে আরো জানা যায় যে, খারবেল তার রাজত্বের দ্বাদশ বছরে বহসিতমিত বা বৃহস্পতিমিত্র নামক মগধরাজকে তার পাদবন্দনা করতে বাধ্য করেন।[১২] এই বৃহস্পতিমিত্র যে স্বয়ং পুষ্যমিত্র শুঙ্গ সেই বিষয়ে মত প্রচলিত রয়েছে।
বিভিন্ন গ্রন্থে পুষ্যমিত্রকে একজন বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী শাসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অশোকাবদান গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, ইতিহাসের বুকে অমর হওয়ার উদ্দেশ্যে এক মন্ত্রীর পরামর্শে পুষ্যমিত্র, বৌদ্ধ ধর্ম ধ্বংস করতে উদ্যত হন। প্রথমেই তিনি কুক্কুতারাম বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে ভিক্ষুদের হত্যা করেন। এরপর তিনি সকল নগরীতে একটি শিলালিপি স্থাপন করে ঘোষণা করেন যে, তার নিকট একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কর্তিত মস্তক নিয়ে এলে পুরস্কার স্বরূপ একটি করে স্বর্ণমুদ্রা, অন্যমতে একশত মুদ্রা প্রদান করা হবে।[১৩] বিভাষা নামক দ্বিতীয় শতাব্দীর সর্বাস্তিবাদ-বৈভাষিক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুষ্যমিত্র কাশ্মীর সীমান্তে প্রায় পাঁচশত বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেন ও বহু ভিক্ষুকে হত্যা করেন।[১৪] পঞ্চদশ শতাব্দীর তিব্বতী লামা তারানাথ তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, ব্রাহ্মণ রাজা পুষ্যমিত্র মধ্যদেশ হতে জলন্ধর পর্য্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করেন ও বহু বৌদ্ধ পণ্ডিতকে হত্যা করলে সমগ্র উত্তর ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম অবলুপ্তির পথে চলে যায়।[১৪] যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই বিষয়ে একমত হন নি। বিভাষা গ্রন্থে উল্লিখিত বৌদ্ধ কল্পকথা ও প্রবাদানুসারে, বোধি বৃক্ষ ধ্বংস করতে উদ্যত হলে বৃক্ষের রক্ষাকারী যক্ষ দংষ্ট্রানিবাসী সসৈন্যে সম্রাটকে হত্যা করেন। চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত শারিপুত্রপরিপিচ্ছ নামক মহাসাংঘিক গ্রন্থের চীনা অনুবাদেও এই কাহিনী স্থান পেয়েছে। আর্য্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক গ্রন্থে পুষ্যমিত্র শুঙ্গকে উদ্দেশ্য করে গোমিমুখ্য ও গোমিষণ্ড ইত্যাদি কটূক্তি করা হয়েছে।[১৪] শুঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালেই যে তক্ষশীলা অঞ্চলের বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলিকে ক্ষতি করা হয়েছিল, জন মার্শালের মতে তার প্রমাণ রয়েছে। তার মতে সাঁচীর স্তুপ পুষ্যমিত্র শুঙ্গের রাজত্বকালে ধ্বংস হয় এবং পরবর্তী সম্রাট অগ্নিমিত্রের রাজত্বকালে পুনর্নির্মাণ করা হয়।[১৪][১৫] দেউর কোঠার স্তূপ যে পুষ্যমিত্রের আমলেই ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই বিষয়ে বহু ঐতিহাসিক সহমত পোষণ করেন।[১৬]
পুষ্যমিত্রের দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলির সত্যতা সম্বন্ধে বহু ঐতিহাসিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।[১৪] রোমিলা থাপরের মতে, এই ধরনের কোন ঘটনার কোন পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[১৭] এতিয়েন লামোত্তে ও কোয়েনরাড এলস্টের মত বেলজীয় ভারততত্ত্ববিদেরা পুষ্যমিত্রের বৌদ্ধ বিরোধিতার ঘটনা যে সম্পূর্ণ অমূলক, তা মনে করেছেন।[১৮]
পুষ্যমিত্র শুঙ্গ
| ||
রাজত্বকাল শিরোনাম | ||
---|---|---|
পূর্বসূরী মৌর্য্য রাজবংশ |
শুঙ্গ সম্রাট খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫- খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ |
উত্তরসূরী অগ্নিমিত্র |