প্রবাহী বলবিজ্ঞান হল পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা, যেটি প্রবাহীগুলির (তরল, গ্যাস, এবং প্লাজমা) বলবিজ্ঞান এবং তাদের উপর বলের সম্পর্কিত শাখা।[১]:৩ বিভিন্ন শাখায় এর প্রভূত প্রয়োগ রয়েছে, সেগুলির মধ্যে আছে যন্ত্র, পুর, রসায়ন ও জৈবচিকিৎসা প্রকৌশল এবং ভূপ্রকৃতিবিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান, এবং জীববিজ্ঞান।
এটিকে প্রবাহী স্থিতিবিজ্ঞান এবং প্রবাহী গতিবিজ্ঞান এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, এর মধ্যে প্রথমটি স্থিতাবস্থায়, এবং দ্বিতীয়টি গতিশীল অবস্থায় প্রবাহীগুলির ওপর বলের প্রভাব সম্পর্কে অধ্যয়ন।[১]:৩ এটি ধারাবাহিক বলবিজ্ঞানর এমন একটি শাখা, যেখানে পদার্থ যে পরমাণু দিয়ে তৈরি সেই তথ্যটি ব্যবহার না করেই পদার্থের প্রতিরূপ করা হয়; অর্থাৎ, এখানে কোন মাইক্রোস্কোপিক (অণুবীক্ষণিক) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়না, বরঞ্চ ম্যাক্রোস্কোপিক (বড় আকার সম্পর্কিত) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। প্রবাহী বলবিজ্ঞান, বিশেষত প্রবাহী গতিবিজ্ঞান, সাধারণত জটিল গণিতের গবেষণার একটি সক্রিয় ক্ষেত্র। অনেকগুলি সমস্যা আংশিক বা সম্পূর্ণ অমীমাংসিত থাকে এবং সাধারণত কম্পিউটার ব্যবহার করে সাংখ্যিক বিশ্লেষণের দ্বারা সবচেয়ে ভাল সমাধান করা যায়। একটি আধুনিক বিভাগ, যাকে গণনামূলক প্রবাহী গতিবিজ্ঞান (সিএফডি) বলা হয়, সেটি এই পদ্ধতির প্রতি নিবেদিত।[২] কণা চিত্র বেগ-মাপন, যেটি প্রবাহীটির ধারার দৃশ্যায়ন এবং বিশ্লেষণের জন্য একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি, প্রবাহীর ধারার উচ্চমাত্রায় দৃশ্যমান থাকার সুবিধাও গ্রহণ করে।
প্রবাহী বলবিজ্ঞানর অধ্যয়ন কমপক্ষে প্রাচীন গ্রিসের দিনগুলিতে শুরু হয়েছিল, যখন আর্কিমিডিস প্রবাহী স্থিতিবিজ্ঞান এবং প্লবতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর বিখ্যাত সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন যা এখন আর্কিমিডিস সিদ্ধান্ত হিসাবে পরিচিত। এটি তাঁর রচনা অন ফ্লোটিং বডিজয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি সাধারণভাবে প্রবাহী বলবিজ্ঞানর উপর প্রথম বড় কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রবাহী বলবিজ্ঞানর দ্রুত অগ্রগতি শুরু হয়েছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা), ইভানজেলিস্তা টরিসেলি (ব্যারোমিটার আবিষ্কার), আইজাক নিউটন (সান্দ্রতা নিয়ে কাজ) এবং ব্লেজ পাস্কালের (উদস্থিতিবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা, পাস্কালের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন) মত বিজ্ঞানীদের হাত ধরে। এরপর একে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দানিয়েল বার্নুয়ি, তিনি ১৭৯৩ সালে শুরু করেছিলেন গাণিতিক প্রবাহী গতিবিজ্ঞান হাইড্রোডায়নামিকা।
বিভিন্ন গণিতবিদ (জিন লে রন্ড ডি'আলেমবার্ট, জোসেফ লুই ল্যাঞ্জরেজ, পিয়েরে-সাইমন ল্যাপ্লেস, সিমোন ডেনিস পয়েসন) অন্তর্নিহিত প্রবাহ আরও বিশ্লেষণ করেছিলেন। জিন লোনার্ড মারি পোইসুল এবং গথিফ হ্যাগেন সহ বেশিরভাগ প্রকৌশলী সান্দ্র প্রবাহ অন্বেষণ করেছিলেন। ক্লড-লুই নেভিয়ার এবং জর্জ গ্যাব্রিয়েল স্টোকস নেভিয়ার–স্টোকস সমীকরণের গাণিতিক ন্যায্যতা দিয়েছিলেন। পরিসীমা স্তর নিয়ে কাজ করা হয়েছিল (লুডভিগ প্রান্ডটল, থিওডোর ভন কার্মান)। বিভিন্ন বিজ্ঞানী যেমন অসবার্ন রেনল্ডস, আন্দ্রে কলমোগোরভ, এবং জেফ্রি ইনগ্রাম টেলর সান্দ্র প্রবাহী এবং চাপ এবং প্রবাহের বেগে বিশৃঙ্খল পরিবর্তনকে আরও বোধগম্য করে তোলেন।
প্রবাহী স্থিতিবিজ্ঞান বা উদস্থিতিবিজ্ঞান হল প্রবাহী বলবিজ্ঞানর একটি শাখা যেখানে স্থিতাবস্থায় তরলের অবস্থার অধ্যয়ন করা হয়। যে অবস্থার অধীনে স্থিতাবস্থার প্রবাহী স্থিতিশীল ভারসাম্যে থাকে এটি তার অধ্যয়নের শাখা। এর বিপরীতে প্রবাহী গতিবিজ্ঞান হল গতিতে থাকা তরলগুলির অবস্থার অধ্যয়ন। উদস্থিতি দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনার জন্য প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দেয়, যেমন বায়ুমণ্ডলীয় চাপ কেন ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার সাথে পরিবর্তিত হয়, কেন কাঠ এবং তেল জলের উপর ভাসে, এবং পাত্রের আকার যাই হোক না কেন তার অন্তস্থিত জলের উপরিভাগ সর্বদা সমতলে থাকে। হাইড্রলিক্সের মৌলিক বিষয় হল হাইড্রোস্ট্যাটিক্স। হাইড্রলিক্স হল তরল সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ব্যবহারের জন্য প্রকৌশল সরঞ্জাম। এটি ভূপ্রকৃতিবিজ্ঞান এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান (উদাহরণস্বরূপ, ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্ব এবং অভিকর্ষজ বলের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমগুলি বোঝার জন্য), থেকে শুরু করে আবহাওয়াবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান (রক্তচাপ প্রসঙ্গে) এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
প্রবাহী গতিবিজ্ঞান প্রবাহী বলবিজ্ঞানর একটি উপভাগ যেখানে প্রবাহী ধারা নিয়ে কাজ হয়— এটি গতিশীল তরল এবং গ্যাসের বিজ্ঞান।[৩] প্রবাহী গতিবিজ্ঞানর একটি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো আছে— যেখানে ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়— যেখানে প্রবাহ পরিমাপ থেকে প্রাপ্ত গবেষণামূলক ও অর্ধ-অভিজ্ঞতামূলক সূত্র গ্রহণ ক'রে ব্যবহারিক সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্য ব্যবহার করা হয়। একটি প্রবাহী গতিবিজ্ঞান সমস্যার সমাধানে, স্থান এবং সময়ের অপেক্ষক হিসাবে, সাধারণত তরলটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হিসাবের মধ্যে রাখা হয়, যেগুলি হল গতিবেগ, চাপ, ঘনত্ব, এবং তাপমাত্রা। এটি নিজেরই বেশ কয়েকটি উপবিভাগ রয়েছে, সেগুলি হল বায়ুগতিবিজ্ঞান[৪][৫][৬][৭] (গতিশীল বায়ু এবং অন্যান্য গ্যাসের অধ্যয়ন) এবং হাইড্রোডাইনামিক্স[৮][৯] (গতিশীল তরলের অধ্যয়ন)। প্রবাহী গতিবিজ্ঞানর বিভিন্ন ধরনের প্রয়োগ রয়েছে, যেমন বিমানের ওপর বল এবং গতিবিধি গণনা, পাইপলাইনের মাধ্যমে পেট্রোলিয়ামের ভর প্রবাহ হার নির্ধারণ, বিবর্তিত আবহাওয়া নিদর্শনগুলির পূর্বাভাস, মহাশূন্যে নীহারিকাকে বোঝা এবং বিস্ফোরণের মডেল তৈরি। যানবাহন প্রকৌশল এবং ভিড়ের গতিবিজ্ঞানয় কিছু প্রবাহী-গতিশীল নীতি ব্যবহৃত হয়।
<references>
-এ সংজ্ঞায়িত "Batchelor1967" নামসহ <ref>
ট্যাগ পূর্ববর্তী লেখায় ব্যবহৃত হয়নি।