প্রারম্ভিক মানব মাইগ্রেশন বলতে মানব উদ্ভবের প্রথম পর্যায়ে সারা পৃথিবীতে মানুষের বিস্তার ও মাইগ্রেশনকে বোঝানো হয়, যা প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকা ছেড়ে হোমো ইরেকটাস প্রজাতির মানুষের বেরিয়ে পড়া থেকে শুরু হয়েছিল। ক্রমেই এই প্রজাতিকে অনুসরণ করে হোমো হাইডেলবারগেন্সিস সহ আনুমানিক ৫ লক্ষ বছর আগে বসবাসরত হোমো গণের অন্যান্য মানব প্রজাতিরা সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ধারণা করা হয়, এরা ডেনিসোভানস ও নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির মানবদের আদি পুরুষ। ধারণা করা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ের এই মানব প্রজাতিরা পানিতে নিমজ্জিত স্থলসংযোগ হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে (History Alive, pub. 2004, TCI)।
আফ্রিকার মধ্যে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানবেরা বিবর্তনের ধারায় অপেক্ষাকৃত নতুন এবং আনুমানিক ৩ লক্ষ বছর আগে এদের উদ্ভব হয়।[১] এটা ধারণা করা হয় যে শারীরিকভাবে আধুনিক মানব প্রজাতি ৭০ হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা থেকে অভিবাসিত হওয়া হোমো স্যাপিয়েন্স এর বংশধর। এরা ৫০ হাজার বছর আগে এশিয়ার দক্ষিণ উপকূল ও ওশেনিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক মানুষ ৪০ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাগৈতিহাসিক ইউরেশিয় হোমো স্যাপিয়েন্স জীবাশ্ম পাওয়া যায় ইসরায়েল ও গ্রীসে, যার বয়স প্রায় যথাক্রমে ১,৯৪,০০-১,৭৭,০০ বছর ও ২,১০,০০০ বছর। এই জীবাশ্ম হোমো স্যাপিয়েন্সদের প্রথম বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়াকে নির্দেশ করে, যারা নিয়ান্ডারাথাল জনগোষ্ঠী কর্তৃক পরবর্তীতে বাস্তুচ্যুত হয়। [২][৩][৪][৫][৬]
অভিবাসিত আধুনিক মানব প্রজাতির সাথে স্থানীয় আর্কাইক মানব প্রজাতিগুলোর আন্তঃপ্রজননের কথা জানা যায়, যার ফলে সমসাময়িক মানব সম্প্রদায়ের ভেতর ঐ সকল আর্কাইক মানব প্রজাতির অতি ক্ষুদ্র বৈশিষ্টের (১০ শতাংশেরও নিচে) কথা জানা যায়।
সর্বশেষ বরফ যুগের পর, ২০ হাজার বছর পূর্বে উত্তর ইউরেশিয় জনগণ প্রাচীন আমেরিকা মহাদেশে অভিবাসিত হয়। এর ১২ হাজার বছর পর উত্তর ইউরেশিয়া আবার জনবহুল হয় হোলোসিন শুরু হবার পর। ৪ হাজার বছর আগে আর্কটিক কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডে পালিও-এস্কিমো জনসংখ্যা সম্প্রসারিত হয়। সর্বশেষে এর ২ হাজার বছর পর অস্ট্রোনেশিয়ার জনসংখ্যা দ্বারা পলিনেশিয়া জনবহুল হয়।
সবচেয়ে প্রাচীন মানব প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে অস্ট্রালোপিথেসিন পূর্বপুরুষ থেকে, প্রায় ৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে। খুব সম্ভবত পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ান পার্বত্য উপত্যকা থেকে যেখানে জানামতে সবচেয়ে প্রাচীন প্রস্তর অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিককালে চীনের স্যাংচেন সাইট থেকে ২.১২ মিলিয়ন বছর পুরোনো পাথুরে যন্ত্রপাতির নমুনা পাওয়া গেছে এবং দাবি করা হয় আফ্রিকার বাইরে মানুষের বসবাসের সবচেয়ে পুরোনো নমুনা এটি। এর আগে আফ্রিকার বাইরে সবচেয়ে পুরোনো মানব বসতির নমুনাটি ছিল জর্জিয়ার মানিসিতে, ৩ লক্ষ বছর পুরোনো। [৭]
প্রায় ২ থেকে ৩ মিলিয়ন বছর পুর্বে হোমো গণের মানবেরা পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে ছড়িয়ে পড়ে। তখনো পশ্চিম আফ্রিকায় মানববসতি হয়নি। হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির মানুষেরা প্রায় ১.৯ মিলিয়ন বছর পূর্বে আফ্রিকার বাইরে অভিবাসিত হওয়া শুরু করে এবং লেভান্তিন করিডোর ও আফ্রিকার অন্তরীপের উপত্যকা দিয়ে ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে। এই অভিবাসন সাহারা মরুভূমির শ্যামলায়ন তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। পরবর্তীতে হোমো ইরেক্টাস পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্বশেষ স্থান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রজাতির জনসংখ্যা বণ্টনের ধারা পাওয়া যায় ১.৩ মিলিয়ন বছরের পুরোনো ওল্ডোয়ানের পাথুরে অস্ত্রের নমুনা প্রাপ্তি অনুযায়ী যা একেবারে সর্ব উত্তরের ৪০ তম অক্ষরেখা বরাবর সম্প্রসারিত ছিল। আফ্রিকার বাইরে এই অভিবাসনের নমুনা প্রাপ্তির মূল প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলো হলঃ পাকিস্তানের রিওয়াত, লেভান্তের উবেইদিয়া এবং ককেশাসের মানিসি। [৮]
চীনে ১.৬৬ মিলিয়ন বছর পুরোনো মানব বসতির ধারণা পাওয়া যায় ব্যবহৃত পাথুরে যন্ত্রপাতি নমুনা থেকে। শানঝি প্রদেশের জিহউদু প্রত্ন্স্থল থেকে হোমো ইরেক্টাসের সবচেয়ে পুরোনো আগুন ব্যবহারের নমুনা পাওয়া যায়, যা ১.২৭ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। [৯][১০]
দক্ষিণপূর্ব এশিয়া (জাভা) তে মানুষের পা পড়ে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে এবং পশ্চিম ইউরোপে ১.২ মিলিয়ন বছর পুর্বে। [১১]
রবার্ট জি বেডনারিকের মতে, হোমো ইরেক্টাস নৌযান তৈরি শিখেছিল এবং সাগরে চলাচল করত, যদিও এই তত্ত্বটি বিতর্কিত। [১২]
অভিবাসনের ১ মিলিয়ন বছর পর হোমো ইরেক্টাস নতুন প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়। হোমো ইরেক্টাস একটি ক্রোনোস্পিসিস বা ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত মানব প্রজাতি এবং কখনোই তা বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়নি। ধারণা করা হয় এর বিবর্তিত পরের প্রজাতি গুলো ০.৫ মিলিয়ন থেকে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার বছর আগ পর্যন্ত টিকে ছিল। এদের মধ্যে ইউরোপে ৮ লক্ষ পছর পুর্বে ছিল হোমো এন্টেসেসর এবং আফ্রিকায় ৬ লক্ষ বছর আগে ছিল হোমো হাইডেলবারগেন্সিস। হোমো হাইডেলবারগেন্সিস এরপর পূর্ব আফ্রিকা ও ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকায় এই প্রজাতি হোমো রোডেশিয়েন্সিস নামে পরিচিত আর ইউরেশিয়াতে নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানস হিসেবে।
হোমো হাইডেলবারগেন্সিস, নিয়ান্ডারথাল আর ডেনিসোভানসরা একবারে ৫০ তম অক্ষাংশ ছাড়িয়ে আরো দূরবর্তী উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, ৩২ হাজার বছর পূর্বে নিয়ান্ডারথালেরা আর্কটিকেও পৌঁছে গিয়েছিল, যখন তারা তাদের পূর্ববর্তী হোমো স্যাপিয়েন্স কর্তৃক বাস্তুচ্যুত হয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইউরালের প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট বাইজোভায়াতে ২০১১ সালের এক খননকার্যে। [১৩]
এই সময়ের ভেতর ধারণা করা হয়, অন্যান্য মানব প্রজাতিও পুরো আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এর স্বপক্ষে ফসিলের নমুনা বেশ বিরল। তাদের অবস্থানের নির্দেশনা পাওয়া যায় আধুনিককালে আফ্রিকান জনগণের জিনোমে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আন্তঃপ্রজাতি মিলনের ফলে সৃষ্ট বৈশিষ্ট্য থেকে। [১৪][১৫][১৬][১৭] ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আবিষ্কৃত হোমো নালেডি প্রজাতির মানব ফসিল থেকে। এটি সম্ভবত ৩ লক্ষ বছরের পুরোনো ফসিল, যা সেই সময়ের আর্কাইক মানব প্রজাতির একটি প্রমাণ।[১৩]
নিয়ান্ডারথালেরা নিকট প্রাচ্য ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, যখন ডেনিসোভানসরা মধ্য ও পূর্ব এশিয়াতে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ওশেনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানসের আন্তঃপ্রজাতি প্রজননের নমুনা পাওয়া যায়, যেখানে তাদের জীবনাচরণ পরস্পর মিশে গিয়েছিল।[১৮]
মরক্কোর জেবেল ইরহুদ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত থার্মোলুমিনেসেন্স পদ্ধতিতে সময় নির্ধারণ পরীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায় প্রায় ৩ লক্ষ বছর পুর্বে হোমো স্যাপিয়েন্স এর উত্থান ঘটেছিল।[১৯] এর আগে সবচেয়ে পুরোনো নমুনাটি ছিল ২ লক্ষ বছর আগের, এগুলো ছিল প্রাগৈতিহাসিক সেই মানব প্রজাতির হাড়ের সংগ্রহবিশেষ যাদের একত্রে ওমো রিমেইনস বলা হয়।[২০] ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ার ওমো ন্যাশনাল পার্কে ক্ষননকার্য চালিয়ে এই হাড়ের সংগ্রহ পাওয়া যায়।
জুলাই ২০১৯ এ মানবতত্ত্ববিদগণ প্রতিবেদন করেন, দক্ষিণ গ্রীসের এপিডিমা গুহায় ২ লক্ষ ১০ হাজার বছর পুরোনো হোমো স্যাপিয়েন্সের এবং ১ লক্ষ ৭০ হাজার বছর পুরোনো হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস এর উপস্থিতির নমুনা পাওয়া গেছে যা পূর্বে প্রাপ্ত হোমো স্যাপিয়েন্সের ১ লক্ষ ৫০ হাজার বছরের নমুনার চেয়ে পুরোনো।[৪][৫][৬][২১]
উত্থানের শুরু থেকেই প্রাচীন কালের আধুনিক এই মানব প্রজাতি পশ্চিম ইউরেশিয়া, মধ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিম আফ্রিকায় নিজেদের বাসস্থান সপ্রসারিত করে। যখন ইউরেশিয়ায় এদের বসতি সম্প্রসারণ নিয়মিত ছিল না, তখনও মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই প্রজাতির মানবের ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়।[১৮][২২] আকুলিয়ান ধরনের পাথুরে যন্ত্রপাতি যুগের একদম শেষের দিকে সাব-সাহারান আফ্রিকায় মানব সম্প্রসারণ হয় প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে। পশ্চিম আফ্রিকায় এই মানব প্রজাতির সাথে বেশ দেরিতে প্রাগৈতিহাসিক বা আর্কাইক মানবের সহাবস্থানের নমুনা পাওয়া যায়, যা মোটামুটি ১২ হাজার বছর পুরোনো।[২৩]
আধুনিক যুগে খোই-সান মানব সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষেরা দেড় লক্ষ বছর আগে বসতি সম্প্রসারণ করতে থাকে। অথবা ধারণা করা হয়, ২ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে সম্প্রসারণ শুরু হয়। যার ফলে ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর পূর্বে মেরিন আইসোটোপ পর্ব ৫ এর ভয়াবহ ক্ষরার যুগ শুরু হবার মূহুর্তে আফ্রিকায় দুই প্রজাতির মানবগোষ্ঠী পাওয়া যায়। একটি হল দক্ষিণ আফ্রিকায় খোই-সানদের পূর্বপুরুষেরা যাদের জিনোমে হ্যাপ্লোগ্রুপ এল ও গ্রুপের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিদ্যমান ছিল, অন্যটি মধ্য/পূর্ব আফ্রিকায় বসবাস করতে থাকা বর্তমানের বাকি সকল মানবগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ, যাদের জিনোমে ম্যাক্রোহ্যাপ্লো গ্রুপ এল ওয়ান-সিক্স মাইতোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিদ্যমান। ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার বছর পুর্বে পূর্ব আফ্রিকার দিকে এল ও গ্রুপের ডিএনএ বাহী মানব প্রজাতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অভিবাসন যাত্রা লক্ষ করা যায়।
আনুমানিক ১ লক্ষ ৩০ হাজার পূর্বে মধ্য আফ্রিকায় বর্তমানের আফ্রিকান পিগমি সম্প্রদায়ের পূর্ব পুরুষদের সম্প্রসারণ হয়। একেবারে সুনিশ্চিত করে বলতে গেলে ৬০ হাজার বছর পুর্বে এই সম্প্রসারণ হয়।[২৪][২৫][২৬][২৭]
ফসিল নমুনার বিক্ষিপ্ততার কারণে এই সময়কালে আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলের অবস্থা বলা কষ্টকর। ধারণ করা হয়, আনুমানিক ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্স পশ্চিম সাহেলিয়ান অঞ্চলে পোঁছায়। হোমো স্যাপিয়েন্স সংশ্লিষ্ট পশ্চিম আফ্রিকার সবগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটের নমুনার বয়স ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছরের পুরোনো নয়। আফ্রিকার অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদাভাবে প্রাচীন মধ্য প্রস্তর যুগের সাইটগুলো নির্দেশ করে যে ১২ হাজার বছর পূর্বে এখানে প্রাচীন মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল এবং হোমো স্যাপিয়েন্সের সাথে তাদের আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন হয়েছিল। [২৮]
আনুমানুক ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর থেকে ১ লক্ষ ১৫ হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্স এর জনসংখ্যা লেভান্ত ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সম্ভবত এরও প্রাচীন ধারা ছিল যা ছড়িয়ে পড়েছিল ১ লক্ষ ৮৫ হাজার বছর আগে। ধারণ করা হয়, অভিবাসনের প্রথম স্রোত সম্ভবত ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর পূর্বে চীনে (উত্তর আমেরিকাও হতে পারে) পৌঁছে[২৯], কিন্তু সমসাময়িক মানব প্রজাতিতে কোন জিনগত চিহ্ন না রেখেই মারা যায়।[১৮]
আনুমানিক ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর পুর্বে আধুনিক মানুষ আফ্রিকা ছেড়ে পাড়ি জমায় এবং কিছু প্রমাণ আছে দুটি ভিন্ন পথে তারা অগ্রসর হয়। একটি হল নীল নদ উপত্যকা হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, অন্তত আধুনিক ইসরায়েলের দিকে (কাফজেহঃ ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বছর পূর্বে) এবং আরেকটি হল বর্তমানে লোহিত সাগরে অবস্থিত বাব-এম-মান্দেব প্রণালী হয়ে আরব উপদ্বীপ পার হয়ে বর্তমান সংযুক্ত আরব আমিরাত (১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর পূর্বে)[৩০] ও ওমানের (১ লক্ষ ৬ হাজার বছর পুর্বে)[৩১] মত জায়গাগুলোতে এসে বসতি স্থাপন করে। সম্ভবত এই ধারাটি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে (জ্বালাপুরমঃ ৭৫ জাহার বছর পুর্বে)। যদিও এ জায়গাগুলোতে কোন মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া যায় নি, তবে আমিরাতের জাবেল ফায়া, ভারতের জ্বালাপুরম সহ এই প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলোতে মানব ব্যবহৃত পাথুরে যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়, যার সাথে পূর্বে আফ্রিকায় প্রাপ্ত পাথুরে যন্ত্রপাতি মিলে যায়। ধারণা করা হয় এই পাথুরে যন্ত্রপাতিগুলোর স্রষ্টা এই আধুনিক মানব প্রজাতিই।[৩২] এই অনুসন্ধানগুলো আফ্রিকা হয়ে ১ লক্ষ বছর পূর্বে দক্ষিণ চীনে মানব প্রজাতির অস্তিত্বের দাবি কে সমর্থন করে ( ঝিরেন গুহা, ঝিরেন্ডং শ্ংঝুয়ো সিটি, চীনঃ ১ লক্ষ বছর আগে) এবং একইসাথে পূর্ব এশিয়ায় প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরোনো মানব প্রজাতি লুইজিয়াং হোমিনিড(লুইজিয়াং বিভাগ) যে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার বছর থেকে ১ লক্ষ ১১ হাজার বছর পুর্বে এই অঞ্চলে বসবাস করত তার দাবিকেও সমর্থন করে।[৩৩] এছাড়া লুনাডং থেকে প্রাপ্ত মোলার দাঁত (উপরে ও নিচের পাটিতে মাড়ির সবচেয়ে শেষের দাঁত) দুটির বয়স নির্ণয় পরীক্ষা থেকে জানা যায়, এগুলো সম্ভবত ১ লক্ষ ২৬ হাজার বছর পুরোনো মানব্ব প্রজাতির দাঁত।[৩৪][৩৫] যেহেতু আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা মানব প্রজাতির এই ধারাটির বিষয়ে ওয়াই-ক্রোমোজোম এবং মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ভিত্তিক জিন বিশ্লেষণে কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না, সেহেতু ধারণা করা যায়, তাদের জনসংখ্যার উল্ল্যেখযোগ্য বড় অংশই বাঁচেনি এবং তারা আমাদের এই অঞ্চলের প্রধান পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পৃক্ত। তাদের এই বড় ধরনের বিলুপ্তির পিছনে ব্যাখ্যা হিসেবে অনেকে টোবা অগ্ন্যুতপাত কে দেখেন, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।[৩৬]
প্রাচীন মানব মাইগ্রেশনের যে অংশটুকুকে সাম্প্রতিক ছড়িয়ে পরা বলে, তার সূচনা হয়েছিল ৭০ হাজার বছর আগে। এই মাইগ্রেশনকেই সারা পৃথিবী জুড়ে আধুনিক মানুষদের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেশন স্রোত বলা যায়। আনুমানিক ৭৫ হাজার বছর পূর্বে পূর্ব আফ্রিকার হোমো স্যাপিয়েন্স মানব প্রজাতির একটি ক্ষুদ্র অংশ লোহিত সাগরের বাব-এল-মান্দেব প্রণালী পার হয়ে বর্তমান ইয়েমেন এসে পৌঁছায়।[৩৭] এদের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি হবে না এবং এরা তাদের জিনে মাইট্রকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হ্যাপ্লোগ্রুপ এল থ্রি বহন করেছিল।[৩৮][৩৯] উত্তরের এই পথ ধরে সিনাই /সিরিয়া/ইসরায়েল (লেভান্ত) এ এই গোত্রের আগমনের বিষয়ে সাম্প্রতিক একটি পর্যালোচনা পাওয়া যায়। প্রায় ৫৫হাজার বছর আগে এদেরই উত্তরসূরীরা উপকূলের পথ ধরে আরব উপদ্বীপ, পারস্য ও ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ৭০ থেকে ৫০ হাজার বছর পূর্বে এই উপকূলীয় মাইগ্রেশন জিনোমে মাইটকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হ্যাপ্লোগ্রুপের উপবয় ডেরিভেটিভ এম ও এন এর সাথে সম্পর্কিত।
ইসরায়েলের মিসিলিয়া গুহার প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হতে প্রাপ্ত আটটি দাঁত বিশিষ্ট চোয়ালের হাড়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ পাওয়া যায়, যার বয়স জানা যায় আনুমানিক ১ লক্ষ ৮৫ বছর পূর্বের। একই গুহায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৪০ হাজার বছর আগের লেভোলয়েস ধরনের পাথুরে যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। এখান থেকে প্রারম্ভিক এই মানব মাইগ্রেশনের বয়স আরো আগের বলে প্রমাণ হতে পারে, যদি প্রাপ্ত ওই চোয়ালের হাড়ের সাথে এই যন্ত্রপাতির সম্পর্ক বের করা যায়।[৪০][৪১]
হোমো স্যাপিয়েন্স নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানসদের সাথে আন্তঃপ্রজাতিয় প্রজনন করেছিল,[৪২] সে কারণে মেইনল্যান্ড এশিয়া ও আমেরিকার আদিবাসীদের ডিএনএ তে ০.২ ভাগ ডেনিসোভান ডিএনএ পাওয়া যায়।[৪৩]
এশিয়ার উপকূল ও ওশেনিয়া ধরে চলা মাইগ্রেশন আনুমানিক ৫০ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করে।[৪৪] অস্ট্রেলিয়া পৌঁছানোর মাধ্যমে হোমো ইরেক্টাস কে বসতি স্থাপনের দিক দিয়ে ছাড়িয়ে যায় হোমো স্যাপিয়েন্স। ডেনিসোভানস বংশপরম্পরা লক্ষ করা যায় মেলানেশিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ছোট ছোট গোত্র যেমন- ফিলিপাইনের মামানওয়া, নেগ্রিতো প্রভৃতি গোত্রে। এ থেকে এটা বোঝা যায়, পূর্ব এশিয়ায় যেখানে ডেনিসোভানদের বসবাস ছিল সেখানে আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন হয়েছে।[৪৫][৪৬][৪৭] ধারণা করা হয়, ডেনিসোভানরা ওয়ালেস লাইন অতিক্রম করে ছিল এবং ওয়ালেসিয়া ছিল তাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। হোনো স্যাপিয়েন্স লোম্বোক গ্যাপ অতিক্রম করেছিল এবং ফ্লোরেসের মত দূরবর্তী স্থানে গিয়ে পৌঁছেছিল কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় তখন পা রাখতে পারেনি।[৪৮]
এই সময়ে সাগরের উচ্চতা ছিল নিচে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ সমুদ্র উপকূল সমষ্টিগতভাবে সুন্দা নামে একটিমাত্র ভূখণ্ড হিসেবে ছিল। বর্তমানের অস্ট্রেলিয়া আর পাপুয়া নিউগিনির মহাদেশীয় ভূমির দিকে সুন্দা এবং সাহুলের মধ্যবর্তী প্রণালী হয়ে উপকূল ধরে মাইগ্রেশন চলছিল তখন। এখানে ওয়েবার রেখার মধবর্তী শূন্যস্থান ছিল ৯০ কিলোমিটার চওড়া[৪৯], সুতরাং অস্ট্রেলিয়া আর নিউগিনিতে মাইগ্রেশনের জন্য সমুদ্র ভ্রমণের ভাল দক্ষতা প্রয়োজন ছিল। উপকূলীয় এলাকা ধরে চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেও মাইগ্রেশন চলছিল এবং অবশেষে এই অংশটি চীনে মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাবার আগেই জাপান পৌঁছে। মাইটোকন্ড্রিয়াল হ্যাপলোগ্রুপ এম এবং ওয়াই-ক্রোমজোমের হ্যাপ্লোগ্রুপ সি এর উত্তরসূরী মাইটোকন্ড্রিয়াল হ্যাপ্লোগ্রুপ এর প্যাটার্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।
অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাংশ থেকে প্রাপ্ত একজন আদিবাসীর চুলের একটি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে সেই আদিবাসী সেই সকল মানব গোত্রের অনুসারী যে গোত্র পূর্ব এশিয়া থেকে ৬২ হাজার থেকে ৭৫ হাজার বছর পূর্বে এই অঞ্চলে মাইগ্রেশন হয়ে এসেছিল। আধুনিক এশিয়ানদের পূর্বে (২৫ হাজার থেকে ৩৮ হাজার বছর আগে) এই অঞ্চলে একটিমাত্র মানব গোত্র মাইগ্রেশন হয়েছিল- এই তত্ত্বকে এটি সমর্থন করে। পরবর্তীতে উত্তর আমেরিকায় এদের মাইগ্রেশন হয়।[৫০][৫১] আনুমানিক ৫০ হাজার বছর আগে এই মাইগ্রেশন সংঘটিত হয়, আনুমানিক ৮ হাজার বছর আগে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির স্থলভূমি আলাদা হবার আগেই এই মানব মাইগ্রেশন সংঘটিত হয়।[৫২] এই তত্ত্ব সমর্থিত হয় ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়াতে প্রাপ্ত প্রাচীন মানব বসবাসের বন্দোবস্তের প্রমাণসাপেক্ষে[৫৩][৫৪], ৪০ হাজার বছর পূর্বের মানুষের নমুনা সাপেক্ষে[৫৫], ৬৫ হাজার বছর পূর্বের মানব সম্প্রদায়ের বসবাসের নিদর্শন প্রাপ্তি সাপেক্ষে[৫৬] এবং টিম ফ্ল্যানারি কর্তৃক বিতর্কিত ৪৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার বছর পূর্বে মানব সম্প্রদায় কর্তৃক অস্ট্রেলিয়ার মেগাফনা বা বৃহদায়তন প্রানীপ্রজাতিসমুহের বিলুপ্তির নিদর্শন থেকে।[৫৭] এগুলো সবই আমেরিকা মহাদেশে মানব মাইগ্রেশনের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্ত ব্যবহৃত পাথরের যন্ত্রপাতি নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।[৫৮]
উপকূলীয় মাইগ্রেশনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় আসা মানুষেরা আনুমানিক ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার বছর আগে ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকে সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। নব্য প্রস্তর যুগের শুরুতে প্রাচীন মানব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া পুরোনো পৃথিবী (আফ্রো-ইউরেশিয়া অঞ্চল) ও আমেরিকা মহাদেশ মানব গোত্রসমূহের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে।
পশ্চিম দিক দিয়ে এই মানব সম্প্রদায়ের ভেতর মাইটোকন্ড্রিয়াল আর হ্যাপ্লোগ্রুপ বাহী মানুষেরা এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কয়েক হাজার বছর পূর্বের এই সময়ে এম ওয়ান হ্যাপ্লোগ্রুপ বাহী জনসংখ্যার একটি অংশ উত্তর আফ্রিকা ও আরব সাগরের তীরবর্তী আফ্রিকার উপদ্বীপ অঞ্চলসমূহে (হর্ণ অভ আফ্রিকা) পাল্টা মাইগ্রেশন হয়।
সম্ভবত ৪৩ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপে আধুনিক মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে, নিয়ান্ডারথাল জনসংখ্যা এসময় দ্রুত তাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।[৫৯] সমসাময়িক ইউরোপিয়েদের মধে নিয়ান্ডারথাল পূর্বসূরীদের ছাপ বিদ্যমান, কিন্তু সারকথা এটাই যে ৪৭ হাজার বছর পূর্বেই নিয়ান্ডারথালদের সাথে আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ ইউরোপে আধুনিক মানুষের বিস্তারকালের সময় থেকেই তা বন্ধ হয়।[৬০]
মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর পরীক্ষা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, আধুনিক মানব প্রজাতি অন্তত একটি জেনেটিক বটলনেক এর মধ্য দিয়ে গেছে। জেনেটিক বটলনেকের অর্থ হল, উক্ত প্রজাতির সংখ্যায় উল্ল্যেখযোগ্য হ্রাস পাওয়া, সেটা প্রাকৃতিক কোন দুর্ঘটনা বা মানবসৃষ্ট কোন কারণে হতে পারে। আধুনিক মানুষের ঐ জেনেটিক বটলনেক এর মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের জিনগত বৈচিত্র্য উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়। আবহাওয়াগত ও ভৌগোলিক বিভিন্ন প্রমাণ রয়েছে এধরনের ঘটনার। সেনোজয়িক পর্যায়ে টোবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাত এ ধরনের একটি ঘটনা, যার ফলে প্রায় ১ হাজার বছরের শীতল অধ্যায় শুরু হয় এবং গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলসমূহে মানব বসতির পরিমাণ উল্ল্যেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।[৬১] এমতাবস্থায় জেনেটিক ড্রিফট এবং ফাউন্ডার ইফেক্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। আফ্রিকানদের জিনোমে একটা বড় বৈচিত্র্য আছে, যার কারণ হল টোবা বিস্ফোরণের ফলে আফ্রিকায় তুলনামূলক বেশি মানবসংখ্যা সম্প্রসারণ হয়েছিল।[৬২] সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যসমূহ এটাতেই আলোকপাত করে যে, প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণের সাথে নন-আফ্রিকানদের ডিএনএ কম ধারাবাহিক।[১৮]
আধুনিক মানব প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্সের সবচেয়ে সাম্প্রতিক বিস্তৃতি হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে আনুমানিক ৪০ হাজার বছর পুর্বে। এটা হয়েছিল বরফ যুগের উত্তরকালের বড় প্রাণী শিকারের সংস্কৃতি আত্তীকরণের ফলে।[৬৩] নিয়ান্ডারথালেরা তখনও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বাস করত এবং এসময় ইউরোপে আগত আধুনিক মানব প্রজাতির (ক্রো-ম্যাগনন বা ইউরোপের আধুনিক মানব প্রজাতি হিসেবে পরিচিত) সাথে তাদের আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন খুব কমই হয়েছে বলা চলে। আইবেরিয়ান উপদ্বীপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মত বেশ কিছু অঞ্চলে নিয়ান্ডারথাল এবং স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানব প্রজাতির জনসংখ্যা সমভাবে মিশে গেছে।
ইউরোপ ও জনবসতিপুর্ণ পৃথিবীর অন্যান্য অংশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য হল উত্তর অক্ষরেখা। নিয়ান্ডারথাল বা ক্রো-ম্যাগনন যে মানব প্রজাতিই হোক না কেন, প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনাসমূহ এটা বলে, আনুমানিক ৪০ হাজার বছর পূর্বে আর্কটিক রাশিয়াতে মানুষ পৌঁছেছিল।[৬৪]
ক্রো-ম্যাগননদেরকে শারীরতত্ত্বীয় ভাবে ইউরোপের প্রথম আধুনিক মানব প্রজাতি বলা হয়। আনুমানিক ৫০ হাজার বছর পুর্বে তারা ইউরেশিয়া অঞ্চলে ঢুকেছিল জাগরোস পর্বতমালা দিয়ে (যেটা বর্তমানে ইরান ও তুরস্কের পুর্বাঞ্চল) । এদের দুইটি গ্রুপ ছিল, যাদের একটি গ্রুপ ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল ধরে দ্রুত বসতি স্থাপন করতে থাকে অন্যটি উত্তর দিকে মধ্য এশিয়ার সমতল ভূমিতে মাইগ্রেশন হতে থাকে।[৬৫] এই আধুনিক মানুষদের দল আনুমানিক ৪৩-৪৫ হাজার বছর আগে ইটালি[৬৬] ও ব্রিটেন[৬৭] আবিষ্কার করে এবং একইসাথে ৪০ হাজার বছর আগে আর্কটিক রাশিয়ায় পা রাখে।[৬৪][Mamontovaya Kurya: an enigmatic, nearly 40 000 years old Paleolithic site in the Russian Arctic ১]
ইউরাল পর্বতমালার পশ্চিমাংশ জুড়ে মানব প্রজাতি কলোনি স্থাপন করে, এসময় তারা প্রধানত বল্গা হরিণ শিকার করত।[৬৮] কিন্তু এসময় তারা বেশ কিছু অভিযোজনগত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ঃ শীতকালে এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা থাকত -২০ থেকে -৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং এসময় উপযুক্ত জ্বালানী ও পর্যাপ্ত আশ্রয়েরও বেশ অভাব দেখা দিত। তারা এসময় পায়ে হেঁটে পথ চলত এবং শিকার হিসেবে গোত্রভূক্ত গবাদিপশুর পালের উপর খুব বেশি নির্ভর করত। এসকল প্রতিকূলতা কারিগরি আবিষ্কারের মাধ্যমে জয় করা সম্ভবপর হয়ঃ লোমশ পশুর চামড়া থেকে পরনের কাপড় তৈরির মাধ্যমে শীতের হাত থেকে রক্ষা, পশুর হাড় ব্যবহার করে আশ্রয় ও উনোন তৈরি করা এবং মাটিতে গর্ত করে পুরোপুরি বরফাচ্ছাদিত অংশে বরফের "সেলার" তৈরি করা, যেখানে হাড় ও খাবার মাংস সংরক্ষণ করা যায়।[৬৮][৬৯]
ইটালির পাগলিচ্চি গুহার প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে দুজন ক্রো-ম্যাগনন প্রজাতির মানুষের একটি মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ সিকোয়েন্স আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো প্রায় ২৩ থেকে ২৪ হাজার বছর পুরোনো। এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হ্যাপ্লোগ্রুপ এন ভুক্ত।[৭০]
আনুমানিক ৪৫ হাজার বছর পুর্বে আধুনিক মানুষের বিস্তৃতি হয় এবং ১৫ থেকে ২০ হাজার বছর পুর্বে ইউরোপে পুরোপুরি মানব কলোনি বিস্তৃত হয়।[৭১][৭২]
এই সময়ের ভিতর নিয়ান্ডারথাল প্রজাতি ধীরে ধীরে বসতি হারায়। আধুনিক মানুষের ইউরোপ দখল করতে বেশ সময় লেগেছিল ধারণা করা হয়। এটা অনুমান করা যায় যে, নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানব প্রজাতি অঞ্চল দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। নিয়ান্ডারথালদের মস্তিষ্ক আকারে বেশ বড় ছিল, শরীরের অন্যান্য গঠনেও তারা বৃহদাকার ছিল, তাদের শারীরিক কাঠামো হোমো স্যাপিয়েন্সের তুলনায় বেশ শক্তিশালী ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ২ লক্ষ বছর ধরে ইউরোপে বসবাস করায় তীব্র শীতের আবহাওয়াতে তারা মানিয়ে যাবার জন্য উপযুক্ত প্রজাতিই ছিল। শারীরিক ভাবে আধুনিক মানব প্রজাতি যারা ক্রো ম্যাগনন হিসেবে পরিচিত, তাদের ছিল বিস্তৃত বাণিজ্যিক যোগাযোগ, উন্নততম প্রযুক্তি, এবং শারীরিক গঠন যা দৌড়ানোর উপযুক্ত। এসকল বৈশিষ্ট্য নিয়ান্ডারথালদের পরাস্ত করে ইউরোপ থেকে বাস্তুচ্যুত করে, যাদের সর্বশেষ বাসস্থান ছিল আইবেরিয়ান উপদ্বীপ। ২৫ হাজার বছর পূর্বের নিয়ান্ডারথালদের জীবাশ্ম নমুনা তাদের বিলুপ্ত হবার স্বাক্ষ্য দেয়। তাদের সর্বশেষ জনগোষ্ঠী ৩০ হাজার থেকে ২৪ হাজার বছর পূর্বে জিব্রাল্টারের দক্ষিণমুখী সমুদ্র উপকূলে পাহাড়ের গুহাগুলিতে বসবাস করত।
জনসংখ্যা জিনতত্ত্বের লিংকেজ ডিসইক্যুইলিব্রিয়াম এর ব্যাপ্তি থেকে ধারণা করা হয়, আনুমানিক ৪৭ হাজার থেকে ৬৫ হাজার বছর পূর্বে ইউরপীয় পূর্বপুরুষে সর্বশেষ নিয়ান্ডারথাল জিনের উপস্থিতি ছিল।[৬০] নৃতাত্ত্বিক ও জীবাশ্ম নমুনা থেকে জানা যায়, আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন সংঘটিত হয়েছিল পশ্চিম ইউরেশিয়ায়, সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে। বিভিন্ন পর্যালোচনা বলে,উত্তর আফ্রিকার গ্রুপগু ইউরোপীয়দের তুলনায় পূর্ব এশিয়ায় নিয়ান্ডারথাল জিনের সংমিশ্রণ বেশি।[৭৩][৭৪] উত্তর আফ্রিকার গ্রুপগুলোতে অন্যান্য নন-আফ্রিকার গ্রুপের মতই নিয়ান্ডারথালদের সাথে একই ডেরাইভড এলিলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে সাব-সাহারান আফ্রিকান গ্রুপ হল আধুনিক মানব প্রজাতির একমাত্র গ্রুপ, যাদের জিনে নিয়ান্ডারথালদের জিনের উপস্থিতি পাওয়া যায় না। নিয়ান্ডারথালদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ডিস্ট্রোফিন জিনে বি০০৬ নামের একটি হ্যাপ্লোটাইপ এখনো সাহেল ও হর্ণ অভ আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোতে বিভিন্ন যাযাবর পশুপালক গোষ্ঠীর মানুষে দেখা যায়। তারা আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং, সাব-সাহারান আফ্রিকার উত্তর ও উত্তর-পূর্বের এসকল অঞ্চলে নিয়ান্ডারথাল বি০০৬ হ্যাপ্লোটাইপের উপস্থিতি প্রমাণ করে, এখানে জনসংখ্যায় নন-আফ্রিকান অঞ্চল থেকে মাইগ্রেশন হয়েছিল এবং আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন হয়েছিল।
"তিয়ানুয়ান ম্যান" আনুমানিক ৪০ হাজার বছর পুর্বে চায়নাতে বসবাস করা এক মানব গোষ্ঠী, যাতে উল্লেখযোগ্য নিয়ান্ডারথাল জিনের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন ওই গোষ্ঠীর মানুষে চালানো একটি ডিএনএ পরীক্ষালব্ধ পর্যালোচনা থেকে ২০১৭ সালে জানা যায়, এই মানবগোষ্ঠী আধুনিক এশিয়া ও আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত।[৭৫] ২০১৩ সালের একটি গবেষণা বলে, পূর্ব এশীয়দের ক্রোমোজমের থ্রিপি২১.৩১ অংশের সাথে ১৮ টি নিয়ান্ডারথাল জিনের সংমিশ্রণ রয়েছে যা নিয়ান্ডারথালদের সাথে আন্তঃপ্রজাতি প্রজননের ফলাফল। একমাত্র পূর্ব এশিয়দের জনসংখ্যায় নিয়ান্ডারথাল হ্যাপ্লোটাইপ সুষ্ঠভাবে গৃহীত হয়েছিল আনুমানিক ৪৫ হাজার বছর পূর্বে এবং ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার বছর পূর্বে হঠাৎ এই অঞ্চলে জনসংখ্যায় বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত এই সংমিশ্রণ চলছিল। পূর্ব এশিয়ার জনসংখ্যায় এই জেনেটিক সংমিশ্রণ ইউরেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের জনসংখ্যার তুলনায় (ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যা) বেশি হয়েছে। এই গবেষণা এটাই বলে পূর্ব এশিয়া ও আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের সাথে নিয়ান্ডারথালদের আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন হয়েছিল।
২০১৬ সালে জনসংখ্যা জিনতত্ত্বের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, পূর্ব এশিয়াতে প্রাচীনকালে জনবসতি সম্প্রসারণের মূলে ছিল জাপানের "আইনু" জনগোষ্ঠী। পূর্ব এশিয়ায় আধুনিক কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর তুলনায় আইনু জনগোষ্ঠী আরো প্রাচীন জনগোষ্ঠী যারা উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ানদের সাথে প্রাক-প্রস্তর যুগের প্রাচীন সম্পর্কযুক্ত।[৭৬] ২০১৩ সালের এক গবেষণা বলে, মঙ্গোলীয়দের সাথে এদের বেশ কিছু ফিনোটাইপ বৈশিষ্ট্য মিলে যায় যেখানে ৩৫ হাজার বছর পূর্বে এক্টোডিসপ্লাসিন এ রিসেপ্টর জিনের বিবর্তন রয়েছে।
এই অঞ্চলের জনসংখ্যায় এ,বি এবং জি হ্যাপ্লোগ্রুপ উদ্ভূত হয় আনুমানিক ৫০ হাজার বছর পূর্বে এবং এই হ্যাপ্লোগ্রুপ বহনকারী জনগোষ্ঠী আনুমানিক ৩৫ হাজার বছর পূর্বে সাইবেরিয়া, কোরিয়া ও জাপানে জনসবসতি সম্প্রসারণ করে। এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সর্বশেষ বরফ যুগের সময় উত্তর আমেরিকা থেকে এই অঞ্চলে আসে।
আনুমানিক ২০ হাজার বছর পূর্বে, নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির প্রায় ৫ হাজার বছর পর, সর্বশেষ বরফ যুগ শুরু হয়, যা উত্তর গোলার্ধের অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন আশ্রয়ের দিকে ধাবিত করে। সম্ভবত এই বরফ যুগে আশ্রয়ের জন্য মানব প্রজাতি অভিবাসনের মাধ্যমে অবশেষে ইউরোপকে দখল করে, আজকের দিনে সেই ঐতিহাসিক আর্কাইক জনগোষ্ঠী তাদেরই বংশধর। ইউরোপের জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ পরবর্তীতে পাল্টে যায় দুটি অভিবাসনের জন্য; একটি হল নব্যপ্রস্তর যুগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা মানব বসতির সম্প্রসারণ এবং অন্যটি হল এরও পরে তাম্রযুগে ইন্দো-ইউরোপীয় সম্প্রসারণ। আর্কটিক বৃত্তের বেশ উপরে ৭১°উত্তর অক্ষরেখায় সাইবেরিয়ার ইয়ানা নদীতে একটি প্রস্তরযুগের প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট বিদ্যমান, তেজস্ক্রিয়-কার্বন বয়স নির্ধারণ অনুযায়ী সাইটটি ওই বরফ যুগের, প্রায় ২৭ হাজার বছর পুরোনো। এই সাইট প্রমাণ করে আমাদের পূর্ববর্তী ধারণার চেয়েও আগে মানব প্রজাতি এরকম রূক্ষ, অধিক উচ্চ ও লেইট প্লাইস্টোসিন পরিবেশে জনবসতি স্থাপন করে।[৭৭]
পালিও-ইন্ডিয়ান মানবগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় মধ্য এশিয়া থেকে। এরা পূর্ব সাইবেরিয়া ও বর্তমান আলাস্কার মধ্যবর্তী বেরিঙ্গিয়া স্থল সংযোগ অতিক্রম করেছিল। মানুষ বরফ যুগের শেষ পর্যন্ত আমেরিকা মহাদেশের পুরোটা জুড়েই বসবাস করেছিল, আরো ভালভাবে বলতে গেলে বরফ যুগ শেষে বরফ গলার দিনগুলো পর্যন্ত, যা বর্তমান থেকে ২৩ হাজার বছরের পুরোনো নয়।[৭৮][৭৯][৮০][৮১] আমেরিকা মহাদেশের দিকে পালিও-ইন্ডিয়ানদের অভিবাসন যাত্রা ও পুরো মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সময় ও যাত্রাপথ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো চলমান।[৮২]
তাদের অভিবাসন যাত্রার পথ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্রচলিত তত্ত্বানুযায়ী তাদের অভিবাসনের পথ তৈরি হয়েছিল প্লাইস্টোসিন বরফযুগের সময় সমুদ্রের উচ্চতা যখন কম ছিল তখন বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হতে যাওয়া প্লাইস্টোসিন বৃহদাকার গবাদিপশুর পালের পথ অনুসরণ করার মাধ্যমে।[৭৯][৮২] এই পথ ছিল লরেন্টাইড ও করডিলেরান আইস শীট বা বরফাচ্ছাদিত পথের মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি সরু বরফমুক্ত করিডোর।[৮৩] আরেকটি পথের কথা বলা হয়, যেটা হয় পায়ে হেঁটে অথবা প্রাচীন আমলের নৌকা চলা পথ, যা দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে দক্ষিণ আমেরিকার চিলি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৮৪] সমুদ্র উপকূলে দিয়ে অভিবাসনের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা যদি থেকেও থাকে, তা আজ সমুদ্রগর্ভে বিলীন কারণ অতীতের তুলনায় বর্তমানে সমুদ্র উচ্চতা বেড়েছে ১০০ মিটারের মত।[৮৫] সাম্প্রতিক গবেষণায় আমাজোনিয়াতে অস্ট্রালেশীয় আদিবাসী জিনের উপস্থিতি উপকূলীয় পথে অভিবাসনের তত্ত্বকে জোরালো সমর্থন দেয়।[৮৬][৮৭]
হোলোসিন কাল হচ্ছে চলমান ভৌগোলিক সময়কাল বা অধ্যায়। এর সূচনা হয়েছিল আনুমানিক ১২ হাজার বছর পূর্বে বরফ যুগের শেষ হবার পর থেকে। হোলোসিন পর্বে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যে জলবায়ু পরিবর্তনের সূচনা ঘটে ৯ হাজার বছর পূর্বে। ভূ-তাত্ত্বিকভাবে উদ্বাস্তু অঞ্চলে বসবাসরত জনসংখ্যা এ সময়ে অভিবাসন শুরু করে। এই সময়ের ভিতরে স্থলভাগের প্রায় সবটুকু অঞ্চল হোমো স্যাপিয়েন্সের করায়ত্তে ছিল। যদিও বেশির ভাগ অঞ্চল তখনও বরফে আচ্ছাদিত ছিল। এই বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলসমূহে নতুন করে জনবসতি স্থাপন শুরু হয়।
এই সময়কালে পৃথিবীর মধ্য দ্রাঘিমাংশের অঞ্চলসমূহ বা টেম্পারেট জোনে মধ্যপ্রস্তর যুগ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগে পরিবর্তিত হয়। নব্য প্রস্তর যুগ পরবর্তীকালে প্রাচীন পৃথিবীতে ব্রোঞ্জ যুগের দ্বার উন্মুক্ত করে যে যুগে মানব সভ্যতায় আনুমানিক ৪ হাজার বছর পূর্বে নিকট প্রাচ্য ও চীনে লিখিত সভ্যতার ধারাবাহিক উত্থান পরিলক্ষিত হয়।
ধারণা করা হয়, মধ্যপ্রস্তর যুগ থেকে নব্য প্রস্তর যুগে এই বিরাট মাইগ্রেশন পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষাসমূহের প্রাক-আধুনিক ভাষাবৈচিত্র্য তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। এই ভাষাসমুহের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল- নাইজার-কংগো, নাইলো-সাহারান, আফ্রো-এশিয়াটিক, ইউরালিক, সাইনো-টিবেটিয়ান ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোত্রসমূহ। বিতর্কিত ও দূরবর্তী নস্ট্রাইটিক তত্ত্বের স্বীকার্যনুযায়ী ইউরেশিয়ার প্রধান প্রধান ভাষাসমূহের (সাইনো-টিবেটিয়ান বাদে) উদ্ভব হয়েছে হোলোসিন সময়কালের শুরুতে প্রচলিত একটিমাত্র আদিম কথ্য ভাষা থেকে।
২০১৪ সালে জিনগত বিশ্লেষণের একটি নমুনা বলে, ইউরোপে বর্তমানে যে আদি জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের তিনটি বংশগত ধারা রয়েছেঃ একটি হল পশ্চিমের শিকারী মানবগোষ্ঠী, যাদের উৎপত্তি ইউরোপের ক্রো-ম্যাগনন জনগোষ্ঠী থেকে, আরেকটি হল প্রাচীন ইউরোপের কৃষিজীবী মানবগোষ্ঠী, যারা নব্যপ্রস্তর যুগের বিপ্লবের সময় নিকট প্রাচ্য থেকে ইউরোপে আগমন করেছিল এবং প্রাচীন উত্তর ইউরেশিয় জনগোষ্ঠী যারা ইন্দো-ইউরোপীয়দের সম্প্রসারণের সময় ইউরোপে বসতি সম্প্রসারণ করেছিল।[৮৮]
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে নাইলোটিক জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে পূর্ব সুদানিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মত অভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকে। প্রাক-নাইলোটিক এসব জাতিগোষ্ঠীগুলো গবাদিপশুদের গৃহপালন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পূর্ব সুদানিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীরা খুব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দ আগে থেকেই এই অঞ্চলে ছিল (যেখানে প্রস্তাবিত নাইলো-সাহারান জাতিগোষ্ঠীর বয়স একদম শেষ প্রস্তরযুগের সময়ের, আনুমানিক ১৫ হাজার বছর পুর্বে)। নাইলোটিক ভাষাভাষী জনগণের উৎপত্তির কেন্দ্র খুব সম্ভবত নীল নদের পূর্বাঞ্চলে, বর্তমানে যে অঞ্চলটি দক্ষিণ সুদান হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রাক-নাইলোটিক মানবগোষ্ঠী ছিল পাস্টোরালিস্ট বা গবাদিপশু চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা মানবগোষ্ঠী। যেখানে তাদের প্রতিবেশী প্রাক-মধ্য সুদানিক জাতিগোষ্ঠী ছিল কৃষিজীবী।[৮৯]
পশ্চিম কিংবা মধ্য আফ্রিকায় নাইজার-কংগো মানবগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় আনুমানিক ৬ হাজার বছর পুর্বে। তাদের বসতি সম্প্রসারণ হয়েছিল সাহেল অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণের ফলে, যখন খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯০০ সালে সবুজ সাহারা শুষ্ক হয়ে মরুভূমি হতে থাকে। বান্টু জাতিগোষ্ঠীর সম্প্রসারণের ফলে আফ্রিকার মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে বান্টু ভাষা ও সংস্কৃতি সম্প্রসারিত হতে থাকে এসব জায়গায় আগে থেকে বসবাস করা জনগোষ্ঠীকে আংশিক অপসারণ করে।[৯০] এই প্রক্রিয়া আফ্রিকার এই উত্তরাংশে শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৩ হাজার বছর পুর্বে, যা দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে প্রায় ১৭০০ বছর আগে।[৯১]
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলসমূহ জনবসতিপূর্ণ হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সাল থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। নিউ ক্যালিডোনিয়ার লাপ্টিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে লাপ্টিয়া জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে তাদের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মৃৎশিল্পের নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। এরা মূলত ছিল অস্ট্রোনেশিয় ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী যারা পরবর্তীতে ওশেনিয়া মহাদেশের নিকটে (পাপুয়া নিউগিনি ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ) স্থানান্তরিত হয় আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যেখানে এদের সাথে পূর্বতন পাপুয়া জনগোষ্টীর সাথে সংমিশ্রণ হয় কিছুক্ষেত্রে। দূরবর্তী অঞ্চলে জলপথে ভ্রমণের কৌশল রপ্ত থাকায় এই জনগোষ্ঠী ওশেনিয়া মহাদেশের দুরবর্তী সব অঞ্চল যেমন ভানুয়াটু, নিউ ক্যালিডোনিয়াতে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এরপর তারা ফিজি, সামোয়া ও টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জেও পা রাখে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের উপকূল তীরবর্তী এলাকাগুলোতে এক যাযাবর মানবগোষ্ঠীর বাস ছিল যারা সমুদ্রের উপর জীবিকা নির্বাহ করত। শুন্য বছর বা ইয়ার জিরোর মধ্যেই মাইক্রোনেশিয়া পুরোপুরি মানব বসতি হয়ে ওঠে। এরপর তাহিতি সহ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পূর্ব পলিনেশিয়াও ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মানব বসতি হয়ে ওঠে। পলিনেশিয় অঞ্চলে সর্বশেষ মানব বসতি হলো নিউজিল্যান্ড, যেখানে ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে মানব বসতি স্থাপিত হয়।[৯২]
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হল আমেরিকা মহাদেশের সর্বশেষ মানব বসতি স্থাপনার অঞ্চল। এদের ভিতর পুরোনো মানব বসতির অঞ্চল হল বৃহত্তর এন্টাইলস অঞ্চল (কিউবা ও হিসপানিওলা), যেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০-৩৫০০ সালে মানব বসতি স্থাপিত হয় এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নমুনার তুলনামূলক পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায় এই জনগোষ্ঠী ইউকাটান চ্যানেল অতিক্রম করে মধ্য আমেরিকায় পৌঁছে। সকল প্রমাণাদি এটা উত্থাপন করে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল ও তার পরবর্তীকালে সকল অভিবাসীগণ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে অরিনোকো অঞ্চল হয়ে এসেছে। এই জনগোষ্ঠীর বংশধরদের মধ্যে তাইনো ও কালিনাগো জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরাও রয়েছে।[৯৩]
প্রারম্ভিক মানব মাইগ্রেশনের সর্বশেষ মানব বসতির মাইগ্রেশন হয় আর্কটিক অঞ্চলে।
আর্কটিক অঞ্চলের ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি সংস্কৃতি হিসেবে উত্তর আমেরিকা মধ্যাঞ্চল ও আর্কটিকের পূর্বাঞ্চলকে বলা হয়। এরা ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এই ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি সংস্কৃতির ছাপ আছে পালিও-এস্কিমো সংস্কৃতি সহ ইন্ডিপেন্ডেন্স সংস্কৃতি এবং প্রাক-ডোরসেট সংস্কৃতিতে।[৯৪]
ইনুইত সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠী থুল সংস্কৃতির বংশধর, যাদের উদ্ভব ঘটেছিল আলাস্কার পশ্চিমাচল থেকে আনুমানিক ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে এবং এরা ডোরসেট সংস্কৃতিকে সেসময় প্রতিস্থাপন করে।[৯৫][৯৬]
|তারিখ=
(সাহায্য)
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|ইউআরএল=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। www.ncbi.nlm.nih.gov। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=
(সাহায্য)
|doi=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)।
|ওয়েবসাইট=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)