এই নিবন্ধটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে মনে হচ্ছে এটি একটি ব্যক্তিগত ভাবনা বা মতামত সম্বলিত রচনা এবং হয়তো নিবন্ধটির পরিচ্ছন্নকরণ প্রয়োজন। (মে ২০২৩) |
মহারাজ প্রতাপাদিত্য গুহরায় | |
---|---|
যশোর সম্রাট | |
জন্ম | ১৫৬১ যশোর, বাংলা, ভারতীয় উপমহাদেশ (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ১৬১১ (বয়স ৫০) বেনারস, মুঘল ভারত (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, ভারত) |
স্ত্রী |
|
বংশধর | উদয়াদিত্য, সংগ্রামদিত্য এবং বিন্দুমতি। |
পিতা | শ্রী হরি অথবা শ্রী ধর |
ধর্ম | হিন্দু |
মহারাজা প্রতাপাদিত্য গুহরায় (বাংলা: প্রতাপাদিত্য) (১৫৬১–১৬১১ খ্রি) বঙ্গদেশের যশোহর সাম্রাজ্যের নৃপতি, মুঘল শাসনাধীন ভারতে স্বাধীন "স্বরাজ" এর আদর্শ স্থাপন করতে চান এই বাঙ্গালী সম্রাট ।[১] ষোড়শ শতকের সূচনায় যখন সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে বিস্তার হতে থাকে মুঘল সাম্রাজ্য, সেই অমানিশার ক্রান্তিলগ্নে পূর্ব ভারতে স্বতন্ত্র সনাতনী শাসনের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত রেখেছিল বাঙ্গালার ৮ টি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য। এই রাজ্যসমূহের মধ্যে যশোর রাজ্যের অগ্নিকুলগৌরব রায়শ্রেষ্ঠ মহারাজাধিরাজ প্রতাপাদিত্যের নেতৃত্বে হিন্দুর ক্ষমতা ক্রমশ রূপ নেয় , মুঘল সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে সমগ্র বৃহৎবঙ্গে শাসন বিস্তার করে তিনি নির্মাণ করেন অখণ্ড সনাতনী যশোর সাম্রাজ্য । তাঁর অখণ্ড যশোর সাম্রাজ্য কেন্দ্রে ধূমঘাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে বিহারের পাটনা, দক্ষিণে উড়িষ্যার পুরী ও পূর্বে চট্টগ্রামের কাছে সন্দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রতাপাদিত্য তার পিতার মৃত্যুর পরে যশোরের সকল সম্পদের একমাত্র উত্তরসূরী হয়েছিলেন।[২]
প্রতাপাদিত্যের বাবা বিক্রমাদিত্য শ্রীহরি ছিলেন কায়স্থ এবং বাংলার আফগান শাসক দাউদ খান কররানির অধীনে একজন প্রভাবশালী রাজ কর্মচারী।[৩] দাউদ কররানী প্রধানমন্ত্রী লোদী খানকে হত্যা করেন এবং রাজক্ষমতাবলে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।[৪] দাউদ খান কররানী তাকে ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি প্রদান করেন এবং মৃত জমিদার চাঁদ খানের জমিদারি তাকে দান করেন। উল্লেখ্য যে, চাঁদ খানের কোন বংশধর ছিল না।[৫] দাউদ খানের পতনের পর শ্রীহরি বিপুল সংখ্যক সরকারি সম্পদের মালিক বনে যান ।[৩] শ্রী হরি ১৫৭৪ সালে বাওর এলাকায় যান এবং সেখানে নিজেকে মহারাজা বিক্রমাদিত্য হিসেবে ঘোষণা করেন।[৪] বৈষ্ণব ধর্ম মতে পিতা-মাতা তার নাম রেখেছিলেন গোপীনাথ। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে অতি অল্প বয়সে শ্রীহরি বিক্রমাদিত্যর ঔরসে বসু কন্যার গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় প্রতাপ গোপীনাথ। এই প্রতাপই বিশ্ববিশ্রুত বঙ্গেশ্বর মহারাজা প্রতাপাদিত্য। যুবরাজ অবস্থায় তিনি প্রতাপাদিত্য নামে পরিচিত হয়েছিল।
রাম রাম বসু প্রতাপ সম্পর্কে লিখেছেন, “জ্যোতিষিরা বললেন সব বিষয়েই উত্তম কিন্তু পিতৃদ্রোহী। হরিষেবিষাদ মনে রাজা অন্নপাশনে পুত্রের নাম রাখলেন প্রতাপাদিত্য।” কার্যক্ষেত্রে প্রতাপ মাতার মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন এবং পিতৃদ্রোহী হয়েছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র ৫দিন তখন সুতিকাগৃহে তার মায়ের মৃত্যু হয়। শ্রীহরি পত্নী বিয়োগে যেমন মর্মাহত হলেন তেমনি পুত্রের পিতৃঘাতী হওয়া নিশ্চিত মেনে নিয়ে অশান্তি ভোগ করতে লাগলেন। সুতরাং প্রথম হতেই তিনি প্রতাপের উপর বিরক্ত হলেন।
প্রতাপ পিতৃস্নেহ তিনি বিশেষ পাননি। অল্প বয়সে মা মারা যাওয়ায় কাকীমা বসন্ত রায়ের প্রথমা স্ত্রীর স্নেহে লালিত পালিত হতে থাকেন। পিতা তার উপর বিরক্ত থাকলেও স্নেহমমতার মুর্তিমান অবতার রাজা বসন্ত রায়ের স্নেহগুণে তার বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। খুল্লতাত পত্নীর অতুল স্নেহে প্রতাপের যে নিজের জননী নাই তা তিনি জানতেন না। প্রতাপ কাকীমাকে মা জ্ঞান করে বড় ভক্তি করতেন। তার ঔদ্ধত্য মায়ের স্নেহের কটাক্ষে বিলুপ্ত হতো। প্রতাপের রাজত্বকালে এই মাতাই “যশোহরের মহারাণী” বলে পরিচিত ছিলেন।
অতি শিশুকালে প্রতাপ শান্ত ও নিরীহ ছিলেন। আপত্য স্নেহের প্রভাবে বাল্যকালেই প্রতাব চঞ্চল ও অস্থিরমতি হয়ে উঠলেন। এই সময় প্রতাপ বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও মেধাবী ছিলেন। তিনি জীবনে সংস্কৃত, ফারসী ও বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃতি তান্ত্রিক স্তবাদি অতি সুন্দর আবৃত্তি করতেন। ফারসীতে পত্র লিখতে ও অতি সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন। প্রাদেশিক বাংলায় তিনি সৈন্যগণের সহিত কথা বলতেন। এই সব শিক্ষাই তার তত মত ছিল না। তিনি শাস্ত্র অপেক্ষা শস্ত্র শিক্ষায় অধিক পক্ষপাতী ছিলেন। তার সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট শিক্ষক ছিলেন রাজা বসন্ত রায় স্বয়ং। তিনি পিতৃব্য বসন্ত রায়ের সুযোগ্য অভিভাবকত্বের উত্তর কালে যশোর রাজ্যের সুযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন। পূর্ব থেকেই রাজা বসন্ত রায় উদীয়মান যুবকের অদম্য উদ্যম ও লোক পরিচালনায় ক্ষমতা দেখে প্রতাপের সম্পর্কে অনেক কিছু আশা করতেন।
বাল্যকালে প্রতাপ যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তিনি তরবারী, তীর চালনা ও মল্লযুদ্ধে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। জন্মাবধি সুন্দরবনের সাথে প্রতাপের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি সুন্দরবনের জঙ্গলে ব্রাঘ্র, হরিণ, গন্ডার (পূর্বে ছিল) প্রভৃতি শিকার করতেন। প্রতাপ বন্ধুবান্ধবসহ অরণ্যে প্রবেশ করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। এই সময় বালক প্রতাপের উচ্ছৃঙ্খলতায় বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় বড়ই বিপদে পড়লেন। অবশেষে উভয়ে পরামর্শ করে স্থির করলেন যে, বিবাহ দিলে প্রতাপের মতির পরিবর্তন হতে পারে। এই জন্য তারা উভয়ে উদ্যোগী হয়ে প্রতাপের বিবাহ দিলেন। ঘটকারিকায় প্রতাপের তিন বিবাহের কথা উল্লেখ আছে। সর্বপ্রথম প্রতাপের বিবাহ হয় পরমকুলীন, জগদানন্দ রায়ের (বসু) কন্যার সাথে। ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপ সম্মানিত অব্যল্য জিতামিত্র নাগের কন্যা শরৎকুমারীর সাথে মহাসমারোহে বিবাহ করেছিলেন। এই শরৎকুমারীই তাহার পাটরাণী বা প্রধান মহিষী ছিলেন। প্রতাপের তৃতীয় বিবাহ হয়েছিল প্রতাপের রাজা হবার অনেক পরে। বিবাহ হইল পরমাসুন্দরী, গুণবতী, প্রণয়িনী রূপে স্ত্রী পেলেন, কিন্তু তার ঔদ্ধত্য ও মৃগয়াভিযান কমিল না। বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় পূনরবার পরামর্শ কেও প্রাতাপকে রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য রাজধানী আগ্রায় পাঠায়। উদ্দেশ্য ছিল বাদশাহ আকবরের দরবারে যশোর রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে রাজবাড়ীর উপদ্রব দ্রবীভুত হবে এবং তার অনুপস্থিতিকালে ভ্রাতৃদ্বয় কিছুকাল নিশ্চিন্তে রাজ্য শাসন করতে পারবেন। ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে প্রতাপ সূর্যকান্ত ও শংকরের সহিত রাজা বসন্ত রায়ের পত্র নিয়ে আগ্রার দরবারে উপমীত হন। প্রতাপ পত্র নিয়ে টোডর মল্লের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তিনিই সুযোগমত প্রতাপকে বাদশাহের সহিত পরিচিত করিয়ে দেন। তিনি বাদশাহ আকবরকে প্রতাপের কথা খুব ভালভাবেই জানালেন। প্রতাপ সেখানে বিশাল ভারত সাম্রাজ্যের পরিচালনার বিষয়, বিভিন্ন বীর, বিশেষ করে রাজপুত বীরদেব কীর্তি কলা সন্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলেন। রাজধানী আগ্রায় তিনি প্রায় তিন বৎসর ছিলেন। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে টোডর মল্ল বঙ্গের জায়গীরদার দিগের বিদ্রোহ দমন করার জন্য বঙ্গে আগমন করেন এবং পরবর্তী বৎসর বঙ্গের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে অতি সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। টোডর মল্লের অনুপস্থিতিকালে প্রতাপ কৌশল অবলম্বন করে যশোর রাজ্যের সনদ নিজ হাতে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। প্রতাপ রাজধানীতে থাকার সময় তার পিতা ও পির্তব্য তার কাছে রাজস্ব পাঠাতেন। প্রতাপ দুই তিনবারের টাকা সরকারে জমা না দিয়ে আত্নসাৎ করেন। যথাসময়ে সরকার হতে রাজস্বের অনুসন্ধান করা হলে প্রতাপ বসন্ত রায়ের নামে দোষারোপ করেন। তার দোষে রাজস্ব রাজধানীতে পাঠানো হয় না। বঙ্গে বিদ্রোহের পর এ সংবাদ শুভসূচক বোধ হল না। বিক্রমাদিত্যের হাত হতে যশোর রাজ্য বিচ্যুত করার আদেশ হলে গুনগ্রাহী সম্রাট প্রতাপের প্রতি সুদৃষ্টি করেছিলেন এবং উদীয়মান যুবকের নামে যশোর রাজ্যের দ্বিতীয় সনদ লিখে দিয়েছিলেন। প্রতাপ সঞ্চিত অর্থ থেকে বাকী রাজস্ব পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। ১৫৬১ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।[৬] শ্রী হরি তার রাজ্যেকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ৮ ভাগের ৫ ভাগ প্রতাপাদিত্যকে এবং ৮ ভাগের ৩ ভাগ তার ভাই বসন্ত রায়কে প্রদান করেন।
বসন্ত রায় ভাই ছিলেন লক্ষীকান্ত (যিনি পরবর্তীকালে লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরী নামে পরিচিত হন)।যাকে তিনি প্রতিপালন করেন। তিনি তাকে প্রতাপের সাথে জমিদারি এবং প্রশাসনিক বিষয় শিক্ষা দেন।[৬] প্রতাপাদিত্য যশোরের প্রশাসনে যোগদান করেন এবং নিজেকে একজন যোগ্য শাসক হিসেবে প্রমাণ করেন। প্রতাপাদিত্যের অভিষেক কালে বারোভুঁইয়াদের অনেকে যশোর গিয়েছিলেন এবং প্রতাপাদিত্যের কাছে বঙ্গের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন। প্রতাপাদিত্য দেখছিলেন যে, সম্রাট আকবর আগ্রার রাজদরবার, রাজনীতি ও রাজপরিবারের আত্মকলহ- এসব বিষয়ে ব্যস্ত রয়েছেন এবং এর ফলে সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে। এই সুযোগে প্রতাপ সৈন্যগঠন ও সীমান্ত রক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। মূলত আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রাধান্য স্থাপন, পাঠানদের পক্ষ সমর্থন, বঙ্গদেশে হিন্দু শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মুঘল ছাড়াও মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের পাশবিক নির্যাতন থেকে প্রজাদের রক্ষা করার জন্য প্রতাপ চেষ্টা করছিলেন। এই লক্ষ্যেই তিনি নতুন রাজধানী গোছাচ্ছিলেন এবং মুঘলদের বিতাড়নের উপায় নিয়ে বঙ্গের অন্য ভুঁইয়াদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলেন। ভুঁইয়াদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতাপের এই বিদ্রোহী চেতনার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করলেও অনেকেই দূরত্ব বজায় রাখে।[৭] প্রতাপ রাজ্যের অধীশ্বর হবার পর রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেন। ১৫৮৩ সালে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর যশোর নগরের ৮/১০ মাইল দক্ষিণে যমুনা নদী ও ইছামতী নদীর সংগম স্থলে সুন্দরবন ঘেষে ধুমঘাট নামক স্থানে এক নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। তথায় প্রতাপাদিত্যের রাজাভিষেক সম্পন্ন হয়। ধুমঘাটের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে তীরকাটি জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। ধুমঘাটের দুর্গ নির্মাণের প্রধান ভার ছিল পাঠান সেনাপতি কমল খোজার উপর। প্রবাদ আছে যে, প্রতাপের রাজ্যভিষেক উৎসবে এক কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।রাজ্য বিভাজনের পরও বসন্ত রায় অনেক দিন রাজ্যের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।
বাংলার বার ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপাদিত্য সিংহাসনে আহরণ করেই সৈন্যবল বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। সুচতুর প্রতাপ প্রথম থেকেই মোঘলদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে থাকেন। তিনি মোঘলদের আহ্বানে সামন্তরাজ হিসাবে কয়েকবার যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। তিনি মোঘলদের সাথে যেসব যুদ্ধযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে মানসিংহের সাথে উড়িষ্যা অভিযান উল্লেখযোগ্য। উড়িষ্যা থেকে তিনি গোবিন্দ দেব বিগ্রহ এবং উৎকলেস্বর থেকে শিব লিংগ এনে গোপালপুর ও বেদকাশী নামক স্থানে স্থাপন করেন।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপাদিত্য নিজ হাতে রাজ্য শাসন শুরু করেন। ঐ বছরই ধুমঘাট দুর্গ নির্মাণ হয় । তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার মনস্থ করেন এবং মোঘলদের বিরুদ্ধাচারণ করতে শুরু করেন। পিতৃব্য বসন্ত রায় তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন এবং ভয়াবহ পরিণামের কথা বুঝায়ে দেন। প্রতাপ নিষেধ বাণীর উল্টো মর্ম বুঝে বসেন। পিতৃব্য ও ভ্রাতুষ্পুত্র একে অপরের প্রতি বিশ্বাস থাকল না। প্রতাপ সর্বদা বসন্ত রায়কে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন।
প্রতাপ কিছুদিন তার খুড়ার সাথে সদ্ভাব রক্ষা করে চলেছিলেন। বসন্ত রায় নানাবিধ সৎকার্য সাধন করে প্রজাদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। পিতৃব্যের এই সুনাম প্রতাপের মনে বিদ্বেষভাবের জন্ম দেয়। এক শ্রাদ্ধ উৎসবে নিমন্তণ পেয়ে প্রতাপ পিতৃব্যের বাড়িতে গমন করেন এবং সামান্য একটা কথায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তিন পুত্র সহ তাহাকে হত্যা করেন। এই হত্যাকান্ডের সময় বসন্ত রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র রাঘব রায় এক কচুবনে আত্মরক্ষা করেন বলে পরবর্তীকালে তিনি কচুরায় নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
কেউ কেউ বলেন যে, প্রতাপ ও তাহার জামাতা রামচন্দ্র রায়ের মধ্যে যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তার মূলে বসন্ত রায়ের কারসাজি ছিল। প্রতাপ শুধুমাত্র পিতৃব্যকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।[৮] এই ঘটনায় লক্ষীকান্ত অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং জমিদারি প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করে কালীঘাটে তার জন্মভূমিতে চলে যান।[৬][৮] কথিত আছে, প্রতাপাদিত্য সে সময় নিজ নামে মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রতাপাদিত্যের নিজ শাসিত রাজ্যও বহু বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপের ক্ষমতা ও খ্যাতি পুরো ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় সকলে বিশ্বাস করত, দ্বৈববল ছাড়া কেউ এমন বলশালী হতে পারে না।
পিতৃব্যের মৃত্যুর পর প্রতাপাদিত্য সমগ্র যশোর রাজ্যের অধিকার লাভ করেন এবং মহারাজ উপাধি ধারণ করে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। এই সময় বাংলা ও উড়িষ্যার মোঘল-পাঠান শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। প্রতাপ স্বভাবতই পাঠান শক্তির অনুকূলে ছিল। সেসময় তার মনে ভাটি বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্য সংস্থাপনের আশাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি প্রতাপ বাংলার মোঘল সুবেদারকে অমান্য করে রাজ্য শাসন করে যেতে লাগলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। প্রতাপাদিত্যের সমর সজ্জার উদ্দেশ্য বাংলার সুবাদারের কর্ণগোচর হলে তিনি পর্যায়ক্রমে শের খাঁ এবং ইব্রাহীম খাঁ নামক দুইজন মোঘল সেনাপতিকে প্রতাপের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তার প্রতাপকে সামান্য ভূস্বামী মনে করে যশোহরে আসলো। কিন্তু কোন কার্যকরী ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারল না। তার যশোহর বাহিনীর নিকট পরাজয় স্বীকার করে পশ্চাদপসরণ করল। প্রতাপাদিত্যের এই সকল বিজয় বার্তা চারদিকে ছড়ায় পড়লো। বিভিন্ন এলাকার ভূইয়াগণ তার সহিত মৈত্রী স্থাপন করে মোঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। পর পর দুবার মোঘল বাহিনীকে পরাজিত করে তার ধনলিপ্সা বেড়ে গেল। তিনি মোঘল শাসনাধীন সপ্তগ্রাম বন্দর লুট করে ধন সঞ্চয় করতে অগ্রসর হলেন। সপ্তগ্রামের ফৌজদার প্রতাপাদিত্যের অতর্কিত আক্রমণ রোধ করতে পারলেন না। ফলে সপ্তগ্রামের সমুদয় ধন সম্পদ প্রতাপাদিত্যের কুক্ষিগত হল। শ্রীপুর জমিদার বাড়ি শ্রীপুর উপজেলা সদরের ১ কি.মি. এর মধ্যে পাল রাজার রাজপ্রাসাদের ধ্বংশাবশেষ রয়েছে। এখানে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন পাল চৌধুরী। শ্রীপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা জমিদারীর আওতাধীন এলাকা ছিল। শ্রীপুর জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাসাদতুল্য মন কাড়ার মত দৃষ্টি নন্দন বাড়ি এখন বাড়ির প্রবেশদ্বার তথা সিংহদ্বার ভগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। জমিদারীর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় নবাব আলীবর্দ্দি খার নিকট হতে এ জমিদারী খরিদ করা হয়। বৈবাহিক সূত্রে বাংলার বারো ভূইয়ার অন্যতম যশোরের মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সংগে সারদারঞ্জন পাল চৌধুরীর সম্পর্ক ছিল। মহারাজা প্রতাপাদিত্যের ছেলে উদয়াদিত্যের সংগে জমিদার সারদারঞ্জন পাল চৌধুরীর মেয়ে বিভাপাল চৌধুরীর বিবাহ হয়েছিল। এ সূত্র ধরে মহারাজ প্রতাপাদিত্য শ্রীপুরে এসেছিলেন। আরো জনশ্রুতি আছে এ বিভাপাল চৌধুরীকে কেন্দ্র করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বৌঠাকুরানীর হাট' উপন্যাস রচনা করেন। বর্তমানে বাড়ীর প্রবেশদ্বার তথা সিংহদ্বার ভগ্ন অবস্থায় বিরাজমান।[৯]
মহারাজা প্রতাপাদিত্য রাজদন্ড গ্রহণ করে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ভাগে মগ ও পর্তূগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার দমনে মনোনিবেশ করেন। মগ ও ফিরিংদের অত্যাচারে ভারতের ভূস্বর্গ বঙ্গ দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হল। মগেরা কোন শাসন মানত না। মগেরা যে মুল্লুকে যেত সে এলাকাকে একেবারে ধ্বংস করে ছাড়ত। তৎকালে দক্ষিণ বঙ্গ জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা এদেশের নারী পুরুষ ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করতো। বন্দীদেরকে হাতের তালুতে ছিদ্র করে সরু বেত ঢুকিয়ে হালি করে জাহাজের পাটাতনের নিচে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো। ভাগীরথী থেকে সুদুর চট্টগ্রাম পর্যন্ত তারা এরুপ উপদ্রব চালাত। এসব জলদস্যুদের হার্মাদ বলা হত। প্রতাপাদিত্য এদের বশীভূত করেন। অনেকেই তার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিল।
এই সময় আগ্রার দরবারে নানারকম অশান্তি বিরাজ করছিল। বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর শাহজাদা সেলিম নুরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এইবার জাহাঙ্গীর দরবারে প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হলো। এই সময়ে বসন্ত রায়ের পুত্র কচু রায়ও সমগ্র কাহিনী বাদশাহের গোচরীভূত করল। সমুদয় অভিযোগ শুনে জাহাঙ্গীর তার সেনাপতি মানসিংহকে পাঠালেন প্রতাপাদিত্যকে দমনের জন্য।
১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহ কাশী থেকে রাজমহলে আসলেন এবং বঙ্গদেশকে প্রকৃতভাবে মুঘল করতলে আনার জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে যশোর অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রায় ২৫ বছর পাঠানরা বঙ্গে পরাজিত হলেও প্রতাপাদিত্য ও অন্যান্য ভূঁইয়াগণের কারণে সেই পরাজয়ে মোঘলদের কোন লাভ হয়নি।
মানসিংহের এ যাত্রা সম্পর্কে ভারতচন্দ্র বলেন
‘আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর। চললেন মানসিংহ যশোহর নগর।। মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া। কাছে কাছে অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া।’
মানসিংহ কালিন্দি নদী পাড় হয়ে বসন্তপুরে ছাউনি করলেন এবং দেখলেন, প্রতাপাদিত্য তার চারিদিকে সৈন্য সাজিয়ে যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন করে রেখেছেন। বসন্তপুর ও শীতলপুরের পূর্বভাগে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। হঠাৎ একদিন ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হয়ে মানসিংহের তামান রসদ ও ছাউনী বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেল। শুকনা জ্বালানী কাঠ ও খাদ্যের অভাবে সৈন্যদের ভীষণ অসুবিধা হলো। এই সময়ে আন্দুলিয়া নিবাসী ভবানন্দ মজুমদার নামক এক জমিদার রাজা মানসিংহকে সর্বপ্রকার সাহায্য দান করলেন। তারই সাহায্যে মানসিংহ ধুমঘাট আক্রমণ করতে সমর্থ হন।
অগণিত দিন ধরে এ যুদ্ধ সংঘটিত হলো এবং মানসিংহ বিজয়ী হয়ে প্রতাপাদিত্যকে বন্দি করেছিলেন। মানসিংহ প্রতাপকে চিনতেন এবং অত্যন্ত ভালোবাসতেন। উড়িষ্যাভিযানে প্রতাপের বীরত্বের কথা তার মনে ছিল। তিনি যশোর যুদ্ধে বঙ্গীয় বীরের অসাধারণ সমর কৌশলে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি নিজে মহাবীর, তাই বীরত্বের মর্যাদা বুঝতেন। যুদ্ধ শেষে জয়লাভ করলেও তিনি প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। প্রতাপাদিত্য যশোর রাজ্যের ১০ আনা অংশে (বাকি ৬ আনা বসন্ত রায়ের ছেলে কচু রায়) মুঘলদের সামন্ত রাজা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।মানসিংহ স্বাধীনতার চিহ্ন পতাকা ও মুদ্রা বিলুপ্ত করবার আদেশ দিয়েছিলেন।যদিও লক্ষীকান্তের উত্তর পুরুষরা দাবি করে যে রাজা মানসিংহ বসন্ত রায়কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। প্রতাপাদিত্য কে পরাজিত করার পর রাজা মান সিংহ তার গুরুপুত্র লক্ষীকান্ত এর সাথে দেখা করেন।[১০]
দিল্লির সম্রাট আকবর অনেকবার সেনাবাহিনী পঠিয়েছেন এই সকল বিদ্রোহ দমনের জন্য কিন্তু সুন্দরবন প্রতাপাদিত্যকে একটি ভালো অবস্থান দিয়েছিলো যার ফলে সে সহজেই সম্রাটের বিরোধিতা করতে পারতেন। তার এই বিদ্রোহ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলেছিলো। তবে এই বিদ্রোহ কোন সাধারণ যুদ্ধের মত ছিল না। এই বিষয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণের নিরবতা এটা প্রমাণ করে যে স্থানীয় বিরোধ মিটানোর জন্য আসলে সম্রাট খুব ছোট একটা সৈন্য দল পাঠিয়েছিলেন। চাঁচড়ার রাজপরিবারের নথি থেকে জানা যায়, খান আজিম নামে আকবরের একজন সেনাপতি প্রতাপাদিত্যের কিছু পরগনা দখলে নিতে পেরেছিলেন। যদিও প্রতাপাদিত্য সেই রাজ শক্তিকে অনেকবার হারিয়েছিলেন কিন্তু এতে করে তার ক্ষমতা ও প্রভাবও অনেক কমে গিয়েছিলো।[২] বিশাল রাজ্যের অধিকাংশই সুন্দরবনের অন্তর্গত ছিল। তাহার সময়ে যশোর রাজ্য বাঙ্গলার একটি প্রধান জনপদ হওয়ায় দুর্গম সুন্দরবন লোকের পক্ষে সুগম হয়ে উঠে। কিন্তু তখনও সুন্দরবনের নিবিড় অরণ্য সমভাবে বিদ্যমান থাকিয়া ব্যাঘ্র, গগুর, কুম্ভীরের আশ্রয়স্থানরূপে বিরাজ করিত। প্রতাপদিত্যের সময় যে সকল জেসুইট পাদরী এতদ্দেশে আগমন করিয়াছিলেন, র্তাহীদের বিবরণে সুন্দরবনের যে বর্ণনা দৃষ্ট হয়, তাহাতে তাহার নিবিড় অরণ্য ও বন্ত জস্তুর উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ও তার স্থাপিত গ্রাম, নগর, গড়, চত্বর প্রভৃতির চিহ্ন অদ্যাপি সুন্দরবনের মধ্যে বিদ্যমান থাকিয়া ষোড়শ শতাব্দীতে ইহা কিরূপ গৌরবময় হইয়াছিল তাহার পরিচয় প্রদান করিতেছে ।
সপ্তদশ শতাব্দী হইতে আবার ইহার জনপদসমূহ নিবিড় অরণ্যে পরিণত হইতে আরম্ভ হয়। যে কারণে সুন্দরষনের নিবিড় অরণ্য নিবিড়তম হয়, সাধারণতঃ তাহার দুইটি কারণ অনুমিত হয়ে থাকে। তাহার প্রথম কারণ জলপ্লাবন ও ভূমিকম্প এবং দ্বিতীয় কারণ মগ ও ফিরিঙ্গী জলদ্বস্বাগণের অত্যাচার। এই দুই কারণে ইহার অধিবাসিগণ ইহার মধ্যস্থ গ্রাম নগর পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হওরায় সুন্দরবনের সপ্তদশ শতাব্দী, আবার ধ্বংসারম্ভ ।[১১]
প্রতাপাদিত্য বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, রাজপুত, বাগদি, নমঃশূদ্র, পার্বত্য কুকী, আফগান বংশোদ্ভূত সৈনিক এবং ভাড়াটিয়া পর্তুগীজ সৈনিকদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তিনি উদয়াদিত্যকে সলকা দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব দেন। উদয়াদিত্যের সাথে ছিল জামাল খান নামে এক আফগান সেনাপতি। জামাল খান ছিলেন অশ্বারোহী এবং হস্তী বাহিনীর প্রধান। আর একজন আফগান ৫০০ নৌযানের একটি নৌবহর এর নেতৃত্ব দেন।
১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে কাররানী আফগানরা উড়িষ্যা জয় করে ও পুরী অঞ্চলে তাদের ডেরা বানায় । ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে মুঘলদের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর বিহারের কাররানী আফগানরা সিপাহসালার কাতলু খানের সাথে উড়িষ্যায় পালিয়ে যায় ও স্বাধীন আফগান রাজ্য সালতানাত-এ-উড়িষ্যাহ (سلطانا به اودیشا) প্রতিষ্ঠা করে । বলা বাহুল্য এই আফগান শাসনে উড়িষ্যাবাসী হিন্দুদিগের শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল । ইতঃপূর্বে পাঠানদের দ্বারা পুরী জগন্নাথ মন্দির ও বিগ্রহ বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এখন পাঠান সুলতানের হুকুমে মুশরিকদের ইবাদতস্থান এই জগন্নাথ মন্দির পুরোপুরিভাবে বন্ধ ও বার্ষিক জগন্নাথ রথযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ।
এই কঠিন অবস্থায় পুরী মন্দিরের একজন রক্ষক বিজয়রাম ভঞ্জ বাঙ্গালার স্বাধীন হিন্দুরাজ্য যশোরে আসেন ও মহারাজের কাছে জগন্নাথ মন্দিরের দুর্দশার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেন । প্রতিবেশী স্বধর্মীয়দিগের ওপর এই অত্যাচারের সংবাদে মহারাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন। আষাঢ়’র শুরুতেই উড়িষ্যা আক্রমনের জন্য নৌবাহিনী সঞ্চালন শুরু হতে থাকে, নৌসেনাপতি সূর্যকান্ত গুহরায় ও মদনমোহন মল্ল মিলে কোষা, মাচোয়া, বেপারি, জালিয়া ও সর্বাধিক বিধ্বংসক ঘুরাব ইত্যাদি বিভিন্ন দুর্দম বঙ্গদেশীয় নৌকাবাহিনী সজ্জিত করে উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন ।
এসময় উড়িষ্যায় শাসন করতেন ‘মসনদ-এ-আলা’ (علا در مسند) ঈশা খান লোহানী, যিনি মূর্তিপূজকদের ওপর অত্যাচারের জন্য অত্যন্ত কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন । যশোরের রাজার আক্রমনের খবর শুনে ঈশা খান উড়িষ্যার উত্তর সীমান্তে হিজলি বন্দরে সেনা সাজিয়ে রাখেন। আষাঢ়’র এক বৃষ্টিমুখর দিনে হিজলিতে ঈশা খানের সাথে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সম্মুখ সাক্ষাৎ হয় । সুবর্ণরেখা নদীর পশ্চিম তীরে পাঠান সেনার সাথে যশোর সেনার এক বিধ্বংসী নৌযুদ্ধ হয় । অপরাহ্নের সাথেই মহারাজ প্রতাপাদিত্য ঈশা খান কে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন ও ঈশা খান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করে ।
বিজয়ী রায়শ্রেষ্ঠ প্রতাপাদিত্য পুরীক্ষেত্রে প্রবেশ করেন ও দীর্ঘ ১৪ বছরের অচলাবস্থার পর পুনরায় জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদঘাটন ও নিত্যপূজাচর্চার সূচনা হয় । পুরীতে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপিত হয় ও উড়িষ্যা সালতানাত যশোর রাজ্যের অধীনে একটি সামন্তরাজ্যে পরিণত হয়, উড়িষ্যার শাহজাদা জামাল খান ও সিপাহসালার কামাল খান যশোর সেনায় সেনাপতিরূপে যোগদান করে ।[১২][১৩]
উড়িষ্যা জয়ের স্মারক হিসেবে পিতৃব্য বসন্তনারায়ণ রায়ের অনুরোধে প্রতাপাদিত্যে পুরী থেকে উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ ও গোবিন্দদেব বিগ্রহ আনয়ন করেন । যশোরের গোপালপুরে গোবিন্দদেব মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় ও বসন্ত রায়ের উদ্যোগে বেদকাশীতে মন্দির নির্মাণ করে উৎকলেশ্বর মূর্তি স্থাপিত হয় । বেদকাশীস্থিত উৎকলেশ্বর শিবমন্দিরের শিলালিপিতে উল্লিখিত রয়েছে –
“নিৰ্ম্মমে বিশ্বকর্ম্মা যৎ পদ্মযোনিপ্রতিষ্ঠিতম্।উৎকলেশ্বরসংজ্ঞঞ্চ শিবলিঙ্গমনুত্তমম্ ॥ প্রতাপাদিত্যভূপেনানীতমুৎ কলদেশতঃ । ততো বসন্তরায়েন স্থাপিতং সেবিতঞ্চ তৎ ॥”
উড়িষ্যায় পাঠানদের পরাজিত করার পর মহারাজ প্রতাপাদিত্যের আত্মবিশ্বাস ও সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যায়, উপরন্তু ভারত থেকে বিধর্মীয় শাসকদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বতন্ত্র ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে । অতঃপর তাঁর দৃষ্টি স্থিত হয় পশ্চিমের মুঘল সাম্রাজ্যের দিকে । ভারতবর্ষকে তিনি মুঘল শাসনের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প হন ।
পূর্ব ভারতে মুঘলদের বাণিজ্যের অন্যতম অর্থকরী কেন্দ্র ছিল সাতগাহ নৌবন্দর । প্রতাপাদিত্য এই বন্দর দখল করে মুঘলদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন, উপরন্তু সাতগাহর মতো ঐশ্চর্যশালী বন্দর যশোর রাজ্যের সমৃদ্ধির কারন হবে । সুতরাং ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে ৬৪ দাঁড়বিশিষ্ট ১০০টি ঘুরাব যুদ্ধনৌকা সহযোগে ও পর্তুগিজ সেনাপতি ফ্রান্সিসকো রডার বিধ্বংসী কামানবাহিনীর সাথে প্রতাপাদিত্য সাতগাহ আক্রমণ করেন ।
সাতগাহের মুঘল নবাব এই অতর্কিত আক্রমনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে মুঘল সেনা যশোর সৈন্যবাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু যশোরের দুর্মদ ঘুরাব নৌবাহিনীর আক্রমণ ও অগণিত গোলাবর্ষণে সকল মুঘলদের সলিলসমাধি ঘটে । প্রতাপাদিত্য সাতগাহ বিজয় করে এটিকে যশোর সাম্রাজ্যের প্রধান বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ।[১৫]
বঙ্গাধিপ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যের গৌরব দিন দিন সমগ্র ভারতবর্ষে বিস্তৃত হচ্ছিল। সাতগাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হারানো ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে এক বিশাল ক্ষতি । অতঃপর মুঘল বাদশাহ আকবর প্রতাপের ক্ষমতা নির্মূল করিবার জন্য আজিম খাঁ নামক অপর এক সিপাহসালারকে বহু রণনিপুণ সেনা সমভিব্যাহারে বাঙ্গালা আক্রমণে প্রেরণ করেন। আজিম নির্বিঘ্নে পাটনা ও রাজমহল অতিক্রম করিয়া আসিলেন, প্রতাপের পূর্ব নির্দেশমতে কেউ তাকে বাধা দিল না । পরিস্থিতি শান্ত বিবেচনা করে সিপাহসালার আজিম খান রায়গড়ের কাছে বাঙ্গালার শ্যামল প্রান্তরে শিবির খাটিয়ে নিরুদ্বেগে বিশ্রাম সুখ উপভোগ করতে থাকেন।
“সংবাদমশিবং শ্ৰুত্বা আকব্বরমহীপতিঃ । প্রেষয়ামাস সেনান্যমাজিমখানসংজ্ঞকং ॥ বিংশসহস্র সৈন্যানি ঘাতয়িত্বা ক্ষণং তদা । আজিমং পাতয়ামাস তীব্রাঘাতেন ভূতলে”
এই অবস্থায় নিশীথ রাত্রে প্রতাপাদিত্য সৈন্যবাহিনীসহ চতুৰ্দ্দিক হইতে ভীষণ বিক্রমে মোগল সেনা আক্রমণ করেন । এই আকস্মিক আক্রমণে মোগল সেনা বিধ্বস্ত হয়ে পরে । সমস্ত রাত্রি দুই পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয়। বহু মোগল সেনা বঙ্গীয় যোদ্ধাদের শাণিত কৃপাণের মুখে পড়ে খণ্ড খণ্ড হতে থাকে। এই ভীষণ যুদ্ধে আজিম খান ভূতলে পতিত হয়ে নিহত হয়, প্রায় বিশ হাজার মোগল সৈন্য নিহত ও বন্দী হয় এবং প্রচুর যুদ্ধোপযোগী বহুমুল্য দ্রব্যে প্রতাপের রাজকোষ পূর্ণ হয়।
রায়গড় যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সামরিক আধিপত্য সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়ে পরে, সমগ্র উপমহাদেশে রাষ্ট্র হয়ে যায় যে সমগ্র হিন্দুস্তানকে দাপটের মধ্যে রাখা মুঘল বাদশাহ বাঙ্গালার নৃপতির কাছে একের পর এক যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হচ্ছে । এদিকে বন্দি ২০০০০ মুঘল সেনাও যশোর বাহিনীতে যোগদান করে সাম্রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধি করে ।
এহেন অবস্থায় তিনি পূর্ব ভারতের মুঘল রাজধানী রাজমহল আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন । আসন্ন যুদ্ধের জন্য কূটনৈতিক পরিকল্পনা শুরু করেন বীর সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী । ৫০০০ অশ্বারোহী বাহিনী সুসংযত করেন সেনাপতি প্রতাপসিংহ দত্ত, এদিকে সেনাপতি কালীদাস ঢালী ২০০০০ ঢালী বাহিনী নির্মাণ করেন ।
অতঃপর প্রায় পঁচিশ হাজার যশোর সৈন্য নিয়ে মহারাজ প্রতাপাদিত্য রাজমহল আক্রমণ করেন । এসময় রাজমহলের মুঘল সুবেদার ছিলেন নবাব শের খান ।গঙ্গার তীরে রাজমহলে শের খাঁ’র নবাব বাহিনীর সাথে যশোর রাজসৈন্যের প্রবল যুদ্ধ হয় । অবশেষে নবাব সৈন্যের পরাজয় হয় ও শের খাঁ প্রাণভয়ে দিল্লি পালিয়ে যান । মহারাজ প্রতাপাদিত্যে রাজমহল জয় করে পূর্ব ভারতের মুঘল রাজধানীর পতন ঘটান এবং প্রায় দশ কোটি টঙ্কা ও প্রচুর ঐশ্চর্য (অর্থ) লাভ করে যশোরের শ্রীবৃদ্ধি করেন ।[১৭]
বসন্ত রায়ের মৃত্যুর পর সমগ্র যশোর রাজ্যের অধিকার পেয়ে প্রতাপাদিত্য প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠেন । যশোরের পন্ডিতগণ বলেন -
"যুগযুগ্মষু চন্দ্রেচ শকে হত্বা বসন্তকং । প্রতাপাদিত্যনামাসৌ জায়তে নৃপতির্মহান ।।"
মুঘল রাজধানী রাজমহল বিজয়ের পর পূর্ব ভারতে মুঘলদের একমাত্র দুর্গ ছিল সুবাহ-এ-বিহারের পাটনাতে (بیهار در سوبا)। পাটনার নবাব শেখ ইব্রাহিম খান সেলিম জানতেন রাজমহল জয়ের পর প্রতাপাদিত্য পাটনা দখলে আসবেন । বস্তুত প্রতাপের মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না, তবে তিনি সীমান্তে মুঘল সেনা প্রস্তুত রাখেন ।
এদিকে প্রতাপাদিত্য গঙ্গাপাড় করে বিহারে প্রবেশ করে দ্রুত উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকেন । পাটনার কাছে মোটালাগঢ় নামক স্থানে মুঘল সেনার সাথে যশোর সেনার যুদ্ধ হয় । আক্রমণাত্মক যশোর সৈন্যবাহিনী বিস্তৃত ত্রিমুখী সজ্জা গঠন করে, সর্দার শঙ্কর চক্রবর্ত্তীর পরিকল্পনা অনুসারে সম্মুখে ঢালী পদাতিক বাহিনীর আক্রমনের সাথে দুদিক থেকে সেনাপতি প্রতাপসিংহের ক্ষিপ্রগতি অশ্বারোহী বাহিনী মুঘলদের নিঃশেষ করে । এরকম বিধ্বংসী সাঁড়াশি আক্রমণে অধিকাংশ মুঘল সৈন্যই নিহত হয়, ইব্রাহিম খান পরাজয় স্বীকার করে ও তাকে বন্দি করা হয় । মহারাজ প্রতাপাদিত্য কিল্লা-এ-পাটনা (پاتنا در کیلا) বিজয় করেন ।[১৮]
বঙ্গদেশে প্রতাপাদিত্যর স্বাধীনতা ঘোষণা, স্বাধীন নৃপতি হিসেবে রাজ্যাভিষেক এবং একের পর এক দুর্গ জয় মুঘল সাম্রাজ্যের শেকড়ে কুঠারাঘাত করেছিল । ইতঃপূর্বে যশোর সৈন্যবাহিনীর কাছে একের পর এক যুদ্ধে আব্রাম খাঁ, শের খাঁ দের মতো মুঘল সেনাপতির পরাজয়ের পর মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরবে আঘাত লেগেছিল । তাই ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর যশোর রাজ্য দমনের জন্য সেনাপতি মান সিং র সাথে ২২ জন মুঘল ওমরাহ কে যুদ্ধে পাঠায় । মান সিং সহ বাইশ জন মুঘল ওমরাহ বিশাল সংখ্যক সেনা ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে যশোর আক্রমণ করতে আসে । যশোর আক্রমনের সময় কালিন্দী নদীর পূর্ব তীরে বসন্তপুর অঞ্চলে ছাউনি নির্মাণের সময় দেখেন প্রতাপাদিত্য তার চারিদিকে সৈন্য সাজিয়ে যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন করে রেখেছেন । বসন্তপুর-শীতলপুর অঞ্চলে যশোর বাহিনীর সাথে মুঘল বাহিনীর ভীষণ যুদ্ধ হয় । রণসজ্জিত যশোর বাহিনীর গেরিলা ডোঙ্গার আক্রমণে মুঘল বাহিনী কার্যত নাকানিচোবানি খায় । যুদ্ধে সেনাপতি সূর্যকান্ত গুহ প্রবল পরাক্রম দেখান। মুঘলদের বাইশজন ওমরাহর বারো জন প্রতাপাদিত্যর হাতে নিহত হয় এবং বাকি দশ জন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় । নিহত বারো জন ওমরাহ কে যশোরের ঈশ্বরীপুরের কাছে কবর দেওয়া হয়, সেই স্থান "বারো ওমরার গোর" নামে পরিচিত ।
প্রতাপাদিত্য র কুলাচার্যগণের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে বারো জন ওমরাহ একত্রে প্রতাপ কে আক্রমণ করে এবং সকলেই প্রাণ বিসর্জন দেয় ।
"বঙ্গধিপবধার্থায় প্রতিজ্ঞাঞ্চ চকায় সঃ । দ্বাবিংশতিতমখানান প্রেষয়ামাস সত্বরং ।।"
এমনই একদিন তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মোগলদের রসদ ছাউনি বারুদ সবই নষ্ট হয়ে যায় । অতঃপর বিশ্বাসঘাতক ভবানন্দের সাহায্যে কোনরকমে মান সিং প্রাণ বাঁচিয়ে পালায় । এর পর আর কোনোদিন প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করার সাহস করেন নি ।
"Maharaja Pratapaditya of Jessore having declared himself independent of the authorities of the Emperor of Delhi, the Emperor Jahangir successively sent 12 Omrahs with large armies to subdue him, but Pratapaditya defeated them all in battle." "[১৯][২০]
মোঘলরা ১০০০ অশ্বারোহী হয় এবং ৫০০০ বন্দুকধারীর এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করে। এই বাহিনীতে বেশ কিছু অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন যেমন, মির্জা মাক্কীহ, ইফতিকার খান, মির্জা সাইফুদ্দিন, শেখ ইসমাইল ফতেপুরী, সায়েক কয়সার এবং লাচ্মি রাজপুত। মুঘল পদাতিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুবাদার ইসলাম খানের ভ্রাতা গিয়াস খান ওরফে এনায়েত খান। একই সময় তার জামাতা বাকলার রাজা রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযান প্রেরণ করা হয় যাতে তিনি বাকলা থেকে যশোরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারেন। ১৬১১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুঘল বাহিনী ইছামতি এবং ভৈরব নদীর তীর ধরে যশোরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকে। দ্রুত তারা যমুনা এবং ইছামতি সঙ্গমস্থলে সলাকা নামক একটি স্থানে পৌঁছায়।[৩] মুঘল বাহিনীর সলকার দিকে অগ্রসর হলে উদিত্যনারায়ণ আচমকা তাদের উপর আক্রমণ করেন। মুঘল বাহিনী কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আফগান জামাল খান কে দুর্গের দায়িত্বে রেখে যান। যশোর বাহিনী মুঘল বাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করে। পরে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে যশোর বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। খাজা কামাল নিহত হন। উদিত্য নারায়ণ পলায়ন করেন। জামাল খান তার হস্তী বাহিনী নিয়ে উদিত্য নারায়ণ কে অনুসরণ করেন।[৩]
এরপর প্রতাপাদিত্যের বাহিনী মুঘল সেনাদের পেছোতে বাধ্য করে । প্রতাপাদিত্য মুঘলদের বিরুদ্ধে একটি বড় জয় পেয়েছিলেন ।এরপর তিনি মুঘলদেরকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন যাতে তাকে বাংলার ন্যায়সঙ্গত শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বলেন।[৩]
প্রতাপাদিত্য দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এবারের যুদ্ধক্ষেত্র খাগড়াঘাট খাল এবং যমুনার সংগম স্থান। জনুয়ারি, ১৬১২ সালে মুঘল বাহিনী যশোর বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং তাদের দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থান নিতে বাধ্য করে। যশোর বাহিনীর বিপুল গোলাবর্ষণের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীর অগ্রসরকে বাধা দেয়। কিন্তু এক অতর্কিত আক্রমণে মোগলবাহিনী দুর্গ দখল করে নেয়। প্রতাপাদিত্য বাধ্য হয়ে দুর্গের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে যান।[৩] দ্বিতীয়বারের মতো পরাজয়ের পর প্রতাপাদিত্যের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। রাজা মান সিং লক্ষ্মীকান্ত কে সিংহাসনে বসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।[৮] ভবানন্দ মজুমদার নামে প্রতাপাদিত্যের এক কর্মচারীকে সিংহাসনে বসানো হয়। পরবর্তীকালে তিনি নদীয়া রাজপরিবারের পত্তন করেন।[২১]
যুবক বয়সে প্রতাপাদিত্য উড়িষ্যায় যুদ্ধযাত্রা করে উড়িষ্যার একটি বিশাল অংশ জয় করেন । একজন দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা হওয়ায় প্রতাপ তাঁর যুদ্ধ প্রস্তুতি পরীক্ষা করার জন্য এই যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যায় তখন বিভিন্ন ছোট বড় শাসকরা নিজস্ব পরাক্রম দেখিয়ে আসছিলেন। প্রতাপ এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। নিজস্ব রাজ্যের শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব সুদক্ষ কর্মচারীদের বুঝিয়ে, অভিন্নহৃদয় বন্ধু শঙ্কর চক্রবর্তী ও সূর্যকান্ত গুহ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন উড়িষ্যা অভিমুখে। সঙ্গে চলল একদল রণদুর্মদ বাঙালি সৈন্য। এই যাত্রায় প্রতাপ মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা জনিত ত্রুটি গুলি খুঁটিয়ে দেখলেন, দানধ্যানের মাধ্যমে জয় করে নিলেন উৎকলবাসীর মন, সুমিষ্ট ব্যবহারে সুসম্পর্ক তৈরী করে নিলেন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিদ্রোহী পাঠানদের সঙ্গে যা ভবিষ্যতে তাঁকে বহু সাহায্য করেছিল। কিন্তু প্রতাপ চাইছিলেন একটি শক্তিশালী সম্মুখ যুদ্ধ। সুযোগ এসে গেল। পিতৃব্য বসন্ত রায় অনুরোধ পাঠালেন প্রতাপের কাছে–উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ এবং গোবিন্দদেব নামে শ্রীবিষ্ণুর কমনীয় মূর্তি নিয়ে আসার জন্য। মধ্য উড়িষ্যায় অবস্থিত এই মূর্তি দুটি নিয়ে চলে আসা সহজ কাজ ছিল না। তদুপরি এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সমগ্র উৎকলবাসীর ভাবাবেগ। যাইহোক বহু উৎকোচ দিয়ে পূজারীদের মাধ্যমে মুর্তিদুটি হস্তগত করে ফেললেন প্রতাপ। কিন্তু প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই স্থানীয় সমাজপতিদের আক্রমণের মধ্যে পড়ে গেলেন। যাই হোক এ আক্রমণ তার কাছে শুকনো পাতার মত উড়ে গেল। কিন্তু প্রতাপ বুঝলেন এত সহজে তিনি ছাড় পাবেন না। তাই আগেভাগেই সৈন্যবাহিনীকে তিনটি আলাদা দলে ভাগ করে নিয়ে শুরু করলেন বাংলা অভিমুখে পথ চলা। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই হল। সুবর্ণরেখা নদীর তীরে আক্রান্ত হলেন উড়িষ্যার বিভিন্ন ছোটবড় রাজাদের মিলিত বাহিনীর দ্বারা। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর হেরে গেল সেই মিলিত বাহিনী। বন্দী হলেন প্রধান উৎকলী সমরনায়করা। কৌশলী প্রতাপ বন্দীসেনানায়কদের যথোচিত সম্মান দেখিয়ে মুক্তি দিলেন, সঙ্গে দিলেন মিত্রতার স্মারক হিসেবে প্রচুর উপহার। উৎকলী সামন্তরাজাদের জড়িয়ে নিলেন বন্ধুত্বের বাঁধনে। সাথে উড়িষ্যার একটি বিশাল অংশ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল ।
রাজা প্রতাপাদিত্য একজন যোগ্য প্রশাসক ছিলেন। তার সময় দেশে আইনের শাসন বজায় ছিল।
কবি ভারত চন্দ্র লিখেছিলেন-
‘যশোর নগর ধাম প্রতাপ আদিত্য নাম মহারাজা বঙ্গজ কায়সত্ম নাহি মানে পাতশায়, কেহ নাহি আটে তায় ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ বরপুত্র ভবানীর প্রিয়তম পৃথিবীর বায়ান্ন হাজার যার পল্লী ষোড়শ হলকা হাতি অযুত তুরঙ্গ সাতি যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।’
প্রতাপাদিত্যের আমীর ওমরাহগনের মধ্যে সূর্যকান্ত ও শঙ্কর প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। সুপন্ডিত, ধীরস্থির কর্তব্যকাসার এবং ব্রাহ্মনোচিত প্রতিভা সম্পন্ন শঙ্কর চক্রবর্তী রাজস্ব ও রাজ্য শাসনের ব্যাপারে পরিদর্শন করতেন। মহাযোদ্ধা, অসমসাহসী, সবশাস্ত্র বিশারদ এবং লোক পরিচালনে অদ্বিতীয়, ক্ষমতাশালী সূর্যকান্ত রাজত্বের প্রথম ভাগে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তিনি সৈন্য রক্ষণ, যুদ্ধব্যবস্থা ও বলসঞ্চয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। শঙ্কর দেওয়ান ও মন্ত্রণা বিভাগের কর্তা এবং সূর্যকান্ত সৈন্যবিভাগের অধ্যক্ষ।
এক সময় প্রতাপাদিত্যের রাজ্য আরাকানের সীমানা থেকে উত্তর কলিঙ্গ অবধি ছিলো।প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের মধ্যে বৃহত্তর ২৪ পরগনা, যশোর এবং খুলনা ছিল। বর্তমান কুষ্টিয়া, বরিশাল এবং ভোলাও তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২২] প্রথম পর্যায়ে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল মুকুন্দপুর অঞ্চলে। পরবর্তীকালে ধুমঘাটে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন তিনি। পরে ধুমঘাটেরই নাম হয় যশোহর। প্রতাপাদিত্য পাটনার যুদ্ধ ও রাজমহলের যুদ্ধে মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করে পাটনা, রাজমহল, থেকে বলেশ্বর ও সন্দ্বীপ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন ।
প্রধান নিবন্ধ: যশোরেশ্বরী কালী মন্দির
যশোরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা ছিলেন যশোরেশ্বরী । জনপ্রিয় কিংবদন্তীর মতে, এক সকালে রাজপরিবারের একজন সাধারণ কর্মকর্তা, কাছাকাছি একটি বন থেকে আলোকিত আলো আবিষ্কার করেছিলেন। যখন তাকে অবহিত করা হল, তখন তিনি আলোর উৎস অনুসন্ধানে যান। জঙ্গলের ভিতর গভীরে তিনি মা কালীর একটি মূর্তি খুঁজে পেয়েছিলেন, যা আলো নির্গত করছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে এটি পৃষ্ঠপোষক দেবতার মূর্তি, তার রাজ্য ও তার জনগণের রক্ষাকর্তা। তাই তিনি মূর্তিটি তার রাজধানীতে নিয়ে এসে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যাতে সে উপাসনা করতে পারে।[২৩]
সমগ্র বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যা একত্রে বৃহৎবঙ্গজুড়ে রায়শ্রেষ্ঠ প্রতাপাদিত্যের যশোর সাম্রাজ্যের বিস্তার হয় । সমগ্র পূর্বভারতে হিন্দু সাম্রাজ্যের গৌরবের মঙ্গলময় শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। বিহার জয়ের স্মারক হিসেবে সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্ত্তী মিথিলার দ্বারভাঙ্গা প্রদেশের হায়াঘাটে জগজ্জননী ভগবতী মন্দির স্থাপন করেন । মহারাজ প্রতাপাদিত্য পূণ্যক্ষেত্র কাশীধামে নির্মাণ করেন বিখ্যাত চৌষট্টি ঘাট ও চৌষট্টি যোগিনী কালীমন্দির ।
প্রতাপ রাজনীতি বিশারদ ছিলেন। প্রতাপের রাজত্বকালে তিনি প্রয়োজন বুঝে নানা স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। প্রতাপের দুর্গসমূহ পশ্চিমে হুগলী নদী থেকে পূর্বে বালেশ্বর নদী পর্যন্ত এলাকা জুড়ে ছিল। কিছু কিছু দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়।তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৪ টি দুর্গ ছিল যশোর, ধুমঘাট, রায়গর ,কমলাপুর, বেদকাশি, শিবসা, প্রতাপনগর, শালিখা, মাতলা, হায়দার গড়, আড়াই কাকি, মানি, রায়মঙ্গল এ অবস্থিত ছিল। সাতটি দুর্গ ছিল বর্তমান কলকাতায় অবস্থিত। স্থানগুলো হল, মাতলা, রায়গর, তালা, বেহালা, শালিকা, চিৎপুর এবং মুলাগড়।
বাংলাদেশের খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার ৬ নং উত্তরবেদকাশি ইউনিয়নের বড়বাড়ি গ্রামে রাজা প্রতাপাদিত্যের দূর্গের সুউচ্চ ভিটা, লাখ লাখ ছোট ইটের তৈরি চওড়া দেওয়াল মাটি খুড়লে এখনো দেখতে পাওয়া যায়।শিব মন্দিরের কিছু দুষ্প্রাপ্য প্রস্তরখন্ড আজও দেখা যায়।তবে তা অবহেলায় বাড়ির বাহিরে পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীতে নয়টি ভাগ ছিল। প্রধান সেনাপতির অধীন এর প্রত্যেক বিভাগে পৃথক পৃথক সেনানী ছিল। সেনাবাহিনীতে ঢালি বা পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী সৈন্য, তীরন্দাজ সৈন্য, গোলন্দাজ সৈন্য, নৌ সৈন্য, গুপ্ত সৈন্য, রক্ষী সৈন্য, হস্তী সৈন্য, পার্বত, কুকী সৈন্য, এই নয় বিভাগে বিভক্ত ছিল। যুদ্ধে ঢাল, তলোয়ার, শড়কী, বল্লম, লেজা, কামান, বন্দুক, বর্শা, তীর প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্র ব্যবহৃত হতো। প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন দুজন ব্রাহ্মণ শঙ্কর চক্রবর্তী এবং রুদ্রাদিত্য ভট্টাচার্য। প্রতাপের গোলন্দাজ বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন ফ্রান্সিসকো রড়া। নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন সূর্যকান্ত গুহরায় ও অগষ্টাস পেড্রো। সুখা নামক এক দুঃসাহসী বীর গুপ্ত বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন রত্নেশ্বর বা যজ্ঞেশ্বর নয়, বিজয়রাম ভক্তচৌধুরী প্রমুখ। হস্তী সৈন্য বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন জামাল খান লোহানী। পদাতিক বাহিনী প্রধানের নাম ছিল কালিদাস রায় এবং মদনমোহন মল্ল।
ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতে লিখিত আছে যে, সে সময়ে তাঁহার বায়ান্ন হাজার ঢালী, একান্ন হাজার তীরন্দাজ, বহুসংখ্যক অশ্বারোহী, বহুযূথ হস্তী, অসংখ্য মুদ্গরধারী সৈন্য ছিল।
“যস্য দ্বারি দ্বাপঞ্চাশৎসহস্রচর্ম্মিণঃ একপঞ্চাশৎসহস্রধন্বিনঃ অশ্বারোহা অপি বহুবঃ মত্তহস্তিনাং বহুযুথাঃ সন্তি অন্যে চাসংখ্যা মুদ্গরপ্রাসাদিহস্তাঃ।”
ভারতচন্দ্র এর লেখা 'অন্নদামঙ্গল' কাব্য অনুসারে প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীতে ৫২০০০ ঢালী ছিল। অনেক কুকি সৈন্য ছিল। তাদের সেনাপতির নাম ছিল রঘু। অশ্বারোহী বাহিনীতে ১০ হাজার সৈন্য ছিল। যাদের সেনাপতি ছিলেন প্রতাপ সিংহ দত্ত। মহিউদ্দিন এবং নুরুল্লা ছিলেন তার সহকারী। তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুন্দর এবং ধুলিয়ান বেগ। জয়পুর বংশাবলীচরিত অনুসারে ১৬০০ হাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও দুর্ধর্ষ বীর সুখার নেতৃত্বে প্রতাপাদিত্যের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী ছিল।
প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য ছিলেন বাঙ্গালী কায়স্থ, ব্রাহ্মণ রাজপুত, ঢালী, বাগদি, রাজবংশী, আগুড়ি, পার্বত্য কুকী, পর্তুগিজ সৈন্য এবং আফগান মুসলমান। বহু সংখ্যক আরকানিজ এবং কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত সৈন্য তার বাহিনীতে ছিল। তার বাহিনীর সেনাপতিদের মধ্যে ছিলেন উড়িষ্যার সুলতান ওসমান খানের শাহজাদা জামাল খান এবং সিপাহসালার কামাল খান, এরা সবাই আফগান মুসলমান ছিলেন, কামাল খান পরবর্তীকালে কালীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কমলদাস নাম গ্রহণ করে । প্রধান সেনাপতি ছিলেন দুজন বাঙালি ব্রাহ্মণ যাদের নাম ছিল শঙ্কর চক্রবর্তী এবং রুদ্রাদিত্য ভট্টাচার্য। রুদ্রাদিত্য ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী বৈশাখী দেবীর স্বামী ।
প্রতাপাদিত্যের নৌবাহিনী তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী ছিল । তাঁর নৌবাহিনী এতই শক্তিশালী ছিল যে তিনি মুঘলদের সম্মুখ নৌযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন:
"খরার দেশের সেনা, এবার জলার দেশে আয়"
নদীমাতৃক বঙ্গদেশে বিভিন্ন দুর্ধর্ষ নৌযুদ্ধে প্রতাপাদিত্য অজেয় হয়ে উঠেছিলেন । বাংলার উপকণ্ঠে পর্তুগীজ জলদস্যু এবং আরাকান জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বাংলার কোন শাসকই একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেননি। বারো ভূঁইয়াদের সবারই নিজস্ব নৌ বাহিনী ছিল। অধ্যাপক রাধা কুমুদ মুখার্জি এর পর্যালোচনায়,
তৎকালীন সময়ে বাংলার হিন্দুরা যাদের মূল নৌঘাঁটি অবস্থিত ছিল চান্দিখান এবং সাগরদ্বীপে। এ দুটি নৌঘাঁটি দুর্ধর্ষ রাজা প্রতাপাদিত্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অনেক যুদ্ধজাহাজ সর্বদা যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় থাকত। এছাড়াও আরও তিনটি স্থানে প্রতাপাদিত্যের শিপ ইয়ার্ড এবং ডকইয়ার্ড ছিল। সেই স্থানগুলি হল ধুবালি, জাহাজঘাটা, এবং চাকরাশি। সেখানে যুদ্ধ জাহাজ মেরামত এবং সংরক্ষণ করা হতো।
যুদ্ধ জাহাজগুলো সাধারনত সুন্দরবনের কাঠ দ্বারা নির্মিত হত। কিছু কিছু জাহাজে ৬৪টি দাড় থাকত। এসকল নৌযানের বেশিরভাগই কামান দ্বারা সজ্জিত থাকত। ওলান্দাজ ঐতিহাসিক জস গমানসের মতে সে সময় মুঘলদের নৌযানের সংখ্যা ছিল ৫০০টি। তখন রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌযানে সংখ্যা ছিল তার প্রায় দ্বিগুণ।[২৪] প্রতাপাদিত্যের নৌ-বাহিনী প্রথমে বাঙালি সেনাপতিদের অধীনে থাকলেও পরবর্তীকালে পর্তুগিজ সেনাপতিদের হাতে এর নেতৃত্ব প্রদান করা হয়েছিল।প্রতাপাদিত্য নিম্নবঙ্গ ও সুন্দরবন অঞ্চলে নদীনালা ও খাল বিলের কথা বিবেচনা করে নৌশক্তি ও নৌবাহিনীর দিকে মনোনিবেশ করেন। দেশে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংস্থান, নদীর অবস্থা ও উপকূলের প্রকৃতি বিচার করে কাতরী নির্মাণ করেন। প্রতাপ বাহিনীর ব্যবহৃত দ্রুতগামী নৌকা সমূহের মধ্যে ছিল - ঘুরাব, বেপারী, কোশা, বলিয়া, পাল, মাচোয়া, পশতা, জালিয়া, পিয়ারা, মহলগিরি প্রভৃতি। এই সকল নৌকাসমূহের মধ্যে ঘুরাব সবচেয়ে শক্ত ও শক্তিশালী। তার সময়ে যশোরের কারিগরগণ জাহাজ নির্মাণে বিশেষত্বলাভ করেছিল। তৎকালে শায়েস্তা খাঁ যশোর হতে অনেক জাহাজ প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। প্রতাপাদিত্যের উৎকৃষ্ট কাতরীর সংখ্যা সহস্রাধিক ছিল। ইসলাম খাঁর নবাবী আমলে আব্দুল লতীফ নামে একজন ভ্রমণকারীর বিবরন হতে জানা যায়, “প্রতাপাদিত্য বঙ্গদেশের শক্তিশালী রাজা। তাঁর যুদ্ধসামগ্রীতে পূর্ণ সাতশত নৌকা এবং বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য ছিল এবং তার রাজ্যের আয় পনের লক্ষ টাকা।” কালীগঞ্জ - শ্যামনগর সড়কের পূর্ব পার্শ্বে মৌতলার নিকট তার জাহাজ ঘাটা কুআর বন নামক স্থানে জাহাজের পোতাশ্রয় ছিল। নিকটবর্তী দুদলিয়া গ্রামে ছিল তার কাতরী নির্মাণের ডক। জাহাজঘাটার নৌবিভাগের সর্বাধ্যক্ষ ফ্রেডারিক ডুডলির নামে একটি গ্রাম আছে। ডকের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন খাজা আব্দুল্লাহ এবং নৌসেনার অধ্যক্ষ ছিলেন অগাষ্টস পেড্রো।
খাগড়াঘাট যুদ্ধের পর মুঘলরা এক সন্ধি প্রস্তাব করে। মুঘলরা এই বিপুল যুদ্ধে জয়লাভ করলেও উভয় পক্ষের সেনারা ক্লান্ত এবং অবসন্ন ছিল। চুক্তিতে প্রতাপাদিত্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।[৪] প্রতাপাদিত্য গিয়াস খানের নিকট পরাজিত হবার পর তাকে শৃঙ্খলিত করে গিয়াস খান নিজে ইসলাম খানের দরবারে হাজির করেন। ঢাকায় তাকে আটক করে রাখা হয়।[৩] প্রতাপাদিত্যের জীবনের শেষ দিনগুলি সম্পর্কে খুব ভালো কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি। কিছু মুঘল দলিলে পাওয়া যায় যে তাকে বন্দি অবস্থায় দিল্লি নেয়ার পথে তিনি বেনারস থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাংলায় ফেরার পথে তিনি মারা যান।[৩] তেজস্বিতা, ধর্মনিষ্ঠা ও স্বাধীনতা স্থাপনের চেষ্টা প্রতাপকে এ অঞ্চলের লোকদের নিকটই শুধু নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের কাছে অমর করে রেখেছে।
গুরম্নদেব রামদাস স্বামী তাই লিখেছেন-
বলিলে যে বঙ্গদেশী প্রতাপের কথা, শুন গুরম্নত্ব তার। তেজোবীর্য্যগুণে প্রতাপ প্রস্ত্তত ছিলো স্বাধীনতা লাভে, কিন্তু তা’র জাতি, দেশ না ছিল প্রস্তুত; জ্ঞাতিবন্ধু বহু তা’র ছিল প্রতিকূল, তাই হল ব্যর্থ চেষ্টা। মূঢ় সেই নর, দেশ, কাল , পাত্র মনে না করি’ বিচার, একা যে ছুটিতে চায়; চরণস্খলনে নাহি রহে কেহ ধরি’ উঠাইতে তারে।।[২]
১৫৫৬-১৬০৫ বাদশাহ আকবরের রাজত্ব।
১৫৬৩-১৫৭২ সুলেমান কররাণী বঙ্গের শাসনকর্তা।
১৫৬০-৬১ গৌড়ে প্রতাপাদিত্যের জন্ম।
১৫৭২-৭৬ দায়ুদ খাঁ রাজা ছিলেন।
১৫৭৬, আকমহল যুদ্ধ ও দায়ুদের মৃত্যু।
১৫৭৪ যশোর-রাজ্যের প্রতিষ্ঠা।
১৫৭৫, গৌড়ের ধ্বংস।
১৫৭৭ যশোর রাজ্যের প্রথম সনদ ও বিক্রমাদিত্যের রাজত্ব শুরু।
১৫৭৬-৭৯ হোসেনকুলি খাঁ বঙ্গের মোগল সুবাদার।
১৫৭৮ প্রতাপাদিত্যের আগ্রা গমন।
১৫৭৭-৭৯, টোডরমল সাম্রাজ্যের উজীর
১৫৮০ বঙ্গে জায়গীরদারদের বিদ্রোহ।
১৫৮০-৮২ টোডরমল বঙ্গের সুবাদার।
১৫৮২, রাজস্বের হিসাব প্রস্ত্তত।
১৫৮২ যশোর-রাজ্যের সনদ নিয়ে প্রতাপাদিত্যের প্রত্যাগমন।
১৫৮২-৮৪ খাঁ আজম বঙ্গের সুবাদার।
১৫৮৩ বিক্রমাদিত্যের মত্যু।
১৫৮৪ প্রতাপের রাজ্যাভিষেক।
১৫৮৪-৮৭ শাহবাজ খাঁ বঙ্গের সুবাদার।
১৫৮৭ ধুমঘাটে দুর্গ নির্মাণ, যশোরেশবরীর আবির্ভাব ও উদয়াদিত্যের জন্ম।
১৫৮৯-৯৮ মানসিংহ বঙ্গের সুবাদার।
১৫৯৫ রাজমহলে রাজধানী।
১৫৯২-৯৩ প্রতাপাদিত্যের উড়িষ্যাভিযান ও গোবিন্দদেব বিগ্রহাদি নিয়ে প্রত্যাগমন।
১৫৯৫ বসমত্মরায় ও গোবিন্দ রায়ের হত্যা এবং হিজলী বিজয়।
১৫৯৬ বাকলার কন্দর্পনারায়ণের সহিত প্রতাপাদিত্যের সন্ধি, হোসেনপুরের যুদ্ধে পাঠানের পরাজয় এবং কন্দর্পের মত্যু।
১৫৯৮-৯৯ মানসিংহের দাক্ষিণাত্য গমন। জগৎসিংহের মৃত্যু, বালক মহাসিংহ বঙ্গের সুবাদার।
১৫৯৯ প্রতাপাদিত্যের স্বাধীনতা ঘোষণা। খৃষ্টান পাদরীগণের আগমন। বঙ্গের প্রথম গির্জা নির্মাণ। মানসিংহের প্রত্যাগমন ও শেরপুরের যুদ্ধে ওসমানের
পরাজয়।
১৬০০ মানসিংহ আগ্রায় গিয়ে সাত-হাজারী মনসবদার হন এবং বহুসৈন্য নিয়ে রাজমহলে আসেন।
১৬০২ রামচন্দ্রের সাথে প্রতাপ-কন্যার বিবাহ ও রামচন্দ্রের পলায়ন।কার্ভালো কর্তৃক সন্দ্বীপ অধিকার এবং দ্বিতীয় যুদ্ধে আরাকান রাজ্যের পরাজয়।
১৬০৩-০৪ মানসিংহের যশোহর আক্রমণ, প্রতাপের সাথে যুদ্ধ ও সন্ধি। কেদার রায়ের হসেত্ম মোগল সেনানী মান্দারায় ও কিলমকের পরাজয়। মানসিংহের
শ্রীপুর যাত্রা। কেদারের পরাজয় ও হত্যা। সুবাদারী ত্যাগ করে মানসিংহের আগ্রায় প্রত্যাগমন।
১৬০৫ আকবরের মৃত্যু ও জাহাঙ্গীরের সিংহাসন আরোহণ।
১৬০৫-০৬ আটমাসের জন্য মানসিংহ বঙ্গে পুনঃপ্রেরিত হন।
১৬০৬-০৭ কুতবউদ্দীন বঙ্গের সুবাদার।
১৬০৭-০৮ জাহাঙ্গীর কুলি খাঁ বঙ্গের সুবাদার।
১৬০৮-১৩ ইসলাম খাঁ বঙ্গের সুবাদার।
১৬০৮ প্রতাপাদিত্যের সাথে ইসলাম খাঁর বজ্রপুরে সাক্ষাৎ ও সন্ধি।
১৬০৯ ঢাকায় রাজধানী স্থাপন।
১৬০৯-১০ মোগল সেনানী ইনায়েৎ খাঁ ও মীর্জা নাথন প্রতাপের বিরম্নদ্ধে প্রেরিত হন। সালিখার যুদ্ধে উদয়াদিত্যের পরাজয় ও খোজা কমলের মৃত্যু। ধুমঘাটের
নৌ-যুদ্ধে প্রতাপের পরাজয় ও ঢাকায় গমন।
১৬১০-১১ ঢাকায় বন্দী থাকবার কিছুদিন পরে প্রতাপ পিঞ্জরাবদ্ধ হয়ে আগ্রায় প্রেরিত হন। পথে বারাণসীতে মত্যু। বয়স ৫০ বছর।[২]