প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান অধিযুগ ৪৬০ - ৫৪.১ কোটি বছর আগে | |
-৪৫০ — – -৪০০ — – -৩৫০ — – -৩০০ — – -২৫০ — – -২০০ — – -১৫০ — – -১০০ — – -৫০ — – ০ — স্কেল: কোটি বছর |
প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান বলতে পৃথিবীর ইতিহাসে সাম্প্রতিক ফ্যানারোজোয়িক অধিযুগের আগেকার দীর্ঘস্থায়ী একটি কাল কে বোঝায়, যা ভূতাত্ত্বিক সময় অনুসারে নিজস্ব একাধিক অধিযুগে বিভক্ত। আজ থেকে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্মের মাধ্যমে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কালের আরম্ভ, এবং প্রায় ৫২ কোটি বছর আগে প্রথম খোলকবিশিষ্ট বহুকোষী প্রাণীদের আবির্ভাব ও ক্যাম্ব্রিয়ান যুগ তথা ফ্যানারোজোয়িক অধিযুগের সূচনার মাধ্যমে এর সমাপ্তি। প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ানকে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান বলা হয় কারণ এই কাল এসেছিল ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের আগে, আর ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের এহেন নামকরণের কারণ এই সময়কার পাথর প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ওয়েল্স্ থেকে, আর ওয়েলসের ধ্রুপদী নাম ক্যাম্ব্রিয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত পেরিয়ে আসা মোট সময়ের প্রায় ৮৮% জুড়ে আছে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান।
পৃথিবীর ইতিহাসের আট ভাগের সাত ভাগ জুড়ে থাকা সত্ত্বেও প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কাল সম্পর্কে মানুষের জানা তথ্য অপেক্ষাকৃত কম, আর যেটুকু জানা গেছে তা-ও সবেমাত্র গত ৬০ বছরে। প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান থেকে প্রাপ্ত জীবাশ্ম প্রমাণ ফ্যানারোজোয়িকের চেয়ে কম, আর এই স্বল্প জীবাশ্মেরও (স্ট্রোমাটোলাইট প্রভৃতি) বায়োস্ট্র্যাটিগ্রাফিক ব্যবহারের সুযোগ সীমিত।[১] এর কারণ হল অনেক প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান শিলা অত্যধিক মাত্রায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের প্রাথমিক ধর্ম (সঞ্চিত জীবাশ্ম সমেত) লুপ্ত হয়েছে, এবং প্রচুর সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তারা স্থূল ফ্যানারোজোয়িক শিলার নিচে চাপা পড়ে গেছে।[১][২]
ধারণা করা হয় আজ থেকে কমবেশি ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবী নিজেই ক্ষুদ্রতর বস্তুকণাসমূহের পারস্পরিক সংঘর্ষ ও গলনের পরে জমাট বেঁধে স্থিতিশীল হয়। এর অল্প সময় পরে একটি মঙ্গলের আয়তনবিশিষ্ট শিশুগ্রহ (planetesimal) পৃথিবীকে ধাক্কা মারে এবং এই ধাক্কার ফলে ছিটকে ওঠা পদার্থকণা ঘনীভূত হয়ে চাঁদের উৎপত্তি হয় (আরও দেখুন - বৃহৎ সংঘর্ষ মতবাদ)। আনুমানিক ৪৪০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর উপরিভাগ পাকাপাকিভাবে জমাট বেঁধেছিল, কারণ তেজস্ক্রিয়মিতিক পদ্ধতিতে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রাপ্ত কিছু জারকন কেলাসের বয়স নির্ণয় করা হয়েছে ৪৪০ কোটি ৪০ লক্ষ বছর।[৩]
প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান নামটা আর্কিয়ান ও প্রোটেরোজোয়িক অধিযুগকে একসাথে বোঝাতে ব্যবহৃত একটা সাধারণ নাম হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন স্ট্র্যাটিগ্রাফি দ্বারা অনুমোদিত।[৪] ভূবিজ্ঞানী এবং পুরাজীববিদরা যেখানে বিভিন্ন অধিযুগগুলোর নামের ব্যবহারের প্রয়োজন নেই সেই সমস্ত আলোচনায় এই নামটা ব্যবহার করে থাকেন। ক্রিপ্টোজোয়িক নামটাও প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কালকে বোঝাতে এক সময়ে ব্যবহৃত হত।
প্রাণ সৃষ্টির সময়কাল সম্বন্ধে একেবারে নিশ্চিত হওয়া এখনও সম্ভব হয়নি, কিন্তু পশ্চিম গ্রীনল্যান্ডের উপকূলের নিকটবর্তী কিছু দ্বীপ থেকে ৩৮০ কোটি বছরের পুরোনো পাথরে কার্বনের নমুনা পাওয়া গেছে, যা জৈব উৎসসঞ্জাত হতে পারে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে ৩৪৬ কোটি বছরেরও বেশি প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়ার সুসংরক্ষিত অবশেষ পাওয়া গেছে।[৫] ঐ একই জায়গা থেকে আরও কিছু নমুনা পাওয়া গেছে যেগুলো জীবাশ্ম হওয়ার সম্ভাবনা আছে, আর এই দ্বিতীয় প্রকার নমুনাগুলোর বয়স আরও ১০ কোটি বছর বেশি। প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ানের পরবর্তী দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যাক্টেরিয়াদের নিরবচ্ছিন্ন জীবাশ্ম প্রমাণ পাওয়া যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতবর্ষ থেকে আসা কিছু বিতর্কিত 'প্রাচীনতর' নিদর্শন বাদ দিলে প্রথম জটিল বহুকোশী জীবেদের আবির্ভাবের সময়কাল নির্ধারণ করা যায় আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে। এই ধরনের জীবাশ্মের প্রত্যক্ষ নিদর্শন পাওয়া গেছে ল্যান্টিয়ান প্রস্তরক্ষেত্র থেকে, যা অন্তত ৫৮ কোটি বছরের পুরোনো। ৫৪ কোটি ২০ লক্ষ বছর থেকে ৬০ কোটি বছর সময়সীমার মধ্যেকার বেশ কিছু বিচিত্র কোমলদেহী বহুকোশী জীবের নমুনা পাওয়া গেছে পৃথিবীর নানা স্থান থেকে। এদের একত্রে বলা হয় এডিয়াকারান বায়োটা। এই সময়কালের শেষ দিকে প্রথম শক্ত খোলকবিশিষ্ট প্রাণীর আবির্ভাব হয়। ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের শেষদিকের পাথরের স্তরে বার্জেস শেল থেকে বহু বিচিত্র প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের কোনো কোনোটা বর্তমান প্রাণীগোষ্ঠীসমূহের উৎস প্রজাতি হতে পারে। ক্যাম্ব্রিয়ানের প্রথম পর্যায়ে প্রাণীদের বিবর্তনের আকস্মিক বহু-বিভাজনের ঘটনাকে প্রাণের ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ বলা হয়।[৬][৭]
প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান ডাঙায় প্রাণী বা উন্নত উদ্ভিদের অস্তিত্ব না থাকলেও সায়ানোব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবেরা মাদুরের মত আস্তরণের আকৃতির উপনিবেশ স্থাপন করত।[৮]
প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কালের প্লেট টেকটনিক্স এবং অন্যান্য ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তিসমূহের কার্যকলাপের নিদর্শন আজকের পৃথিবীতে খুব কম স্থানেই সুরক্ষিত আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় ৩০০ কোটি বছরের আগে ছোট ছোট মহাদেশীয় ভূভাগ তৈরি হয়েছিল, আর আনুমানিক ১০০ কোটি বছর আগে প্রথম বার সেই সমস্ত ভূভাগ একত্র হয়ে একটি অতিমহাদেশ গঠন করে। রোডিনিয়া নামক এই অতিমহাদেশ ভেঙে যায় আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে। এর অবস্থিতির সময় একাধিক তুষার যুগ এসেছিল, যাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটা ২২০ কোটি বছর আগে হুরনিয়ান উপযুগে আর শেষেরটা ৬০ কোটি বছর আগে সংঘটিত হয়। এই শেষোক্ত তুষার যুগে সম্ভবত নিরক্ষীয় অঞ্চল পর্যন্ত বরফের চাদর বিস্তৃত হয়েছিল, ফলে একটি তুষারগোলক পৃথিবীর সৃষ্টি হয়।
সমসাময়িক বায়ুমণ্ডল সম্বন্ধে স্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না। অধিকাংশ ভূতাত্ত্বিক বিশ্বাস করেন বায়ুমণ্ডলের প্রাথমিক উপাদান ছিল নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রীয় গ্যাসসমূহ। মুক্ত অক্সিজেন একেবারেই ছিল না। অবশ্য আদি আর্কিয়ানের পর থেকে অক্সিজেনসমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলের সমর্থক তত্ত্বও আছে।[৯]
পৃথিবীর জলমণ্ডল ও পরবর্তীকালে বায়ুমণ্ডলে আণবিক অক্সিজেনের ধারাবাহিক সরবরাহ শুরু হয় প্রথম সালোকসংশ্লেষকারী উদ্ভিদেরা তাদের বিপাকজাত বর্জ্য পদার্থ হিসেবে এই গ্যাস প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করতে শুরু করার সময় থেকে। বায়ুমণ্ডল অক্সিজেনসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে আনুমানিক ২৩০ কোটি বছর আগে। অক্সিজেন তীব্র জারক গ্যাস। বায়ুমণ্ডলের নিষ্ক্রীয় থেকে তীব্র জারক হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়াকে কখনও কখনও অক্সিজেন বিপর্যয় বলা হয়, কারণ সালোকসংশ্লেষকারী উদ্ভিদ ব্যতীত অন্যান্য অনেক জীবের পক্ষে অক্সিজেনের প্রভাব ছিল ক্ষতিকর। প্রথমে উৎপন্ন মুক্ত অক্সিজেন খুব তাড়াতাড়ি ভূভাগের শিলা (প্রধানত লোহাঘটিত শিলা) কর্তৃক শোষিত হয়ে যেত। যখন ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে লোহা ও অন্যান্য জারণক্ষম পদার্থের সম্পূর্ণ অংশই জারিত হয়ে গেল, তার পর থেকে উৎপন্ন মুক্ত অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে জমতে শুরু করে, আর ধীরে ধীরে আধুনিক অক্সিজেনসমৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছায়। এই ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বের নানা প্রান্তে অবস্থিত প্রাচীন পাহাড় ও গিরিখাতের পাথরে, আয়রন অক্সাইড বা মরচের স্পষ্ট ও গাঢ় স্তরের অবস্থান থেকে। এই স্তরগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে লোহা আর অক্সিজেনের মধ্যে প্রথম রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রমাণ।
তেজস্ক্রিয়মিতিক তারিখ গণনাপদ্ধতি বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক ঘটনার আসল সময়ক্রম নির্ধারণ করতে সমর্থ হওয়ায়[১০] পৃথিবীর ইতিহাসের আদিম পর্যায়গুলোর বর্ণনা ও চিহ্নিতকরণের অনেকগুলো প্রামাণ্য পরিভাষা চালু করা গেছে। প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কাল তিনটে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান অধিযুগে বিভক্ত: হেডিয়ান (পৃথিবীর জন্ম থেকে ৩৯০ বা ৪০০ কোটি বছর আগে পর্যন্ত), আর্কিয়ান (৪০০ কোটি থেকে ২৫০ কোটি বছর আগে পর্যন্ত) এবং প্রোটেরোজোয়িক (২৫০ কোটি বছর থেকে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কালের শেষ/প্রায় ৫২ কোটি বছর আগে পর্যন্ত)।
প্রস্তাব রাখা হয়েছে যে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কালকে গতানুগতিক সময়ভিত্তিক বিভাগের মাপকাঠিতে না ফেলে পৃথিবীর ভূমিরূপ গঠনের বিভিন্ন পর্যায় অনুযায়ী অধিযুগ ও মহাযুগে ভাগ করা উচিত। এই ধরনের ব্যবস্থা ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্তরের গঠন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে পারে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান কালকে পাঁচটা 'প্রাকৃতিক' অধিযুগে ভাগ করা যায়। যথা:
ভূগাঠনিক পাতসমূহের চলনের ফলে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন মহাদেশের গঠন ও ভাঙনের চক্র আবর্তিত হয়েছে। কখনও কখনও সমস্ত বা প্রায় সমস্ত প্রধান ভূখণ্ড তথা মহাদেশ একত্র হয়ে সুবিশাল অতিমহাদেশ গঠন করেছে। প্রথম জ্ঞাত অতিমহাদেশ হল ভালবারা। আদিম কয়েকটি মহাদেশের সংযোজনের ফলে এর উৎপত্তি হয়েছিল এবং ৩১০ কোটি বছর আগে এটি অতিমহাদেশ হয়ে ওঠে। ২৮০ কোটি বছর আগে ভালবারা অতিমহাদেশ ভেঙে যায়, এবং তার প্রায় ১০ কোটি বছর পর নতুন অতিমহাদেশ কেনোরল্যান্ড গঠিত হয়। আনুমানিক ২৫০ কোটি বছর আগে কেনোরল্যান্ড ভেঙে গিয়ে কয়েকটি ক্রেটন বা মহাদেশীয় খণ্ড উৎপন্ন হয়, যথা লরেন্শিয়া, বাল্টিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং কালাহারি। অতিমহাদেশ কলাম্বিয়া বা 'নুনা' গঠিত হয় ২০০ কোটি থেকে ১৮০ কোটি বছর আগে এবং ভেঙে যায় ১৫০ থেকে ১৩০ কোটি বছর আগে[১১][১২]। রোডিনিয়া অতিমহাদেশ আজ থেকে আনুমানিক ১০০ কোটি বছর আগে গঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়,এবং প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে তা আটটি মহাদেশে ভেঙে যায়।
|ইউআরএল=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২৮।
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)