পূর্ববঙ্গ ও আসাম | |||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
ব্রিটিশ ভারতেরের প্রদেশ | |||||||||||
১৬ অক্টোবর ১৯০৫ –২১ মার্চ ১৯১২ | |||||||||||
![]() পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ | |||||||||||
রাজধানী | ঢাকা | ||||||||||
ইতিহাস | |||||||||||
• প্রতিষ্ঠিত | ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ | ||||||||||
• বিলুপ্ত | ২১ মার্চ ১৯১২ | ||||||||||
| |||||||||||
বর্তমানে যার অংশ | ![]() ![]() |
পূর্ববঙ্গ ও আসাম ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি স্বল্পকাল স্থায়ী প্রদেশ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর এই প্রদেশ গঠিত হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পূর্বাঞ্চল নিয়ে এই প্রদেশ গঠিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে এই প্রদেশ গঠিত হয়েছিল।[১]
ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামসহ আরো অনেক অঞ্চল নিয়ে গঠিত ব্যাপক আয়তন বিশিষ্ট প্রদেশ। প্রদেশের রাজধানী ছিল কলকাতা। এছাড়া কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীও ছিল। বিপুলায়তন প্রদেশ শাসন করা কষ্ট সাধ্য ছিল। এছাড়া অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলা ছিল অনুন্নত। বাংলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ১৯০১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে মুসলিমদের মধ্যে ২২জন এবং হিন্দুদের মধ্যে ১১৪জন ইংরেজি ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন ছিল। সরকারি উচ্চপদে মুসলিম ছিল ৪১জন এবং হিন্দু ১২৩৫জন।[২] ব্রিটিশ সরকারের মতে বিশাল প্রদেশ শাসনে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন এবং অনুন্নত পূর্ববঙ্গের উন্নয়ন তরান্বিত করার উদ্দেশ্যে নতুন প্রদেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ছিলেন প্রদেশের স্থপতি।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা থেকে পূর্ববঙ্গ ও আসাম পৃথক করা হয়।[৩][৪] কুচবিহার ও ত্রিপুরা সহ কয়েকটি দেশীয় রাজ্যকে প্রাদেশিক গভর্নরের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত রাখা হয়। তবে এসব রাজ্যকে প্রদেশের অংশ করা হয়নি। ব্রিটিশ সরকারের মতে প্রশাসনিক সুবিধার্থে এই নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়।
ঢাকাকে নতুন রাজধানী করার ফলে এখানে অনেক নতুন স্থাপনা গড়ে উঠে যার মধ্যে রয়েছে কার্জন হল, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন), ঢাকা ক্লাব, ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), সেক্রেটেরিয়েট ভবন (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন) ইত্যাদি। কার্জন হল আইনসভা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রদেশের স্থপতি লর্ড কার্জনের নামানুসারে এই নাম রাখা হয়। প্রদেশের গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার, ল্যান্সলট হেয়ার এবং লর্ড মিন্টোর নামানুসারে সড়ক স্থাপিত হয়। রেসকোর্স এসময় গড়ে উঠে। নতুন সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় প্রদেশে নতুন শিল্প বিশেষত তাঁত শিল্প বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।[২]
ঢাকার জনসংখ্যা এসময় পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। রাজধানী হওয়ার পাঁচ বছর পরে ১৯১১ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা ২১% বৃদ্ধি পায়। ঢাকা ও পাবনা জেলায় সূতা রং করার শিল্পও বিকশিত হয়।[২]
ইতিপূর্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হত। নতুন প্রদেশ গঠনের পর ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় শিক্ষার বিস্তার ঘটে এবং এই খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এসময় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগ স্থাপিত হয়। পূর্বে এই অঞ্চলে ঢাকা কলেজ ও রাজশাহী কলেজ ছাড়া ডিগ্রি পর্যায়ের কোনো কলেজ ছিল না এবং বেসরকারি কলেজগুলি সরকারি সহায়তা বঞ্চিত ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন অবস্থায় ছিল। পাশাপাশি কোনো কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া শিক্ষক স্বল্পতাজনিত সমস্যা বিরাজ করছিল।[২]
প্রদেশ গঠনের পর শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যা নিরসনের উদ্দেশ্যে নতুন স্কুল ও কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৯০৬ সাল ঢাকা কলেজে শিক্ষক ছিলেন ১২ জন এবং চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক ছিলেন ৫ জন। ১৯১১ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৩০ ও ২০ হয়। ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালসহ ১২ জন শিক্ষক ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ব্রিটিশ নাগরিক। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কলেজে ফারসি, সংস্কৃত, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুসলিম ছাত্রদের সুবিধার্থে বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থা এবং আসন সংরক্ষণ করা হয়। পাঁচ বছরে স্কুল পর্যায়ে ২০% শতাংশ শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায়। প্রতি জেলায় নারীদের জন্য একটি করে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছাত্র ও শিক্ষকদের আবাসিক ভবন তৈরী হয়।[২]
ঢাকা, শিলং ও চট্টগ্রামকে যুক্তকারী রেল, সড়ক ও জলপথ পূর্বের তুলনায় বেশি সক্ষম হয়ে উঠে। নতুন রেললাইন ও স্টিমার সেবা চালুর ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রাজশাহী, মালদহের সাথে যোগাযোগ সহজ হয়। ইতিপূর্বে কলকাতা ছিল প্রধান বন্দর। নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। সড়ক নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ সহজ হয় এবং ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। জেলা শহরগুলির মধ্যে সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়।[২]
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল না বলে মুসলিমরা নতুন প্রদেশ গঠনকে উন্নয়নের সুযোগ হিসেবে দেখে এবং একে স্বাগত জানায়। অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। খুব নগন্য সংখ্যক মুসলিম নেতা এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতাভিত্তিক আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়ার পর কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা, ঢাকা ইত্যাদি স্থানে দাঙ্গা সৃষ্টি হয়।[২] বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে সন্ত্রাসবাদি আন্দোলন শুরু হয়। এসময় অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দলসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদি দল গড়ে উঠে।[৫]
১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে কংগ্রেসের সমর্থনপুষ্ট বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মোকাবেলার জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হয়।[২][৬] মুসলিম লীগ পরবর্তীতে ভারতের মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান গঠনের নেতৃত্ব দেয়।
সন্ত্রাসবাদি হামলা, মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি কারণে ব্রিটিশ সরকার পুনরায় বিষয়টি বিবেচনা করে। শেষপর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ রদ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১১ সালের এপ্রিলে আসামকে পূর্বের ন্যায় কমিশনারের শাসনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯১২ সালের এপ্রিলে বাংলা একত্রিত করার কাজ সম্পন্ন হয়। ফলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারায়।[২]
১৯০৫ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত নিম্নোক্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নরগণ দায়িত্বপালন করেছেন।