পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস হল প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের পূর্ব অঞ্চল বা পূর্ব এশিয়ায় বসবাস করা মানুষের ইতিহাস। এই অঞ্চলটি প্রাচীন সভ্যতা, যেমন চীন, জাপান ও কোরিয়াকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত বিকাশ লাভ করেছে।
প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ১.৮ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ৪০,০০০ বছর পর্যন্ত হোমো ইরেক্টাস পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বসবাস করত।[১] প্রায় ২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনে প্রথম নথিভুক্ত সভ্যতা পাওয়া যায়।
ধারণা করা হয়, হোমো ইরেক্টাস ১.৮ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ৪০,০০০ বছর পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বসবাস করত। বেইজিংয়ের ঝুকোদিয়ানে ৪০টি পৃথক "হোমো ইরেক্টাস" ফসিল পাওয়া যায়, এবং ধারণা করা হয় তা ৪০০,০০০ বছর পূর্বের। এই ফসিলগুলো পিকিং মানব নামে পরিচিত। ধারণা করা হয় এই প্রজাতি কয়েক লক্ষ বছর আগে চীনে,[১] এবং সম্ভবত ২০০,০০০ বছর পূর্বে ইন্দোনেশিয়ায় বসবাস করত। হয়ত তারাই প্রথম আগুনের ব্যবহার করে এবং খাবার রান্না করে।[২]
হোমো স্যাপিয়েন্সরা গণ্ডার ও অতিকায় হাতীর পালকে অনুসরণ করে প্রথম এশিয়ার সমভূমিতে আসে। প্রায় ৪৩,৫০০ বছর পূর্বে তারা দক্ষিণ সাইবেরিয়ায় পৌঁছায় এবং সেখান থেকে কয়েকটি দল দক্ষিণে বা পূর্বে গমন করে।[৩][৪]
খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ অব্দে কোরীয় উপদ্বীপ তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। রাজ্যগুলো হল বাইকজি, সিল্লা ও গোগুরিও। যদিও এদের ভাষা ও সংস্কৃতি এক ছিল, তবু তিনি রাজ্য এই উপদ্বীপ দখলের জন্য সর্বদায় যুদ্ধে লেগে থাকত। এছাড়া গোগুরিও চীনের সাথেও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গোগুরিও-সুই যুদ্ধ, যেখানে গোগুরিও রাজ্য সুই রাজবংশকে দূর করতে সক্ষম হয়।
সিল্লা রাজ্য নিকটবর্তী শহর ও জনপদ জয় করতে থাকলে তারা পীত সাগরে প্রবেশাধিকার লাভ করে এবং তাং রাজবংশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। তাং রাজবংশ সিল্লা রাজ্যের সাথে মিলিত হয়ে গোগুরিওদের দমন করার কৌশল গ্রহণ করে। যেহেতু গোগুরিওরা পূর্বে উত্তর দিক থেকে চীনের একটি আক্রমণ পরাস্ত করেছিল, ফলে একই সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে সিল্লারা আক্রমণ করতে তাদের পরাজিত করতে পারত। যাই হোক, গোগুরিওদের পরাজিত করার জন্য তাং-সিল্লা যৌথভাবে গোগুরিওদের মিত্র বাইকজিকে দমন করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় একটি আক্রমণের ভিত্তি গড়ে তুলে।
৬৬০ সালে সিল্লা ও চীনের তাংদের যৌথ বাহিনী বাইকজি আক্রমণ করে এবং বাইকজিকে সিল্লায় অন্তর্ভুক্ত করে। রাজধানী সাবি দখল এবং বাইকজির শেষ রাজা উইজা ও অন্যান্য অভিজাত পরিবারকে বন্দীর মধ্য দিয়ে সিল্লা ও তাং একত্রে বাইকজিদের দমন করে।
ইয়ামাতো যুগের জাপান ও বাইকজিদের মধ্যে দীর্ঘ ও ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ছিল। ৬৬৩ সালে বাইকজির বাকি সৈন্যদল ও জাপানি নৌবাহিনী মিলে সিল্লা সেনাদের সম্মুখীন হতে দক্ষিণ বাইকজিতে বাইকগ্যাং যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাং রাজবংশ থেকে ৭,০০০ সৈন্য ও ১৭০টি জাহাজ পাঠানো হয়। ৬৬৩ সালে আগস্টে বাইকগ্যাংয়ে পাঁচটি সম্মুখ নৌ সমরের পর তংজিয়ান নদীর তীরে সিল্লা-তাং বাহিনী জয় লাভ করে।
সিল্লা-তাং বাহিনী পরবর্তীতে তাদের মূল লক্ষ্য গোগুরিওতে আক্রমণ করে। গোগুরিওবা এক শতাব্দী পূর্বে সুই রাজবংশকে দমন করেছিল, কিন্তু পশ্চিম থেকে তাং রাজবংশের আক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। সিল্লা-তাং মিত্রশক্তি গোগুরিও-তাং যুদ্ধে জয় লাভ করে। এর ফলে সিল্লারা ৬৬৮ সালে কোরীয় উপদ্বীপের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ একত্রিত করে।
কিন্তু চীনের তাং রাজবংশের সাথে এই রাজ্যের সম্পর্কের মূল্য দিতে হয়। সিল্লাদের সমগ্র উপদ্বীপে চীনা শাসকের নির্ধারিত করের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে হয়। সিল্লা পরবর্তীতে উত্তরে আধুনিক পিয়ং ইয়ং পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে একত্রিত রাজ্য গঠন করতে প্রায় এক যুগ চীনা সেনাদের বিতাড়িত করতে সংগ্রাম করে।
চীনের সিয়া সাম্রাজ্য (আনু. ২১০০-১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) হল সিমা কিয়ান রচিত শিজি (ইতিহাসের আলেখ্য) ও ব্যাম্বু অ্যানাল্স এ বর্ণিত চীনের প্রথম সাম্রাজ্য।[৫][৬]
এরপর শাং সাম্রাজ্য হুয়াংহো নদীর উপত্যকায় শাসন করে। শাং সাম্রাজ্যের ইতিহাস জানা যায় শুজিং (ক্লাসিকস অব হিস্ট্রি), ব্যাম্বু অ্যানাল্স ও শিজি থেকে। প্রথাগত সময়কাল অনুযায়ী, শাংরা খ্রিস্টপূর্ব ১৭৬৬ থেকে ১১২২ অব্দ পর্যন্ত শাসন করে। কিন্তু ব্যাম্বু অ্যানাল্সে উল্লেখিত বর্তমান সময়ের নথি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে তারা খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫৬ থেকে ১০৪৬ অব্দ পর্যন্ত শাসন করে।
চৌ রাজবংশ (আনু. ১০৪৬-২৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিল চীনের সবচেয়ে দীর্ঘকাল স্থায়ী সাম্রাজ্য।[৭] কিন্তু চীনে এই রাজবংশের প্রকৃত রাজনৈতিক ও সেনা নিয়ন্ত্রণ সমাপ্ত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৭৭১ অব্দে। এই সময়কাল পশ্চিম চৌ নামে পরিচিত ছিল। চীনের ইতিহাসের এই যুগ ছিল চীনা ব্রোঞ্জের তৈজসপত্র নির্মাণের শীর্ষ সময়। এই সাম্রাজ্যের যুদ্ধরত রাজ্য কালে লিখন রীতি তার আধুনিক রূপে বিবর্তিত হয়।[৮]
জাপানের ইতিহাস তিন ভাগে বিভক্ত। চীন ও কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক।
জাপানে বসতি স্থাপিত হয় ৩০,০০০ বছর পূর্বে, যখন জাপানের দক্ষিণে কোরিয়া ও চীনের সাথে এবং উত্তরে সাইবেরিয়ার সাথে স্থল যোগাযোগ চালু হয়। ২০,০০০ বছর পূর্বে সমুদ্রতলের উত্থানের ফলে চারটি বৃহৎ দ্বীপ গঠিত হয় এবং বর্তমান সময়ে এশিয়া মহাদেশের সাথে জাপানের স্থল যোগাযোগ ১৫,০০০-১০,০০০ বছর পূর্বে সম্পূর্ণরূপে সমুদ্র বক্ষে হারিয়ে যায়। ফলে কোরীয় উপদ্বীপে কিছু অভিবাসন হয়।
প্রাচীন জাপানের পুরাণের কোজিকিতে জাপানের সৃষ্টি পুরাণ এবং সূর্যের দেবী আমাতেরাসুর সাথে সম্রাটদের বংশানুক্রমিক যোগসূত্র সম্পর্কিত বর্ণনা রয়েছে।
প্রাচীন মৃৎশিল্প জাপানের কিশুতে বিকাশ লাভ করে। কিশুর দুটি যুগ বিভাগ রয়েছে। একটি জোমন (আনু. ৭,৫০০-২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং অপরটি ইয়াওই (আনু. ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ২৫০ খ্রিষ্টাব্দ)।