ফতেপুর সিকরি | |
---|---|
শহর | |
স্থানাঙ্ক: ২৭°০৫′২৮″ উত্তর ৭৭°৩৯′৪০″ পূর্ব / ২৭.০৯১° উত্তর ৭৭.৬৬১° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | উত্তর প্রদেশ |
জেলা | আগ্রা |
প্রতিষ্ঠাতা | আকবর |
জনসংখ্যা [১] | |
• মোট | ৩২,৯০৫ |
ভাষা | |
• দাপ্তরিক | হিন্দি[২] |
• অন্যান্য | উর্দু[২] |
সময় অঞ্চল | IST (ইউটিসি+5:30) |
যানবাহন নিবন্ধন | UP-80 |
মানদণ্ড | Cultural: ii, iii, iv |
সূত্র | 255 |
তালিকাভুক্তকরণ | 1986 (১০ম সভা) |
ফতেপুর সিকরি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা জেলার একটি শহর। সাল ১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ অবধি সম্রাট আকবর শহরটিকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন কিন্তু পরে পাঞ্জাবের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা বাতিল করেন। ১৬১০ সালে শহরটি সম্পূর্ণরূপে বর্জিত করা হয়।[৩]
ফতেপুর সিকরি নামটির উৎপত্তি হয় সিকরি নামের গ্রাম থেকে, যেটি এখানে আগে অবস্থান করত। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৯৯৯-২০০০ সালের খননকার্য থেকে জানা যায়, আকবর এখানে রাজধানী স্থাপন করার আগে থেকে এখানে মানুষের বসবাস ছিল। সম্রাট বাবরও ফতেপুর সিকরি খুব পছন্দ করতেন। তার সৈন্যেরা এখানকার শুকরি ঝিলের জল ব্যবহার করতেন তাই বাবর জায়গাটির নাম দিয়েছিলেন শুকরি। বাবর সিকরিকে বিনোদনের জন্য ব্যবহার করতেন এবং এর সীমান্ত-অঞ্চলে মহারানা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করেছিলেন।
আগে এখানে শেখ সেলিমের খানকা ছিল। ১৫৬৯ সালে আকবরপুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয় এইখানে। যে শেখ জাহাঙ্গীরের জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আকবর এখানে একটি ধর্মীয় প্রাঙ্গণের নির্মাণ করেন। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় জন্মদিনের পরে আকবর এখানে একটি প্রাচীর-ঘেরা শহর এবং এক রাজশাহী প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৫৭৩ সালে আকবরের গুজরাত বিজয়ের পরে শহরটির নাম হয়ে যায় ফতেপুর সিকরি, 'বিজয়ের শহর'। মূল প্রবেশদ্বারটি বুলন্দ দরওয়াজা নামে পরিচিত।
আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, আকবর ফতেপুর সিকরি নির্মাণে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ এর স্থাপত্যশৈলীর নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। তৈমুর লং-কর্তৃক প্রচলিত পারসিক আদাল প্রক্রিয়ার আড়ম্বর পুনরুজ্জীবিত করতে আকবর প্রাঙ্গণটি পারসিক নীতিতে নির্মাণ করেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবে এটি ভারতীয় আদলে পরিবর্তিত হয়। ফতেপুর সিকরির আশে-পাশে বেলেপাথরের প্রাচুর্য্য থাকায় এখানকার অধিকাংশ অট্টালিকা লাল রঙের। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে জ্যামিতিকভাবে সজ্জিত বেশ কিছু স্বতন্ত্র চাতাল দেখতে পাওয়া যায় যা আরব ও মধ্য এশিয়ার তাঁবু-আকৃতির বিন্যাসের অনুকরণে বানানো। সমগ্র ফতেপুর সিকরি এইভাবে আকবরের দুর্দান্ত শিল্পভাবনা ও তার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণ ঘটানোর ক্ষমতা তুলে ধরে এবং একটি স্বতন্ত্র স্থাপত্যধারার প্রচলন করে।
কিন্তু প্রাসাদটি নিকটবর্তী একটি ঝিলের উৎস্যমুখ বন্ধ করে দেয় এবং আশে-পাশের জল-সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত্য হয়। এছাড়া প্রাসাদটি রাজপুতানার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় শত্রুদ্বারা আক্রমনের ভয়ও ছিল। এই সমস্ত কারণে প্রাসাদটিকে ১৫৮৫ সালে বর্জণ করা হয় এবং রাজধানী লাহোরে স্থানান্তরিত করা হয়। আকবর ১৬০১ সালে কিছুদিনের জন্য এখানে ফিরে এলেও পাকাপাকিভাবে আর ফেরেননি। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট মোহম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮) এবং তার প্রতিনিধি সৈয়দ হাসান আলি খান বরহা্কে এখানে হত্যা (১৭২০) করা হয়। মারাঠাদের দিল্লী বিজয়ের পরে তারা এই প্রাসাদের দখল নিলেও পরে তা ইংরেজদের হস্তগত হয়। তারা এটিকে সদর দপ্তর ও সেনা-ছাঁউনি হিসাবে ব্যবহার করেন।
কয়েক শতাব্দী ধরে একটানা ব্যবহারের দরুন দু'মাইল লম্বা এবং এক মাইল চওড়া প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের অধিকাংশ অংশ অক্ষত রয়েছে। এটির তিনদিক এখনও পাঁচ মাইল লম্বা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, যা এর প্রতিষ্ঠার সময়ে বানানো হয়েছিল। প্রাসাদ এবং সংলগ্ন মসজিদটি ব্যবহৃত হতে থাকলেও শহরটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। আগ্রা রোডের 'নহবত খানা' প্রবেশদ্বারের কাছে পুরনো শহরের বাজারের কিছু ধ্বংসাবশেষ ছাড়া অধিকাংশ জায়গা জুড়ে এখন রয়েছে খালি, অনুর্ব্বর জমি। আধুনিক শহরটি প্রাসাদের পশ্চিমদিকে অবস্থিত। এটি ১৮৬৫ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত পৌরসভার স্বীকৃতি পায় তবে পরে এটিকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নথীভুক্ত করা হয়। ১৯০১ সালে এই জায়গার জনসংখ্যা ছিল ৭,১৪৭। যদিও আকবরের সময়ে অঞ্চলটি পশমের কাপড় ও রেশমী সুতো কাটার জন্যে বিখ্যাত ছিল, এটি পরে স্থপতি ও ভাস্করদের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সিকরি গ্রামটি এখনও এর কাছে অবস্থিত।
১৯৯৯-২০০০ সালের ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের করা খননকার্যের ভিত্তিতে আগ্রার অভিজ্ঞ সাংবাদিক ভানু প্রতাপ সিংহ বলেন, এখানকার পুরাকালের দ্রব্যসামগ্রী, মূর্তি ও গঠনপ্রণালী দেখে মনে হয় এটি একটি ১,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো 'সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্থান', যা হারিয়ে যায়। জৈন সম্প্রদায়ের বরিষ্ঠ নেতা স্বরূপ চন্দ্র জৈন বলেছেন, "পুরাতাত্ত্বিক খননে এখান থেকে একশোরও বেশি জৈন মূর্তি এবং একটি মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর পাওয়া গেছে যার উপরে সাল লেখা রয়েছে। ১,০০০ বছরেরও পুরনো এইসব মুর্তিগুলি আসলে ভগবান আদিনাথ, ভগবান ঋষভনাথ, ভগবান মহাবীর ও জৈন যক্ষিনীদের।" ঐতিহাসিক সুগম আনন্দ স্বীকার করেছেন এখানে আকবরের আগমনের পূর্বেও মানুষের বসবাস, মন্দির ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। তিনি আরও বলছেন যে পাহাড়ের ঢালে একটি খালি জায়গায় আকবর তার রাজধানী স্থাপনা করেন।[৪][৫]
ফতেপুর সিকরি বাবরের খুব পছন্দের জায়গা ছিল এবং এখানকার ঝিল থেকে সৈন্যদের জল সরবরাহ হত বলে তিনি একে শুকরি (যার অর্থ ধন্যবাদ) বলতেন।[৬] অ্যানেট বেভারিজ 'বাবরনামা'-এর অনুবাদে লিখেছেন, বাবর সিকরিকে শুকরি বলতেন। তার স্মৃতিচারণাতে বাবর লিখেছেন, তিনি রাণা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করার পরে এখানে 'বিজয়ের উদ্যান' নামে এক বাগান বানিয়েছিলেন। গুলবদন বেগমের 'হুমায়ুননামা'-তে লেখা আছে, বাবর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন যা তিনি বিনোদন ও লেখার জন্যে ব্যবহার করতেন। একটি নিকটবর্তী ঝিলের মাঝখানে তিনি একটি বেদী নির্মাণ করেন। হিরণ মিনার থেকে এক কিমি দূরে একটি পাথরের চড়াই ছিল যার তলায় বাওলি ছিল। এখানে একটি পাথরের ফলকে খোদাঈ করা ছিল বাবরের বিজয়ের ইতিহাস।
১৫৬৯ সালে সিকরিতে জাহাঙ্গীরের জন্মের আগে পর্যন্ত আকবর নিঃসন্তান ছিলেন এবং এর পরে সন্ত শেখ সেলিম চিস্তি জাহাঙ্গীরের জন্মের সফল ভবিষ্যদ্বাণী করলে তার সম্মানার্থে একটি ধর্মীয় প্রাঙ্গণ নির্মাণ করেন। জাহাঙ্গীরের দু'বছর পূর্ণ হওয়ার পরে তার সহনশক্তি পরীক্ষা করার জন্য আকবর প্রাচীর-ঘেরা শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। শেখ সেলিমের খানকাতে নিজের রাজধানী স্থাপন করে আকবর নিজেকে এবং নিজের রাজ্যকে সুফি রীতি-নীতির অন্তর্ভুক্ত করেন।[৭]
ফতেহপুর সিক্রি পাথুরে পর্বত, ৩ কিলোমিটার (১.৯ মা) দৈর্ঘ্য এবং ১ কিমি (০.৬২ মা) প্রশস্ত এবং প্রাসাদ শহরটি একটি ৬ কিমি (৩.৭ মা) প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত, এর চতুর্থ সীমানা সহ তিনদিকে প্রাচীর। শহরটি প্রায় ৪০ মিটার উঁচু পর্বতমালার চারপাশে সংগঠিত হয়েছে এবং এটি প্রায় একটি রম্বসের আকারে পড়ে। স্থল কাঠামোগুলির সাধারণ বিন্যাস, বিশেষত "উদ্যান এবং পরিষেবা এবং সুবিধার ধারাবাহিক এবং সংক্ষিপ্ত ধাঁচ" যা শহরটির বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিল নগর প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই সিদ্ধান্তে নিয়ে আসে যে ফতেহপুর সিক্রিটি মূলত তার বিখ্যাত বাসিন্দাদের অবসর এবং বিলাসবোধের জন্য নির্মিত হয়েছিল।[৮]
এটি ৫ মাইল (৮.০ কিমি) দীর্ঘ দুর্গের প্রাচীর বরাবর গেটগুলির মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা যায়, যথা, দিল্লি গেট, লাল ফটক, আগ্রা ফটক এবং বীরবলের গেট, চন্দনপাল গেট, দি গওয়ালিয়র গেট, তেহর গেট, ছোর গেট এবং আজমেরি গেট। প্রাসাদটিতে রানী যোধা বাইয়ের জন্য গ্রীষ্মের প্রাসাদ এবং শীতের প্রাসাদ রয়েছে।
ভারতীয় জনগণনা তথ্য অনুসারে ফতেপুরপুর সিক্রি এর জনসংখ্যা ২৮৭৫৭ জন। পুরুষ ৫৩%, এবং নারী ৪৭%। শহরের সাক্ষরতার হার ৪৬%, যেখানে ভারতের জাতীয় সাক্ষরতার হার ৭৪%, যার মধ্যে নারী স্বাক্ষরতার হার ৩৪% এবং পুরুদের মধ্য স্বাক্ষরতার হার ৫৭%। এ শহরের জনসংখ্যার ৫৯% শতাংশ ৬ বছরের কম বয়সী জনসংখ্যা।
ফতেহপুর সিক্রি আগ্রা জেলার পনেরটি ব্লক সদর দফতরের একটি। এর অধীনে ৫২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত (গ্রাম পঞ্চায়েত ) রয়েছে।
ফতেহপুর সিক্রি, ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার একটি নির্বাচনী এলাকা এবং আরও পাঁচটি বিধানসভা ( আইনসভা ) অংশ নিয়ে গঠিত: আগ্রা গ্রামীণ, ফতেহপুর সিকরি, খেরগাও, ফতেহবাদ, বাহ।
সব মিলিয়ে আগ্রা জেলার ফতেহপুর সিক্রি দুর্গের নিকটে সিসোদিয়া রাজপুতের ১২ টি গ্রাম রয়েছে। এগুলি হলেন দৌলতাবাদ, নয়াবাস, সাথা, কোরাই, বেহরাবতী, ব্যয়ারা, আন্ডেরা, কচোড়া, সিঙ্গারপুর, বিদ্যাপুর, ওয়ানরা, আরুয়া।
ফতেপুরপুর সিকরি আগ্রা থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার (২৪ মা) দূরে অবস্থিত। এর নিকটতম বিমানবন্দর হল আগ্রা বিমানবন্দর ( খেরিয়া বিমানবন্দর হিসাবে পরিচিত), যা ফতেহপুর সিকরি থেকে ৪০ কিলোমিটার (২৫ মা) দুরে অবস্থিত। নিকটতম রেলওয়ে স্টেশনটি ফতেহপুর সিকরি রেলওয়ে স্টেশন, যা শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার (০.৬২ মা) দূরে। এটি সড়ক পথে আগ্রা এবং প্রতিবেশী কেন্দ্রগুলির সাথে সংযুক্ত, যেখানে ইউপিএসআরটিসি চালিত নিয়মিত বাস পরিষেবা, পর্যটন বাস এবং ট্যাক্সি চলাচল করে।
ফুট্টিপুর সিসরি ( ফিশারস ড্রইং রুম স্ক্র্যাপ বুক, ১৮৩৩) তাঁর কবিতায় লেটিয়া এলিজাবেথ ল্যান্ডন তার বিসর্জনকে 'মৃতদের প্রতিশোধের' সাথে যুক্ত করেছেন।