ফলিংওয়াটার | |
---|---|
অবস্থান | মিল রান, পেনসিলভেনিয়া |
নিকটবর্তী শহর | ইউনিয়নটাউন |
স্থানাঙ্ক | ৩৯°৫৪′২২″ উত্তর ৭৯°২৮′৫″ পশ্চিম / ৩৯.৯০৬১১° উত্তর ৭৯.৪৬৮০৬° পশ্চিম |
নির্মিত | ১৯৩৬–১৯৩৯ |
স্থপতি | ফ্র্যাংক লয়েড রাইট |
স্থাপত্যশৈলী | আধুনিক স্থাপত্য |
পরিদর্শন | প্রায় ১,৩৫,০০০ |
পরিচালকবর্গ | ওয়েস্টার্ন পেনসিলভানিয়া কংসেরভেন্সি |
মানদণ্ড | সাংস্কৃতিক: (২য়) |
মনোনীত | ২০১৯ (৪৩তম সেশন) |
এর অংশ | ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের বিংশ শতাব্দীর স্থাপত্য |
সূত্র নং | 1496-005 |
রাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্র |
অঞ্চল | ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা |
মনোনীত | ২৩ জুলাই ১৯৭৪[১] |
সূত্র নং | 74001781[১] |
মনোনীত | ২৩ মে ১৯৬৬[২] |
অবৈধ উপাধি | |
মনোনীত | ১৫ মে ১৯৯৪[৩] |
ফলিংওয়াটার স্থপতি ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের নকশা করা স্থাপত্য। পিটসবার্গের ৬৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে দক্ষিণ-পশ্চিম পেনসিলভেনিয়ার এক গ্রামীণ এলাকায় ১৯৩৫ সালে এটি নির্মিত হয়।[৪] বাড়িটি মিল রান সেকশনের বিয়ার রান উপত্যাকার একটি পাহাড়ি ঝর্ণার অংশবিশেষের উপর স্থাপন করা হয়েছে। ভৌগোলিক ভাবে এটি পেনসিলভেনিয়ার ফেটি অঞ্চলের ষ্টুয়ার্ট শহরের অন্তর্গত। লিলিয়ান কফম্যান এবং তার স্বামী, কফম্যান’স ডিপার্টমেন্ট স্টোরের স্বত্বাধিকারী এডগার জে. কফম্যানের পারিবারিক অবকাশ বাড়ি হিসেবে নির্মিত এ স্থাপনা কফম্যান হাউজ নামেও সমধিক পরিচিত।
নির্মাণ হবার পরে টাইম ম্যাগাজিন এটিকে স্থপতি ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপত্যকর্ম হিসেবে অভিহিত করে।[৫] মারা যাবার পূর্বে দেখা উচিত এমন ২৮ টি যায়গার একটি একটি তালিকা করেছিলো আমেরিকান স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন জানুয়ারী ২০০৮ সংখ্যায় তাতে ফলিংওয়াটারকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৬] আমেরিকান সরকার ১৯৬৬ সালে এটিকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষণা করে।[২]
১৯৯১ সালে আমেরিকান স্থপতি ইন্সটিটিউটের American Institute of Architects সদস্যরা ফলিংওয়াটারকে আমেরিকান স্থাপত্যের সর্বকালের সেরা কাজ হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০৭ সালেও এটি আমেরিকার ২৯তম জনপ্রিয় স্থাপত্য হিসেবে স্থান বজায় রাখে।[৭] ফলিংওয়াটারসহ আরো কয়েকটি স্থাপনা ২০১৯ সালের জুনে ২০ শতাব্দীতে ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের স্থাপত্যকর্ম শিরোনামে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হয়।[৮]
৬৭ বছর বয়সে ফ্র্যাংক লয়েড রাইট বিশেষ তিনটি ভবনের ডিজাইন এবং নির্মাণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ পান। ১৯৩০ সালের শেষ দিকে বিয়ার রানের ফলিংওয়াটার; রাসিনের জনসন ওয়াক্স ভবন, এবং মেডিসনের হার্বার্ড জ্যাকব হাউজ-এই তিনটি কাজের মধ্য দিয়ে রাইট স্থাপত্য সমাজে তার সমীহ জাগানিয়া অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হন।[৯]
কফম্যান’স
এডগার জে কফম্যান পিটসবার্গের এক ব্যবসায়ী; কফম্যান’স ডিপার্টমেন্ট স্টোরের প্রধান। স্ত্রী লিলিয়ান কফম্যান, স্বামীর মতোই রোমাঞ্চপ্রিয়। পর্বতারোহন এবং ঘোড়সওয়ারী উপভোগ করেন। তাছাড়া লিলিয়ান এবং এডগার দুজনেই জনকল্যাণমুখী কাজের ব্যাপারে উৎসাহী। তাদের বাড়িটাও তাই এই ধরনের ইচ্ছার অংশ হবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। [১০]
এডগার এবং লিলিয়ান দম্পতির একমাত্র সন্তান কফম্যান জুনিয়র তার বাবার এবং স্থপতি রাইটের বন্ধুত্বের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।[১০] ১৯৩৪ সালের এক গ্রীস্মে কফম্যান জুনিয়র ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের স্থাপত্য বৃত্তান্ত পড়ে রাইটের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে উইসকনসিনে রাইটের বাড়িতে হাজির হন। সময়টা তখন সেপ্টেম্বরের শেষ দিক। তিন সপ্তাহের মধ্যে কফম্যান জুনিয়র রাইট এবং তার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত সমাজভিত্তিক স্থাপত্য প্রোগাম তালিয়েসিন ফেলোসিপের প্রতিনিধিত্ব শুরু করেন। ১৯৩৪ সালে এরকম একটি উপলক্ষে কফম্যান জুনিয়রের সাথে এডগার এবং লিলিয়ান কফম্যান বেড়াতে যান এবং এখানেই তাদের সাথে ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে।[১০]
কফম্যান ফ্রান্সের ফক্সচ্যাপেল এলাকায় ১৯২৩ সালে নির্মিত তার নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। লা টরেল নামক এই বাড়িটি পিটসবার্গের স্থপতি বেনো জানসেন ডিজাইন করেছেন। পিটসবার্গের বাইরে একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কফম্যান পরিবারের কিছু সম্পত্তি ছিলো। এর মধ্যে একটি ঝর্নার কাছের ছোট অস্থায়ী ঘর তাদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এই অস্থায়ী নিবাসটি যখন নস্ট হয়ে গেলো তখন কফম্যান রাইটের সাথে যোগাযোগ করলেন এখানে কিছু একটা করার জন্য। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ স্থপতি ফ্র্যাংক লয়েড রাইট বিয়ার রান পরিদর্শন করে ঝর্নার চতুরদিকের এলাকাটি জরিপ করার জন্য বলেন। ফেটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী এটি সম্পন্ন করে এবং রাইটের কাছে পাঠানো হয় ১৯৩৫ এর মার্চে। এই জরিপে ঐ এলাকার পাথর, গাছ, ভূমি বিন্যাস ইত্যাদি সবকিছু নিখুঁতভাবে তুলে আনা হয়।
তালিয়েসিনে স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের সাথে প্রথম সাক্ষাতের নয় মাস পরে সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ খুব সকালে এডগার কফম্যান স্থপতি রাইটকে অবাক করে দিয়ে বার্তা পাঠালেন যে তিনি সেদিনই রাইটের সাথে দেখা করতে আসছেন। আসলে কফম্যান তার নতুন প্রকল্পের নকশা দেখার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। রাইট তড়িৎ ফিরতি বার্তায় জানালেন যে তিনি তার নকশা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তবে আসলে তিনি তখনও কিছুই করেননি। দ্রুত নাস্তা সেরে সকল ব্যস্ততা ঝেড়ে ঠান্ডা মাথায় বসলেন নকশা নিয়ে এবং কফম্যান তার কাছে পৌছার পূর্বে যে দুই ঘণ্টা সময় হাতে পেলেন তাতেই একটি প্রাথমিক ভূমি নকশা তৈরী করে ফেলেন।[১১] রাইটের এক সহযোগী এডগার ট্যাফেল বলেছিলেন যে রাইট নকশা করছিলেন এবং একই সাথে মুখে বলছিলেন কীভাবে বিভিন্ন পরিসর পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে কাজ করবে।[১২]
কফম্যানের ইচ্ছা ছিলো তিনি বাড়িতে বসে ঝর্ণার উচ্ছলতা দেখবেন। কিন্ত রাইট তার পরিকল্পনায় ঝর্ণার উপরেই স্বয়ং বাড়িটাকে বসিয়ে দেন।[১৩][১৪] রাইটের পরিকল্পনায় কফম্যান প্রথমে তাই খুবই হতাশ হন কারণ তিনি চেয়েছিলেন বিয়ার রান ঝর্ণার দক্ষিণ পাশে পাহাড়ি ঢালে তিনি বাড়িটা বসাবেন যেন বিপরীত দিকে তাকালে সরাসরি ঝর্ণা দেখা যায়। তিনি রাইটকে বলছিলেন যে এই যায়গাটাই হচ্ছে তার সম্পত্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক।[১৫]
কফম্যানের ইচ্ছা তার বাড়িটি অনেক মানুষের পদচারনায় মুখর থাকবে। এজন্য তার বড় পরিসরের দরকার ছিলো। তাছাড়া কফম্যান দম্পতি আগেই অনুরোধ করেছিলো তাদের এবং তাদের সন্তানের জন্য আলাদা এবং অতিরিক্ত অতিথিকক্ষ সহ মোট চারটি শয়ন কক্ষ থাকবে।[১৫]
ঝর্ণার এলাকা বাদ দিয়ে যতটুকু জায়গা পাওয়া যায় তাতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না বিধায় স্থপতি রাইট ঝুলন্ত পরিসর তৈরীর চিন্তা করেন। বিষয়টা একটু জটিল তাই কাঠামো প্রকৌশলী মেন্ডেল গ্লিকম্যান এবং উইলিয়াম ওয়েজলে পিটারকে সাথে নিয়ে রাইট নিজেই কাঠামো নকশা প্রস্তাব করেন। দুজনেই রাইটের ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপনা জনসন ওয়াক্স হেডকোয়ার্টারের পিলার নকশার সাথে জড়িত ছিলেন।
১৯৩৫ সালের ১৫ অক্টোবর কফম্যানের কাছে নকশা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।[১৬] এ সময় রাইট পুনরায় যায়গায় গিয়ে ঘুরে দেখেন এবং বাড়ি নির্মাণের সম্ভাব্য খরচের হিসাব তৈরী করেন। ডিসেম্বরে এসে নির্মাণ স্থানের পশ্চিমে প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহের জন্য পাথর উত্তোলন ব্যবস্থা বসানো হয়। নির্মাণ কাজের জন্য রাইট তার সহযোগী রবার্ট মোশারকে নিয়োগ করেন তবে রাইট মাঝে মাঝে নিজেও পরিদর্শন করতেন।[১৬] ১৯৩৬ সালের মার্চে নির্মাণ কাজের উপযোগী ফইনাল নকশা তৈরী হয় এবং এপ্রিল থেকে মুল ভবনের কাজ শুরু হয়।
বাড়ি মালিক কফম্যান, স্থপতি রাইট এবং নির্মাণ কোম্পানীর মধ্যকার দ্বন্দে অচিরেই কাজের গতি ব্যহত হয়। কনক্রিট সিমেন্টের ব্যাপারে রাইটের ভালো অভিজ্ঞতা নেই এমনটা আঁচ করে এডগার কফম্যান স্থানীয় আরেকটি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে রাইটের কাঠামো নকশা পরীক্ষা করান। কিন্তু এই রিপোর্ট যখন রাইটের হাতে দেয়া হয় তখন তিনি উল্টো ক্ষেপে গিয়ে কফম্যানকে অনুরোধ করেন তার সকল নকশা ফেরত দিতে কারণ তিনি আর এই প্রকল্পের সাথে থাকবেন না। শেষ পর্যন্ত কফম্যান পিছু হটেন।[১৬]
ঝুলন্ত অংশের কাঠামো নকশায় রাইটের সহযোগী প্রকৌশলীদ্বয় ছাদ তলের সাথে সমন্বিত টি (T) আকৃতির বিম প্রস্তাব করেন। ফলে নিচের পরিসরে সিংলিংয়ের কাজ করে আবার উপর থেকে আসা সংকোচনমুলক চাপকে সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করে। ঠিকাদার ওয়াল্ট হল্ট, যিনি নিজেও প্রকৌশলী ছিলেন, আলাদা ভাবে ভার হিসেব করে প্রথম তলার ছাদের জন্য অতিরিক্ত ইস্পাত ব্যবহারের কথা বলেন। কিন্তু রাইট তা মানতে নারাজ। তবে ঠিকাদার রাইটের অজ্ঞাতে ঠিকই ইস্পাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন।[১৭] কারো কারো মতে কফম্যানের নিয়োগ করা প্রকৌশলীই রাইটের কাঠামো নকশায় থাকা ইস্পাতের পরিমাণকে দ্বিগুন করে দিয়েছিলেন এবং কফম্যানের পরামর্শে ঠিকাদার তাই পালন করেন।[১৬]
তাছাড়া রাইট ছাদ ঢালাইয়ের সময় ঝুলন্ত অংশ সামান্য একটু উপরমুখী রাখতে নির্দেশ করেছিলেন যেন ছাদ নিচের দিকে ঝুলতে চাইলেও সেটাতে ভারসাম্য আসে। কিন্তু ঠিকাদার তা অগ্রাহ্য করেন অথবা ভুল করেন। ফলে ছাদের ফর্মওয়ার্ক খুলে দেয়া মাত্রই ঝুলন্ত অংশ আরেকটু ঝুলে পড়ে। পরবর্তীতে রাইট জানতে পেরে সহযোগী রবার্ট মোশারকে তিরস্কার করেন।[১৮]
কফম্যানের সম্মতিতে তার প্রকৌশলী পশ্চিম ঝুল বারান্দার নিচে ভারবাহী আলাদা দেয়াল তোলার ব্যবস্থা করেন। একদিন পরিদর্শনে এসে রাইট এই দেয়ালের অস্ত্বিত্ব আবিষ্কার করে মোশারকে নির্দেশ দেন দেয়াল এবং ছাদের সংযোগস্থলের পাথর সরিয়ে ফেরার জন্য যাতে দেয়ালের সাথে ছাদের আর কোন সংযোগ না থাকে। কফম্যানকে তিনি পরে বুঝিয়ে দেন যে দেয়ালের সমর্থন ছাড়াই ঝুলন্ত ছাদ বিগত কয়েক মাস ধরে ভালোভাবে টিকে আছে।[১৯]
মুল ভবন ১৯৩৮ সালে সম্পন্ন হয়। পরের বছরই অতিথিশালার কাজ শেষ হয়।
খরচ
ফলিংওয়াটারের সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৩৫,০০০ ডলার।[২০][২১][২২] তবে শেষ পর্যন্ত একটি আলাদা অতিথিশালা সহ নির্মাণ ব্যয় দাড়ায় ১,৫৫,০০০ ডলারে। এর মধ্যে মুল ভবনের জন্য ৭৫,০০০ এবং আসবাবপত্রের জন্য অতিরিক্ত ২২,০০০ ডলার ব্যয় হয়। অতিথিশালার জন্য ব্যয় হয় ৫০,০০০ ডলার। বাকী ব্যয় গ্যারেজ,পরিচারিকাদের আবাসন এবং স্থাপত্য পরামর্শকের সম্মানী। এছাড়াও ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন এবং সংযোজনে ২২,০০০ ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হিসাব করা হয়।[২৩] ২০১৮ সালে এই অর্থ মুল্যস্ফীতি সহ চিন্তা করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৩৮০ কোটি টাকা ধরা যায়। ২০০১ সালে যে সংস্কার কাজ করা হয় তার ব্যয় হিসাব করা হয় ১১.৫ বিলিয়ন ডলার।[২৪]
ব্যবহার
১৯৬৩ সালে ফলিংওয়াটারকে ওয়েস্টার্ন পেনসিলভেনিয়া কনজারর্ভেন্সি সংস্থার কাছে ন্যস্ত করা পর্যন্ত এটি পারিবারিক অবকাশ বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।[২১] পিটসবার্গের ব্যস্ততম নগর পরিবেশ ছেড়ে সপ্তাহান্তে কফম্যান পরিবার চলে আসতো একটু অবসর কাটানোর জন্য্। স্বচ্ছ পানিতে লিলিয়ান খোলামেলা সাতার কাটতেন। বাড়ির নিয়মিত মেহমান শিল্পী ডিয়েগো রিভেরার সাথে আধুনিক শিল্পসংগ্রহ নিয়ে আলোচনায় সময় কেটে যেতো বেশ।[২৫] কফম্যান জুনিয়র বলতেন রাইট মনে করতেন মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির সৃস্টি, সুতরাং প্রকৃতি থেকে যে স্থাপত্য উৎসরিত হবে তা মানুষের অব্যক্ত চাওয়াকে নিশ্চিতভাবে ধারণ করতে পারবে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় যদিও ফলিংওয়াটারে বিস্তৃত জানালার ব্যবহারে অনেক খোলামেলা পরিবেশ তৈরী হয় কিন্তু তবুও কেউ ভিতরে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন প্রশান্ত চিত্তে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। পেছনের পাহাড় যেন তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে।[২৬]
ফলিংওয়াটার স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের একটি অনন্য শিল্পকর্ম। এর অন্যতার কারণ বহুমাত্রিকতা এবং চারিপার্শ্বের প্রকৃতির সাথে একাত্বতা- উভয়ই। ফলিংওয়াটারকে বলা হয় রাইটের অর্গানিক আর্কিটেকচার বা জৈব স্থাপত্যের পথে গতিময় যাত্রা।[২৭] বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীন পরিসরের একে অপরের সাথে একাত্ব হয়ে যাওয়া এবং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে অন্তমিল তার উপরে গুরুত্ব আরোপ করার চেস্টার মধ্য দিয়ে জাপানি স্থাপত্যের বিষয়ে রাইটের যে অনুরাগ তার শক্তিশালী প্রতিফলন ঘটেছে। সমসাময়িক জাপানী স্থপতি তাদাও আনদো বলেনঃ
“ আমি মনে করি জাপানী স্থাপত্য থেকে রাইট যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুভব করেছেন তা হলো কীভাবে একটি পরিসরকে নিজের মত করে তৈরী করতে হয়। আমি যখন পেনসিলভিনিয়ায় ফলিংওয়াটার ভ্রমণ করি, সেখানে আমার মতোই পরিসরের স্পর্শকাতরতা অনুভব করি। বরং বাড়তি আকর্ষণ হচ্ছে প্রকৃতির একটি নিরব সুর লহরী যেন আমার অস্তিত্বে কড়া নাড়ে।”[২৮]
জৈব ডিজাইনের এই ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাসকে পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রতি এর ব্যবহারকারীর ভালবাসার প্রকাশ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এটি বেশি খ্যাত প্রকল্প এলাকার বৈচিত্রের সাথে একাত্ম হওয়ার কারণে। একটি জীবন্ত ঝর্ণার উপরে এটি অবস্থান করছে যেখানে পানির ধারা বাধাহীনভাবে এর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিয়ার রানের পানির শব্দ ঘরের ভিতরে মোহনীয় করে তোলে বিশেষ করে যখন শরতে বরফ গলতে থাকে এবং পাথরের দেয়াল ও ভাসমান উমুক্ত ছাদ চারদিকের পাহাড়ী গঠনের সাথে ঐকতানে মিলিত হয়। নকশায় বিস্তুত জানালা এবং ঝুল বারান্দা থাকার কারণে পুরো পরিসর তার পারিপাশ্বিকের কাছে পৌচে যেতে পারে। রাইটের নিজস্ব ভাবনার আলোকেই প্রধান দরজা ঝর্ণার দিক থেকে একটু দূরে স্থাপন করা হয়।
প্রধান ঘরের ভিত্তি থেকে একটু উচ্চতায় পাহাড়ের পাদদেশেেআরাদা আলাদা ভবনে চারটি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, পারিচারিকাদের আবাসন এবং অতিধিশালা করা হয়। এগুলো মুল ভবনের পরে হলেও এতে আগের মতোই একই ধরনের উপকরন এবং নকশার সুক্ষ বিষয়গুলোর অনুসরণ নিশ্চিত করা হয়। অতিথিশালায় একটি সাতার কেন্দ্র আছে যার অতিরিক্ত পানি গড়িয়ে পড়ে নিচের পাহাড়ী প্রবাহের সাথে মিলিত হয়।
বৈঠকখানার ফায়ারপ্লেস বড় পাথরখন্ডের সাথে সমন্বিত করে দেয়া হয়েছে। এই পাথরখন্ড কাজের যায়গায় পাওয়া গিয়েছিলো এবং এটাকে যথাস্থানে রেখেই বাড়ি তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মেঝে করার সময় দেখা যায় প্রায় একফুটের মতো উচু হয়ে থাকে। তবু পাথরটিকে রেখে দেয়া হয় যেন ভিতরের এবং বাইরের পুরাতন পরিবেশের স্মৃতি রোমন্থন করতে পারে। রাইট প্রথমে পাথরটি কেটে মেঝের সমান করে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু এটি ছিলো কফম্যান পরিবারের খুব প্রিয় রোদ স্নানের যায়গা তাই লিলিয়ান কফম্যান নিজেই সুপারিশ করলেন এটা রেখে দেয়ার জন্য।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পাথুরে মেঝেতে মোম পালিশ করা তবে ফায়ারপ্লেসের মেঝে অমসৃনই থাকলো যার ফলে মনে হচ্ছিলো উষ্ম আগুনের হলকার মধ্য দিয়ে শুকনো পাথর বের হয়ে আসছে।
ফলিংওয়াটারে প্রকৃতির সাথে একাত্বতা এমনকি এর প্রথ্যেকটি ক্ষুদ্র অংশেও পরিলক্ষিত হয়। উদাহরনস্বরূপ, যেখানে কাচের দেয়াল পাথরের সাথে মিশেছে সেখানে ইস্পাতের কাঠামো বাদ রাখা হয়েছে। বরং স্বচ্ছ কাচ এবং তার উল্লম্ব বিভাজকগুলো এমনভাবে পাথরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে যেন পাথরের দেয়ালে তা সামান্যতম বিরক্তি তৈরী করেনি। ঝুলন্ত বৈঠকখানা থেকে একটি সিড়ি সরাসরি নেমে গিয়েছে নিচের পানিতে। মুল বাড়ি এবং অতিথিশালার মধ্যে যে সংযোগ স্থাপনকারী পরিসর আছে সেখানে যে পানির ফোটা ছিটকে জমা হয় তা আবার সরু ধারায় নেমে যায়। শয়নকক্ষগুলো তুলনামুলক ছোট এবং ছাদও নিচুতে রাখা হয়েছে যেন বাইরের দিকে মুক্ত পরিসর, বারান্দা, ঝুলন্ত অংশতে মানুষ বেশি আকর্ষণ অনুভব করে।
নির্মাণের শুরু থেকেই রাইটের পরিকল্পনা ছিলো বাড়ির বাহিরের দৃশ্যে যতটা সম্ভব পেনসিলভানিয়ার গ্রামীণ পরিবেশের সাথে বিলীন করে দেয়া।[২৯] এটা করতে গিয়ে দুটো রংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন। কনক্রিটের জন্য হালকা মেটে রং এবং স্টিল বা ধাতব অংশের জন্য তার সব সময়ের পছন্দের চেরী লাল (cherokee red)।[৩০]
ফলিংওয়াটারকে যখন জনসম্পত্তি হিসেবে ছেড়ে দেয়া হয় তখন বাড়ির দিকে পাকিং এলাকার একটি দিক দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। এই দেয়ালে ফলিংওয়াটার দর্শনে আগত দর্শনার্থীদের জন্য ওয়েস্টার্ন পেনসিলভানিয়া কনজারভেন্সি সংস্থা ভ্রমণ গাইড প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। কফম্যান জুনিয়র নিজেই এর পরিবর্তিত অন্দরসজ্জার নকশা তৈরী করে দেন। এক্ষেত্রে মুল ভবনে রাইটের করা নকশা থেকে সাহায্য নেয়া হয়।
২০০৯ সালে মিউজিয়াম অব মডার্ণ আর্টে ফলিংওয়াটারের একটি মডেল সন্নিবেশিত হয়। [৩১]
ফলিংওয়াটারে ঝুলন্ত অংশ
১৯৫৫ সালে পিতার মৃত্যুর পরে কফম্যান জুনিয়র বাড়ির মালিকানা বুঝে নেন এবং যথারীতি অবকাশ হাউজ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। তবে ফলিংওয়াটারের সংরক্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত তাকে মনোযোগ বাড়াতে হচ্ছিলো। সার্বক্ষনিক খোজ খবর রাখার সুবিধার্থে ১৯৬০ সালে পিতার ইচ্ছানুযায়ী ওয়েস্টার্ন পেনসিলভানিয়া কনজার্ভেন্সি সংস্থার কাছে স্বত্ব হস্তান্তর করেন।[৩২] বাড়ির পাশাপাশি এর ১৫০০ একর জমিও হস্তান্তর করা হয়। তবে বাড়ি হস্তান্তর করলেও কফম্যান জুনিয়র এর বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ এবং শিক্ষামুলক প্রোগামের সাথে সংশ্লিস্ট থাকেন। ১৯৬৪ সালে সংস্থার নিয়মিত ভ্রমণ গাইড প্রোগাম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সংস্থার পরিচালন ভাবনা অনুযায়ী সকল কাজের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য মাঝে মাঝে স্বশরীরে পরিদর্শনও করতেন। কফম্যানের অংশীদার স্থপতি পল মায়েনও দর্শনার্থী কেন্দ্র নকশা করে ফলিংওয়াটারের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন। ১৯৮১ সালে এটি নির্মিত হয়।[৩৩] প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১,৬০,০০০ দর্শনার্থী ফলিংওয়াটার দর্শনে আসেন। [৩৪]
ফলিংওয়াটারের রক্ষনাবেক্ষন
গত ৮০ বছর ব্যবধানে ফলিংওয়াটারে স্বাভাবিক ক্ষয় স্পস্ট।। এর কারণ হচ্ছে ভবনটির উপরে আদ্রতা এবং সূর্যরশ্নির প্রভাব। দক্ষিণ-পশ্চিম পেনসিলভেনিয়ার হিমশীতল পরিস্থিতি এবং স্থাপনার পানির সংস্পর্শ থাকা ভৌত কাঠামোর উপর মারাত্বক প্রভাব ফেলে।[৩৫] এই কারণে, পাথরের বহি:দেয়ালগুলি মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে হয়। রক্ষনাবেক্ষন কাজের অংশ হিসাবে প্রয়োজন মতো বাড়ির বিভিন্ন অংশে পুনরায় রঙ করা হয়।
ফলিংওয়াটারের ছয়টি বাথরুম কর্ক টাইলস দিয়ে মসৃন করা। মেঝেতে বসানোর সময় কর্ক টাইলসটি মোমের প্রলেপ করে দেওয়া হত যেন এর মসৃন তল মেঝেতে পানি সরানোর কাজ সহজ করে দেয়। সময়ের সাথে সাথে কর্ক সেই জায়গাগুলিতে ক্ষয় দেখাতে শুরু করেছে যেখানে পানির চলাচল অবিরত রয়েছে। সংরক্ষণাগারটি নতুন কর্ক টাইলস প্রয়োগ করার আগে ক্ষতিগ্রস্থ কর্কটি সরিয়ে এবং পানির কোনও ক্ষতি থেকে নিচে কংক্রিটটি পুনরুদ্ধার করে এই পৃষ্ঠগুলি পুনরুদ্ধার অব্যাহত রাখে।[৩৬]
এছাড়াও ফলিং ওয়াটারের কাঠামো ব্যবস্থায় খুবি ঝুকিপূর্ন অংশ ছিলো কনক্রিটের তৈরী ঝুলন্ত বারান্দাসমূহ। নির্মাণ কালেই ফর্মওয়ার্ক সরানোর সাথে সাথে কংক্রিটের ঝুলন্ত অংশে ছাদ ঝুলে যাবার প্রবণতা দেখা যায়। এই বিচ্যুতি সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ১৫ ফুট (৪.৬ মিটার) ছাদের অংশ প্রায় ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত ঝুলে পড়ে।
১৯৯৫ সালে, ওয়েস্টার্ন পেনসিলভেনিয়া কনজারভেন্সি ফলিংওয়াটারের কাঠামোগত অখণ্ডতা নিয়ে একটি গবেষণা শুরু করে। কাঠামো প্রকৌশলীগন সময়ের সাথে সাথে ঝুলন্ত ছাদের গতিবিধি বিশ্লেষণ করেন এবং এর প্রেক্ষিতে কাঠামোর কোথায় এবং কি পরিমাণ শক্তিমত্তা বাড়াতে হবে তা ঠিক করেন। । বিশ্লেষনে দেখা যায় ঠিকাদার সত্যই ছাদ ঢালাইয়ের সময় রাইটের পরিকল্পনার চেয়ে বেশি শক্তিশালীকরণ যুক্ত করেছে; কিন্তু তারপরও এর শক্তিমত্তা পর্যাপ্ত ছিলোনা। সমস্যাটি সমাধানের জন্য একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়।[৩৭] কনক্রিট এবং স্টিল উভয়ই সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাছাকাছি ছিলো। ১৯৯৭ সালে এ কারণেই ঝুলন্ত ছাদের নিচে কিছু অস্থায়ী গার্ডার স্থাপন করা হয়।[৩৫],[৩৮]
২০০২ সালে, পোস্ট-টেনশনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে কাঠামোটি স্থায়ীভাবে মেরামত করা হয়। লিভিংরুমের ফ্ল্যাগস্টোন ফ্লোর ব্লকগুলি পৃথকভাবে ট্যাগ করা এবং সরানো হয়েছিল। ব্লকগুলি কংক্রিটের ঝুলন্ত বিম এবং ফ্লোর জোয়েস্টগুলিতে যুক্ত হয়েছি:, উচ্চ-শক্তিযুক্ত ইস্পাত তারগুলি ব্লক এবং বহির্মুখী কংক্রিটের দেয়ালের ভিতর থেকে টেনে নিয়ে শেষ প্রান্তে জ্যাক ব্যবহার করে শক্ত করা হয়েছিল। এভাবে ফ্যালিংওয়াটারের অভ্যন্তর এবং বাহ্যিক চেহারা অপরিবর্তিত রেখেই মেঝে তল ও দেয়ালগুলি পুনরুদ্ধার করা হয়। এরপরেই বিচ্যুতি বন্ধ হয়[৩৯] তবে কনজার্ভেন্সি সংস্থা পুনরায় বিচ্যুতি হয় কিনা তা নিয়মিত তদারক করে।