প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র (যেটি শুধু প্রতিফলক নামেও অভিহিত হয়) বিশেষ এক প্রকার দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এটি আলোক প্রতিফলক একটি বক্র আয়না, কিংবা একাধিক বক্র আয়নার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। আলোর প্রতিফলন ব্যবহার করে এটি প্রতিবিম্ব তৈরি করে। আইজ্যাক নিউটন এর উদ্ভাবক ছিলেন। এটি প্রতিসরক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবিত হয়। বিচ্ছুরণের কারণে প্রতিসরক দূরবীক্ষণ যন্ত্র আলোকরশ্মিগুলোর বিভিন্ন বর্ণের একই বিন্দুতে অধিশ্রয়ণ বা ফোকাস করতে ব্যর্থ হয়। প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য ছিল এই ত্রুটি দূরীভূত করা। প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রেও ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়, তবে এর নকশায় বড় আকৃতির অবজেক্টিভ থাকায় অতিরিক্ত ভুল-ত্রুটি সহজেই পরিহার করা সম্ভব হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহৃত অধিকাংশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রই প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র। প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রে প্রায়ই অতিরিক্ত আলোকীয় উপাদান যোগ করা হয়। এর ফলে আরো সুবিধাজনক অবস্থানে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় ; অনেক সময় এর ফলে প্রতিবিম্ব আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেহেতু প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রে আয়না ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে "ক্যাটোপরিক" বা আয়না ব্যবহারকারী দূরবীক্ষণ যন্ত্র অভিহিত করা হয়।
নিউটনের সময়কাল থেকে ১৮০০ শতকে এ ধরনের দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আয়না ধাতু দিয়ে তৈরি করা হতো। ধাতব আয়না নিউটনের প্রথম প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহত্তম প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র "লেভিয়াথান অব পার্সনসটাউন" ১.৮ মিটার প্রশস্ত ধাতব আয়না দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে পাতলা রূপার স্তরের প্রলেপযুক্ত কাচ ব্যবহার করে প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রে আয়না ব্যবহার করা শুরু হয়। ১৮৭৮ সালে প্যারিস মানমন্দিরে ১.২ মিটার চওড়া "এ.এ.কমন্স" আয়না ব্যবহার করা হয়। ক্রসলি ও হার্ভার্ড প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র এই আয়না অবলম্বনে উন্নতমানের আয়না প্রস্তুত করা হয়। ধাতব আয়নার ব্যবহার অত্যন্ত সমালোচিত ছিল। কাচের আয়নার ব্যবহার পুনরায় প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সুনাম অর্জনে সাহায্য করে। ধাতব আয়না আলোকরশ্মির দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিফলিত করতে পারত ; অর্থাৎ আপতিত আলোকরশ্মির এক-তৃতীয়াংশই অপচয় হয়ে যেত। আবার ব্যবহৃত ধাতুও একটা সময় ক্ষয়ে যেত। এই ধাতুক্ষয় রোধে ব্যবস্থা নিলে দেখা যেত, প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র ঠিকমত বিম্ব গঠন করতে পারত না।
হাবলের মহাশূন্য পর্যবেক্ষণ দূরবীক্ষণ যন্ত্র এক প্রকার প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র। দৃশ্যমান আলোর পরিধির বাইরে কাজ করতে সক্ষম, এমন প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র-ও নির্মাণ করা হয়েছে। রঞ্জন রশ্মি প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আলহাজেনের একাদশ শতাব্দীতে রচিত পুস্তক থেকে সর্বপ্রথম ধারণা পাওয়া যায়, বক্র বা গোলীয় আয়না লেন্সের মত কাচ করে। পরবর্তীতে তার লেখা লাতিন ভাষায় অনূূদিত হয়। [১] প্রতিসরক দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর জিওভান্নি ফ্রান্সেসকো সাগরেদো, গ্যালিলিও-সহ অনেকেই আয়নাকে "অবজেক্টিভ" হিসেবে ব্যবহার করে দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরির প্রস্তাব দেন। [১] ১৬২৬ সালে বোলোনিয়ার অধিবাসী সিজার কারাভাজ্জি এ ধরনের একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন। পরবর্তীতে ইতালীয় অধ্যাপক নিকোলো জুচ্চি ১৬১৬ সালে পিতলনির্মিত উত্তল আয়না ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন। তিনি এ-ও বলেন, আয়নাটি সন্তোষজনক প্রতিবিম্ব সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়।১৬৬৩ সালে জেমস গ্রেগরি প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নকশা তৈরি করেন। পরবর্তীতে রবার্ট হুক এই নকশা অবলম্বনে "গ্রেগরীয় দূরবীক্ষণ যন্ত্র" নির্মিত হয়। [২][৩]
তবে আইজ্যাক নিউটন-ই ১৬৬৮ সালে প্রথম প্রকৃত দূরবীক্ষণ প্রতিফলক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।[৪]